আমি এই ব্লগে আজ যা লিখব-যাদের জন্যে লিখব, তাদের অনেকেই এখন হয়ত বুঝবে না। হয়ত তাদের সারাটা ব্যার্থজীবনে ও বুঝে উঠবে না। তবুও যদি, এই লেখা তাদের মনে নতুন দিশার জন্ম দিতে পারে-মানসিক অন্ধকারে একটুও ফুটে ওঠে আলো-আমি বাধিত হব।

A.

বাঙালী কবে থেকে বামপন্থী? আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুটো পর্ব। প্রথমে জাতিয়তবাদি বিপ্লবী যেমন ক্ষুদিরামরা ছিলেন ধর্মীয় জাতিয়তাবাদি। গীতা হাতে দেশ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন। সেটা ছিল এক অর্থে ধর্মীয় প্রতিবাদি আন্দোলন। তবে আল-কায়দার পরিচালিত ইসলামিক প্রতিবাদি আন্দোলনের সাথে
আমাদের ধর্মীয় প্রতিবাদি আন্দোলনের সব থেকে বড় পার্থক্য হচ্ছে-আন্দোলনটা বৃটিশদের তাড়াবার জন্যে হলেও, বিপ্লবীরা বৃটিশ ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনৈতিক ব্যাবস্থা এবং সমাজেই আ রাখতেন বেশী। সনাতন হিন্দু সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে, তারা বিপ্লবী হন নি। আল-কায়দা পুরো উলটো। তারা পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধেই শুধু যুদ্ধ করে না-পাশ্চাত্য সমাজব্যাবস্থার বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করে।

এটা চলেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। ১৯২০ সাল থেকেই মানবেন্দ্র রায় বা চাচা মুজফরের চেষ্টায়, বলশেভিক বিপ্লবের ঢেউ এবং আদর্শ ভারতেও এল। এরা প্রথম জীবনে সবাই ধর্মীয় প্রতিবাদি আন্দোলনেরই শরিক ছিলেন। মূলত জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন হিসাবে কৃষক-প্রজা পার্টি এবং ভারতীয় কমিনিউস্ট পার্টির জন্মের মধ্যে দিয়ে বাঙালীর বামপন্থী হওয়া শুরু।

এর পরে ১৯৭০-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত র‌্যাডিক্যাল কমিনিউস্টরা দুই বাংলা দাপিয়ে বেড়িয়েছে। পেটের তীব্র ক্ষুদায় পশ্চিম বঙ্গে যেমন নক্সল পন্থীরা তেমনই বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দাবিদার কর্নেল তাহেরের দলবল রাষ্ট্র যন্ত্রকে ভীষন ভাবেই চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে। কিন্ত পেটের ক্ষিদের সাথে রোম্যান্টিসিজম মেশানো এই অর্ধ-বিপ্লবীদের সব চেষ্টা ব্যার্থ হয়। মিলিটারি শাসনে বাংলাদেশ থেকে কমিনিউজম প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে থাকে এবং ৯১ সালে সোভিয়েত পতনের পর ১৯৯৩ সালে কমিনিউস্ট পার্টি অব বাংলাদেশে সব থেকে বড় ভাঙন আসে। এবং বাংলাদেশের বিগত নির্বাচনে সিপিবি ( কমিনিউস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ ) একটিও আসন পায় নি।
পশ্চিম বঙ্গের ইতিহাস একটু উলটো। এখানে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সিপিএম লোককে সমাজতান্ত্রিক রিলিফ দেওয়ার কথা ঘোষনা করে। ১৯৭৭-১৯৮২ সালে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের রাজত্বকালে ব্যাপক ভাবে পশ্চিম বঙ্গে ভূমি সংস্কার আন্দোলন হয়। রায়তরা জমির ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। কিন্ত একই সাথে দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন শ্রমিক আন্দোলনের ফলে পশ্চিম বঙ্গ থেকে সব শিল্প গোটাতে থাকে। ১৯৮৫ সালের মধ্যেই পশ্চিম বঙ্গে অবস্থিত ভারতের সর্বাধিক সমৃদ্ধ শিল্পাঞ্চল গুলি-যেমন হাওড়া বা দুর্গাপূর শিল্প নগরীর পরিবর্ত্তে শিল্প-শ্বশান নগরীতে পরিণত। হাওড়া-ব্যন্ডেল এবং কৃষ্ণনগর শিয়ালদহ-দুই লাইনেই আমার ছোটবেলা থেকে যাতায়াত- ট্রেন লাইনের দুধারে শুধু কারখানার কঙ্কাল ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ত না। ফলে ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলি যেমন সাংঘাতিক ভাবে এগিয়ে যায়, পশ্চিম বঙ্গ বামফ্রন্ট শাসনে ঠিক ততটাই পিছিয়ে পড়ে। ১৯৭৭ সালে গুজরাতিদের গড় ইনকাম ছিল বঙ্গবাসীদের মোটে ৩০% বেশী-মহারাষ্ট্র এবং গোয়া বাদ দিয়ে তখন বাকী রাজ্যগুলি মাথাপিছু ইনকামে পশ্চিম বঙ্গের পেছনেই ছিল। বর্তমানে গুজরাতিদের মাথাপিছু গড় উপায় বাঙালীদের থেকে ২৫০% বেশী। গুরগাঁও বা হায়দ্রাবাদে গেলে মনে হয়, কোলকাতা তৃতীয় বিশ্বের আর দিল্লী বা হায়দ্রাবাদ প্রথম বিশ্বের শহর।
B.
যাইহোক বামফ্রন্ট সরকারের ব্যার্থতা নিয়ে লিখতে বসি নি। এসব তথ্য বা বিতর্ক সবই সবার জানা। মূল ব্যাপার হল, দীর্ঘ ৩২ বছর রাজত্বের পর, সিপিম সরকার নিশ্চিত ভাবেই পশ্চিম বঙ্গ থেকে বিদায়ের মূখে। বিগত লোকসভা নির্বাচন এবং তার পরবর্ত্তী সমস্ত স্থানীয় নির্বাচনে তারা গোহারা হারছে। সাথে সাথে পশ্চিম বঙ্গের কমিনিউস্ট আন্দোলনের একটি দীর্ঘ অধ্যায় ও শেষ হতে চলেছে। আমার ধারনা ২০১১ সালের পর পশ্চিম বঙ্গে সিপিমকে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হবে-সেমন করে এখন নক্সাল দলগুলিকে খুঁজতে হয়। সিপিএমের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষের জনবিক্ষোভ এতই তীব্র, ২০১১ সালের হারে পর যখন পুলিশ বাহিনী নিজেদের অধিকারে থাকবে না, তখন পার্টিটা আদৌ টিকবে কি না আমার সন্দেহ আছে। রুমানিয়াতে চেসেস্কুর পতনের পর, সাধারন মানুষ যেমন স্থানীয় অত্যাচারী কমিনিউস্ট নেতাদের ধরে ধরে পিটিয়েছিল-পশ্চিম বঙ্গের পরিস্থিতি ঠিক একই ধরনের অগ্নিগর্ভ।

