গোড়া ধর্মীয় এবং সৃষ্টিতত্ত্ববাদী ইন্টারনেট সাইটগুলোতে যেন উৎসবের সাড়া পড়ে গেছে। যাক, দেড়শ’ বছর পরে বিশ্বমানবতার শত্রু ওই ব্যাটা ডারউইনকে ভুল বলে প্রমাণ করা গেল। প্রায় ৪৪ লক্ষ বছর আগে মরে যাওয়া প্রায়-মানুষ আর্ডির (ardipithecus ramidus) ছবিতে মালা লাগিয়ে ডিসকভারী ইন্সটিটিউট বা আল জাজিরার অফিসে ঝুলিয়ে দিলেও কিন্তু অবাক হবার কিছু থাকবে না। এতগুলো বছর ধরে, লক্ষ লক্ষ ডলার ঢেলে, বিহের মত পিএইচডি-ওয়ালারা যা করতে পারেনি, আর্ডির মত একটা ৪৪ লক্ষ বছরের মরে পচে ভুত হয়ে যাওয়া খুব সাধারণ মহিলা তা করে দেখিয়ে দিল!  খ্রীষ্টান মোল্লারাদের তো এখন পোয়া বারো, ভারজিন মেরীর পরে ‘হোলি আর্ডি’র উদয় কি যা তা ঘটনা!

এত দিন ভাবতাম, আমাদের ওদিককার মোল্লারা এসব বিবর্তন-ফিবর্তন বোঝেও না, খুব বেশি হলে ‘জোকার’ নায়েকের মত দুই একটা লোক বিবর্তন নিয়ে কিছু না জেনে না শুনে বোকার মত মন্তব্য করে বসে। এদের কথাগুলো শুনতেও এত হাস্যকর যে, এ নিয়ে বেশী মাথা ঘামানোর কোন দরকার নেই। কিন্তু আবারও আমাকে ভুল প্রমাণ করে ( যেটা মোটেও কোন বিরল ঘটনা নয় 🙂 ) দিয়ে উদয় হলেন আল-জাজিরা, যাকে অনেকেই মনে করেন মধ্যপ্রাচ্যের এবং মুসলিম বিশ্বের  বেশ উদার দৃষ্টিভঙ্গীসম্পন্ন একটা পত্রিকা। আল জাজিরা আর্ডির খবর প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথেই ফলাও করে প্রচার করে বসলো যে, নাহ এতদিনে পশ্চিমা বিশ্বের বিপথগামী পাপী বিজ্ঞানীরা তাহলে হুশ ফিরে পেয়েছেন, এবং তারা এখন স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন যে ডারউইনের দেওয়া মানুষের উৎপত্তি এবং বিবর্তনের বস্তুবাদী ব্যাখ্যাটা আসলেই ভুল ছিল ! [i]

আমিও ভাবি, একরকমভাবে ভালোই হল!  প্রথমতঃ বিবর্তন নিয়ে আমার আর অযথা লেখালেখির দরকার নেই, আর ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বইটার প্রকাশককে বলতে হবে বাজার থেকে বইটা উঠিয়ে নিতে, তাহলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যাবে।  সারা পৃথিবীর সব জীববিজ্ঞানীরা এবার ল্যাব থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারে। স্কুল কলেজের সব জীববিজ্ঞানের বইগুলো আবার না হয় নতুন করে লিখতে হবে, একটু ঝামেলা হলেও সে আর এমন কি! ওদিকে বেশীরভাগ ওষুধের কোম্পানীগুলোর ব্যাবসাও লাটে উঠবে, বিবর্তনের তত্ত্বের উপর ভিত্তি না করে নাকি আজকার বেশীরভাগ ওষুধই তৈরি করা সম্ভব হয় না! কিন্তু মানব সভ্যতার এত বড় একটা ভুল তো সংশোধিত হবে -এর কাছে এসব ছোটখাটো অসুবিধা তো নিতান্তই তুচ্ছ! আমরা আবার চোখ বুঝে শুধু ডারউইন-পূর্ব কেন কোপার্নিকাসেরও আগের যুগে ফিরে যেতে পারি – ফ্ল্যাট আর্থ, ডাইনী পুড়ানো, স্থির প্রজাতি তত্ত্ব, ছয় হাজার বছর আগের প্রথম মানুষ আদম আর হাওয়া, গন্ধম ফল……… এসবের কোনটাকেই আর বাদ দেওয়ার দরকার কি? 
  
