পূর্ব থেকে পশ্চিম

পরশপাথর

                               পর্বঃ

পর্ব – ১

ইমিগ্রেশান অফিসার কোনক্রমেই আমাকে ক্লিয়ারেন্স দেবেন না আমি বুঝতে পারলাম না, খুব সহজেই আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পরিচয় গোপন করতে পারতাম, এমনকি পাসপোর্টেও সেটা না রাখতে পারতাম, সেক্ষেত্রে তারা কি করে আমাকে আটকাতেন? বাংলাদেশ সরকারেরতো এমন কোন কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা নেই যেখান থেকে তারা আমার সব তথ্য পেয়ে যেতে পারে কিন্তু মুহূর্তে কিহলে কিহতে পারত, সেসব ভাববার অবকাশ নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত ক্ষমতাধারীদের ফোন করতে পারি, তাদের কাছে এর সমাধান দুধভাত; এমন কাউকে দিয়ে ফোন করাবে, হয়তো তখন ইমিগ্রেশান অফিসার নিজেই প্লেন তুলে দিয়ে আসবে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যেসময় হাতে আছে, তাতে, তুলে দেবার অনেক আগেই প্লেন আসমানে লুকোবে

ছোটবেলায় আমার পাশের বাড়ির কাকাদের দেখতাম বিদেশ যাচ্ছে সবাই চোখের জলে, মুখের জলে চারপাশ ভিজিয়ে, আকাশেবাতাসে মাতম তুলে, আশপাশের পাড়া প্রতিবেশীদের জানান দিয়ে তাদের বিদায় দিত যাবার আগে তারাও তাদের নানা ইচ্ছার কথা, অনিচ্ছার  কথা, শুরুর কথা, শেষের কথা, বলা নাবলা কথা,সবকিছু নিঃশেষে উজাড় করে দিয়ে যেত বিশেষ করে বাড়ীর বউদের বারবার করে সাবধান করে দিত, তাদের অবর্তমানে তাদেরর মাবাবার যেন বিন্দুমাত্র অযত্ন,অবহেলাও না হয় যদিও বাড়ীতে থাকা অবস্থায় নানাবিধ কারণেঅকারণে তারা নিজেরাই মাবাবার যত্ন করবার দিকে খুব একটা নজর দিতে পারেনি অন্যদিকে তাদের যাওয়া উপলক্ষ্যে বাড়ির উঠোনের লাল মুরগীটা কিংবা পুকুর থেকে তোলা বড় রুই মাছটাও নির্বিচারে প্রাণ বিসর্জন দিত যাওয়ার পর, সারাদিন বাড়ীর সবাই মন খারাপ করে রাখতো,কেউ ইচ্ছায়, কেউ অনিচ্ছায় সবার দেখাদেখি আমিও একটু মন খারাপ করে থাকতাম, মনখারাপ নিয়ে রাতে ঘুমোতে যেতাম সকাল বেলা হয়তো ঘুম থেকে উঠে দেখতাম, আমার সেই কাকা রীতিমতো লুঙ্গি পরে, আয়েশী ভঙ্গিমায় সময় নিয়ে, পুকুর ধারে দাঁত ব্রাশ করে চলছে ঘটনা হচ্ছে, বিদেশ যাবার পথে কোনো এক এয়ারপোর্ট থেকে তাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে, কাগজপত্র ঠিক নেই লে কাকা আমার ব্রাশ করতে করতে সবাইকে বুঝাতে চেষ্টা করত, কেমন করে নিজের মাথার বুদ্ধি খাটিয়ে, ইমিগ্রেশান অফিসারদের নাস্তানাবুদ করে, একদিনও জেল না খেটে সে বাড়ি ফিরে এসেছেতার জায়গায় অন্য কেউ লে, একেবারে কম হলেও দশ বছরের জেল হয়ে যেত আমি আমার সেই কাকার কথা ভাবছিলাম, আর ভাবছিলাম, আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে ঠিক কয় বছরের জেল বলে গল্পটা বানাবো

