ইরতিশাদ আহমদ

“Only reason can convince us of those three fundamental truths without a recognition of which there can be no effective liberty: that what we believe is not necessarily true; that what we like is not necessarily good; and that all questions are open.”

– Clive Bell (1881-1964)

[ক্লাইভ বেল-এর রচনার সাথে আমার পরিচয় ঘটে সত্তর দশকের প্রথম দিকে। তাঁর ‘সভ্যতা’*-র মাধ্যমে। বইটা পড়েছিলাম বাংলায়। ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা মোতাহার হোসেন চৌধুরী ‘অনুদিত’ বেল-এর Civilization বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ঊনিশশো পঁয়ষট্টি সালে। মোতাহার হোসেন চৌধুরী শুধু অনুবাদই করেন নি, নিজের ব্যাখ্যা-টীকা যোগ করে একটা অসাধারণ বইকে অনন্য করে তুলেছেন বাঙ্গালী পাঠকদের জন্য। বইটাকে অনুদিত না বলে প্রচ্ছদে বলা হয়েছে ‘ক্লাইভ বেল অবলম্বনে’। (শুনেছি সম্প্রতি বইটার নতুন সংস্করণ বেরিয়েছে বাংলাদেশে।)

বইটা আমার প্রয়াত পিতার সংগ্রহে ছিল। কেমন করে যেন আমার ঝাঁপিতে ঠাঁই করে নিয়েছে। সেদিন গত বৎসরান্তের ছুটির এক অলস অবসরে কেন জানি না শেলফে রাখা বইটার উপরে গিয়ে চোখ পড়লো। পাতা উল্টাতে উল্টাতে মনে হলো বইটার মূল বক্তব্য আজকের যুগেও ভীষন রকমের প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে অনেক অসভ্যতাই যখন আধুনিক সভ্যতার মোড়কে আমাদের সমাজে এবং দেশে দিব্যি গ্রহনযোগ্য হয়ে গেছে একটা বিরাট সংখ্যক মানুষের কাছে।

ক্লাইভ বেল-এর ‘সিভিলাইজেশন’ প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে। যুদ্ধবিরোধী মনোভাবই বেল–এর মনে সভ্যতা নিয়ে প্রশ্ন জাগায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে মিত্রশক্তি সভ্যতা রক্ষার লড়াই বলে প্রচারণা চালায়। বেল–এর মানবতাবাদী এবং অনুসন্ধিৎসু মন তা মেনে নিতে পারে নি। তাই সভ্যতা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেন, যার ফলশ্রুতি ‘সিভিলাইজেশন’।

নীচের লেখাটা ক্লাইভ বেল অবলম্বনে মোতাহার হোসেন চৌধুরীর বই‘সভ্যতা’-র কিছু কিছু অংশ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা – বিক্ষিপ্ত চিন্তাও বলা যেতে পারে। উদ্দেশ্য – সভ্যতার এই ক্রান্তিকালে মুক্তমনার পাঠকদের চিন্তার খোরাক জোগানো। – ই আহমদ]

ক্লাইভ বেল সভ্যতার ইতিহাস লিখতে যান নি। চেষ্টা করেছেন সভ্যতার সংজ্ঞা দিতে। পেরিক্লেস-এর সময়ের এথেন্স, রেনেসাঁর যুগের ফ্লোরেন্স আর অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সকে তিনি সভ্য সমাজের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। আলোচনা করেছেন ওই তিনটি যুগের কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে। সবকিছুই নিখুঁত, নিপাট ছিল না ওই তিন যুগে। নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনাও ঘটেছে অনেক। ক্ষমতার দৌরাত্মও দেখা গেছে অল্প-বিস্তর। তবুও তুলনামূলক বিচারে ওই তিন সভ্যতার যুগে তিনি দেখতে পেয়েছেন দুটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের প্রভাব। এই দুটি বৈশিষ্ট্য হলো মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচার। আরো দেখেছেন, আলোক ও মাধুর্যের সাধনায় ওই তিনটি যুগ এগিয়ে ছিল।