বিবর্তন কি তাহলে আদৌ ঘটছে?

কিন্তু আমার এই সুখী কোপার্নিকাসের আগের যুগে প্রত্যাবর্তনের সাধু উদ্দেশ্যে আবারও বাধ সাধলো সেই পুরনো পথভ্রষ্ট(!) বিজ্ঞানীর দলঃ)। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, সিএনএন সহ বিভিন্ন চ্যানেল এ টুকরা টুকরা খবর পড়লাম, কিন্তু কোথাওই বিজ্ঞানীদের নাকে খত দিয়ে ‘এত্তবড়’ ভুল স্বীকার করতে দেখলাম না, বরং উল্টোটাই শুনলাম কয়েকদিন ধরে। ইংরেজীতে একটা কথা আছে ‘ফ্রম দ্যা হরসেস মাউথ’, যার অর্থ হচ্ছে কোন খবরের উৎস থেকে সরাসরি শোনা। তাই যখন ডিস্কভার চ্যানেল এ আর্ডির ওপর যখন ২ ঘন্টার ডকুমেন্টারীর কথা শুনলাম, তখন ভাবলাম যাক এবার তাহলে ‘স্বয়ং ঘোড়া’ দের মুখ থেকেই আসল কথাটা শোনা যাক।  বিজ্ঞানীরা যারা আর্ডির ফসিল খুঁজে পেয়েছেন এবং প্রায় ১৫ বছর ধরে তা নিয়ে গবেষণার কাজে ব্যাস্ত আছেন তাদের কাজ এবং তার বিশ্লেষণ নিয়ে এ অনুষ্ঠান। তারপর আবার না চাইতেই এক কাঁদি – ২ ঘন্টার এই অনুষ্ঠানের পরে আবার এই বিজ্ঞানীদের নিয়ে এক ঘন্টার এক আলোচনা সভা। কিন্তু কোথায় কি? কেউ তো নাকে খত দিচ্ছে না, তওবাও করছে না, বরং বুক ফুলিয়ে ব্যাখ্যা করছে আর্ডি কিভাবে ডারউইনের দেওয়া বিবর্তনতত্ত্বকে আরও জোরদারভাবে ব্যাখ্যা করছে এবং আমাদের চোখের সামনে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসকে আরও পরিষ্কারভাবে তুলে ধরছে।

তাহলে কেন বলা হচ্ছে, ডারউইনের প্রস্তাবিত বিবর্তন তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেছে আর্ডি?  পৃথিবীর তাবত জীব কি তাহলে বিবর্তনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এখানে আসেনি? তারা কি তাহলে প্রত্যেকে আলাদা আলদাভাবে ‘সৃষ্টি’ হয়ে পৃথিবীতে এসে জুটেছে……এরকম প্রশ্নগুলো যে আজকে একবিংশ শতাব্দীর প্রথমে বসে করতে হচ্ছে সেটা মেনে নেওয়াই কষ্টকর। কিন্তু কি আর করা, আল-জাজিরার মত তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ সংবাদ সংস্থা যদি এরকম মিথ্যা খবর প্রচার করে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে তাহলে দুঃখজনক হলেও একে খন্ডন করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আজকে বিজ্ঞানীদের সামনে এই প্রশ্নটা পৃথিবী কি আসলেই সূর্যের চার পাশে ঘুরছে এমন প্রশ্ন করারই সামিল।

