মহুয়া আজ গাইবে না ঠিক করেছে। যত সাধাসাধিই করা হোক না কেন, সে আজ গাইবেই না। অন্তত আজকের দিনটা সে নিজের ইচ্ছেমত কাটাতে চায়। ভোরবেলায় ছাদে উঠে চুপিচুপি খালিগলায় অনেকক্ষণ গান গেয়েছে সে।গান তার কাছে একান্ত নিজস্ব ভাললাগার ব্যাপার। ঠিক তেমনি কবিতাও। নিজের কবিতার ডায়রীটা তাই খুব যত্ন করে রাখে সে, অনেকটা আড়াল করেই, তার ড্রয়ারে তালাবন্দী করে। তবু এতকিছুর পরও নিস্তার নেই, কিভাবে যেন একবার ছোটভাইটার হাতে সে ডায়রী চলে যায়, তারপর এই নিয়ে কত হাসি ঠাট্টা! কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, পাত্রপক্ষের কাছে তার এই গুণের তালিকা ঠিকই তুলে ধরা হচ্ছে! অন্যসময় তার লেখালেখি নিয়ে রীতিমত পরিহাস চলে, আর গান নিয়েও কড়াকড়ি, ‘খবরদার,বাইরে কোনো উপলক্ষে গান গাওয়া চলবে না ।’
কিন্তু কি বিরক্তিকর ঘটনা হচ্ছে কিছুদিন ধরে! আজ বিকেলেও সেরকম কিছুই হবে হয়ত। ক্লান্ত বোধ করে মহুয়া। সাজগোজ করে পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে বসতে হবে, মুখে একটা মৃদু হাসি ধরে রাখতে হবে, যখন গাইতে বলা হবে তখন গাইতে হবে, দরকার হলে কবিতা পড়ে শোনাতে হবে! আর কত!

নাহ, আজ অন্যরকম একটা দিন কাটাবে মহুয়া। যেদিন কেউ দেখতে আসে সেদিন ওকে মা বাইরে যেতে দিতে চান না, ভার্সিটিতেও না। কিন্তু আজতো অন্যদিনের মত নয়। আজ তার জন্মদিন, আজ যা ইচ্ছে তাই করবে সে! ভাল করে চুল বাঁধলো, কপালে ছোট্ট একটা টিপ।
মা রান্নাঘরে বেশ ব্যস্ত সকাল থেকেই, বিকেলের আয়োজন ।
মহুয়া আস্তে করে বলল- আমি ভার্র্সিটি যাচ্ছি মা…
মা ব্যস্ত খুব, খেয়ালই করলেন না।
ফোনটা সাথে নেয় নি ও, কেউ আজ তাকে বিরক্তও করতে পারবে না।
গলির মোড়ে দুটো বখাটে দাঁড়িয়ে, আজকে সে আর মাথা নিচু করল না। কিন্তু ছেলেগুলো অন্যদিনের মতই গান গেয়ে উঠলো। মহুয়া তাকালো তাদের চোখের দিকে, শান্ত, স্থির দৃষ্টিতে। ছেলে দুটো এখন অন্যদিকে তাকিয়ে ,তাদের বেসুরো গান বন্ধ হয়ে গেছে !

ক্যাম্পাসে পৌঁছুতেই বান্ধবী শিলার সাথে দেখা।
-হ্যাপী বার্থডে মহুয়া, তোকে বেশ লাগছে! ক্লাশ করবি তো ?
-থ্যাঙ্কস । ক্লাশটা হবে কিনা জানিস ?
শিলা বলল-জানি না রে, আমি একটু ঘুরে আসি, তুই থাক তাহলে ।
চলে গেল শিলা, কোথায় কে জানে! হয়ত প্রেমিকের সাথে।মহুয়া খোঁজ রাখে না, কারো সাতে পাঁচে নেই ও। হাতে গোনা কজন বন্ধু তার । মাঝে মাঝে খুব একাকীত্বে ভোগে। আবার এই একাকীত্বও বেশ লাগে তার ।

ক্যাম্পাসটা দারুন , ওর ভালই লাগছে একা একা হাঁটতে। বাঁধানো চত্বরে বসে পড়ল মহুয়া। একটু পর শিহাব এল, চারুকলার ছাত্র। ওরা বেশ ভাল বন্ধু, সময় পেলে প্রায়ই ছেলেটা ওদের সাথে আড্ডা দিয়ে যায় । শিহাব মহুয়ার কবিতার ভক্ত । তবে তার প্রতি ছেলেটার অন্যরকম ভাললাগা যে আছে সেটা মহুয়া বেশ টের পায় , ওর চোখ দেখলেই তা বোঝা যায় !