যাকগে স্পেকুলেশন আমার কাজ না। সেটা নিয়ে লিখছিও না। মূল কথাটা হল, বাঙালীরা ছিল দক্ষিন এশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার সব থেকে বড় ধারক এবং বাহক। সেই ইতিহাস আজ সমাপ্তির পথে। নক্সাল দলগুলির অজস্র দল-উপদল। সিপিএম শেষ। কমিনিউস্টদের আজ সম্পূর্ন ভাবেই সাধারন বাঙালী বর্জন করেছে।

এর মানেত এই নয়-মুক্তবাজার অর্থনীতিই আমাদের আলো দেখাবে? এনরন, ওয়ার্ল্ড কম, সত্যম কেলেঙ্কারীর পরে, আমরা সবাই জানি-মুক্তবাজার অর্থনীতি আসলেই চোর-ডাকাতদের আখরা যাদের মুখে সি ই ওর মুখোশ। ধনতন্ত্রের কলে মানুষের যন্ত্রনা আগেও যা ছিল-আজও তাই আছে। পৃথিবীর সব দেশেই গণতন্ত্রটা ঠিকাদারতন্ত্র। কিছু ব্যাবসায়ী আসল রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দখল করে সাধারন মানুষকে ঠকাচ্ছে। পশ্চিম বঙ্গের অবস্থা এমনই করুন, সেই ঠকানোকে জনগন মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে কারন, উলটো দিকের অত্যাচারি সিপিএম দানবকুলের হাতে করা আর হাজতবাস করা সমার্থক হয়ে উঠেছিল। সিপিএম জেলরদের কাছে হাজতবাস করার থেকে ব্যাবসায়ীদের হাতে ঠকা ভাল, এই বাস্তব বাঙালী আজকে মানছে। না মেনে উপায় নেই। আমাদের আজ এতটাই দুর্দিন।

C.

তাহলে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় ভুলটা কোথায় যদি ধনতন্ত্রে মানুষের সমস্যাগুলোর সমাধানের বদলে, সেগুলো বেড়েই চলে?