নাহ, বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক করেনি আর্ডির আবিষ্কার, বরং তাকে আরও বিস্তৃত করেছে।বিজ্ঞানের অন্যতম কুলীন জার্নাল ‘সাইন্স’ এ আর্ডির উপর ১১টি বৈজ্ঞানিক গবাষনা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এ মাসে। ডিস্কভারী চ্যানেলে যে বিজ্ঞানীরা সাক্ষাতকার দিলেন তারাসহ আন্তজাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন  ৪০ জন  বিজ্ঞানী  লিখেছেন এই প্রবন্ধগুলো, আর্ডি সংক্রান্ত তাদের দীর্ঘ ১৪ বছরের গবেষণা এবং সিদ্ধান্তগুলোকে ব্যাখ্যা করে। তারা তাদের এই প্রবন্ধগুলোর সংকলনের ভূমিকাটা (Light on the Origin of Man প্রবন্ধে) শেষ করেছেন এই বলে :

“মানুষের বিবর্তনের  অপেক্ষাকৃত আধুনিক পর্বটা সম্পর্কে আমরা বেশ ভাল করে জানি, আমরা এ সময়ের অনেক ফসিল রেকর্ডই খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু আমাদের ইতিহাসের শুরুর সময়টা এবং তারও আগে সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে ভাগ হয়ে যাওয়ার সময়ে এবং ঠিক আগের বনমানুষদের তেমন কোন ফসিল পাওয়া যায়নি।  Ardipithecus ramidus  আমাদেরকে এই দু’টো সময়ের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে সহায়তা করছে। আর্ডি আমাদেরকে ডারউইনের লেখা ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’বইটির শেষ কথাগুলো আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে…

There is grandeur in this view of life, with its several powers, having been originally breathed into a few forms or into one; and that, whilst this planet has gone cycling on according to the  fixed law of gravity, from so simple a beginning endless forms most beautiful and most wonderful have been, and are being, evolved.”[ii]

 
অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা নিজেরাই বলছেন যে আর্ডির এই আবিষ্কার ডারউইনের প্রস্তাবিত বিবর্তন তত্ত্বকেই সমর্থন করছে। তাহলে, আল জাজিরাইয় প্রকাশিত খবরটি শুধুই ভিত্তিহীনই নয় বরং তা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি এক বানোয়াট গুজব ছাড়া আর কিছু নয়। পাশ্চাত্যের ছয় হাজার বছরের পুরনো পৃথিবীতে বিশ্বাসী সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের সাথে আসলে এদের কোনই পার্থক্য নেই।
 
মানুষ আর শিম্পাঞ্জী কি একই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে?

এবার তাহলে বিবর্তন তত্ত্বের আরেকটু ভিতরে ঢোকা যাক। অতীতে যখনই কেউ ভুল করে বলেছেন যে, মানুষ শিম্পাঞ্জী থেকে এসেছে তখনই শুধু বিজ্ঞানীরা নয়, বিবর্তনের মূল তত্ত্ব সম্পর্কে  জ্ঞান রাখা মানুষজন অত্যন্ত সতর্কভাবে তা সংশোধন করে দিয়েছেন। না আমরা সরাসরি শিম্পাঞ্জী থেকে  বিবর্তিত হইনি, বরং শিম্পাঞ্জী(এবং বনোবো) এবং মানুষ একই সাধারণ পুর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে যার যার আলাদা পথে বিবর্তিত হয়েছি গত ৭০-৮০ লক্ষ বছরে ধরে। অর্থাৎ, শিম্পাঞ্জী এবং মানুষ নামক প্রজাতি দু’টি একে অপরের নিকটতম আত্মীয় হলেও তারা কেউ একে অপরের থেকে সরাসরি আসেনি বা বিবর্তিত হয়নি। আবার অন্যদিকে, জীববিজ্ঞানে এই দশকের অন্যতম বড় অর্জন হচ্ছে মানুষের জিনোমের পূর্ন সংশ্লেষণ। শুধু তো তাই নয়, পরবর্তীতে ২০০৫ সালে শিম্পাঞ্জীর জিনোমেরও সংশ্লেষন সম্পূর্ণ করা হয়। জিনোম সংশ্লেষন থেকেও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, শিম্পাঞ্জী আর মানুষের জিনের মধ্যে প্রায় ৯৮% সাদৃশ্য রয়েছে। অর্থাৎ, শিম্পাঞ্জীরা যে আমাদের নিকটতম আত্মীয় তা নিয়েও কোন সন্দেহ নেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে।  আর্ডির ফসিল কি মানুষের বিবর্তনের ধারার এই মূল ব্যাখ্যা থেকে সরে এসেছে? আমরা কি তাহলে একই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে আসিনি?

