রেসিজম, মানবতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে আদি শত্রু এবং মানুষের সবচেয়ে পুরোন সাথী। মানুষ যেদিন হতে ঈশ্বর আর শয়তান নামের দু’জনকে চিন্তা করতে শুরু করলো এবং ভাল ও খারাপ কাজের জন্য যথাক্রমে দু’জনকে দায়ী করতে থাকলো, সেদিন হতে রেসিজম মানুষের চিন্তার সঙ্গী। ছোটবেলায় পড়েছি, “পাপকে ঘৃনা কর, পাপীকে নয়’- এই কথাটি আজো অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়ে রয়ে আছে। যেদিন হতে আমরা ভেবেছি ভাল কাজ হচ্ছে ঈশ্বরের আর খারাপ কাজ হচ্ছে শয়তানের, তখনই আমরা খারাপ কাজের মানুষগুলোকে আলাদা করে ফেলেছি – কারণ তারা শয়তানের উপাসনা করে, ভালোর নয়।

যুগে যুগে রেসিজমের চিন্তা ধারণা নানান ভাবে আমাদের মধ্য দিয়ে বংশ পরম্পরায় বয়ে চলেছে। একদম আদিম সমাজের মানুষ শুধু মাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে প্রকৃতির সাথে বা প্রকৃতির অন্য জীবের সাথে বা এক অন্যের সাথে লড়াই করতো। সেখানে গোত্রবিশেষের বা মানুষের নিজেদের মাঝে বিদ্ধেষের বিশেষ সুযোগ ছিল না। কিন্তু যখন গোত্র গোত্র বিশেষ মিলে সমাজ হল, সমাজ হতে রাষ্ট্র হল, সমাজে আচরণ বিধি হল, সমাজ ও রাষ্ট্রে শাসক এবং শাসিত গোষ্ঠি হল, এরই কোন পর্যায়ে মানুষে মানুষে বিভেদের সৃষ্টি হল।

ধর্মগুলো মানবতার কথা বললেও রেসিজম থেকে সম্পুর্ণ মুক্ত হতে পারলো না। ইহুদী ধর্মগ্রন্থে বলা হয় ইহুদীরা ঈশ্বরের পছন্দের জাতি। গ্রীক পূরাণেও গ্রীক জাতি নিজেদের ঈশ্বরের সন্তান মনে করে। এভাবে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে যে ধরণের হিংসার বীজ রয়েছে, তাতে মনে হয়েছে যে ধর্মগ্রন্থগুলো ঈশ্বরের বাণী হতে পারে না। একজন ঈশ্বরের কাছে তার সৃষ্টির মাঝে কোন পার্থক্য থাকতে পারে না। শুধু ধর্মগ্রন্থই নয়, দর্শনগুলোও নিজেদের সম্পুর্ণ মুক্ত করতে পারেনি রেসিজম হতে। একারণেই আমরা দেখি এরিষ্টটল, কান্ট, হেগেলের মত বিখ্যাত দার্শনিকদেরকেও রেসিজমের বীজ অন্তরে ধারণ করতে। এরিষ্টটল মনে করতেন যে গ্রীক জাতি প্রকৃতগত ভাবে মুক্ত এবং বর্বর (প্যাগান বা নন-গ্রীক) জাতি প্রকৃতগত ভাবেই দাস। কান্ট এবং হেগেল উভয়েই মনে করতেন যে, কালো মানুষদের বুদ্ধি কম এবং তারা সাদা মানুষের তুলনায় নীচু জাতের।

