নীল নির্জনে

ফরিদ আহমেদ

 

নীল জলের টানে দিগন্তের দিকে ঝুঁকে পড়েছে সূর্য। একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে কবিতা। সাগরের লোনাজল ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ বাতাসে উড়ছে চুল। পায়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছে রূপোলী বালু। অপূর্ব সুন্দর একটা দৃশ্য। অনন্ত  সৌন্দর্যময় এই বেলাভূমি। এই সৌন্দর্যের সামনে এসে দাঁড়ালে যে কারোরই মন ভাল হয়ে যাবার কথা। কিন্তু, কবিতার বিষাদবোধ কিছুতেই কমছে না। বরং আরো বেড়েই যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছে না যে, মাত্র তিন বছর আগেই এইখানে সে কাটিয়ে গেছে তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম কটা দিন।

 

নীলিম আর সে বিয়ের পরে এইখানে এই কক্সবাজারেই মধুচন্দ্রিমায় এসেছিল। কাটিয়ে গিয়েছিল গভীর আনন্দঘন বুনো সাতটি দিন। কী পাগলামিটাই না করতো নীলিম তাকে নিয়ে তখন। গলা জড়িয়ে ধরে নাকে নাক ঘষে নাকি সুরে এক ডজন ছেলেমেয়ে দিতে হবে বলে আব্দার জানাতো ছেলেমানুষের মতো । মাঝে মাঝে গলা মোটা করে হুমকিও দিতো দস্যু সাজার ভান করে। অদ্ভুত ছিল নীলিমের আদরের ধরন। একটু সুযোগ পেলেই কবিতার দীঘল চুলের মধ্যে নাক গলিয়ে দিত সে।  ঘ্রান নিতো সারা মাথা জুড়ে। কখনো বা কানের লতি কামড়াতো কুটুস কুটুস করে। কখনো চোখের উপর চুমু খেয়ে চলতো ক্রমাগত। কখনো বা নাক টিপে দিত একগাল হাসি দিয়ে। কখনো বা গলা চেপে ধরে মেরে ফেলার মিথ্যা ভয় দেখাতো। আর ঠোট দুটো নিয়ে যা করতো না, সেটা ভাবতেই গাল লাল হয়ে যেতো কবিতার। তার ঠোটে যে কি মধু পেতো নীলিম কে জানে। কবিতা মাঝে মাঝে ভাবতো, তার বিবাহিত বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করে দেখবে। তাদের স্বামীরাও কি তাদেরকে নিয়ে এরকম ছেলেমানুষি আদর আদর খেলা খেলে কিনা। লজ্জায় অবশ্য কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি কখনো। ভয়ও ছিল মনে কিছুটা। অন্যদের স্বামীরাও যদি একই কাণ্ড কারখানা করে তাহলে যে নীলিমের বিশেষত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। থাক না নীলিম তার কাছে বিশেষ একজন হয়ে। কারই বা ক্ষতি তাতে?

 

তিন বছর আগের সময়টাকে এখন অনেক যুগ আগের বলে মনে হচ্ছে কবিতার কাছে। মাত্র কয়েক বছরে কত কিছুই না বদলে যেতে পারে। তিন বছর পর আবার একই জায়গায় ফিরে এসেছে তারা দুজন। কালের চক্রে হয়তো। নাহ, দ্বিতীয়বার মধুচন্দ্রিমার জন্য নয়। বরং শোভনভাবে আলাদা হয়ে যাবার জন্য। ঢাকার ভয়াবহ ভীড়ভাট্টার মধ্যে তার এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নীলিমকে জানাতে ইচ্ছা হয়নি কবিতার। তাই অনুরোধ করেছিল দুটো দিনের জন্য কক্সবাজারে যাবার জন্য। কি বুঝেছিল নীলিম কে জানে। কোন উচ্চবাচ্য করেনি সে। ছুটি নিয়ে নিয়েছিল অফিস থেকে।

 

বড় করে শ্বাস ফেললো কবিতা। কীইবা করার ছিল এছাড়া তার। নতুন জীবন এবং নতুন স্বপ্ন তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া। পুরনো জীবনটা যে বড্ড বেশি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য। কোনভাবেই আর জোড়াতালি দেবার কোন সুযোগ নেই। সে যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে তাকে অনুভব করার কোন শক্তিতো কারো নাই। নেই এই অতলান্ত সাগরের, নেই এই দিগন্ত ছোঁয়া আকাশের, নেই এই চিক চিক করা বালুকাবেলার, কিংবা ওই অবারিত ঘন সবুজ বনানীর।