আবারও তাহলে দেখা যাক বিজ্ঞানীমহল কি বলছেন এ প্রসঙ্গে। ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক আর্ডির খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে ‘আর্ডি লাইটস দ্যা ওয়ে’ শিরোনামে মানব বিবর্তনের এই সময়সুচিটা প্রকাশ করে। শিরোনামের ঠিক নিচেই লেখা ছিল,

‘এই নতুন কঙ্কালটি  শিম্পাঞ্জী আর আমাদের সর্বশেষ সাধারণ পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্যগুলোকে আরও খোলাসা করে দিয়ে বিবর্তনের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ন ফাঁক পূরণ করলো। তবে এখনও আরও অনেক অজানা বহু কিছুই আবিষ্কৃত হওয়ার অপেক্ষায় আছে।‘

নীচের সময়সূচীটা[iii] একটু খেয়াল করে দেখলেই এখনকার আধুনিক বনমানুষ বা এপদের সাথে(গরিলা, শিম্পাঞ্জী, বনোবো) মানুষের সাধারণ পূর্বপুরুষদের ভাগ হয়ে যাওয়ার সময়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। ৮০ লক্ষ বছর আগে গরিলারা ভাগ হয়ে গেছে আধুনিক মানুষ, শিম্পাঞ্জী এবং বনোবোর সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে। তারপর, ৬০-৭০ লক্ষ বছর আগে, বিবর্তনের ধারায় মানুষের পূর্বপুরুষেরা ভাগ হয়ে গেছে শিম্পাঞ্জী এবং বনোবোর পূর্বপুরুষ থেকে।


 
ছবিঃ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক মানব বিবর্তনের ধারা (ছবিতে ক্লিক করে বড় করে দেখুন)

এবার তাহলে আবারও দেখা যাক আর্ডির আবিষ্কার এবং গবেষণায় নিয়োজিত বিজ্ঞানীরা নিজেরা কি বলছেন। টিম ডি হোয়াইট, হাইলে সেলাসি, ওয়েন লাভজয় সহ ৭ জন বিজ্ঞানীর সাইন্সএ প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘ardipithecus ramidus and Paleobiology of Early Hominids’ শেষ ক’টা লাইন এখানে প্রণিধানযোগ্য,

‘সম্ভবত ar. ramidus এর সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল যে সে ডারউইনের দেওয়া ব্যাখ্যাকে জোড়ালোভাবে পুনপ্রতিষ্ঠিত করেঃ  মানুষ শিম্পাঞ্জী থেকে সরাসরি বিবর্তিত হয়ে আসেনি। বরং এসেছে  সুদুর অতীতে, মিওসিন যুগে আফ্রিকায় জঙ্গলে বিচরণ করা শিম্পাঞ্জী আর মানুষের সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে ধারাবাহিকভাবে বিবর্তিত হওয়া বিভিন্ন আদিপুরুষ থেকে।’

তাহলে এই মুহূর্তে, এতটুকু অন্তত বলা যায়, বিজ্ঞানীরা আর্ডির খোঁজ পাওয়ার আগে মানব বিবর্তনের মূল ধারা সম্পর্কে যে প্রকল্প দিয়েছিলেন এখনও তাকেই আরও জোরদারভাবে তুলে ধরছেন। বিবর্তনবাদের মূল তত্ত্ব তো বটেই, মানুষ আর শিম্পাঞ্জী যে একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে তা নিয়েও সংশয়ের বিন্দুমাত্র কোন অবকাশ নেই।
 
তাহলে আর্ডি নিয়ে এত হৈচৈ কেন?
 
