(১)
খ্যাপা রামকৃষ্ণ বলতেন যত মত তত পথ। আজকের দুনিয়াই টিভি, ইউটিউব এবং ইন্টারনেটের নানান ধর্মীয় বিতর্কে যোগ দিলে বিলক্ষন মনে হতে পারে সফটওয়ার প্রোডাক্ট ভার্সনের ন্যায় কোরান-গীতা-বাইবেল ইত্যাদি গ্রন্থ সমূহের 700.0, 800.0….1900.0., 2000.0 ইতাদি ভার্সন সহজলভ্য। যেমন যুগ, যেমন জ্ঞান, তেমন ভার্সান! আবার একই যুগে নানান প্রকৃতি এবং দেশের ওপর নির্ভর করে কোরানের কোন ভার্সন চলবে! হিন্দু ধর্মগ্রন্থ এবং বাইবেলের ক্ষেত্রে এই ট্রেন্ড আবার অনেক দিনের পুরানো ইতিহাস।

ইউ টিউবে ‘জোকার’ জাকিরের কোরানিক ভার্সান ইংরেজী শিক্ষিত মুসলিমদের জন্যে, সৌদি আরবে আবার অন্য রকম-আমেরিকার চাপ খেয়ে পাশ্চাত্যে কোরান অনেক লিব্যালার-সেখানে পন্ডিতরা যুক্তি খোঁজেন উদারতান্ত্রিক ভার্সনের কমপ্যাটিবল কোরান কিভাবে রচনা করা যায়! গীতা বা বাইবেল বা হিন্দু ধর্ম গ্রন্থগুলির ও একই বেহাল অবস্থা!

বই সেই একটাই-আল কোরান। মহম্মদ নিজের কুকীর্তি বা সুকীর্তি, অভিজ্ঞতালদ্ধ জ্ঞান সুপার মাফিয়া আল্লার নামে চালিয়ে কোরান রচনা করেন। মহম্মদের ইতিহাস আর কোরান পাশাপাশি রেখে পড়লে, যেকোন বুদ্ধিমান লোক খুব সহজেই বুঝবে কোরানে কি এবং কেন লেখা হয়েছিল। অবশ্য সে যুক্তিবাদের পথে ধার্মিকরা হাঁটবেন না-কারন অতটা হাঁটার কষ্ট নিতে জানলে, তারা ধার্মিক হবেন ই বা কেন!

হজরত মহম্মদ যা করেছেন, তাতে আমার আপত্তি নেই। ৪০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য উপদেশ দিয়েছিলেন রাজন্যবর্গ দেশ শাসন করতে, নিজের আইনকে ঈশ্বর কতৃক স্বপ্নে প্রদত্ত আইন বলে চালাবে। রাজাকে রাজ্য শাসন এবং বিস্তারের জন্যে নিজের আদেশকে ঈশ্বরের আদেশ বলে চালানোর সুচতুর কৌশল কৌটিল্য মহম্মদের জন্মের ১০০০ বছর আগেই দিয়ে গিয়েছিলেন। কৌটিল্যসুত্র মেনেই ভারত ও ইউরোপের রাজন্যবর্গ নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে রাজত্ব করেছে পৃথিবীর সর্বত্র। তবুও মহম্মদ কৌটিল্যের সেরা ছাত্র হিসাবে ইতিহাসে আবির্ভূত হলেন-কারন অন্যান্য রাজন্য বর্গ ঈশ্বরকে কাজে লাগিয়েছেন নিজেদের পারিবারিক রাজত্ব কায়েম করতে। সেখানে হজরত মহম্মদ সেই ঐশ্বরিক স্কীমকে হাতিয়ার করে মানব সমাজের আরো পূর্নাঙ্গ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। লক্ষ্য – মানব সাম্যের ওপর ভিত্তি করে গরীব দরদী এবং একটি শক্তিশালী সমাজের বিকাশ। তবে হ্যাঁ সেখানেও দাশ প্রথার বিলোপ, নারীর জন্যে সমানাধিকার তিনি আল্লার নামে নামালেন না। কারন সেই যুগে যখন শিশু মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশী, নারীর গর্ভে ছয় থেকে সাতটি সন্তান না এলে, জনসংখ্যার বিলোপ ছিল অবসম্ভ্যাবী-তখন নারীকে প্রজননের মেশিন ছাড়া অন্য কিছু ভাবা ছিল অসম্ভব। কোরান এবং হিন্দু গ্রন্থ সমূহে তাই একই কারনে নারী সেই প্রজনন মেশিন । যাইহোক, এই ইসলামের ওপর ভিত্তি করেই আরবের প্যাগান সমাজ পরবর্ত্তী তিন শতকে পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী এবং জ্ঞানী সমাজে পরিণত হল। কারন ইসলাম তৎকালীন সময় অনুসারে আরো উন্নত সামাজিক আইন এবং চিন্তা বলবৎ করতে সক্ষম হয়।