এই তিনযুগের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করে বেল দেখিয়েছেন, সুসভ্যতার জন্য সমাজে প্রাচুর্যের দরকার হয় না, মোটামুটি সামর্থ্য থাকলেই চলে। উপরন্তু বলেছেন, বাড়াবাড়ি রকমের প্রাচুর্য আসলে সুসভ্যতার পরিপন্থী। আবার এটাও তাঁর উপলদ্ধি যে অধিকাংশ জনগোষ্ঠী অভাব-অনটনে থাকলে সুসভ্যতা সৃষ্টি করা কঠিন। অতি দারিদ্র্যও সুসভ্যতা সৃষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে শৈল্পিক সৌন্দর্যের চর্চা করা সুসভ্য মানুষের কাজ নয়।

বোঝা দরকার, সভ্যতা আর সুসভ্যতার মধ্যে পার্থক্য আছে এই কথাটার উপর তিনি জোর দিচ্ছেন।
সভ্যতার সব উপকরণের উপস্থিতি থাকা সত্বেও একটা ধনী সমাজ সুসভ্য নাও হতে পারে। অন্যদিকে মোটামুটি সচ্ছল একটা সমাজ সুসভ্যতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। তবে একটা অতি দরিদ্র সমাজে মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানো যায় না বলে সভ্যতার ভিত্তিও প্রতিষ্ঠিত হয় না, সুসভ্যতা তো দূরের কথা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, সুসভ্যতার পূর্বশর্ত যদিও সভ্যতা,শুধুমাত্র সভ্যতা থাকলেই সুসভ্যতা সৃষ্টি হয়ে যায় না। সভ্যতা নির্ভর করে সমাজের আর রাষ্ট্রের ওপর। অন্যদিকে সুসভ্যতা গড়ে ওঠে ব্যক্তির রুচি আর সৌন্দর্যপ্রিয়তার ভিত্তিতে। আর সুসভ্যতা প্রাণ পায় সেই রুচি আর সৌন্দর্যপ্রিয়তা যখন ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে ব্যাপ্ত হয়। ব্যক্তির রুচি থেকেই সমষ্টির সংস্কৃতি ঋদ্ধ হয়। আর ঋদ্ধ সংস্কৃতি থেকেই জন্ম নেয় উন্নত সভ্যতার।

শুরুতেই বলে নেয়া দরকার, বেল আর চৌধুরী সভ্যতা বলতে সুসভ্যতার কথাই বুঝিয়েছেন।

সভ্যতার সাধনা আলোক ও মাধুর্যের সাধনা। “সুখের সাধনাও বটে, তবে ইতর সুখের নয়, সুক্ষ্ম সুখের”। আর এখানেই সভ্যতার সাথে সুসভ্যতার পার্থক্য। গাড়ী-বাড়ী, রাস্তা-ঘাট, ঝলমলে দোকানপাট সভ্যতার নিদর্শন হতে পারে, সুসভ্যতার নয়। আধুনিকতার সব উপকরণ ব্যক্তি এবং সমাজজীবনে সহজলভ্য হলেই সেই সমাজকে সভ্য বলা যায় না। শিক্ষার সাথে সভ্যতার সম্পর্কটাকেও সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন মোতাহার হোসেন চৌধুরী, “শিক্ষা দিয়ে শিক্ষিত করা সভ্যতা, আর সুশিক্ষিত হওয়া সুসভ্যতা। শিক্ষিত করা যায়, আর সুশিক্ষিত হতে হয়। তাই সুশিক্ষিত ব্যাক্তি স্বশিক্ষিতও বটে”। আরো বলা যেতে পারে, ভোগ আর উপভোগের মধ্যে যে পার্থক্য সভ্যতা আর সুসভ্যতার মাঝে সেই ফারাক।

তাই কোন সমাজে অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থান, এই মৌলিক অধিকারগুলির নিশ্চয়তা থাকলেই সেই সমাজ সভ্য হয়ে যায় না। বড়জোর সুসভ্যতা সৃষ্টির দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে বলা যায়। এই অধিকারগুলির নিশ্চয়তা দেয়া রাষ্ট্রের বা সমাজের দায়িত্ব, কিন্তু সভ্যতা সৃষ্টির ও রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের নয়। নিরাপত্তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলেও সভ্য সমাজ গড়ার দায়িত্ব ব্যক্তির। উন্নত সভ্যতা সৃষ্টিতে রাষ্ট্রের ভুমিকা সহায়কের, নির্মাতার নয়।