আমার মতে, রেসিজমের মূলে রয়েছে অন্ধ-বিশ্বাস এবং অহংকার। আমার বিশ্বাস, বা ধর্ম, বা জাত অন্যদের তুলনায় ভিন্ন এবং উৎকৃষ্ট – এই ধরণের চিন্তার প্রতফলনই হল রেসিজম। তাই আমরা দেখি ধর্মযুদ্ধগুলো থেকে শুরু করে বিশ্বযুদ্ধ এবং আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে বা হচ্ছে তার সবকয়টির সাথেই এই রেসিজম ওতপ্রেতভাবে জড়িত। মানবতা হয়েছে লুন্ঠিত। অন্ধ-বিশ্বাসের প্রকৃতিটি বুঝা খুব জরুরী যদি আমরা রেসিজমকে চিহ্নিত করতে চাই। নিজের বিশ্বাসকে অন্ধ ভাবে পালন করে যদি মানবতাকে উপেক্ষা করি এবং মানুষের মাঝে বিভেদের দেয়াল তুলে দেই তবে, নিজের অজান্তেই রেসিজমের বীজ বপণ করে চলবো। এক জন ধর্মপ্রাণ মানুষ, যিনি কোনদিন হয়তো মিথ্য বলেননি বা অন্যায় করেননি, তিনিও হয়তো একজন নাস্তিককে ঘৃনা করতে পারেন, কিংবা একজন নাস্তিক, নিজেকে মুক্তচিন্তার অধিকারী দাবী করেও, যদি এই ধারণা পোষন করেন যে ধর্মপ্রাণ মানুষই সমাজকে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে, তাহলে তিনিও রেসিজম অন্তরে ধারণ করছেন। ধর্ম নয়, ধর্মের মাঝে বিদ্যমান রেসিজমই দায়ি সভ্যতাকে পেছনে নেওয়ার জন্য।

অন্ধ-বিশ্বাস শুধু মাত্র ধর্ম বা বর্ণেই বিদ্যমান তা নয়। যদি নিজের মতবাদকেই সেরা হিসেবে গন্য করি, , বা সিনিয়র কলিগ হয়ে জুনিয়র কলিগদের তাচ্ছিল্য করি, বা একজন ব্লগার হয়ে সহব্লগারের মতামতকে হেয় প্রতিপন্য করি, বা দেশের সমস্ত রাজনীতিবিদদের চোর মনে করি, বা প্রবাসী সব ভাইয়দের স্বার্থপর মনে করি, বা গরীবলোক মানেই চুরি করে মনে করি, বা কাজের লোকদের যথাযথ সম্মান না দিই, বা বুয়েটের ছাত্র বা ইডেনের ছাত্রী বলে নিজেকে একটু ভিন্ন মনে করি, বা আমার ছেলে কোন অপরাধ করতে পারে না এমন ধারণা মা হিসেবে পোষন করি, বা সকল তরুণদের উচ্ছৃঙ্ঘল মনে করি, বা সকল বুইড়াদের ফালতু মনে করি – এই সবই অন্ধ-বিশ্বাসের প্রতিফলন। আর যখন এই অন্ধ-বিশ্বাষটুকু প্রকট হয়, তখন ভিন্ন মতালম্বী মানুষটিকে আর মানুষ হিসেবে দেখা হয় না – যাহাই রেসিজমের সৃষ্টি করে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নিজেকে মুক্তচিন্তার মানুষ বলে দাবী করলেও, প্রকৃত রেসিজম থেকে মুক্ত থাকা কতটা কষ্টকর। নিজেও যে এর উর্ধ্বে ছিলাম দাবী করি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় কালে অমনোযোগী ছাত্রদের হেয় করেছি, দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেছি সেটা তাদের ভালোর জন্যই করেছি, কিন্তু আজ উক্ত কাজ ভুল ছিল স্বীকার করি। মানবতা এবং অহিংসাকে জীবনের পাথেয় করেছি। সকল মানুষ সমান এবং সকলের সমান ভাবে বাঁচার অধিকার রয়েছে এই পৃথিবীতে, এটা বিশ্বাস করি। শুধু সকল মানুষ নয়, সকল জীবেরই বাঁচার সমান অধিকার রয়েছে বলেই মনে করি। একে অন্যের বিশ্বাস এবং মতামতের উপর সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাশীলতার মাধ্যমেই আমরা পারি রেসিজমকে পেছনে ফেলে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।