মনে রাখতে হবে নৃতত্ত্ববিজ্ঞান এবং বিবর্তনের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের উৎপত্তির মূল কারন গোষ্ঠিবদ্ধ জীবন। প্রকৃতির ভয় থেকে ঈশ্বরের উৎপত্তি অতিসরলীকরন। পশু পাখীরাও ঝড় বাদলাকে ভয় পায়-কিন্ত তাদের ঈশ্বর নেই। ঈশ্বর আদিম সমাজে গোষ্ঠিবদ্ধ জীবনের জন্যে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ন প্রয়োজন হিসাবেই বিবর্তিত হয়েছে। একটি সমাজ কিছু আইনের ভিত্তিতে গোষ্টিবদ্ধ হয়-সেই আইন গুলির উৎপত্তিকে সমাজ বিজ্ঞানে বলে ‘সেলফ অর্গানাইজেশন’। অর্থাৎ কিছু অনু পরামানু যেমন নিজেদের আনবিক শক্তিক্ষেত্রের আওতাই এসে আস্তে আস্তে একটি শক্তিশালী ক্রীস্টাল তৈরী করে-তেমন ই মানুষ নিজেদের মধ্যে পারস্পারিক আইন তৈরীর মাধ্যমে একটি গোষ্ঠিবদ্ধ সমাজের জন্ম দিয়ে থাকে। এই আইন যত সমাজের রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেসের উপযোগী হয়, সমাজ তত শক্তিশালী হয়। অর্থাৎ যেসব সমাজের আইনগুলিতে সামরিক শক্তি বা মিলিটারিজম, পরোপকার বা আলট্রুইজম এবং প্রজননের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়-সেই সমাজ বিবর্তনের শক্তিতে ভবিষ্যতে সব থেকে প্রসার লাভ করে। মিলিটারিজম, আলট্রুইজম এবং রিপ্রোডাকশন -যেকোন প্রানীকূলের মূল সারভাইভার স্ট্রাটেজি। যদি ভিনগ্রহের কোন মানুষ আমাকে কোরান বা গীতাকে এক কথায় প্রকাশ করতে বলে-আমি লিখব এই বই গুলি মানব সমাজের সারভাইভাল স্ট্রাটেজির ম্যানুয়াল ছিল মধ্যযুগে।

