শহীদ অরুন ক্ষেত্রপাল, পরম বীর চক্র

শহীদ অরুন ক্ষেত্রপাল, পরম বীর চক্র


গল্পের শিরোনাম দেখেই অনেকের হয়ত একটু কেমন কেমন মনে হবে। কেউ বা আবার ভাববেন গল্পের আদলে আবার বুঝি সেই ধর্ম বিষয়ক কোন পুরনো কচকচানি। এটাকে আসলে গল্প না বলে অনুলিখন বলাটা মনে হয় ভাল। কারন এতে লেখকের কোন কৃতিত্ত্ব নেই, কারন এটি একটি সত্য ঘটনা। আমি শুধু এখানে তুলে ধরার কাজটাই করছি। আমি জানি না ইসলাম ধর্মমতে বিধর্মী কাউকে শহীদ বলা যায় কিনা, জানার কোন দরকারও দেখি না। তবে আমাদের গল্পের তরুন অরুনকে শহীদ উপাধিতে ভূষিত করেছিল তারই প্রতিপক্ষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মুসলমান অফিসার।

ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) এম এল ক্ষেত্রপাল, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার, জন্ম বর্তমান পাকিস্তানভুক্ত পাঞ্জাবে্র সারগোদায়। ৭১ এর যুদ্ধে এক ছেলে অরুন ক্ষেত্রপালকে তিনি হারিয়েছেন এক সম্মুখ সমরে। ৪৭ এর দেশভাগের পর আরো অনেকের মতই তাকেও চলে যেতে হয় ভারতে। বৃদ্ধ বয়সে তার খুব ইচ্ছে হল তার প্রিয় জন্মস্থানকে আবার একবার চোখের দেখা দেখার। কিন্তু ভারত পাকিস্তান তিক্ত সম্পর্কের কারনে তার এই শখ বহুদিন পুরন হতে পারেনি। ২০০১ সালের কোন একদিনে অবশেষে তার সেই স্বপ্ন বাস্তবের মুখ দেখল। ৮১ বছর বয়সে তিনি পাঞ্জাবের সারগোদায় তার জন্মভূমি দর্শনে গেলেন। নামলেন লাহোর এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্টে লাউঞ্জে বেরিয়ে দেখলেন তাকে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই অভ্যার্থনা জানাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডীয়ার খাজা মোহাম্মদ নাসের এসেছে। এই অপ্রত্যাশিত অভ্যার্থনায় বেশ অবাক হলেও নামটি তার কাছে একেবারে অপরিচিত নয়। পাকিস্তানী এই ব্রিগেডিয়ার তার সাথে বেশ কয়েকবার চিঠিতে যোগাযোগ করেছেন তার সাক্ষাত লাভের জন্য। অপরিচিত পাকিস্তানী অফিসারের সাথে সাক্ষাতে ক্ষেত্রপাল তেমন আগ্রহ বোধ করেননি। তবে এবার সামনাসামনি সাক্ষাতে অনুরোধ আর ঠেলতে পারলেন না। কথা দিলেন জন্মস্থান দর্শন শেষ করে তিনি এই পাকিস্তানী ভদ্রোলোকের বাড়িতে তিন দিনের আতিথ্য গ্রহন করবেন।

যথারীতি তাই হল, সারগোদায় নিজের জন্মস্থান দর্শন সেরে এমএল ক্ষেত্রপাল লাহোরে ব্রিগেডিয়ার খাজা নাসেরের বাড়িতে মেহমান হয়ে এলেন। তিনটি দিন কেটে গেল খুবই চমতকার, পাকিস্তানী এই পরিবারের আতিথ্যে মুগ্ধ ক্ষেত্রপাল। খাজা নাসেরের সাথে তার গড়ে উঠল নিবিড় অকৃত্রিক বন্ধুত্ত্ব। খুবই ভাল সময় কাটল, যদিও তার কাছে মনে হচ্ছিল যে কোথাও কিছু একটা আছে যা তিনি জানেন না।

