(আমার একটি পুরোন লেখা, ১৯৯৮ সালে লেখা হয়েছিলো, হয়তো মুক্তমনার পাঠক এবং লেখকদের ভাল লাগবে – মীজান রহমান)

আজকাল আমার এয়ারপোর্টে যাওয়া হয় না খুব একটা। আগে যেতাম, বেশ ঘনঘনই যেতাম। মিটিং থাকতো পৃথিবীর নানা জায়গায়। যাকে বলে প্রফেশনাল মিটিং। মিটিংয়ে পেপার পড়ার জন্যে কখনো কখনো নিমন্ত্রণ পেতাম। কখনো নিমন্ত্রণ ছাড়াই যেতাম। গৌরী সেনের টাকায় যাবার সুযোগ পেলে নিমন্ত্রণের অপেক্ষা করে কে। আজকাল নিমন্ত্রণ আসে আগের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু আজকাল আর প্লেনে চড়তে ভাল লাগে না। গায়ের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। হার্ট দুর্বল। দুই সিঁড়ি ভাঙলেই হাঁটু ধরে আসে। মিটিংয়ে বসে কেবলই ঘুম চলে আসে চোখে।

আজকাল এয়ারপোর্টে যাই প্রধানত দু’টি কারণে। ছেলেরা আসে। ছেলেরা চলে যায়। যেদিন আসে সেদিন হার্টের কথাটা ভুলে যাই। গিন্নীর গায়েও যেন যৌবন ফিরে আসে। কেউ দেখলে বলবে না সেদিন যে আট বছর আগে তার শরীরের অর্ধেকটা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে পক্ষাঘাত। সারাদিন ধরে এটা-ওটা রান্না করে। সেই ছোটবেলায় ছেলেরা কি পছন্দ করত খেতে সেটা ভোলেনি। বড়ছেলে সুজির হালুয়া খুব পছন্দ করত। চুকচুকে ঘিয়ে ভাজা সুজির হালুয়া। এখন ততটা করে না। কলেস্টরেলের ভয় ঢুকে গেছে। আগে তার মায়ের তৈরি চমচম ভীষণ প্রিয় ছিল। চমচম তৈরি হয়েছে শুনলে সে অন্য খাবার কম খেয়ে চমচমের জন্য পেটে জায়গা করে রাখত। এখন সে চমচম খেতে পায় না, হয়ত চায়ও না খেতে। বৌমা স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে এম.এ. করেছে। চিনির উপর তার কড়া চোখ। কিন্তু আমাদের বাড়িতে এলে ছেলেকে এখনো হালুয়া আর চম্চম্ খেতে হয়। গিন্নী এই দু’টি জিনিস খুব ভাল রাঁধতে পারত। এখনো পারে। চমচম তৈরি করতে সারাদিন উনুনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। স্ট্রোকের রোগীরা সাধারণত উনুনের সামনে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের মায়েরা পারে দাঁড়াতে। আমাদের ছোটছেলের প্রিয় জিনিস আলুভর্তা। অনেক করে পেঁয়াজ লবণ ঝাল আর সরষের তেল মাখানো ভর্তা। যত ঝাল ততই তার পছন্দ। ভাজা মরিচ আর তেল মেশানো ছোলার চট্পটিও তার প্রিয় জিনিস। গিন্নী যে তার অচল হাত দিয়ে কেমন করে এগুলো তৈরি করে দেখে অবাক হই। আমার মাকেও দেখতাম এমনি করে আমার শখের জিনিসগুলো বানিয়ে রাখতেন। কখনো ভাবতাম না যে ওগুলো বানাতে গিয়ে হয়ত তাঁর কোন কষ্ট হচ্ছে। মায়েরা বেঁচে থাকতে তাঁদের কষ্টের কথা আমরা কেউ ভাবি না।