ডারউইন এবং হাক্সলী গত শতাব্দীর শেষের দিকে যখন মানব বিবর্তন নিয়ে লেখেন তখন নিয়ান্ডারথাল ছাড়া মানুষের আর কোন প্রজাতির তেমন কোন ফসিল পাওয়া যায়নি। কিন্তু তারা বিবর্তনের মূল তত্ত্ব এবং সেই সময়ের সীমাবদ্ধ সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রস্তাব করেছিলেন যে, আধুনিক বনমানুষ এবং মানুষ সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে যার যার মত বিবর্তিত হয়ে আজকের এই অবস্থানে এসেছে।

তারপর পুরো বিংশ শতাব্দি প্রথম মানুষের বিভিন্ন প্রজাতির ফসিল পাওয়া গেছে।  এর মধ্যে প্রায় ২০-২৫ লক্ষ বছরের পুরনো মানুষের প্রজাতিগুলোকে বিজ্ঞানীরা Homo (আধুনিক মানুষের গণ)র মধ্যে ফেলেন।  এদের মধ্যে ইতোমধ্যেই বড় মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটে গেছে এবং  বিভিন্ন রকমের হাতিয়ারের ব্যাবহারও শুরু হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এই অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়ের ফসিল রেকর্ড থেকে মানুষ এবং শিম্পাঞ্জীর সাধারণ পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, কারণ তাদের মধ্যে মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্যগুলো আর অবশিষ্ট নেই, ইতোমধ্যেই তারা আধুনিক মানুষের সব বৈশিষ্ট্য অর্জন করে ফেলেছে।  কিন্তু এর চেয়ে পুরনো প্রজাতিগুলোর ফসিল পাওয়া যায়নি বহুদিন। ১৯২৪ সাল থেকেই এখানে সেখানে কিছু আরও পুরনো ফসিলের অংশবিশেষ পাওয়া গেলেও এসব আদিম প্রজাতিগুলোর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পূর্ণ-ফসিল পাওয়া যায়নি যা থেকে বিজ্ঞানীরা কোন সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেন।  তারপরে সত্তরের দশকে এল লুসির (Australopithecus afarensis) আবিষ্কার যা আমাদের মানব ইতিহাসকে প্রায় ৩৭ লক্ষ বছরের পরিধিতে এগিয়ে নিয়ে এল । এর আগে পাওয়া বিভিন্ন ফসিল থেকে বহুলভাবে বিশ্বাস করা হত যে বনমানুষদের সাথে আমাদের ভাগটা ঘটেছে প্রায় দেড় কোটি বছর আগে। এর পর  বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই ভেবে এসেছিলেন যে, মানুষের সোজা হয়ে দুপায়ের উপর হাটতে পারাটা ছিল আফ্রিকার প্লিওসিন যুগের তৃনভুমিতে অভিযোজিত হওয়ার ফসল। লুসির ফসিল যেন তাদের সেই প্রকল্পকেই সঠিকতা এনে দিল। Australopithecus দের হাটুর গঠন থেকে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে তারা দ্বিপদী (bipedal) ছিল। তখনও যেহেতু এর চেয়েও আরও পুরনো কোন পূর্ণ-ফসিল পাওয়া যায়নি বিজ্ঞানীরা ধরে নেন যে লুসির প্রজাতিই আমাদের প্রথম পূর্বপুরুষ যারা হয়তো পৃথিবীর বুকে প্রথম সোজা হয়ে দাঁড়াতে এবং চলাচল করতে শিখেছিল। শুধু তাই নয়, এখান থেকে আরও একটা জিনিষও বোধ হয় প্রথমবারের মত পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বিবর্তনের ধারায় আমাদের এই বড় মস্তিষ্ক আগে আসেনি, তার অনেক আগে আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখেছি। Australopithecus রা দ্বিপদী হলে কি হবে তাদের মস্তিষ্কের আকার তখনও ছোটই রয়ে গেছে।  তাই অনেক বিজ্ঞানীই বড় মস্তিষ্ককে নয় বরং দুই পায়ের উপর খাড়া হয়ে দাঁড়াতে শেখাকে মানুষ নামক প্রজাতির প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে মনে করেন।