“রাষ্ট্র সভ্যতাসৃষ্টির ব্যাপারে সহায়তা করতে পারে, কিন্তু সভ্যতা সৃষ্টি করতে পারে না। সভ্যতা সৃষ্টি করে ব্যক্তি – সুন্দরচিত্ত মানুষের প্রভাবেই সভ্যতা সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রের কাজ নিরাপত্তা ও অবসর সৃষ্টি করা; কিন্তু সেই নিরাপত্তা ও অবসর নিয়ে মানুষ কি করবে তা নির্ধারণের ভার রাষ্ট্রের উপর নয়, মানুষের উপর”।
(সভ্যতা, পৃ ১-২)

নিরাপত্তা ও অবসর তাই সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য। নিরাপত্তার অভাবে মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচারের প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আর অবসরের অভাবে বিঘ্নিত হতে পারে আলোক ও মাধুর্যের সাধনা। এখানেই আসে রাষ্ট্রের ভূমিকা। নিরাপত্তা আর অবসর নিশ্চিত করার দায়িত্ব যদিও রাষ্ট্রের, আলোক ও মাধুর্যের সাধনায় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয় নয়। যদিও আধুনিক রাষ্ট্র নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্বে আছে বলে ব্যাক্তির সাধনায় মাঝে মাঝে বাদ সাধে। বেল-এর মতে অবসরভোগীরাই সুসভ্যতা সৃষ্টি করে। অবসরভোগী বলতে তিনি পরগাছা (পরাশ্রমভোগী) বোঝান নি। যদিও আধুনিক সভ্য সমাজে পরগাছা নয় এমন অবসরভোগী দেখা যায় না। বেল-এর অবসরভোগীরা অলস নয়। তারা বিশ্রী রকমের সম্পদশালীও নয়, তাদের কাজই হচ্ছে আলোক ও মাধুর্যের সাধনা। বেল উল্লেখিত সুসভ্য সমাজে এরা বিশেষ ভাবে সমাদৃত।

ক্লাইভ বেল সভ্যতা রক্ষণাবেক্ষনের জন্য সমাজে অবসরভোগী অভিজাত শ্রেণীর প্রয়োজনীয়তার (The necessity of a leisured élite for the maintenance of civilization) পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। গ্রীক সভ্যতার নিদর্শন আর ইতিহাস উল্লেখ করে দাবী করেছেন সে যুগে সাহিত্য, কারুকলা, আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি এবং চর্চা সম্ভব হয়েছে ওই অবসরভোগী শ্রেণীটির কারণেই। এই শ্রেণীটি কিন্তু ধনী নয়, আবার হতদরিদ্রও নয়। অর্থোপার্জনের জন্য এদেরকে হন্যে হতে হয় না, আবার বিত্তের সাগরে এরা গড়াগড়িও দেন না। যারা অর্থোপার্জনকেই জীবনের একমাত্র ব্রত বলে গ্রহন করেছিলেন সেই সম্পদশালীদের এই অবসরভোগী শ্রেণীটি এড়িয়ে চলতেন।

মোতাহার হোসেন চৌধুরী বুঝতে পেরেছিলেন, এ যুগে রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতায় অবসরভোগী শ্রেণীর প্রতিপালন সম্ভব নয়, তাই বলেছেন –

“একালের পৃথিবীর অবস্থা যে-রকম দাঁড়িয়েছে তাতে মনে হয়, অবসরভোগীশ্রেণী আর সম্ভব নয়। কিন্তু অবসরের প্রয়োজন আছে, অবসরের অভাবে মানুষ মেশিনে পরিণত হয়, মানুষের স্বাধীনতা বলে কিছুই থাকে না। শিল্পী, কবি ও সমঝদারের জন্য আবার অপেক্ষাকৃত বেশী অবসরের প্রয়োজন। তা না হলে তাঁদের আসল কাজটিই করা হয় না।“
(সভ্যতা, পৃ ৮)