 

***************************

 

ঝাউ গাছের পাশে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে কবিতাকে দেখছে ছেলেটা। প্রায় ছয়ফুট লম্বা, একহারা গড়ন। নীল জিন্সের সাথে সাদা রঙ এর একটা টি-শার্ট পড়ে আছে। চোখে রিমলেস চশমা। কবিতার দিক থেকে কিছুতেই চোখ সরাতেই পারছে না সে। জলের দিকে কী অদ্ভুতভাবেই না তাকিয়ে আছে মেয়েটা। যেন প্রতীক্ষা করছে গভীর একাগ্রতা নিয়ে কারো বা কোন কিছুর জন্য। দৃষ্টি নিমগ্ন হয়ে আছে সুদূরের দিকে। নীল জল আর নীল আকাশের পটভূমিকায় শ্যামলা মেয়েটাকে কী অদ্ভুত সুন্দরই না লাগছে। নীল রঙ এর শাড়ী মিশে গেছে যেন সাগরের নীলের সাথে। অবাধ্য বাতাসের সাথে লড়াইয়ে হেরে গিয়ে রেশমি চুলগুলো উড়ে এসে ঢেকে দিচ্ছে মুখের উপরটা। কী আশ্চর্য সৌন্দর্য্য! কী অপূর্ব বিষাদ চিত্র! তবে সৌন্দর্য্য নয়, কবিতার একাকিত্ব এবং একাগ্রতাই তাকে আকৃষ্ট করলো বেশি। এর থেকেও অনেক সুন্দরী মেয়ে তার অফিসে গণ্ডা গণ্ডা আছে। তারপরও দূর থেকে অনুভব করতে পারছে আর দশটা মেয়ের চেয়ে এই মেয়েটা আলাদা কিছু।

 

না তাকিয়েও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে কবিতা টের পেলো কেউ একজন তাকে দেখছে। কোন ধরনের অস্থিরতা অবশ্য অনুভব করলো না সে। ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো কবিতা। অনেক দিন আগে যে রকম হয়েছিল হঠা করেই সেই রকম ঝলা করে উঠলো বুকের ভিতরটা। কবিতাকে তার দিকে তাকাতে দেখেই ধীরে ধীরে ছেলেটা এগিয়ে এলো তার দিকে।  কাছে এসে চোখে চোখ রেখে তাকালো। গভীর মায়াময় শান্ত স্থির দুটো চোখ। কবিতার মনে হলো অচেনা কোন জায়গায় অচেনা কোন আগন্তুক নয়, অনেকদিন পর সে যেন তার হারানো কোন বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছে।

 

কোন কথা না বলে তার সাথে যাবার জন্য হালকা করে ইশারা করে ছেলেটা কবিতাকে। কয়েক মুহুর্তের দ্বিধা ঝেড়ে কবিতাও উঠে পড়ে কোন কথা না বলে। পাশেই একটা রেষ্টুরেন্ট গিয়ে বসে তারা। শুরুটা হয় টুক টাক দ্বিধাগ্রস্থ কথাবার্তা দিয়ে। তারপর আস্তে আস্তে ভেঙ্গে যেতে থাকে সমস্ত অর্গল। গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে কথাবার্তা। দুজনেই ব্যাখ্যা করে কেন তারা এসেছে কক্সবাজারে। ছেলেটার চোখের আশ্বস্ততায় নিজের অজান্তেই কবিতা মুক্ত করে তার দুঃসহ যন্ত্রণার কথা, তার সুতীব্র বেদনার কথা। গত কবছরের সুগভীর দীর্ঘশ্বাসের কথা। কীভাবে তার স্বপ্নের শুরু এখানে আর কীভাবে তা শেষ হতে চলেছে এইখানেই। এই পৃথিবীতে যাকে সবচেয়ে বিশ্বাস করতো, সবচেয়ে বেশি ভালবাসতো, তাকেই স্বামী হিসাবে বেছে নিয়েছিল সে। আর আজ তাকেই ছেড়ে দেবার জন্য এত আয়োজন তার। মনের গভীরে লুকিয়ে রাখা অব্যক্ত কষ্টের কথাও বলতে থাকে কবিতা। এ কষ্টের কথা অন্য কাউকে বলেনি সে কখনো। গর্ভপাত হওয়ার পরের দুঃসহ সময়গুলোর কথা হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসতে থাকে।