আসলে সমস্যা হচ্ছে-সভ্যতার আদি থেকেই সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চলে আসছে ( এটি পড়তে পারেন)। কার্ল মাক্স সেগুলোকে আদর্শবাদি ভাবধারা বললেন- কিন্ত বাস্তব হচ্ছে, তিনি নিজেও যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ওপর ভিত্তি করে সমাজতান্ত্রিক বিবর্তনের ছবি আঁকলেন, তাও সেই আদর্শবাদই হইল। বস্তুবাদ কথাটি মার্ক্সীয় তত্ত্বে হাজার বার আসে বটে-কিন্ত বস্তবাদের দর্শন আরেকটু গভীরে পড়লে বোঝা যাবে, মার্ক্সীয় দর্শন-যা অভিজ্ঞতাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত-তা বাস্তববাদের ( রিয়ালিজম) সাথে সীমা রেখাটানার কাজে নিতান্তই দুর্বল। তাও দান্দিকতা বা ডায়ালেক্টিজম দিয়ে, বাস্তবতার অনেক কাছাকাছি আসা যায়। সেটাই দ্বান্দিকতার কাজ-কিন্ত পরবর্ত্তী কালে বৈপ্লবিক মার্ক্সিস্ট ই হোন ( যেমন লেনিন) বা গনতান্ত্রিক মার্ক্সবাদিই হোন ( বার্নস্টাইন বা কাউটস্কি) , বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে দ্বান্দিকতাকে বর্জন করে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ফ্রেম ওয়ার্কের ওপর সমস্ত ফোকাস ঘুরিয়ে দেন। ব্যাস এই লেনিনজমে এসে মার্ক্সীয় সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধার সম্পূর্ণ ভাবেই বৈদিক সমাজতন্ত্র বা ইসলামিক সমাজতন্ত্রের মতন আরেকটি ধর্মীয় প্রতিবাদি আন্দোলনের রূপ নেয়। ফলে বিংশ শতাব্দির শুরু থেকেই মার্ক্সীয় সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা সম্পূর্ন ভাবে সমাজবিজ্ঞান বা নৃতত্ব বিজ্ঞান থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। আমি মার্ক্সীয় তত্ত্বের কতগুলি মূল ধারনার বিশ্লেষন করে উদাহরন দিচ্ছিঃ
D.
(1) শোষন এবং উৎপাদন ব্যাবস্থাঃ
শোষন কথাটি উদবৃত্ত মূল্য এবং উদবৃত্ত শ্রমের সাথে সংযুক্ত। ধরা যাখ খগেন বাবু মালিক। উনার শ্রমিক ক টাকা শ্রম নিয়ে একটি বস্ত্র উৎপাদন করল। উনি খ টাকায় বেচে দিলেন। গ টাকা লাভ হল। এটা উদবৃত্ত মূল্য এবং এই লাভটা শ্রমিককে শোষন করা টাকা।

প্রশ্ন হচ্ছে চায়ের দোকানের দীপুকে ত এই ভাবেই শোষন করা হয়। কিন্ত তাও, ওপরের মডেলটা অতি সরলীকরন। কারন
১) খগেন বাবু নিজেই শ্রমিক এবং মালিক হতে পারেন। সম্পূর্ণ পারিবারিক উৎপাদন ব্যাবস্থা হতে পারে। এদের মার্ক্স পেটি বুর্জোয়া বলতেন-এবং এদের অবলুপ্তি হবে-এমন ঘোষনাও দিয়েছিলেন। বাস্তবে হয়েছে উলটো।
২) লোকসান ও করতে পারেন। রিস্ক নিচ্ছেন-তার জন্যে একটা গ্যাম্বলিং মূল্যও তার পাওনা।
৩) মার্কেটিং সেলস করতে তাকেও পরিশ্রম করতে হয়। এই গ টাকা লাভটা, তার পারিশ্রমিক হিসাবেও ভাবা যেতে পারে।
৪) গ লাভের টাকাটা শ্রমিকদের মধ্যে বিতরন করা হয় পাবলিক কোম্পানীতে বোনাস হিসাবে
(৫) বর্তমানের পাবলিক কোম্পানীগুলিয়ে মালিক ব শেয়ার হোল্ডার মোটেও প্রফিট থেকে লাভ করে না। প্রফিট সেখানে কর্মীরাই পায়। শেয়ার হোল্ডাররা লাভ করে স্পেকুলেটিভ ভ্যালুয়েশন থেকে। যেমন জেনেনটেকের মতন কোম্পানীগুলি কোন কোয়াটারে কত লাভ করছে, তার থেকেও বেশী গুরত্ব দিচ্ছে, নতুন কি ওষুধ আবিস্কার করল তার ঊপরে। কোম্পানীর ভবিষ্যত ভ্যালুয়েশন সেখানেই।

আরো অনেক কিছুই এই মডেলের বিরুদ্ধে যেতে পারে। সেটা বড় কথা না-যেটা এখানে দ্রষ্টব্য সেটা হচ্ছে কি মার্ক্সীয় শোষন মডেল বা ১-৫ , তার এন্টি থিসিস যা যা বল্লাম, এর কোনটাই সার্বজনীন না। কখনো খাটবে, কখনো খাটবে না।

তাহলে কি ‘শোষনের’ সামাজিক সুত্র ( Social Law) বার করা সম্ভব? বিজ্ঞানে সুত্র কি করে বার করে?

অভিজ্ঞতাবাদ বা এম্পিরিসিজম কিছু সামাজিক সুত্র গঠনের ওপর নির্ভর করে। মার্ক্সিজিম ও যেহেতু এম্পিরিসিজম সেহেতু মার্ক্সিয় তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রথমেই যে প্রশ্ন উঠবে-আমাদের এই জটিল সমাজ ব্যাবস্থার মধ্যে সামাজিক সুত্র বার করা সম্ভব কি না? এর বাস্তব তাৎপর্য্য পশ্চিম বঙ্গে যা দেখেছি তা সাংঘাতিক।