একটু খাপছাড়া হলেও আমার মনে পড়ে গেলো, রবীন্দ্রনাথের কোন এক লেখায় পড়েছিলাম, কাজ হচ্ছে ঘরের দেয়ালগুলোর মতো, আর ফাঁকা জায়গাগুলো অবসর। দেয়াল ছাড়া ফাঁকা জায়গা সৃষ্টি করা যেতো না। আবার ফাঁকা জায়গাটুকু উপভোগ করতে না পারলে দেয়াল তৈরির কোন মানে হয় না।

সভ্যতার দুটি লক্ষণ, মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচার। এই দু’এর প্রতিষ্ঠা ছাড়া সভ্যতা অসম্ভব। মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচার প্রতিষ্ঠায় কি রাষ্ট্রের কোন ভূমিকা নেই? আছে অবশ্যই, তবে বোঝা দরকার বেল-এর রচনায় সামাজিক মূল্যবোধের কথা বিশেষভাবে বলা হয় নি। যে মূল্যবোধের ভিত্তিতে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় তা ‘সভ্যতা’-র মূল আলোচ্য বিষয় নয়। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ঠিকই, কিন্তু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এই নিরাপত্তা থাকলেই সুসভ্যতা সৃষ্টি হয় না। ‘সভ্যতা’-য় আলোচনা করা হয়েছে ব্যক্তিমানসের মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচার নিয়ে।

মূল্যবোধ আর যুক্তিবিচারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বেল বলছেন,

“নিকটবর্তী স্থুল সুখের চেয়ে দূরবর্তী সুক্ষ্ম সুখকে, আরামের চেয়ে সৌন্দর্যকে, লাভজনক যন্ত্রবিদ্যার চেয়ে শিক্ষা ও আনন্দপ্রদ সুকুমার বিদ্যাকে শ্রেষ্ঠ মনে করা – এ সবই মূল্যবোধের নিদর্শন, আর এ-সবের অভাবই মূল্যবোধের অভাব। যুক্তিবিচারের প্রভুত্ব বলতে বোঝায় জীবনের সকল ব্যাপারকে বিচার-বুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবার প্রবনতা”।
(সভ্যতা, পৃ ৩১)

গ্রীক সভ্যতার যুগে আথেনীয়রা যে খুব আরামে জীবন যাপন করতো তা কিন্তু নয়। আরামের উপকরণগুলি যে গ্রীক সভ্যতার কালে, আজকের যন্ত্রসভ্যতার তুলনায়, খুব সহজলভ্য ছিল তা বলা যাবে না। আরাম সভ্যতার সৃষ্টি হলেও সুসভ্যতার উপাদান নয়। আরামের অভাব আথেনীয়দের শিল্প-সাহিত্যের সাধনায় বাধার সৃষ্টি করে নি। আর আরামের উপকরণগুলোর ব্যাপক ব্যাবহার থাকা সত্বেও দেখা যায় অনেক ‘উন্নত’ সমাজে শিল্প-সাহিত্যের তেমন চর্চা বা কদর নাই । আরাম ভোগের চেয়ে শিল্প-সাহিত্যের সৌন্দর্য-মাধুর্য উপভোগ করা সভ্য মানুষের কাছে অনেক বেশি জরুরী।

তাই বেল বিত্তের চেয়ে বরং কিছুটা অভাব থাকাটাকেই সুসভ্যতার জন্য ভালো মনে করেছন।
তাঁর যুক্তি, অভাববোধেরও রকমফের আছে। সত্যিকারের শিক্ষা মানুষেকে অভাব থাকা সত্বেও সুসভ্য সমাজ গড়তে অনুপ্রেরণা যোগাবে। বোঝাতে গিয়ে চৌধুরী লিখেছেন,

“যাঁরা ‘আরো চাই, আরো চাই’ মন্ত্র জপ করেন, দেখতে পাওয়া যায়, কিছুতেই তাঁদের ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না, এবং যত তাঁরা পান ততই যেন তাঁদের সংসারের অনটন বেড়ে যায়। অভাবের দরুন দু’একখানা ভালো বই কিনে পড়াও তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় না। কেনই বা পড়বেন? আগে জীবন, তার পরে বিলাস তো? কিন্তু তাঁরা ভুলে যান যে যাকে তারা ‘বিলাস’ বলেন, কারো কারো কাছে তা-ই জীবন এবং এই ধরনের বিলাস যখন জীবন হয়ে ওঠে তখনই সুসভ্যতার সৃষ্টি”।
(সভ্যতা, পৃ ৪)