অবশেষে তার ভারত ফেরার আগের রাতে খাজা নাসের তাকে বললেন; স্যার আপনাকে আমার কিছু বলার আছে যা অনেক বছর ধরে আমি বলতে পারিনি, অবশেষে ভাগ্য আপনাকে আমার সম্মানিত মেহমান করে পাঠিয়েছে। এ কয়দিনে আমাদের সম্পর্ক এত গাঢ্র হয়েছে যে আমার বলার কাজটা এখন আরো কঠিন। ঘটনাটা আপনার ছেলে অরুন ক্ষেত্রপাল বিষয়ে। ৭১ এর সেই ভয়াল দিনে আপনার ছেলে অরুন ও আমি দেশের প্রতি কর্তব্যের খাতিরে মুখোমুখি লড়াই করি। ভাগ্যের ফেরে সেদিন আমার হাতেই আপনার ছেলের বীরের মত মৃত্যু হয়। তরুন অরুন সেদিন ছিল অপ্রতিরোধ্য, নিজের নিরাপত্তার বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে সে নির্ভীকভাবে আমাদের ডিফেন্স লাইনে ঢুকে পড়ে। দুপক্ষেই চরম ক্ষয়ক্ষতি হয়, এক পর্যায়ে অরুন ও আমি ট্যাংক নিয়ে মুখোমুখি হয়ে যাই। দুজনেই একসাথে গোলা ছুড়ি, আমার গোলাই তাকে আঘাত হানে। এই বীরের পরিচয় আমি যুদ্ধের পর জানতে পারি, জানতে পারি সে কত অল্প বয়ষ্ক ছিল। আমরা সেনাবাহিনীতে নির্দয়ভাবে শত্রুকে হত্যার প্রশিক্ষন পাই, তবে আমরাও মানুষ, তাই কখনো কখনো এমন ঘটনা আমাদের বিবেককেও নাড়া দিয়ে যায়।

এরপর নাসের আরো যোগ করলেন যে এতগুলি বছর ধরে ভেবেছিলেন যে অরুনের পিতার কাছে তিনি ক্ষমা চাইবেন, কিন্তু এখন তার কাছে মনে হচ্ছে যে ক্ষমা করার ক্ষমতা এই পুত্রহারা বৃদ্ধের নেই। তাই আজ তিনি শুধুই এই পিতাকে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জানাতে পারেন যিনি এমন বীর সন্তানকে জন্ম ও লালন পালন করেছেন।

এখন আমাদের ফিরে যেতে হবে এ গল্পের শুরু যেখানে হয়েছিল সেখানে। ১৯৭১ সাল, ৩রা ডিসেম্বর থেকে ভারত পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় সে যুদ্ধ আর শুধু বাংলাদেশেই সীমিত নেই, ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের পশ্চীম সীমান্তেও। পাক-ভারতের সীমান্তবর্তী একটি ছোট এলাকা বাসান্তার, বাসান্তার নামেরই একটি ছোট নদীর ধারে। যায়গাটি আপাত গুরুত্ত্বহীন হলেও সামরিক দিক দিয়ে এর গুরুত্ত্ব অসীম। এলাকাটি রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের হলেও এটি মূলত ভারতীয় এলাকার ভেতর পড়ে, অনেকটা আমাদের বাংলাদেশের মতই। এলাকাটি ভারতের জম্মু ও হিমাচল প্রদেশে যাতায়াতের একটি শর্ট প্যাসেজ, যার নিয়ন্ত্রন যে পক্ষের হাতে থাকবে সে পশ্চীম রনাংগনের যুদ্ধে অনেক এগিয়ে থাকবে। তাই এর নিয়ন্ত্রন দখলে দুপক্ষই মরিয়া।

কাকতালীয়ভাবে দিনটি আমাদের স্বাধীনতার দিন, ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১, সকাল ৮ টা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪৭তম পদাতিক ব্রিগেডের সদস্যরা বাসান্তার নদীর উপর একটি সেতু নির্মান সম্পন্ন করেছে তার আগের রাতেই। এলাকাটি ভারতের নিয়ন্ত্রনে তখনো থাকলেও পাকিস্তানীদের আগে পেতে রাখা জালের মত মাইন ফীল্ডের কারনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মূল অংশ তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও ট্যাংক নিয়ে এই দলকে তেমন কাভার দিতে পারছে না। ভারতীয় সেনাসদস্যরা লক্ষ্য করল যে পাকিস্তানী বাহিনী বিপুল পরিমান ট্যাংক ও ভারী অস্ত্রসমেত তাদের অবস্থানের দিকে রওনা হয়েছে। শক্তির বিচারে অগ্রসরমান পাক বাহিনীর তূলনায় তারা খড়কুটোর মতই। ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়াক জরুরী ভিত্তিতে ব্যাক আপ চাইলেন। কিন্তু বিপদের কথা হল ভারতীয় বাহিনী এক্ষেত্রে অনেকটা অসহায়। পাক বাহিনী নিজেদের পাতা মাইন ফীল্ড চিনে ঠিকই আসতে পারবে, ভারতীয় বাহিনী যা পারবে না। ভারতীয় পদাতিক বাহিনী এগুতে পারে কিন্তু এক্ষেত্রে পাক ট্যাংক বাহিনীর সাথে তারা কিছুতেই এটে উঠতে পারবে না।