একটা চেনা ঘটনা বলি। মেদিনীপুরের পাঁশকুড়াতে একটি চালকল ছিল। ১৫ জন শ্রমিক কাজ করত। মালিক এক স্কুল মাস্টার। এমনিতেই চালকলে লাভ খুব কম। বাপের তৈরী কল বলে উক্ত মাস্টারমশাই টি অনেক কষ্ট করে চালাতেন। কখনো সখনো নিজের পকেট থেকেই চালাতেন। হ ঠাৎ করে পুজোর মাসে বোনাসের দাবীতে সেই চালকল বন্ধ হল। পেছনে ছিল সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটু। এই ঘটনা পশ্চিম বঙ্গে হাজারে হাজারে ঘটেছে আর আমাদের রাজ্যে শক্ত সামর্থ ছেলেরা ভারতের অন্য রাজ্যে গিয়ে করে খাচ্ছে। আমি এই বছরই কিছু গ্রামে ঘুরলাম। যেখানে ঘরের পর ঘরে পুরুষ নেই। সবাই অন্যরাজ্যে চলে গেছে। পুজ়ো বা ঈদের সময় বছরে একবার আসবে।

শোষনের তত্ত্ব কি এখানে খাটে না? শোষনকে সামাজিক সূত্র হিসাবে ধরলে নিশ্চয় খাটে। কিন্ত বাস্তবতা কি তাই? সামাজিক সুত্র দিয়ে কি এখানে বাস্তবতা (রিয়ালিটি) কে ধরা গেল?

আসলেই অভিজ্ঞতা বা ইতিহাসের ভিত্তিতে সামাজিক সুত্র তৈরী করা খুবই কঠিন কাজ। এবং ইতিহাস বা সামাজিক ঘটনাবলীর মধ্যে আদৌ কোন সূত্র লুকিয়ে আছে কি না ( স্ট্রাকচারালিজম) – বা যদিও বা থাকে, তা বর্তমান বা ভাবীকালে, বা সব দেশের সব সমাজে প্রযোজ্য হবে কি না তা আরো শক্ত ঠাঁই।

আমি পেশাদারি জীবনে নানান রকমের গণিতিক এম্পিরিক্যাল মডেলিং করি। আমার কাজ তাও প্রকৃতি বিজ্ঞানের ওপর যেখানে ফোটন ইলেক্ট্রনরা প্রাকৃতিক সুত্র মেনে চলে। তা সত্ত্বেও, অধিকাংশ জটিল সিস্টেমের ক্ষেত্রে কখনো সখনো ২০-৩০টা গণিতিক মডেল ফিট করার পরে, শেষ মেশ কোনক্রমে একটি মডেল দাড়ায় যা একটি নির্দিষ্ট লিমিটের মধ্যে খাটে। এমন নয় যে ওই ২০-৩০ মডেল যা বাতিল করতে হল, তার কোন বেসিস নেই। প্রতিটি মডেলই অতীতের পর্যবেক্ষন এবং যুক্তির ওপরে দাঁড় করিয়ে বানানো হয়। তাতেও দেখেছি সিস্টেমে যখন র‌্যান্ডমনেস বা বিশৃঙ্খলা আসে, যা মানব সমাজের ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রেন বা ফোটনের চেয়ে আরো বেশী প্রযোজ্য, তখন সাংঘাতিক যুক্তি এবং সঠিক পর্যবেক্ষনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মডেলও কাজ করে না। কারন, যেখানে স্ট্রাকচার নেই, সেখানোত জোর করে স্ট্রাকচার বা প্যাটার্ন ঢোকানো যায় না। যেখানে সামাজিক সুত্র তৈরী করা যায় না-সেখানে জোর করে সামাজিক সূত্র তৈরী করতে গেলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে হয়। অথচ যাবতীয় মার্ক্সিস্ট তত্ত্বই এই অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে যে মার্ক্সের তৈরী সামাজিক সুত্রগুলি ইতিহাসের ধারায় বা সমাজে প্রতিভাত হয়। কিন্ত বাস্তব হচ্ছে, তা কখনো হয়, কখনো হয় না। আসলেই কোন সার্বজনীন সামাজিক সূত্রের অস্তিত্ব নেই। মানব সমাজের মতন বিশৃঙ্খল সিস্টেম সূত্র মেনে চলতেই পারে-কিন্ত সেখানে সার্বজনীনতা বা ইন্ডাকশনিজম চলে না। মার্ক্সীয় তত্ত্বের বাকী পিলারগুলি কেও আমরা এই রিয়ালিজম বনাম এম্পিরিসিজমের সমস্যা থেকেই বিশ্লেষন করতে পারি।
E
বেস এন্ড সুপার স্ট্রাকচারঃ
রাজনৈতিক এবং সামাজিক সিস্টেম কিভাবে তৈরী হয়? মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কই বা কি ভাবে গঠিত হয়? মার্ক্সীয় তত্ত্বে তা সম্পূর্ণ ভাবেই উৎপাদন ব্যাবস্থার সাথে মানুষের সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। বেস মানে হল উৎপাদন ব্যাবস্থার সাথে মানুষের সম্পর্ক। এবং এই বেসের ওপর ভিত্তি করেই সামাজিক বা রাজনৈতিক (রাষ্ট্রীয়) গঠনের সুত্রপাত।