কোরান বর্নিত সামাজিক নির্দেশাবলী এক শক্তিশালী আরব সমাজের জন্ম দিয়েছিল। কিন্ত ১২০০ শতাব্দি থেকে সেই সমাজ দুর্বল হতে শুরু করে। কেন? আরবরা বিজ্ঞানে যখন এত এগিয়ে ছিল, তখন তাদের মধ্যে থেকেই গ্যালিলিও বা কোপার্নিকাসের জন্ম হওয়া উচিত। কেন এমন হল না? এ প্রসঙ্গে স্যার কার্ল পপারের একটি বক্তব্য প্রাণিধানযোগ্য–যেকোন দর্শনের সব থেকে শক্তিশালী দিকটিই তার দুর্বলতম অধ্যায়। অর্থাৎ ইসলামের দর্শনের সব থেকে শক্তিশালী দিক- এক অভূতপূর্ব সামাজিক শক্তি যা কঠোর সামাজিক আইন এবং সমাজের জন্যে ব্যাক্তির আত্মত্যাগের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ভিত্তিক সমাজের ভিত্তি হতে পারে না। সেখানে উদার নৈতিক ব্যাক্তি কেন্দ্রিক ভোগ্য সমাজ দরকার। ১৫০০-১৮০০ সালের ইউরোপের দিকে তাকালে দেখা যাবে, শিল্প বিপ্লব এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির পেছনে-সামরিক এবং বাজারের ( মূলত উপনিবেশিক) ভূমিকা ছিল মূখ্য। ওই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিস্কারক, লিও নার্ডো দ্যা ভিঞ্চি, তৎকালীন নগর সম্রাজ্যের অধীশ্বর দের চিঠি লিখতেন -তার আবিস্কার দিয়ে আরো উন্নত অস্ত্র বানানো সম্ভব, তাই তাকে অর্থ দেওয়া হৌক সেসব বানাতে। অর্থাৎ প্রযুক্তিগত আবিস্কার গুলির পেছনে ( বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের কথা বলছি না) , বাজার থেকে ফয়দা তোলার ব্যাক্তিগত লোভ সেকালেও আবিস্কারদের ছিল-একালেও আছে। রেডীও থেকে ইন্টারনেট -বাজার ভিত্তিক সমস্ত প্রযুক্তির আবিস্কার এবং তার ব্যাপক বাজারীকরন আবিস্কারকদের ব্যাক্তিগত লোভ থেকেই উদ্ভুত। বাজারের অনুপস্থিতির কারনেই ভুতপূর্ব সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি মারণাস্ত্র এবং মিলিটারি প্রযুক্তি ছাড়া আর কিছুই বিশ্বকে দিতে পারে নি। কোন জীবনদায়ক্ ঔষুধ সেখানে আবিস্কার হয় নি-সব হয়েছে আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে বা জার্মানীতে।

অর্থাৎ আমি যেটা বলতে চাইছি, ইসলামে সামাজিক শক্তির ব্যাপক চাপ থাকার জন্যে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি সত্ত্বেও আরব সমাজ সামন্ততান্ত্রিক থেকে ধনতান্ত্রিক সমাজে বিকশিত হল না। সেই ঘটনা ঘটল ইউরোপে-কারন সেখানকার রাজন্য বর্গ নিজ স্বার্থেই পোপ হতে মুক্ত হতে এবং উন্নত তর অস্ত্র ও উৎপাদনের জন্য ধর্মের ডানা ছেঁটে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগোলেন। আরবে শিল্প বিপ্লবের জন্যে ইসলামের ডানা ছাঁটা দরকার ছিল দ্বাদশ শতাব্দিতে। কিন্ত তা সম্ভব হল না ইসলামের দুর্বার সামাজিক শক্তির জন্যে। ফলে শিল্প বিপ্লব এবং বিজ্ঞানের উন্নতির সামনে ইসলামের সব থেকে শক্তিশালী ফিচারটিই তাদের পিছিয়ে পরার মূল কারন হিসাবে উদ্ভুত হচ্ছে ক্রমাগত ভাবে সেই দ্বাদশ শতাব্দি থেকে।

কিন্ত ধান ভাঙতে শিবের গীত গাইছি কেন? কারন মুসলমান সমাজের বিদ্বান ব্যাক্তিরাও বোঝেন প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান নির্ভর সমাজ না গড়ে তোলার জন্যে আজ পৃথিবীর ৫১ টি মুসলিম দেশই পাশ্চাত্যের থেকে অনেক বেশী পিছিয়ে পড়েছে। সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রের উত্তোরন একমাত্র তুরস্ক ছাড়া কোথাও সেই ভাবে হয় নি। মিশর, ইন্দোনেশিয়া এবং মালেশিয়ার সাফল্য আংশিক। ফলে মুসলিম সমাজে বিজ্ঞানের প্রসার ঘটাতে গিয়ে এক অদ্ভুত সার্কাসের চলছে। সেখানে বিজ্ঞানের প্রসারের বদলে ইসলাম ধর্ম কত বৈজ্ঞানিক, সেটা প্রচার করতে রাষ্ট্র এবং মিডিয়া “স্ব কিছুই কোরানে আছে” টাইপের অপবিজ্ঞানের জন্ম দিচ্ছে। এমন নয় যে হিন্দু বা খ্রীষ্ঠান ধর্মে এটা হচ্ছে না। ব্যাপক ভাবেই হচ্ছে। কিন্ত তার পেছনে রাষ্ট্রের মদত নেই। কিন্ত ইসলামের ক্ষেত্রে এই অপবিজ্ঞান রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় এক ভয়ংকর দূষনের রূপ নিয়েছে। আমি এই প্রবন্ধে দেখাবো কি ভাবে এই কুকীর্তি সাধিত হয় । কিভাবে একই আয়াত যা সপ্তম শতাব্দির আরবে ছিল রূপকথা, তা অপবিজ্ঞানীদের হাতে পড়ে, “বৈজ্ঞানিক সত্যের” দাবী করে।