কোন এক ব্লগে পড়েছিলাম, দেশের বাইরে যাওয়ার সময় সব ধরণের ডকুমেন্টসএর ফটোকপি সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া ভালো হঠা মনে হলে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়ারিলিজ লেটারএর কপি আমার কাছে আছে এটা আমি ইমিগ্রেশান বা কোথাও দরকার হতে পারে লে রাখিনি, অন্যসব কাগজপত্রের সাথে এমনিতেই রেখে দিয়েছিলাম আর পায় কে? বিতর্কের মাঠে এবার আমি ম্যারাডোনা ইমিগ্রেশান অফিসারকে বললাম, ‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়ারিলিজ লেটারআমার কাছে আছেউত্তর এলো, ‘সেটাতে কাজ হবে নাআমি বললাম, ‘কেন হবে না?’ তিনি বললেন, ‘আপনার জিও লাগবেভাবখানা এমন যে, ‘একবার বলেছি জিও লাগবে, তো ওটাই লাগবে সেটা না লে প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারেও কাজ হবে নাআমার মনে হচ্ছে একটু পরে হয়ত বলবে, ‘এখন আর জিও দিলেও হবে না, যান, আপনি বাসায় গিয়ে ঘুমানআমি বললাম, ‘সরকার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে পারমিশান দেয়া আছে, রিলিজ লেটার দেবার জন্যবস্তুত,আমার রিলিজ লেটারে সরকারের একটা অধ্যাদেশের রেফারেন্সও দেয়া আছে তারপর তিনি সেটা দেখতে দেখতে বললেন, ‘এটাতেতো হবেইনা, তাও আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করে দেখি

যথারীতি স্যারকে ডাকা হল ভাবলাম, দিনের পর দিনস্যারডাক শুনতে শুনতে সকাল গেল, বিকাল গেল; আজকে না জানি কোন মহাস্যারের পাল্লায় পড়তে যাচ্ছি অফিসার বলেন, ‘স্যার উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কিন্তু উনারজিওনেইস্যার বলেন,‘কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক?’ অফিসার বলেন,‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্যার রাগত স্বরে বলেন, ‘আরে সেটাতো বুঝলাম, ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু ঢাকার কোন বিশ্ববিদ্যালয়?’ হায় কপাল! আমি কোথায় আছি? রঙ্গ ভরা এই বঙ্গদেশে কেযে অফিসার, কেযে তার স্যার, কি তার আচার, কিইবা ন্যাচারতা একমাত্র ওপরওয়ালাই জানেন আমার সেই কিংবদন্তির রিক্সাওয়ালার গল্পটা মনে ড়ে গেল যাত্রি রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাবে নাকি?’ রিক্সাওয়ালা বলে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? এটা আবার কোন জায়গায়? ঢাকা ইনভার্সিটির কোন পাশে?’ আমি এয়ারপোর্টের মহান স্যারকে বললাম, ‘আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটি টিচারকিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর তার অফিসারকে বললেন, ‘উনার কি অন্য যেকোন ডকুমেন্ট আছে?’ অফিসার বলেন,‘রিলিজ লেটার আছেস্যার বলেন, ‘তাড়াতাড়ি যেতে দাওসব ঝামেলা এখানেই শেষ মহামান্য অফিসার এবার আমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার বাড়ী কোথায়?’ এবার আর যায় কোথায়? কয়েকশো মণ ওজনের ভাব নিয়ে, রাশভারী কণ্ঠে আমি বললাম,‘পাসপোর্টে দেখেন

ভিতরে ঢুকতে না ঢুকতেই মনটা ভালো হয়ে গেলবিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমার দেশও এগিয়ে যাচ্ছেতিনতিনটা কম্পিউটার এক লাইনে, ইন্টারনেট ব্যবহার করবার জন্য যাক কিছুটা হলেও এয়ারপোর্টটা সার্ভিস দিতে শিখছে আধুনিক বিশ্বের যেকোন এয়ারপোর্টেই ইন্টারনেট ব্রাউজ করার সুযোগ থাকা উচি, এখানেও আছে খুশি মনে এগিয়ে গেলাম প্রথমেই দিলাম, ‘গুগল ডট কম  অবিশ্বাস্য স্পীড রেসপন্স আসলো, ‘সার্ভার নট ফাউন্ডনিজের মনে নিজেই হেসে ফেললাম আগের বাক্যটি খানিকটা পরিবর্তন করে নিয়ে বললাম, ‘বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশ এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সেটাই বা কম কি?’ তবে কেমন জানি আঙ্গুর ফল টক টাইপ ব্যাপার হয়ে গেলোআবার মনে হলো, আরে আঙ্গুর ফলতো টক