“In the social production of their existence, men inevitably enter Into definite relations, which are independent of their will, namely [the] relations of production appropriate to a given stage in the development of their material forces of production. The totality of these relations of production constitutes the economic structure of society, the real foundation, on which arises a legal and political superstructure, and to which correspond definite forms of consciousness. The mode of production of material life conditions the general process of social, political, and intellectual life. It is not the consciousness of men that determines their existence, but their social existence that determines their consciousness. At a certain stage of development, the material productive forces of society come into conflict with the existing relations of production or — this merely expresses the same thing in legal terms — with the property relations within the framework of which they have operated hitherto. From forms of development of the productive forces, these relations turn into their fetters. Then begins an era of social revolution. The changes in the economic foundation lead, sooner or later, to the transformation of the whole, immense, superstructure. In studying such transformations, it is always necessary to distinguish between the material transformation of the economic conditions of production, which can be determined with the precision of natural science, and the legal, political, religious, artistic, or philosophic — in short, ideological forms in which men become conscious of this conflict and fight it out. Just as one does not judge an individual by what he thinks about himself, so one cannot judge such a period of transformation by its consciousness, but, on the contrary, this consciousness must be explained from the contradictions of material life, from the conflict existing between the social forces of production and the relations of production”-A Contribution to the Critique of Political Economy (1859):

অর্থাৎ মার্ক্স ধরেই নিলেন, উৎপাদনের সাথে মানুষের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক সূত্রবালি তৈরী করা যায়। উৎপাদন ব্যাবস্থার সাথে মানুষের সম্পর্কর ওপর সামাজিক সিস্টেম নির্নিত হয় এটা কিছুটা সত্য ত বটেই-কিন্ত সমস্যা হচ্ছে সেই সত্য সার্বজনীন কি না! একজন বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম হলেত মা তাকে ফেলে দেয় না-বরং বেশী ভালোবাসা দিয়ে থাকে! অথবা মাতৃভাষার প্রতি অবুঝ ভালোবাসা কি এই সুপার স্ট্রাকচার দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়?
আসলে সংস্কৃতি এবং সামাজিক আইনগুলি -তথা মানুষের মধ্যে পারিস্পারিক সম্পর্কের উৎপত্তি নিয়ে সমাজবিজ্ঞান, গণিত, বায়োলজি এবং নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানে গত পাঁচ দশক ধরে ব্যাপক গবেষনা হয়েছে। একটা বিশৃঙ্খালিত মানব সম্পর্ক থেকে কিভাবে সামাজিক আইনের জন্ম হতে পারে না নিয়ে ব্যাপক গণিতিক এবং জেনেটিক্সের গবেষনা মানব ও প্রকৃতি ও সংস্কৃতির উদ্ভব নিয়ে আমাদের ধারনাকে আমূল বদলে দিয়েছে। এর কোন কিছুই মার্ক্সীয় তত্ত্বে ঢোকে নি বা মার্ক্সীস্টরা বোঝার চেষ্টাও করেন নি কি দ্রুতহারে মানব প্রকৃতি এবং সমাজবিজ্ঞান জেনেটিক্স নির্ভর হয়ে উঠেছে-তা আর আর কোনভাবেই শুধু উৎপাদনের সুত্র বা বেস দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।
বেস এবং সুপার স্ট্রাকচারের মূল অনুমান ভিত্তি হচ্ছে মানুষের ব্যাবহারিক প্রকৃতির ওপর কোন জন্মনির্ধারিত রেস্ট্রিকশন নেই। অর্থাৎ জীনের ফেনোটাইপ না, পরিবেশই মানুষকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন করে । বেস এবং সুপারস্ট্রাকচারের ভিত্তিভুমি হচ্ছে এই পরিবেশ নির্ভর মানুষের ধারনা।

কিন্ত এই ধারনা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। তাই বার্নাড থিয়েরী মানুষের সামাজিক প্রকৃতির জ়ৈব কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে বলেছেনঃ
(Adaptation and self-organization in primate societies.(Genes and Humanity’s Past: A Renewed Dialogue)
” Even if we admit that behavior is more sensible to environmental variations than morphology, it is a phenotype and, as such, subject to internal constraints” . Behavior is not infinitely flexible; we must admit that the epigenetic systems of transformation confine it to a limited number of possible solutions.”