(২)

একটি বাক্যের অর্থ কত প্রকার হতে পারে, এবং তা নিয়ে কি কি ঢপবাজি করা যায়, সেটা বুঝতে জ্যাকুস দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন তত্ত্ব খুবই উপযোগী।

ডিকনস্ট্রাকশন পাঠ করার একটি পদ্ধতি। দেরিদা দেখান

* প্রতিটা বাক্যের একাধিক অর্থ হতে পারে
* সেই অর্থগুলি পরস্পর বিরোধী হতে পারে
* একই বাক্যের নানা ব্যাখ্যা গুলির পরস্পর বিরোধিতা কমানোর কোন উপায় নেই
* তাই ব্যাখ্যা মূলক পাঠের সীমাবদ্ধতা আছে-এটাকে এপোরিয়া বলে

ডিকনস্ট্রাশনের মুলে আছে ডিফারেন্স (Différance)। এই তত্ত্ব অনুযায়ী

* একটি শব্দের নির্দিষ্ট কোন অর্থ নেই-এক টি শব্দের অর্থ তার কাছাকাছি সে সমার্থক শব্দগুলি আছে, তার সাথে পার্থক্য করে নির্নয় করতে হয়। বাড়ি শব্দটির অর্থ নির্নয় করতে আমদের দেখতে হবে কি করে এই শব্দটি ঘর, গৃহ, বাটিকা, প্রাসাদ, অট্টালিকা ইত্যাদি শব্দের থেকে আলাদা।

* যেহেতু প্রতিটি শন্দ একটি ইমেজ বা ছবি ( আসল বা এবস্ট্রাক্ট) কে প্রতিনিধিত্ব করে সেহেতু বাড়ির সাথে গৃহ, বাটিকা, অট্টালিকা ইত্যাদি শব্দগুলির পার্থক্য নিরূপন করতে, একই সাথে সমার্থক শব্দগুলির ইমেজ, সামাজিক, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকেও ভাবতে হবে ।

একটি বিতর্কিত সুরা ধরে উত্তর দিচ্ছিঃ

9:5 But when the forbidden months are past, then fight and slay the Pagans wherever ye find them, an seize them, beleaguer them, and lie in wait for them in every stratagem (of war); but if they repent, and establish regular prayers and practise regular charity, then open the way for them: for Allah is Oft-forgiving, Most Merciful.