  
কিন্তু  ওদিকে আবার শিম্পাঞ্জী, বনবো এবং গরিলারা যে আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় তা নিয়ে সন্দেহেরও কোন কারন নেই – শুধু তো জেনেটিক সংশ্লেষনের মাধ্যমে পাওয়া জিনের মিল নয়, তাদের দেহের বিভিন্ন ধরণের প্রোটিনের মধ্যে সাদৃশ্য, মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে শুরু করে ক্রোমজমের গঠনের অভূতপূর্ব মিল, এসব থেকেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমান করা যায় যে আধুনিক বনমানুষ এবং মানুষের সাধারণ পূর্বপুরুষ একই ছিল। বিভিন্ন ধরণের গবেষণা থেকে এও অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয় যে, গরিলারা এই সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে প্রথমে, প্রায় ৮০ লক্ষ বছর আগে আলাদা হয়ে যায়, এর পরে ৬০-৭০ লক্ষ বছর আগে মানুষের আদি পূর্বপুরুষের বিভক্তি ঘটে শিম্পাঞ্জী এবং বনবোদের থেকে।  কিন্তু আবার গরিলা, শিম্পাঞ্জী এবং বনবো সবার মধ্যেই ছোট মস্তিষ্ক এবং হাতের আঙ্গুলের উপর ভর করে হাটার বৈশিষ্ট্য (ইংরেজীতে বলে ‘নাক্‌ল ওয়াকিং’) দেখা যায়। এখনো টিকে থাকা এই তিন প্রজাতির বনমানুষের মধ্যেই যেহেতু নাকল ওয়াকিং দেখা যায়,  বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট পরিমান ফসিল রেকর্ডের অভাবে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেন যে, আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষের মধ্যেও এই  বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল। অর্থাৎ, গরিলা, শিম্পাঞ্জী এবং বনবোদের মধ্যে আলাদা আলাদা করে এই বৈশিষ্ট্যটা বিবর্তিত হয়নি, বরং সাধারণ পূর্বপুরুষদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আমরা ধীরে ধীরে আঙ্গুলের উপর ভর করে চলাফেরা না করে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছি।

আর সরষের মধ্যের ভূতটা সেখানেই!  প্রায় ৪৪ লক্ষ বছর আগের এই ছোট্ট খাট্টো আর্ডি আজ মানব ইতিহাসের পাতায় লেখা বেশ কিছু ভুল প্রকল্পকে সংশোধন করে দিতে এগিয়ে এসেছে অত্যন্ত দৃঢ় পদক্ষেপে। লুসি আমাদের ইতিহাসের  বইতে হারিয়ে যাওয়া ৩৭ লক্ষ বছর দূরের পাতাটা লিখতে সাহায্য করেছিল, আর্ডি সেই বইটাকেই আরও দশ লক্ষ বছর বিস্তৃত করলো।

আর্ডির আবিষ্কার থেকে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে যে, ৪৪ লক্ষ বছর আগেই মানুষের আদিপুরুষদের মধ্যে দ্বিপদী বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়, আর্ডি যেমন  দু’পায়ে ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে, মাটিতে ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারে,  তেমনি আবার দিব্যি গাছে গাছে বিচরণও করতে পারে। এরকম কোন ফসিল এর আগে কেউ কখনও দেখেনি, গত দেড়শো বছর ধরে ফসিলবিদেরা এরকম কোন ফসিলের কথা শুধু কল্পনাতেই ভাবতে পেরেছেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আর্ডির খবর প্রকাশের পরপরই তার কঙ্কাল এবং পূর্নাংগ দেহের এই ছবিটা প্রকাশ করে।  এই ছবিটার নীচে যে কথাগুলো লেখা ছিল তা থেকে বিজ্ঞানীদের এই বিস্ময়টা খুব পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পেয়েছে…