কিন্ত হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে মার্ক্সিস্টরা সেই গত একশো বছর ধরেই বিজ্ঞান থেকে সরে গিয়ে বেস-সুপারস্ট্রাকচারের ন্যায় অপবিজ্ঞান এবং অপদর্শনের চর্চা করে চলেছেন। লুই পিয়েরী আলথুজার নামে এক ফরাসী মার্ক্সিস্ট দার্শনিক নিয়ে অনেক মার্ক্সিস্টরা মাতামাতি করেন-তিনি মার্ক্সিজমে স্ট্রাকচারালিজম নিয়ে ‘অনেক’ কাজ করেছেন। কিন্ত তার লেখা বা চিন্তায় আধুনিক বিশৃঙ্খল বিজ্ঞান বা জেনেটিক্স বিজ্ঞান কিভাবে মানব ও সামাজিক প্রকৃতিগুলিকে বোঝার চেষ্টা করেছে-তার কোনকিছুই পাওয়া যাবে না। ফলে মার্ক্সিস্ট মহলে তিনি কেঊকেটা হলেও, বাস্তবে তার চিন্তাধারাও সম্পূর্নভাবে আধুনিক বিজ্ঞান বিরোধি অপদর্শনের জন্ম দিয়েছে। এরা হচ্ছে মার্ক্সিজমের জাকির নায়েক। জাকির নায়েককে নিয়ে যেমন ধর্মপ্রান মুসলিমরা নাচানাচি করে, ঠিক তেমনই আলথুজারের ন্যায় অপদার্শনিকদের নিয়ে মার্ক্সিস্টরা লাফা-লাফি করে। উভয় ক্ষেত্রেই কারন আধুনিক সমাজ এবং জ়ৈববিজ্ঞানে এদের নিদারুন অন্ধত্ব। হিন্দুত্ববাদি, ইসলামিস্ট বা মার্ক্সিস্টদের মধ্যে আমি বর্তমানে কোন পার্থক্যই দেখতে পাই না। কারন এই শ্রেনীর লোক হওয়ার একটাই যোগ্যতা-বিজ্ঞান এবং দর্শনে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা।

F.

শ্রেনীতত্ত্ব-আরেকটি ধাপ্পাবাজি-

উৎপাদন ব্যাবস্থার ভিত্তিতে মানব সমাজকে ভাঙতে গিয়ে এখানেও মার্ক্স সামাজিক সূত্রের জন্ম দিয়েছেন-যা বাকী মার্ক্সিস্ট তত্ত্বের ন্যায় অর্ধসত্য-যা কোথাও খাটে, কোথাও খাটে না। প্রলেতারিয়েত, বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া ইত্যাদি শব্দগুলির সবই সেই ধোঁয়াশা মার্কা ডায়ালোগ। মার্ক্সীয় সূত্র এবং সংজ্ঞা ধরে এগোতে গেলে চায়ের দোকানের দিন আনা দিন খাওয়া মালিক হচ্ছে বুর্জোয়া আর বছরে কুড়ি লাখ টাকা মাইনে পাওয়া সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে প্রলেতারিয়েত! এমন নয় এসব সীমাবদ্ধতা মার্ক্সিস্টরা জানেন না। এর জন্যেও তারা তত্ত্ব্বের অনেক পরিবর্ত্তন ও করেছেন। কিন্ত তা বাস্তবে কুকুরের লেজ সোজা করা। কারন যেখানে ওই ধরনের শ্রেনীর অস্তিত্ব বা বিভাজন সম্ভব না, সেখানে হাজার হাজার তত্ত্ব এবং লেজুর তত্ত্বের প্রদুর্ভাব ঘটিয়েও বাস্তবকে ছোঁয়া যায় না। সবথেকে বড় কথা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে, উন্নতদেশগুলিতে প্রলেতারিয়েত বলে কেও থাকছে না ( রোবটদের যদি প্রলেতারিয়েত বলা যায় সে হবে অন্য কথা)। ২০০১ সালে ওয়ালমার্ট দেখতাম ৩০টা কাউন্টারে একটি বা দুটিতে অটোচেকআউট থাকত। শ্রমিক অনেক বেশী থাকত। এখন প্রায় সব কাউন্টারই অটোমেটিক হয়ে যাচ্ছে। জমি-বাড়ি-ম্যানুফাকচারিং-ট্রাভেল ইত্যাদিতে দালালির ব্যাবসা আমেরিকাতে আর হচ্ছে না-কারন এখন ইন্টারনেট ক্রেতার সাথে বিক্রেতার সরাসরি মেলবন্ধন ঘটাচ্ছে। ক্ল্যারিকাল কাজও উঠে গেছে। ফলে চাকরি পেতে গেলে আজকাল স্কিলড লেবার হতেই হবে-হিউমান রিসোর্সে যে কাজ করে তাকেও স্যাপ বা ওরাকলের এইচ আর প্যাকেজ চালানো জানতে হয়।

প্রশ্ন উঠতেই পারে ভারতে মত দেশে যেখানে ৩০% লোক খেতে পাচ্ছে না-মেশিনের বদলে টি বয় চা দিচ্ছে-সেখানে এর রেলিভ্যান্স কি? সেখানেও কিন্ত আমরা দেখছি স্কিলড লেবার ছাড়া ভদ্র চাকরি বাকীরা পাচ্ছে না। কিন্ত আনস্কিল্ড লেবার বাড়লেও, আনস্কিলডদের জন্যে মার্কেট তাই বলে বাড়ছে না-কমছে। করণিকের চাকরি ভারতেও অবলুপ্তির মুখে। সোনা বা শাড়ির ডিজাইন একদম প্রত্যন্ত গ্রামীন শহরেও ইন্টারনেট থেকে কপি করেই হচ্ছে। এসব আমি ডকুমেন্টারী করতে গিয়েই দেখেছি। গ্রামীন কৃষিতে আনস্কিলড লেবারদের যে মার্কেটছিল, যন্ত্রায়নের ফলে, সেখানেও কাজ অনেক কমেছে। ১৯৭৭ সালে একজন আনস্কিল্ড লেবার পশ্চিম বঙ্গে বছরে ৭০-৯০ দিন কাজ পেত। আজকে তা ২০-৪০ দিনে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে বাঙালী আনস্কিলড শ্রমিকদের সামনে পাঁচটি পথ-ভিক্ষুক হওয়া, আত্মহত্যা করা, অন্যরাজ্যে চাকরীর সন্ধানে গিয়ে স্কিলড লেবার হওয়া, চুরি-ডাকাতি-স্মাগলিং (লুম্পেন প্রলেতারিয়েত) বা মেয়েকে মুম্বাই এ বেশ্যাবৃত্তি করতে পাঠানো। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই পাঁচটি ঘটনাই সমান্তরাল ভাবে ঘটে চলেছে। মুম্বাইযে গোটা ভারত থেকে যে মেয়ে সাপ্লাই হয় তার ৪৫% বঙ্গবাসী বা বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া ভাগ্যহীনা নারী। অত্থচ বাঙালী মধ্যবিত্ত নিজেদের ব্যার্থতা বিশ্লেষন না করে, হয় সাংস্কৃতি গর্বে মশগুল বা মাক্সীয় তত্ত্বের স্বেমহনে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে।