এই আয়াতে সমস্ত গন্ডোগলের উৎপত্তি প্যাগান শব্দের অর্থ থেকে। আলি সিনা এটিকে বিধর্মীদের বি্রুদ্ধে যুদ্ধ বলেও ঘোষনা করতে পারেন-কারন কনটেক্সটুয়ালি মানেত তাই। আবার কেও ঐতিহাসিক দৃষ্টিতেও বলতে পারে, প্যাগান মানে তখনকার মক্কাবাসী ্যারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রত ছিল। তাই বর্তমানে আয়াতটির কোন মূল্য নেই। সেটাও ঠিক। আবার কেও প্যাগান বলতে অমুসলিম ধরেও অর্থ করতে পারেন। আবার প্যাগান বলতে এখানে ইসলামের শত্রুও বোঝানো যেত পারে। ব্যাখ্যাগুলি পরস্পর বিরোধি অর্থের জন্ম দিচ্ছে-কিন্ত কোন ব্যাখ্যাকেই ভুল বলা যাবে না । এটার কারন প্যাগান শব্দটার “ডিফ্যারান্স”। কনটেক্সটুয়ালি শব্দটির একাধিক পরস্পর বিরোধি অর্থ হতে পারে-যার কোনটিকেই অস্বীকার করা যাবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে ধর্ম গ্রন্থগুলিকে যখন আমরা ব্যাখ্যা করছি-সেই ব্যাখ্যামূলক অর্থের কোনটি ঠিক-আর কোন টি বেঠিক কে নির্নয় করবে? দেরিদার ডিকনস্টাকশন অনুযায়ী-এই ঠিক না বেঠিক ব্যাখ্যা এই প্রশ্নটিই অর্থহীন। কারন বাক্যের বাখ্যার সীমাবদ্ধতা আছে এবং একাধিক ব্যাখ্যাই কনটেক্সুয়াল কারনে ঠিক হতে পারে। একই বাক্য কখনোই একটিই মাত্র অর্থ বহন করে না।

এবার ত তাহলে বিশাল গেরো হল। দেরিদার মূল কথা হল একটি বাক্য দিয়ে একটি না একাধিক অর্থ পাঠকের কাছে সব সময় পৌছে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ কোরানের ১২০০ ইন্টারপ্রেটেশন থাকলে ১২০০ টিই ঠিক হতে পারে। তাহলে কি সিদ্ধান্তে আসা যায়?

অ) আল্লা বা ঈশ্বরকে যত্ই বুদ্ধিমান ভাব না কেন-একটি গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে তার বক্তব্যকে পৃথিবীতে পাঠানোর মতন বোকামী আর হতে পারে না! কারন সেই বই এর হাজার হাজার ভাবার্থ হতে পারে, ফলে আল্লা বা ঈশ্বর ঠিক কি চাইছেন, তা কোনদিনই জানা সম্ভব না। অর্থাৎ হীরক রাজার দেশের অবস্থা–ব্যাখ্যার কোন শেষ নাই-ব্যাখ্যার চেষ্টা বৃথা তাই। সুতরাং একজন চোর, ডাকাত, মাস্টারমশাই, ব্যাবসায়ী, যোদ্ধা-একই বই পড়লেও এদের কাছে কোরানের ব্যাখ্যা হবে আলাদা। মোদ্দাকথা ১৫০০ মিলিয়ান মুসলিম কোরান পড়ে ১৫০০ মিলিয়ান ব্যাখ্যা তুলে নিয়ে আসতে পারে-যার অনেক গুলিই পরস্পর বিরোধি হবে-কিছু মিল থাকবে। এবং সেটাই বাস্তব। আল্লা বা ঈশ্বর বুদ্ধিমান হলে বই এর মাধ্যমে, ইনস্ট্রাকশন পাঠানোর রামপাঁঠামো কাজটি করতেন না। উনি ত সৃষ্টির মা-বাপ। একদম মানুষের মস্তিস্কের মধ্যে কোরানটাকে জেনেটিক্যালি ওয়ারড করে পাঠিয়ে দিলেই লেঠা চুকে যেত! আল্লা কি চান? তার আইনের সাম্রাজ্য! সেটা ত মানুষের জেনেটিক কোডে ঢুকিয়ে দিলেই অনায়াসেই হয়ে যেত! উনিই ত মানুষ তৈরী করেছেন! সেটা না করে বই এর মাধ্যমে তার ইচ্ছা বা আইনের কথা জানানোর গাধামো কেন তিনি করলেন তা সত্যই খুব গোলমেলে! একবার ভেবে দেখুন। একটি প্রতিষ্ঠিত আইনের ও হাজার ব্যাখ্যা হয়-আইন বাক্যটি কিন্ত বদলায় না। সুতরাং কিছু আইন সংকলন করে ছেড়ে দিলেই আইনের সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয় না-সামাজিক বিবর্তনের সাথে সাথে সেই একই আইনের ব্যাখ্যাও বদলে যায়। সুতরাং একটি গ্রন্থের মাধ্যমে সর্বকালীন সার্বজনীন একটি ধর্মের প্রতিষ্টা করার ধারনাটাই ডাঁহা ভুল। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বা আল্লার যদি সত্যিই অস্তিত্ব থাকত -ধর্ম রাজ্য বানাতে ধর্ম গ্রন্থ বাজারে ছাড়ার মতন বোকামি তিনি করতেন না। জেনেটিক কোডে সামান্য রদ-বদল করে তিনি তার ধর্ম রাজ্য বানাতে পারতেন! ধর্মগ্রন্থ বাজারে ছেড়ে ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্টার খোয়াব মানবিক ক্রিয়া-কলাপ, যা এই বান্দা বর্তমান প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে করে চলেছে। কারন মানুষের জেনেটিক কোড বদল করার ক্ষমতা আমার হাতে নেই!