বই যাদের কাছে বিলাস নয়, জীবনের অপরিহার্য উপকরণ; এবং সুরম্য অট্টালিকায় বসবাস যাদের কাছে অর্থহীন বিলাস, আলোকিত জীবনের জন্য অপরিহার্য নয়, তারাইতো সুসভ্যতার কারিগর। এঁদের সংখ্যা যে সমাজে যত বেশি সেই সমাজ তত বেশি সুসভ্য।

সুসভ্যতা যে মূল্যবোধের ওপরে প্রতিষ্ঠিত তা ব্যাক্তির রুচির ওপরে নির্ভরশীল। আর যুক্তিবিচারই তো সুসভ্য সমাজে ব্যাক্তির জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার চাবিকাঠি। যুক্তিবিচার ছাড়া সত্যিকারের মূল্যবোধ গড়ে ওঠে না। তাই একটা ভাজা ডিমের চাইতে যে একটা সনেট অনেক মূল্যবান, মূল্যবোধ বোঝাতে এই উপলদ্ধিকে উদাহরণ হিসাবে ব্যাবহার করা হয়েছে।

জানি অনেকেই বলবেন, যেখানে ভাজা ডিম দূরে থাক এক মুঠো ভাত বা এক টুকরো রুটি যোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয় সেখানে এই মূল্যবোধ কোন অর্থে যুক্তিসঙ্গত? প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। আর গুরুত্বপূর্ণ বলেই ক্লাইভ বেল একে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন নি। তাঁর মূল বক্তব্য এই প্রশ্নকে ঘিরেই আসলে।

অভাব থাকা সত্বেও কি সভ্যতা সৃষ্টি হতে পারে? সভ্যতা কি অভাবকে জয় করতে পারে? সমাজে মানুষের নুন্যতম চাহিদার অভাব থাকলে সভ্যতা সৃষ্টি করা কঠিন কাজ, এটা বেল জানতেন। তাই রাষ্ট্র কর্তৃক নিশ্চিত নিরাপত্তাকে তিনি সভ্যতা সৃষ্টির পূর্বশর্ত মনে করেছেন। সেই নিরাপত্তা কোন পথে আসবে, পুঁজিবাদের না সমাজবাদের, সেই তর্ক করতে যান নি বেল তাঁর ‘সভ্যতা’য়। রাজনীতি বেল-এর বিষয় নয়, তিনি ছিলেন একজন শিল্পবোদ্ধা (art critic)। ‘আর্ট’ নামে লেখা বইটাই তাঁকে খ্যাতি দিয়েছিল। ‘আর্ট’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৩ সালে, ‘সিভিলাইজেশন’-এর ঢের আগে।

তবুও নিরাপত্তা বিধানের জন্য অধিকতর সভ্য রাস্তা কোনটা এটা ক্লাইভ বেল বুঝতে পারেন নি, তা কি হয়? তাঁর মতো একজন চিন্তাশীল মানুষ রাজনীতি নিয়ে, রাজনৈতিক ব্যাবস্থা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন নি তা হ’তে পারে না। ‘সভ্যতা’য় তাই রাজনীতি এসেছে, না এসে পারে নি, মূল প্রসঙ্গ না হলেও। রাজতন্ত্রেও সভ্যতা সৃষ্টি হতে পারে, বেল যুক্তি দেখিয়েছেন। বলেছেন, সাইরাস, আলেকজান্দার, তৈমুর, আকবর সকলেই সংস্কৃতি তথা সভ্যতার কদর করতেন। তবে এও বলেছেন, অসাম্যের ওপরে প্রতিষ্ঠিত বলে রাজতন্ত্রীয় সভ্যতা টিকেনা, টিকে থাকতে পারে না। সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এই বলে “অতএব, সাম্য-স্বাধীনতা তথা গণতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার প্রতি আমাদের আকর্ষণ”।