G.
যাইহোক যেটা আমার বক্তব্য সেটা হল, যন্ত্রের ফলে উদ্ভুত সামাজিক বিবর্তন থেকে প্রলেতারিয়েতদের ভারতেও বাঁচানো যাচ্ছে না। উন্নততর উৎপাদন ব্যাবস্থার বিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে না পারলে, তারাও হারিয়ে যাচ্ছে-বিপ্লব হচ্ছে না। কারন শ্রেনী তত্ত্ব তাদের কাছে যতই সত্য লাগুক, পেটের আগুন না মেটালে তারাও বাধ্য হয় পশ্চিম বঙ্গ ছাড়তে। দিল্লীতে আমি এবার সপ্তাহ দুই ছিলাম। আমাদের অফিসে একটি কফি বয় ছিল বাঙালী। কফি খেতে গিয়ে একদিন দেখি সে কমরেড হিরেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের লেখা কিছু পড়ছে। আমি অবশ্য বেশী কিছু উৎসাহ দেখাই নি কথা বলার জন্যে। যাইহোক একদিন সে আমাকে বলে-আপনি ত বাঙালী? আমি বল্লাম হ্যাঁ। আমার খুব বেশী কথা বলার ইচ্ছা ছিল না-কারন এর আগেও দিল্লীর এশিয়াড ভিলেজে ওয়েটারের কাজ করা এস এফ আই এর প্রাত্তন নেতা দেখেছি যে শেষমেশ বাপের আশ্রয়টুকু যাওয়ার পর পশ্চিম বঙ্গে কিছু না করতে পেরে ওয়েটারের কাজ নিয়েছে। পশ্চিম বঙ্গে চাকরী না পাওয়ার পরে, মাস্টার ডিগ্রী নিয়ে ওয়েটার বা কফি বয়ের কাজ করতে করতে ও এরা বামপন্থার সীমাবদ্ধতা বুঝবে না। যাইহোক-ছেলেটি হঠাৎ করে বলে আপনি কোলকাতার লোক। আমি আবার সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম-না, তবে পশ্চিম বঙ্গের লোক। সে এবার আগ বাড়িয়ে বললো , দেখুন আমি এম এ পাশ করেছি সি ইউ থেকে-আপনার চেনাশোনা কেও থাকলে একটু ভাল কাজ দিতে বলুন না। আমরাত আপনার কোম্পানীর কর্মী না-কনট্রাক্টে আসি-খুবই কম মাইনা পাই।
আমি বল্লাম- কেন পশ্চিম বঙ্গ ছাড়লে-তুমি ত মনে হচ্ছে বেশ উচ্চশিক্ষিত।
ও বললো আপনি ত সবই জানেন। আপনিও বিদেশে আছেন।

আমি বললাম, সেত বুঝলাম-কিন্ত যেটা বুঝলাম না সেটা হচ্ছে, পশ্চিম বঙ্গের এই দুরাবস্থার পরেও কি করে কমিনিউজমে তোমার আস্থা অটুট আছে?

ও বললো -দেখুন আমাদের মালিক, ঘন্টা প্রতি আমাদের ১০ টাকা দেয়, আর আপনার কোম্পানীকে চার্জ করে ঘন্টায় ২৭ টাকা। আমাদের ২১ জন এখানে কাজ করছে। এটাকে শোষন বলবেন না?

আমি বল্লাম নিশ্চয় এটা শোষন। কিন্ত তাহলে পশ্চিম বঙ্গে শোষন হীন সাম্যাবস্থা আনার চেষ্টা ছাড়লে কেন?