আ) ধর্মের ব্যাখ্যা মূলক বিতর্কগুলি অর্থহীন জঞ্জালের সৃষ্টি করছে। কারন কোন ব্যাখ্যাই আসলে বেঠিক না। যে কোরানে বিজ্ঞান পাচ্ছে সেও ঠিক ব্যাখ্যা করছে-যে পাচ্ছে না-বা উলটো পাচ্ছে সেও ঠিক ব্যাখ্যা করছে। কারন ওই রকম দুর্বল বাক্যের একটি মাত্র ভাবার্থ থাকতে পারে না। সুতরাং যারা কোরানে বিষ্ঠা এবং মূত্র পাচ্ছে তারাও যেমন ঠিক-আবার যারা ফুল ফলের শোভিত গন্ধ পাচ্ছে তারাও ঠিক। দেরিদার কথা মানতে গেলে ব্যাখ্যা মূলক বিতর্ক সম্পূর্ন অর্থহীন-একাধিক পরস্পর বিরোধি ব্যাখ্যা থাকাটাই বাক্যের ধর্ম!

(৩)

তাহলে কি আমরা জাকির নায়েকের এই ধরনের ধরনের ধাপ্পাবাজির সামনে অসহায়? মোটেও না। আসল সমস্যার মুলেই আঘাত করতে হবে। ডিকনস্ট্রাকশন জনিত দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ধর্মকে মানবিক বা যুগোপযোগী করে তোলার চেষ্টাকে বলে “উইক থিওলজি” বা “দুর্বল ধর্মতত্ত্ব”। এটাই ধর্মতত্ত্বের পোষ্টমডার্নিজম-যে কোন ধর্মতত্ত্বের একটি ই মাত্র ব্যাখ্যা থাকতে হবে তার মানে নেই। কারন ধর্মের টেক্সট বা বাক্যগুলির গঠন খুব দুর্বল। গোদের ওপর বিষফোরার মতন মধ্যযুগীয় শব্দ। ফলে আইসক্রীমের বা চালের যেমন গার্ডেন ভ্যারাইটি প্রোডাক্ট লাইন থাকতে পারে-ইসলাম বা হিন্দু ধর্ম মানেও যে একটিই মাত্র ধর্ম বোঝাতে হবে, তারই বা মানে কি আছে? আসল সত্য ত এটাই ১৫০০ মিলিয়ান মুসলমান ১৫০০ মিলিয়ান রকমের ইসলাম ধর্ম পালন করে। হিন্দু দের মধ্যেও তাই-এক বিলিয়ান হিন্দুর জন্যে এক বিলিয়ান হিন্দু ধর্ম। ভারতে বা পাকিস্থানে যে ধরনের ইসলাম পালন করা সহজ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, আমেরিকাতে তাত হবে না। তাই এখানে, আমেরিকাতে ইসলামের বিবর্তন বা হিন্দু ধর্মের বিবর্তন ও অন্যভাবে হবে। এবং এই ভাবেই ধর্মের উদারনৈতিক ব্যাখ্যাগুলি ক্রমশ গোঁড়া বা রক্ষনশীল ব্যাখ্যাকে কোনঠাসা করতে সক্ষম হবে, সেই বিবর্তনের পথেই। এই ভাবেই ত হিন্দু সংস্কার আন্দোলন সফল হয়েছে। তাই ইসলামের যত বেশী ব্যাখ্যা বাজারে আসবে ধর্মটার বিবর্তন হবে তত দ্রুত-কারন মানুষ তার যুগোপযোগী ব্যাখ্যাটাই খুঁজে নেবে। এই ভাবে বিবেকানন্দের হিন্দু ধর্ম সংস্কার আন্দোলন কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। ভারতের ইসলাম আর আরবের ইসলাম এক না। বাংলার ইসলাম, বাংলার মাটির সাথে কথা বলেই তার ভাবার্থ খুঁজেছিল এক সময়-এখন আবার আরবী হওয়ার চেষ্টা করছে। যা অতীব হাস্যকর কারন বাংলার ইসলামও এই ধরনের উইক থিওলজি থেকে বাংলা সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিবর্তিত ধর্ম। সেই বিবর্তনকে উপেক্ষা করে, আরবের ইসলাম বাংলায় চালাতে গেলে, বাংলা ভাই টাইপের চরিত্রই ভবিষ্যত।