ছেলেরা ঘরে ঢুকতেই গিন্নীর দিন গোনা শুরু হয়ে যায়। চোখের পলকেই যেন চলে আসে যাওয়ার দিনটা। আসার দিনটা পলকে আসে না, শুধু যাবার দিনটাই আসে। ওরা বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে দুয়ারে প্রস্তুত হয় বিদায় নেবার জন্য। গিন্নী এয়ারপোর্টে যেতে নারাজ। ওদের যাবার দিন এলেই তার গা’টা কেমন ম্যাজম্যাজ করতে থাকে। দুয়ার থেকেই বিদায় বলে দেয়। আসল কারণটা ছেলেরা বোঝে না, আমি বুঝি। কিন্তু আমাকে এয়ারপোর্টে যেতে হয়। আমি বাবা। গা ম্যাজম্যাজ করলেও আমাকে যেতে হয়। যতদিন আমি গাড়ি চালাতে পারব ততদিন আমাকে যেতে হবে। এয়ারপোর্টের বারান্দায় গিয়ে বাক্সবোঝাই গাড়িটা খালি হয়ে যায়। গাড়ি হালকা হয়। মন হালকা হয় না। মালপত্র চেক-ইন করার পর ওদের সঙ্গে ডিপার্চার লাউঞ্জে যাই। দু’বছরের নাতিটা সমস্ত লাউঞ্জ দৌড়ে বেড়ায়। কারো গায়ে ধাক্কা লাগতে পারে সেদিকে হুঁশ নেই। তার বাবা পেছন পেছন ছোটে। যেমন করে আমি ছুটতাম ত্রিশ বছর আগে। এখন আমি ছুটতে পারি না, ছুটবার কোন প্রয়োজন নেই। শুধু এই মন, অন্ধ নির্বাক মন, কেবলি ছুটে যেতে চায়।

কিছুক্ষণ পর ওরা সিকিউরিটি চেকের দরজা পার হয়ে ভেতরে চলে যায়। আমি দাঁড়িয়ে থাকি রেলিং ধরে। ভীষণ একটা ক্লান্তি আসে দেহে, মনে। জীবনের আরো একটা অধ্যায় যেন শেষ হয়ে গেল। এই শেষ আর কোনদিন পূর্ণ হয়ে উঠবে না। এটা অন্তিম, এটা চূড়ান্ত। এই শূন্য পাত্র শূন্যই থেকে যাবে অনন্তকাল। এটাই মানুষের নিয়তি। খালি গাড়িটা নিয়ে আমি বাসায় ফিরে আসি। গিন্নী কিছু বলে না। আমিও কিছু বলি না। নৈঃশব্দের তীব্র শিখাটা জ্বলতে থাকে ভেতরে। আমি খাতাপত্র নিয়ে কাজে বেরিয়ে যাই।

অথচ এই সেদিনও আমার বাবাকে ঠিক একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি এয়ারপোর্টে। দু’বারই দাঁড়াতেন তিনি⎯আমার যাবার সময় আর ফেরার সময়। কিন্তু একরকমের দাঁড়ানো নয়। যাবার সময় তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতেন। ফেরার সময় বুকে জড়াতেন না। কেমন যেন দূরে দূরে থাকতে চাইতেন। আর সবাই ভিড় করে দাঁড়াত গেটের কাছে। তিনি গেট থেকে দূরে একটা খালি জায়গাতে দাঁড়িয়ে পথভোলা বালকের মত শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকতেন। আমি শেষবারের মত তাঁকে চট্ করে সালাম করে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে আন্তর্জাতিক যাত্রীদের লাউঞ্জে ঢুকে পড়তাম। আমার ছেলেরাও এখন এমনি করে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে ভেতরে চলে যায়। বিদায় আমার ভাল লাগে না। বিদায়কে আমি ভয় পাই। অথচ বিদায়ই সব বাবাদের নিয়তি। ওরা যখন আসে, থাকার জন্য আসে না, চলে যাওয়ার জন্যে আসে।

বাবার কাছে গল্প শুনতাম তাঁর ছোটবেলার, তাঁর যৌবনের। একই গল্প বারবার বলতেন। বলতেন তাঁর বাবা তাঁকে কত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। প্র মে জমি বন্ধক দিয়েছিলেন, শেষে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর বাবা যখন চাকরি পেয়ে শহরে চলে গেলেন, আমার দাদা স্টেশনে যেতেন বাবাকে ট্রেনে তুলে দেবার জন্যে। বর্ষার সময় গাঁয়ের ঘাটে এসে নৌকা থামত। দাদা নিজেই বাবার টিনের সুটকেশটা ঘাড়ে করে তাঁকে পৌঁছে দিতেন নৌকায়। তারপর একদিন আর নৌকায় যাওয়া হল না তাঁর। একদিন আমার বাবাও আর এয়ারপোর্টে যেতে পারলেন না আমাকে বুকে জড়াবার জন্যে। একদিন আমিও পারব না আমার ছেলেদের গাড়ি করে এয়ারপোর্টে নিয়ে যেতে। পৃথিবী অনেক বদলে গেছে আমার দাদার সময় থেকে। অনেক আধুনিক হয়ে গেছে আজকের মানুষ। আধুনিক হয় না শুধু মায়েরা, বাবারা। তারা সেই একইভাবে এয়ারপোর্টে গিয়ে নিরিবিলি কোণায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।