আর মোতাহার হোসেন চৌধুরীর নিজের কথা,

“সাম্যবাদের প্রতি আমারও আকর্ষণ আছে, এবং রাজনৈতিক প্রবণতা থাকলে আমি বোধহয় কার্য্যতঃই সাম্যবাদী হতুম; কারণ অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণের ফলে আমি বুঝতে পেরেছি যে, ভাগ্যের চক্রান্তকে ব্যর্থ করার জন্য সাম্যবাদের একান্ত প্রয়োজন, আর ভাগ্যের চক্রান্ত ব্যর্থ না হলে জগতের বিশৃঙ্খলা ও কলঙ্ক-কুশ্রীতা দূর করে কঠিন।”।
(সভ্যতা, পৃ ১০)

সাম্যবাদকে ‘নেসেসারি ইভিল’ হিসেবে দেখেছেন মোতাহার হোসেন চৌধুরী। সাম্যবাদকে মুক্তির অন্তরায় মনে করেছেন, কারণ মনে করেছেন সাম্যবাদে ব্যক্তিত্বের সঙ্কোচন অনিবার্য। তবুও সাম্যবাদের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। বলেছেন, মানুষ যে মুক্তির মর্যাদা দিতে পারলো না সাম্যবাদ তারই শাস্তি। তবে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হলেই যে কোন প্রয়াস ছাড়া সভ্যতা আপনাআপনি চলে আসবে তা মনে করেন না। কারণ সভ্যতা শুধু কল্যাণ নয়, সৌন্দর্যও। ব্যক্তির ইচ্ছা ছাড়া সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় না। তাই তাঁর সতর্কবাণী, সাম্যবাদের অধীনে যাতে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সঙ্কুচিত না হয়। মোতাহার হোসেন চৌধুরী তাঁর ‘সভ্যতা’ যখন বের করেন, তখন সমাজবাদের রমরমা অবস্থা চলছিল। সেই সময়ে লেখা তাঁর এই সতর্কবাণীর মধ্যে যে দূরদর্শিতা ফুটে উঠেছে, ভেবে অবাক হতে হয়।

তবুও ‘সভ্যতা’ পড়ে আমার উপলদ্ধি হয়েছে যে, সামাজিক ন্যায়বিচার ছাড়া, ন্যায়-ভিত্তিক সমাজ ছাড়া সভ্যতার স্বপ্ন অলীক কল্পনা মাত্র। কিন্তু সেই সমাজের প্রতিষ্ঠা ক্লাইভ বেল বা মোতাহার হোসেন চৌধুরী কিভাবে সম্ভব তা বলেন নি। হয়তো আশা করেছেন সেই ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে সভ্যতা সৃষ্টির মাধ্যমে। একটা বড়সড় সমঝদার গোষ্ঠীর উদ্ভবের মাধ্যমে। হবে কি? আশা করতে দোষ কি?

সভ্যতার জন্য সৃষ্টিশীল মানুষ দরকার, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার সমঝদার মানুষের বা একটা বোদ্ধা গোষ্ঠীর। বেল এর মতে, “সুসভ্য মানুষ তথাকথিত ভালো মানুষ নয়, স্বাভাবিক মানুষ নয়, শিল্পী কি কবি নয়, দার্শনিকও নয় – সমঝদার”। সুসভ্য সমাজে সৃষ্টিশীল মানুষের সংখ্যা বেশি হতে হবে এমন কোন কথা নেই, তবে প্রচুর বোদ্ধা বা সমঝদার মানুষ থাকা চাই। আলোক ও মাধুর্যের সাধনায় নিয়োজিত যাঁরা, উন্নত যাঁদের মূল্যবোধ, প্রখর যাঁদের যুক্তিবিচার। সৃজনশীল প্রতিভার সংখ্যা খুব একটা বেশি না হলেও সমাজ সুসভ্য হতে পারে। তবে সৃজনশীলতাকে কদর করার মতো মানুষের সংখ্যা যে সমাজে ভয়াবহ রকমের কম, সেই সমাজ সুসভ্য কিনা এ নিয়ে চিন্তিত হ’তে হয় বৈকি।

নভেম্বর ১৩, ২০০৯

* মোতাহার হোসেন চৌধুরী, “ক্লাইভ বেল অবলম্বনে সভ্যতা”, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৬৫।