বোর্ডিংয়ের সময় হয়ে এলো এয়ারপোর্টএর অন্য আর চারপাঁচটা বিমানের থেকে কাতার এয়ারওয়েজের বিমানটাকে বেশ রূপসী আর হৃষ্টপুষ্টই মনে হলো ছোটবেলায় এক হুজুরের ওয়াজ শুনতে গিয়েছিলাম; বেহেস্তের হুরীরা কেমন সেটা বুঝাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, বেহেস্তের হুরীরা বিমানবালাদের থেকেও সুন্দরী এইতো আর মাত্র কয়টা মিনিট! তারপর বেহেস্তের কাছাকাছি পৌঁছে যাবো বিপুল সাহ,উদ্দীপনা ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে বিমানে প্রবেশ করলাম হায় খোদা! কি? এর তুলনায় ঢাকাচট্টগ্রাম রুটেরসোহাগ পরিবহণকিংবাগ্রীনলাইনতো ময়ূরপঙ্খীজানালার সাইডে কোন রকমে দুজনের বসার ব্যবস্থা; মাঝখানেতো তিনজন করে তবে বলে রাখা ভালো, আমি ইকনোমী ক্লাসের যাত্রী, আমারো মনে রাখা উচি ছিলো যে, বিমানের মধ্যেতো আর ফুটবল খেলার ব্যবস্থা থাকবে না অন্যদিকে হুরীদের দেখতে গিয়ে, সত্যি কথা বলতে কিনিজের উপর রাগ হলোকোনভাবেইকতটুকু সুন্দরীএই মানদণ্ডে কাউকে বিচার করা যায় না এখানে কেউ সুন্দরী প্রতিযোগিতায় আসেনি, এসেছে যার যার কর্মক্ষেত্রেসত্যি কথা বলতে গিয়ে একটু মনে হয় মিথ্যাই বলে ফেললাম,নিজের উপর রাগ আসলে হয়নি, সব রাগ গিয়ে পড়েছে ওই হুজুরের উপর    

যথাসময়ে বিমান চলতে শুরু করলো তার আগে জরুরী নির্দেশনা দেয়া হল এবার আমাদের পাইলট নিজের পরিচয় এবং যাত্রার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন তার বলা ইংলিশের মাঝ থেকে শুধু কি একটা যেন নাম্বার আর টাইমটা উদ্ধার করতে পারলাম আর কিছুই বুঝলাম না আমি নিজে যে বুঝতে পারলাম না, আমার নিজের ব্যর্থতা, সেদিকে আমার খেয়াল নেই; অথচ আমার ধারণা হয়েছে, এই পাইলট ব্যাটা শুদ্ধ করে ইংলিশটাও বলতে পারে না, আঞ্চলিক কোন এক ইংলিশ বলে সে আছে নিজেকে সাপোর্ট দিতে গিয়ে আবার নিজেই যুক্তি দেখালাম, ‘বারাক ওবামা ইংলিশতো আমি ঠিকই বুঝতে পারি অতএব, আমার না, নিশ্চিত করে পাইলটের ব্যর্থতা তবে ইংলিশ শুদ্ধ বলুক আর অশুদ্ধ বলুক, নিপুণ দক্ষতায়, ক্ষণিকের মাঝে  আমাদের নিয়ে সে উঠে গেল আকাশের রাজ্যে

এবার শুধু ছেড়ে যাবার পালা, দূরে যাবার পালা উপর থেকে উপরে যাচ্ছে বিমান, যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে সব সব, সব, সব কিছু আমার অস্তিত্ব, আমার শৈশব, আমার কৈশোর, আমার শিকড় তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশ, গরীব একটা দেশে জন্মগ্রহণযে পাপ; মস্ত বড় পাপ সেপাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আমরা চলে যাই, দূরে চলে যাই, সবকিছু ছেড়ে যাই, সবকিছু ছিঁড়ে যাই দূরত্বের নীতি মেনে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে নীচের সব সামনে শুধু আকাশ, আকাশের ওপর আকাশ, অনন্ত অশেষ; পিছনে আমার, ভালোবাসার, অনেক আদরের বাংলাদেশ

আমি জানি, নীচ থেকে উড়ে যাওয়া সবগুলো বিমানের দিকে তাকিয়ে আছে আমারমা কাঁদছে আমি জানালা দিয়ে দেখতে চেষ্টা করি, খুঁজতে চেষ্টা করি খুঁজে পাই না(চলবে)

 

পরশপাথর

সেপ্টেম্বার ১৩,২০০৯

[email protected]