এরকম অসম্ভব একটা অবস্থায় এগিয়ে এলেন ভারতীয় ট্যাংক বাহিনীর ১৭তম পুনা হর্স ইউনিটের একজন তরুন সেকেন্ড ল্যাফটেন্যান্ট, অরুন ক্ষেত্রপাল, যিনি মাত্র ছ্মাস আগে সেনাবাহিনীতে কমিশন পেয়েছেন, অসীম সাহসিকতার সাথে তিনি তার অধীনস্থ মাত্র দুটি ট্যাঙ্ক ও অল্প কিছু পদাতিক সৈন্য নিয়ে অগ্রসরমান পাক বাহিনীর মুখোমুখী হলেন। শক্তির বিচারে পাক বাহিনী তখনো বহু এগিয়ে। কিন্তু এ যুদ্ধে সেদিন সব শক্তির হিসেব নিকেশ উলটে দেয় অরুন। সে যে শুধু পাক বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখে দেয় তা না, উলটো তাদের ধাওয়া করে ঢুকে পড়ে পাক বাহিনীর সুরক্ষিত ডিফেন্স লাইনে। সেদিন অরুনের বাহিনীর হাতে ১০ টি পাকিস্তানী ট্যাংক ঘায়েল হয়। অরুন নিজেই ঘায়েল করে ৪ টি। বন্দী ও দখল করে বেশ কিছু পাক সেনা ও অস্ত্রপাতি। কিন্তু ছত্রভংগ পাকিস্থানীরা নিজেদের ডিফেন্স লাইনের ভেতর আবার জোট বাধে ও পালটা আঘাত হানে। অরুনের দ্বিতীয় ট্যাংকের কমান্ডার নিহত হয়, ট্যাংকটিও হয়ে যায় অচল, অরুনও হয় গুরুতর আহত। এখন শত্রু এলাকায় গুরুতর আহত অরুন একা মাত্র একটি ট্যাংক নিয়ে। এসময় অরুনের কমান্ডার রেডিওতে তাকে নির্দেশ দেন ট্যাংক ফেলে রেখে নিজের জীবন বাচাতে যা তখনো খুবই সম্ভব ছিল। কিন্তু অরুন ঠিকই বুঝেছিলেন যে তিনি এ অবস্থায় পিছু হঠে গেলে এত সাধ্য সাধনার ফসল সেই ব্রীজ চুড়ান্তভাবে পাক দখলেই চলে যাবে। তাই তিনি কঠোর সামরিক নীতি ভংগ করে কমান্ডারের নির্দেশ অমান্য করে ট্যাংকেই রয়ে গেলেন। কমান্ডারকে তিনি তার শেষ ম্যাসেজে বললেন, ” না স্যার, আমি ট্যাংক ছাড়ছি না, আমার কামান এখনো কাজ করছে, এ বেজন্মাদের শেষ দেখতে চাই”। এর পর তিনি মাত্র ১০০ গজ দূর থেকে আরেকটি পাক ট্যাংক ঘায়েল করে দেন। অসীম বিক্রমে একাই তিনি লড়ে ঠেকিয়ে দিলেন নিশ্চিত পাক অগ্রযাত্রা, কিন্তু শেষে তার ট্যাংকে দ্বিতীয় আরেকটি গোলা লাগে, অবসান হয় এ অসামান্য বীরের জীবনের।

সেদিন তার এই বীরত্বে প্রতিপক্ষ পাক কমান্ডারও হয়েছিলেন চরমভাবে মুগ্ধ, তিনিও পরে খবর নিয়ে জেনেছিলেন কে এই বীর। ভারত সরকার তাকে পরম বীর চক্রে ভূষিত করে।

আবার আমরা ফিরে আসি ২০০১ সালের লাহোরে। অভাবিত সত্যের মুখোমুখি হয়ে সেদিন অরুনের পিতা নির্বাক হয়ে গেলেন। একদিকে তার সন্তানের প্রত্যক্ষ হত্যাকারী তার সামনে উপস্থিত যার উষ্ম আতিথিয়েতা তিনি গ্রহন করেছেন গত তিনটি দিন, আবার অন্যদিকে ব্যক্তিগত আবেগের উর্ধ্বে পেশাদার সৈনিক হিসেবে সেই হত্যার যৌক্তিকতা উপলব্ধি এই দুয়ের টানাপোড়েনে তিনি সেরাতে আর কোন কথাই বলতে পারলেন না। তবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন খাজা নাসেরের অকৃত্রিম আবেগ। এটা সত্য ঘটনা না হয়ে কোন কাল্পনিক গল্প হলে মনে হয় এখানে তার কোন অনুভূতি বর্ণনা করা যেত। কিন্তু বস্তুত এ গল্পের এখানেই শেষ।

পরের দিন এম এল ক্ষেত্রপাল খাজা নাসেরের সাথে ছবি তুলে দিল্লী ফিরে যান। পরে খাজা নাসের তাকে সেই ছবি একটি নোটসহ পাঠান যাতে তিনি আবার অরুন ক্ষেত্রপালের বীরত্বের কথা স্মরন করে ও তাকে সম্মান করে শহীদ অরুন ক্ষেত্রপাল বলে সম্বোধন করেন।

সূত্রঃ http://en.wikipedia.org/wiki/Indo-Pakistani_War_of_1971