 

বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে তার যখন গর্ভপাত হয় নীলিম তখন দুই মাসের জন্য বিদেশে। গর্ভপাতের জন্য শ্বাশুড়ী এবং ননদরা সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেছিল তাকে। তার অসতর্কতাকে, তার অবহেলাকে। শ্বাশুড়ী নাতির মুখ দেখার জন্য অধীর হয়ে ছিল। সেই সাধ পূর্ণ না হওয়ায় তার জীবনটাকে দূর্বিসহ করে দিয়েছিল তারা তখন। নীলিম বিদেশ থেকে এসে কোন প্রতিকারই করেনি। বরং নিজেও ঘাড় গুজে গম্ভীর হয়ে ছিল বেশ কিছুদিন। যেন সেও বিশ্বাস করে ওই দূর্ঘটনার জন্য কবিতাই দায়ী। ডাক্তার যদিও বলেছিল যে কবিতার সন্তান ধারণের কোন সমস্যা নেই। তারা ইচ্ছা করলেই আবার সন্তানের জন্য চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু, কবিতা আর রাজী হয়নি। আসলে নীলিমকে আর সহ্যই করতে পারছিলো না সে। কিছুদিনের মধ্যেই এক বস্ত্রে মায়ের বাড়ীতে এসে উঠেছিল কবিতা। অসংখ্যবার নীলিম তাকে নিয়ে যেতে এলেও আর ফিরে যায়নি সে। ততদিনে তীব্র ঘৃণা জন্মে গেছে তার নীলিমের জন্য।

 

গভীর মনযোগ দিয়ে কবিতার গল্প শুনছে ছেলেটা। ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে  গেল কবিতা। তার নিজের যন্ত্রণার ছায়া পরিষ্কারভাবে পড়েছে ছেলেটার খয়েরি চোখে। দীর্ঘ কয়েকটা বছর পর এই প্রথম সে অনুভব করলো নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে সে একা নয়।  চেপে বসা অনড় বোঝাটা সরে যেতে থাকলো কবিতার ঘাড় থেকে। মাত্র শুরু, কিন্তু শুরুতো। এই প্রথম তার বিশ্বাস হচ্ছে যে হয়তো তার জন্য সত্যিই কোন আনন্দময় ভবিষ্যত অপেক্ষা করে আছে কোথাও। আর সেই ভবিষ্যত হয়তো এই গভীর মমতামাখানো কোমল চোখের ছেলেটার সাথেই।  

 

এখানে তারা এসেছিল চিরদিনের জন্য আলাদা হতে। তার হয়তো আর প্রয়োজন হবে না। হয়তো এখনো আশা আছে। কবিতা উঠে দাঁড়িয়ে নীলিমের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। হাত ধরাধরি করে পুরনো দিনের মত তারা দুজনে হেটে যায় নীল সমুদ্রের কাছে। এক বুক ভালবাসা নিয়ে সূর্য ডুব দিচ্ছে সাগরের নরম বুকে। একই রকম ভালবাসা নিয়ে নীলিম বুকে টেনে নেয় কবিতাকে। আগের মত দুহাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে কবিতার। নাক ডুবিয়ে দেয় কবিতার রেশম কোমল ঝরঝরে চুলের মধ্যে। ঘ্রান নেয় দীর্ঘ করে। চুল থেকে নাক উঠিয়ে নাকে নাক ঘষে কিছুক্ষণ। তারপর কবিতার চোখে চোখ রেখে গাঢ় স্বরে জিজ্ঞেস করে, আমাকে ফেলে সত্যি সত্যি চলে যাবার কথা তুমি ভাবতে পারলে পঁচুমনি?

 

অতি পরিচিত সেই আদর আর গভীর ভালবাসাময় ডাক শুনে সারা শরীরে অদম্য কাঁপন জাগে কবিতার। দুহাতে সজোরে আঁকড়ে ধরে নীলিমকে সে। মুখ গুঁজে দেয় নীলিমের বুকে। কবিতার চুলের মধ্যে আদরের হাত বুলোতে বুলোতে গভীর ভালবাসায় কানের কাছে ফিসফিস করে নীলিম বলে পাগলী আমার

 

কবিতার চোখের শ্রাবণ ধারায় ভিজে যেতে থাকে নীলিমের বুক।