আবার ধর্মীয় মৌলবাদিরা ডিকনস্ট্রাকশনের ভাষায় স্ট্রং থিওলজিস্ট-কারন তারা বিশ্বাস করে ধর্মীয় বাক্যের একটিই মাত্র ব্যাখ্যা আছে -যা তারা মানে। কিন্ত আমরা দেখালাম, তা অবৈজ্ঞানিক ধারনা। ধর্মীয় বাক্যের একাধিক অর্থ থাকাটাই বাস্তবে সত্য। মূলত এদের জন্যেই মৌলবাদি জঞ্জালে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে গোটা পৃথিবী।

কিন্ত ধর্মে বিজ্ঞান খুঁজে পাওয়া অপবিজ্ঞানীদের কি হবে? ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কির মতে এই ধরনের উৎপাতের কারন ধর্মগ্রন্থগুলির বাক্য উইক টেক্সট বা দুর্বল ভাবে গঠিত বাক্য যা বিজ্ঞানের ভাষা হতে পারে না। রিচার্ড ডকিন্স ও এই ব্যাপারে সহমত। অর্থাৎ নিউটনের তৃতীয় সূত্র বিজ্ঞান যে ভাষায় লেখে, সেখানে একটি বাক্যের একাধিক মানে নেই। বিজ্ঞান ভাষ্যে বাক্যকে ভীষন ভাবে অবজেক্টিভ হতে হবে যাতে একটিই মাত্র অর্থ হয় এবং সেই অর্থ অনুসরন করে তার পরীক্ষামূলক অনুসন্ধান সম্ভব। কোন বাক্যের একাধিক পরস্পর বিরোধি অর্থ থাকলে, সেই বাক্যকে আমরা বলব উইকটেক্সট ( দুর্বল বাক্য) এবং সেই বাক্যটি বিজ্ঞানের জগতে গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। সুতরাং আমাদের স্ট্যান্ডার্ড উত্তর হওয়া উচিত-কোরান বা গীতায় বিজ্ঞান আছে কি নেই-তাই নিয়ে ধার্মিক রা যত খুশী মাথা ঘামাক। তাতে বিজ্ঞানীদের কিছু যায় আসে না-কারন ওই গ্রন্থ গুলির টেক্সট এত দুর্বল -তা একাধিক অর্থ বহন করে, তাই তা বিজ্ঞানের বিবেচ্য নয়। কেও যদি কোরানে বিজ্ঞান আছে বলে গর্বিত বা খুশী হয়। তাতে কি যায় আসে। হিরোইন বা কোকেন খেয়েও লোকে আপাত ভাবে খুবী উজ্জীবিত থাকে। সেটা তাদের চয়েস-কিন্ত বিজ্ঞানী মহলে তা অর্থহীন প্রলাপ ছাড়া কিছুই না।

মোদ্দা কথা আল্লা নিজের ভেলকি বা কেরামতি দেখাতে চাইলে, মানুষের জেনেটিক কোডেই সেটা করতে পারতেন-বই এর মাধ্যমে সমাজ পরিবর্ত্তনের চেষ্টাটা আমাদের মতন নশ্বর মানুষের কাজ!