-নতুন কিছু লিখেছিস নাকি ?
মহুয়া হাসছে, বলল- না,তুই কি ভাবিস বলতো? আমি প্রতিদিন লিখি নাকি?
-কেন লিখিস না? আচ্ছা আজকে নাহয় গান শুনিয়ে দে।
-ইচ্ছে করছে না রে। তোর আঁকাআঁকির খবর বল…
-তেমন কিছু করছি না। এই তুই সামনের প্রোগ্রামে গাইছিস না শুনলাম, কেন বল তো ? গতবার তো মাতিয়ে দিয়েছিলি
-ওমা! আরো কত গাইয়ে আছে। প্রতিবার কি গাইতে হবে নাকি?
-তোর গান শুনতেই তো আসি প্রোগ্রামে, নিরাশ করলি ।
-তুই আবার কবে থেকে আমার গানের ভক্ত হয়েছিস ?
-প্রথম থেকেই । তুই জানিস না তুই কত ভাল গাইতে জানিস !
মহুয়া আবারো হেসে ফেলল ।-হুম জানি । কত ভাল লিখি তাও জানি। আমার গান আর কবিতার একজন মাত্র ভক্ত। সবেধন নীলমণি !
-কচু আর ঘেচু জানিস !
শিহাবও হাসছে।
-জানিস শিহাব আরো একটা ব্যাপার জানি মনে হচ্ছে !
-বলে ফেল, তোর জ্ঞানের পরিধি নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, সন্দেহ দূর হোক, বল তো…
-অভয় দিচ্ছিস তো ? পরে আবার…
-আরে কি বলবি হাতি ঘোড়া, বল না! শিহাবের চোখে মুখে অস্থিরতা ।
মহুয়া বলে উঠলো-আমার জন্য তোর একটা দুর্বলতা কাজ করে। ভুল বললাম নাকি? আমাকে ভালবাসিস না ?
শিহাব গম্ভীর হয়ে গেল। মহুয়া কখনো ভাবেনি এব্যাপারে ওকে প্রশ্ন করবে। আজ কি যে হল, জিজ্ঞেস করেই ফেলল। কাজটা ঠিক হল কিনা বুঝতে পারছে না। দুজনেই চুপ করে বসে আছে ।
-আমিতো গাইতে পারি না, পারলে তোর জন্য গাইতাম আর নাহয় কবিতাই লিখে ফেলতাম। শিহাব বলে উঠল ।
-সহজ কথাটা বলে ফেললেই পারতি।
-সহজ কথা কি সহজে বলা যায়! আর আমাদের রাস্তাও তো আলাদা…
-মনের কথা জানাতে এত ভয় কেন? রাস্তা আলাদা মানে কি ?তুই ধর্মের কথা বলছিস ?
দীর্ঘশ্বাসটা লুকোতে পারল না শিহাব।বলল-হ্যাঁ, আমাদের পরিবার, সমাজ সবই তো বাধা…
মহুয়া ভাবছে, গভীর করে ভাবতে চেষ্টা করছে ।
-শিহাব, তোকে ভালোবাসি কিনা জানি না, কখনো বাসব কিনা তাও জানি না, তবে একটা ভাললাগা তো আছেই। তোর মত আরেকটা ভাল বন্ধুও নেই আমার…

আবার ভাবনায় ডুবে গেল সে। মাঝেমাঝে এইসব বাধা ভেঙ্গে ফেলতে খুব ইচ্ছে করে ওর। মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করে রাখার এ কোন নিয়ম! মানুষ নিয়মের জন্য নাকি নিয়ম মানুষের জন্য? কি লাভ এইসব নিয়ম মেনে যা শুধু দুর্ভোগ বাড়ায়, একের কাছ থেকে অন্যকে দূরে সরিয়ে রাখে !

বিকেলের রোদ আর ছায়া খেলা করছে সবুজ ঘাসের বুকে। ওরা এখনো বসে আছে, পাশাপাশি , দুজনেই ভাবছে।
শিহাব ভাবছে মহুয়া তার ডাকে সাড়া দেবে কিনা।
আর মহুয়া ভাবছে আরো গভীর ভাবনা…সব নিয়ম একদিন ভেঙ্গে দেবে, নিজের মত করে বাঁচবে ।
“আমি গাইবো, লিখবো…একটাই জীবন, তাই যতভাবে বাঁচা যায় বাঁচব…ভীষনভাবে বাঁচব…
আমার ভীষন গাইতে ইচ্ছে করছে রে, তুই শুনবি ?’
মহুয়া গাইছে, খোলা গলায়…বাঁধভাঙ্গা গান !