মার্চের মাঝামাঝি দেশে যাবার প্ল্যান করছিলাম। দেশে যাওয়া মানে গুচ্ছের কেনাকাটা, কার জন্যে কি কিনবো; কার আবার কোনটা পছন্দ হবে না সেই নিয়ে চিন্তা! কাজের বাইরে সারাটা সময়ই বাজারঘাটে কাটিয়ে দেই। ক্লান্ত লাগে, আবার আনন্দেও মন ভরে থাকে। অন্যদিকে খেয়াল করার সময় পাওয়া যায় না।
এরকম এক সকালে বাড়ি থেকে বেরুবো, হঠাৎ করে পাশের ঘরে গোঙানীর মতন তীব্র আওয়াজ কিছুক্ষণ, তার পরে ধাম করে কোনকিছুর পতনের শব্দ! আমি বলি,’কি হলো, যাবো নাকি, দেখে আসবো নাকি?’ আমার বর বলে,’তোমার দরকার কি উটকো উপযাজক হয়ে খবর নেবার?’ আমি চুপ করে থাকি। পরের দিনও ওই একই ব্যপার। আমি তার কথায় কান না দিয়ে তাসনিমের ঘরের বেল বাজাই। বেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কেউ দরজা খোলে না। দরজায় ধাক্কা দিই এবার কি মনে করে। দরজা খোলা, দরজার পাশে রান্না ঘরের সিঙ্কের সামনে মেঝেতে শুয়ে আছেন ভদ্রমহিলা। কাছে গিয়ে বোঝা গেল জ্ঞান নেই। ঘরে আর কাউকে খুঁজে না পাওয়া গেলে আমরা সুপারকে ফোন করে ডাকি, তিনজন মিলে হাসপাতালে নিয়ে যাই ওকে। পথেই জ্ঞান ফেরে তাসনিমের। কিছুটা লজ্জিত ভঙ্গীতে ফিসফিস করে আমায় বলে,’আমার আসলে কিছু হয়নি, বাসায় নিয়ে চল ।’ কিন্তু এম্বুলেন্সের লোকজন তা শুনবে কেন, হাসপাতালে যেতে হয়। আমরা হাসপাতালের ইনফর্মেশানে বসে শুনি যে ভয়ের কিছু নেই, সে প্রেগন্যান্ট! অতিরিক্ত পরিমান মর্নিং সিকনেসের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।

বাসায় এসে আমি ওর কাছে জানতে চাইলাম, কি খেলে বমি হবে না বলে মনে হয়, তাসনিম?’ খুবই সংকোচিত হয়ে বলে,’ ঋণ বাড়াতে ভাল লাগে না, তবে মনে হয় স্যুপ জাতীয় কিছু খেলে বমি হবে না।’ আমি সিদ্দিকা কবীরের বই দেখে দেখে যথাসাধ্য স্যুপ বানিয়ে আনি। তাসনিমের স্বামী তখন সেমিনারে আমেরিকায়, বাড়িতেও কেউ জানেনা। জানলেও আসা সম্ভব নয় এত অল্প নোটিশে। তাকে প্রচন্ড অসহায় দেখতে লাগে।
ঘরে ফিরলে আমার বর বলে,’যাও কাজকর্ম ফেলে রোগী সেবার দায়িত্ব নাও!’ ইচছা অনিচছার বাইরের একটি জানালা খুলে তাসনিমের সাথে আমার যাওয়া আসার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এক উৎফুল্ল বিকেলে সে আমায় নিজের বাড়ির কথা বলে। ও একটি মুক্তমনের মুসলিম পরিবারের মেয়ে। বাড়িতে মেয়েদের লেখাপড়ায় কখনো কোন বাঁধ ছিলো না। বরং, ওর দুই ভাই এর মতন সমান উৎসাহে ওকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। যদিও পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়েছে তার। বিয়ের পরে যাতে পড়া বনধ না হয় তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাড়িতে গান বাজনাও অচ্ছুৎ ছিলো না। গজল শোনা হতো। একবার আবিদা খানম এসেছিলেন ওদের করাচীর বাসায়। আধুনিকতার সাথে ধর্ম পালনের যে কোন বিরোধ নেই সেটা ওর পরিবার দেখলেই বোঝা যাবে। আধুনিকতা মানে তো আর উশৃংখলতা হতে পারে না, ইত্যাদি! একসময় সে আমাকে বলেঃ
-তুমি আমার জন্যে যা করলে তা আপন বোনও করে না! কওমের মানুষ ছাড়া ভাবা যায় এই সাহায্য!
আমি বলি,’ যে কারো জন্য যে কারোরই সাহায্য করার সময় এটা। আজ আমি তোমার প্রতিবেশী না হয়ে একটি জাপানীজ, বা একজন নেপালী মেয়ে হলেও, আমার বিশ্বাস নিজের মত করে হেল্প করত।’
-তারপরও। পাকিস্তানে বাঙালীদের সবসময় আমরা গাদ্দার বলি, কেউ কেউ নিশ্চই গাদ্দার, তোমরা সেই দলে পড়না।
-তাসনিম, বাঙালীরা তো শখ করে যুদ্ধ করেনি তোমাদের সাথে, তোমরা চাপিয়ে দিয়েছো। তোমার কি ধারণা আছে কত
লক্ষ নির্দোষ বাঙালীকে খুন করেছে তোমাদের আর্মি?
-নির্দোষ বলছ? তারা ষড়যন্ত্রকারী ছিল, না হলে ছিল হিন্দু, কোন নির্দোষ মানুষকে পা-কিস্তানের মুসলমান আর্মি মারতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করিনা। ইসলাম এটা সমথন করে না।
-কেন,হিন্দু হলেই তাকে হত্যা করার অধিকার তোমাদের কে দিেচছে?
-হিন্দুরই তো আসল গাদ্দার! আমি ভাবতে থাকি, এই তিমিরে থাকা মানব প্রজাতিটিকে কি বলা মানায় আমার!
– ইসলাম কি কুমারী মেয়েকে গণধর্ষণ সমথন করে? আমি জানতে চাই। তাসনিম শূন্য চোখে তাকিয়ে বলে;
-যদি শত্রুপক্ষের মেয়ে হয় তাহলে হালাল…।
– তুমি কি জান কত নির্দোষ মেয়েকে তোমাদের আর্মি রেপ করেছে ৭১ এ?
-দু একটা ঘটনা ঘটে থাকতে পারে, তার দায়িত্ব ব্যক্তি নেবে, আমি নিশ্চিৎ তাদের শাস্তি দিতে সরকার কার্পণ্য করেনি!

এবার আমার প্রচন্ড বিরক্ত লাগে। ভেতরের আমি কে চেপে রাখা দায় হয়ে যায়। আমি বলি, ‘তোমার অজ্ঞানতাকে আমি করুণা করি তাসনিম, যা জাননা তা জাননা বলে একটুও লজ্জাবোধ নেই তোমার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ্ব সম্পর্ক না জেনে
এরকম মন্তব্য করা তোমার অপরাধ!’