এবার ছেলেটা ছল ছল করে উঠল। বললো-স্যার ঠাট্টা করছেন? বাড়িতে দুই বোন। বিয়ে দেওয়া হয় নি। স্কুল সার্ভিস কমিশনে বসা ছাড়াত কোন চাকরি নেই রাজ্যে। গ্রামে মাত্র দুবিঘা জমি। এবার আপনিই বলুন আমার কি করা উচিত ছিল? নেতাদের পেছনে ঘুরে ত আর পেট ভরে না।

আমি বল্লাম, তুমি কি একবার ও নিজেকে প্রশ্ন করেছ-কেন দিল্লীতে তোমার মতন উচ্চ শিক্ষিতরা নানান ভাবে করে খাচ্ছে-আর রাজ্যে তোমার বেকার থাকা ছাড়া উপায় নেই? এর পেছনে তোমার পার্টির কোন ভূমিকা নেই? একটা জিনিস ভেবে দেখলেও পার-শোষনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার পরেও, শুধু বেঁচে থাকার জন্যে তোমাকে শোষনক্লিষ্টতাকে ভীষন ভাবে মেনে নিয়ে দিল্লীতে আসতে হচ্ছে। তাহলে এটা বুঝছ-বেঁচে থাকার বাস্তবতা সমাজে সাম্য বা শোষনহীনতার চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ?

শেষের গল্পটা বলার একটা বিশেষ কারন আছে। পৃথিবীর প্রতিটা দেশেই কমিনিউজমের যাবতীয় পরীক্ষা ব্যার্থ হয়েছে-কারন উৎপাদন ব্যাবস্থার ওপর জোর দেওয়া হয় নি। ক্ষমতাই আসার পর বামফ্রন্ট সরকার একগাদা সরকারী ব্যাবসা খুলেছিল-তার একটিও চলে নি। ভূমি সংস্কারে ফলে গ্রামের কারুর হাতে পুঁজি ছিল না, গ্রামীন শিল্পের বিকাশের জন্যে। মুখে বড় বড় কথা বলেছে-কিন্ত এদিকে কোন গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। ফলে গ্রামে জীবিকার সুযোগ বাড়ে নি-বরং আরো অনেক কমে গেছে। ফলে গোটা রাজ্যটাই একটি অচলায়াতনে পরিণত হয়েছে। আর কমিনিউস্ট পার্টির অর্ধশিক্ষিত নেতারা তত্ত্ব আউড়ে গেছেন। যা ছিল সম্পূর্ণ বাস্তব বর্জিত স্বমৈথুন।

তাহলে কমিনিউস্টদের সারাটা জীবন কি ব্যার্থ? তা আমি বলবো না। যারা মানুষকে প্রকৃত ভালোবেসেছেন, তিনি, হিন্দুত্ববাদি বা ইসলামিস্ট বা কমিনিউস্ট যাই হোন না কেন-তার জীবন সার্থক। কারন মানুষকে ভালবাসার ওপরে কোন তত্ত্ব হতে পারে না। সমস্যা হচ্ছে বাঙালী কমিনিউস্টরা আসলে সেই প্রকৃতির ও নন-এদের অধিকাংশই অজ্ঞতা, অহংকার, অভদ্রততা, দ্বিচারিতা, সুবিধাবাদি এবং মূর্খতার পাঁচ মেশালি চচ্চড়ি।

ফলে কেও ই নতুন সমাজতান্ত্রিক পথের সন্ধান দিতে পারছে না। ধনতান্ত্রিক সমাজের সমস্যাগুলি চলে যায় নি-শোষন ক্রমবর্ধমান-আর মুক্তবাজারের নামে চুরি-ডাকাতিও আমরা দেখছি। গণতন্ত্রে সাধারন মানুষকে নিয়ে আসা যাচ্ছে না। সেই ঠিকাদারতন্ত্র রয়েছে। কিন্ত তাই বলে ত মানুষ স্ট্যালিনিজমের মতন খুনী স্বৈরাচারী শাসন চাইবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব উৎপাদনও চাইবে না-কারন সেসব কিছুই প্রমানিত ভাবে ব্যার্থ। ফলত, ভারতীয় অর্থনীতিতে দক্ষিন পন্থী প্রভাব ক্রম বর্ধমান-কারন বামপন্থীদের দেওয়া অর্থনীতিতে পশ্চিম বঙ্গের হাল হবে। লোকজন গরীব থেকে ভিখিরী হবে।
ফলে যে বিকল্প অর্থনীতি বা রাজনীতির সন্ধান করা উচিত ছিল-তা বাঙালী বামপন্থীরা করে নি। এম্পিরিসিজমের মূল মন্ত্রই হচ্ছে, যা কাজ করছে না, তা ফেলে দিয়ে উন্নততর মডেল আনতে হয়। মার্ক্সিজমের সূত্রগুলি অর্ধ সত্য এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যার্থ-এটাকে মেনেই বিজ্ঞানের দিকে চোখ রেখে নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। মার্ক্সিজমের ব্যার্থতাগুলি না মানলে, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন আরো ডুবে যাবে। ব্যার্থতাই নতুন সত্যের জন্ম দেয়। নতুন তত্ত্বের জন্ম দিয়ে থাকে। কিন্ত মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক ব্যার্থতাকে অপবিজ্ঞান বা অর্ধবিজ্ঞান বলে না মানলে বাঙালীর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন চোরাবালিতে আরো ডুবতেই থাকবে। জনগন আমাদের বুঝতে ভুল করছে বা টাইম নিচ্ছে বা একদিন ঠিকই চিনবে-এই টাইপের আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া এদের ভাগ্যে আর কিছুই জুটবে না।