 
 
ছবিঃ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকঃ পূর্নাংগ দেহী ardipithecus ramidus এবং তার কঙ্কালের ছবি (ছবিতে ক্লিক করে বড় করে দেখুন)

 “আর্ডির ফসিল এক মহাবিস্ময় – একজন গবেষক বললেন, ‘এরকম কোন কিছুর কথা ভাবতে পারাও ছিল অসম্ভব’। অধিকাংশ  বিজ্ঞানীর মতে এবং জনপ্রিয় বিশ্বাস ছিল যে, সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে মানুষ এবং শিম্পাঞ্জী যে সময়টা আলাদা হয়ে গিয়েছিল সেই সময়ের গহবর থেকে খুঁজে পাওয়া যে কোন ফসিল দেখতে শিম্পাঞ্জীর মতই হবে। অথচ আর্ডির মধ্যে নাকল ওয়াকিং, গাছে গাছে ঝুলে থাকার ক্ষমতা – এই সব বৈশিষ্ট্যের তেমন কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তার বদলে, তার শ্রোণীর গঠন, মাথার খুলি এবং হাত পার গঠনের মধ্যে আদিম বানর এবং আধুনিক হোমিনিডের বৈশিষ্ট্যাবলীর সম্মিলন দেখা যাচ্ছে। এই  বৈশিষ্ট্যগুলোর এক অদ্ভুত সমন্বয়ের ফলে সে একদিকে যেমন হাতের তালুর সাহায্যে গাছ থেকে গাছে চড়ে বেড়াতে পারতো আবার অন্যদিকে আমাদের চেয়ে কিছুটা কম দক্ষতায় হলেও দুই পায়ের উপর ভর করে দিব্যি মাটিতে হেটে বেড়াতে সক্ষম ছিল।“

তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে? আমরা এতকাল ধরে যে ভেবে এসেছিলাম, আধুনিক বনমানুষ  এবং মানুষের সাধারণ পূর্বপুরুষের মধ্যে শিম্পাঞ্জী-ধরণের দৈহিক বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যাবে সেটা মোটেও ঠিক নয়। বরং এদের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে যেগুলো আরও আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কিছু বানর প্রজাতির ফসিলে পাওয়া গিয়েছিল।শুধু কি তাই?  এতদিন ধরে আমরা আমাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য – দুই পায়ে ভর করে দাঁড়ানোর সময়সীমা সম্পর্কে যা ধারণা করে এসেছি তাও তাহলে সম্পূর্ণভাবে ভুল ছিল! আমরা আসলে লুসির অনেক আগেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখেছি।  শুনতে বেশ সোজাসাপ্টা শোনালেও ব্যাপারটা আসলে এত সোজা নয়, এর ফলে মানব বিবর্তনের ইতিহাসের গল্পের মোড় বেশ খানিকটা কিন্তু ঘুরে যাচ্ছে।

তবে এখানেই গল্পের শেষ নয়, মোটে শুরু… কিন্তু ব্লগের জন্য লেখাটা  ইতোমধ্যেই বেশ বড় হয়ে গেছে। পাঠকের (এবং নিজেরও 🙂 )  ধৈর্যচ্যুতির কথা মাথায় রেখে আজকের মত  লেখাটা এখানেই শেষ করছি। আর্ডির বিভিন্ন গঠনগত বৈশিষ্ট্য এবং তার ফলে মানব ইতিহাসের কোন কোন তথ্যে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তা নিয়ে পরের পর্বে লেখার আশা রইলো…

চলবে…

—————————————————————-
তথ্যসূত্রঃ
[i] ) http://richarddawkins.net/article,4405,n,n
http://sciencereligionnews.blogspot.com/2009/10/making-sense-of-al-jazeeras-strange.html#  
[ii] ) Introduction: Light On the Origin of Man. www.sciencemag.org  SCIENCE VOL 326 2 OCTOBER 2009 61Published by AAAS 
 
[iii] ) http://ngm.nationalgeographic.com/human-evolution/human-ancestor