রাষ্ট্রের কথা এবং মানুষের কথা বলতে গেলে ধর্ম ও শ্রেনী বিভেদ এই দুইটি প্রসংগ চলে আসে অবধারিত ভাবে। আমার কাছে ধর্ম মানুষের ভাষার মতই একটি অংশ। পৃথিবীর সমস্ত কিছু যেমন গতিশীল, সর্বদা পরিবর্তনশীল, তেমনি ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি সর্বদা পরিবর্তনশীল। এক সমাজের ভাষার সাথে অপর সমাজের ভাষার সংমিশ্রনের ফলে তাদের মাঝে এক ধরনের আদান প্রদান ঘটে। সে পরিবর্তন খুব ধীরে ঘটে থাকে, কিন্তু তা চোখে পড়ার মত। আজ আমাদের ভাষায় ইংরেজীর অতি মিশ্রন, সেরকম একটি রুপান্তর এর বহিঃপ্রকাশ। আমাদের সংস্কৃতিতে হিন্দি এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির উপস্থিতিও চোখে পড়ার মত। এ ধরনের পরিবর্তন আমার আপনার ভাল লাগুক বা না লাগুক তাতে সমাজের কিছু আসে যায়না। আপনি আপনার সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম আরো বেশি করে আকঁড়ে ধরতে পারেন। তাতে পরিবর্তনের গতিটাকে কমাতে পারবেন কিন্তু প্রতিরোধ করতে পারবেন না। একে আমি তুলনা করবো নদীর প্রবাহের সাথে। আপনি বাঁধ দিয়ে নদী প্রবাহকে থামাতে পারবেন না, সে যেদিক দিয়ে পারবে সেইদিক দিয়ে বয়ে যাবে। মানুষের মাঝে পরিবর্তনটি সেরকম। যখন তার মাঝে পরিবর্তন এর জোয়ার আসবে তখন সে নিজের অজান্তেই সে জোয়ার এর অংশ হয়ে যাবে। এটাই মানুষের চরিত্র।

সেইদিন হয়তো বেশী দূরে নয়, সহস্র বছর কিংবা তারও কম সময়, যখন মানুষের মাঝে কেবল একটি ভাষা, একটি সংস্কৃতি, একটি শ্রেনী এবং একটি ধর্ম বিদ্যমান থাকবে। সেই ধর্ম হবে মানব ধর্ম। যেখানে কোন মহাপ্রভু বসে থাকবে না মৃত্যুর পরে পাপীদের শায়েস্তা করার জন্য। যেখানে সকল মানুষ হবে আক্ষরিক অর্থে সমান। যেখানে মানুষকে কোন কাল্পনিক মহাপ্রভুকে উদ্দেশ্য করে সেজদা করতে হবে না। যেখানে মানুষ নিজেই তার নিয়তি ঠিক করবে। বিজ্ঞান হবে তার পথ পদর্শক। যে বিজ্ঞান মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করবে, নয় ধ্বংসের জন্য।

শ্রেনীভেদ মুক্ত সমাজ হতে পারে সবার শেষ পর্যায়ে। তার আগে মুক্ত হতে হবে ধর্ম, ভাষা এবং সংস্কৃতির বিভেদ। যতদিন এই বিভেদগুলোর একটিও বর্তমান থাকেব ততদিন শ্রেনীবিভদ থাকবে। তবে এটা ঠিক যে, সবকিছুর মত মানুষের শ্রেনী বিভেদও সাম্যব্যবস্থার দিকে থাবিত হচ্ছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রকৃত শ্রেনীবিভেদ দূর করা সম্ভব কেবল শ্রমের প্রয়োজন বিলুপ্তির মাধ্যমে। যখন শিল্প-কারখানায় কিংবা বাসা বাড়িতে কিংবা অফিস আদালতে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ গুলো সয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় অথবা রোবটের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যাবে তখ্ন শ্রমের প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। উন্নতদেশ গুলোয় জনসংখার ঘাটতি থাকায় তারা সব ক্ষেত্রেই কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থার ব্যবহার বেশি করছে। সেখানে মানুষের জীবনযাত্রার মান এক ধাপ এগিয়ে অনুন্নত দেশগুলোর তুলনায়। তবে যতদিন মানুষের আধিক্য থাকবে ততদিন মানুষ নিজের প্রয়োজনেই শ্রমের প্রয়োজন বাচিয়ে রাখবে। শ্রমিক শ্রেনীর আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলে গেলেই শ্রেনী বিভেদ দূর হয়ে যাবে না। শ্রমিক শ্রেনী ক্ষমতার অংশ হয়ে গেলেই শ্রমের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাচ্ছে না। তবে শ্রমিকদের নুন্যতম মৌলিক আধিকারগুলো (খাদ্য, বাসস্থান, চিকিত্‌সা, এবং শিক্ষা) বাস্তবায়ন করা একান্ত জরুরি, এবং তার জন্য আন্দোলন হতে পারে। প্রকৃত শ্রেনীবিভেদ মুক্ত সমাজ একটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।

সেরকম প্রকৃত ধর্ম বিভেদ দূর হওয়াও দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। সময়ের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে এই ঈশ্বরযুক্ত ধর্ম হতে মানুষ মুক্ত হতে পারবে। মানুষের মনে ঈশ্বরের এই অবস্থান মানুষের জন্ম লগ্ন থেকেই। আমারা যদি একটু মানব সভ্যতার ইতিহাসটিকে পর্যালোচনা করি তবে দেখতে পাই যে মানুষ চরিত্রগত ভাবে খুব দুর্বল প্রকৃতির। কিন্তু তার বেঁচে থাকার আকাঙ্খা অত্যন্ত প্রবল। যে কোন অবলম্বনে সে বেঁচে থাকতে চায়। মানব সভ্যতার একদম আদিম যুগে যখন সে কিছুই জানতো না, তখন সে রাতের অন্ধকারকেই ভয় পেত। সে কামনা করতো যেন এই অন্ধকার চলে যাক, এবং সুর্য যেন অতিসত্বর চলে আসুক। পরবর্তীতে যখন সুর্য উদয় হয়, সে ভাবে কেহ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছে। সেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকুক বা না থাকুক তার কাছে প্রাধান্য পায় তার সাময়িক মুক্তি, এবং তাতেই সে আনন্দিত। অতপর সে যখন আগুন আবিষ্কার করলো, রাতের অন্ধকারকে তার আর তেমন ভয় লাগে না, কিন্তু এখনো প্রাকৃতিক দূর্যোগকে তার ভয় লাগে। ওই কালো মেঘ, বিকট শব্দে পতিত বজ্রপাতকে তার বড় বেশি ভয় লাগে। সে গুহায় বাস করিতে শিখল। সংঘবব্ধ ভাবে বাস করা শিখল। কৃষিকাজ, পশুপালন করা শিখল। কিন্তু প্রাকৃতিক দূর্যোগ, মহামারী রোগ, অনিশ্চিত বিপদ তাদের পিছু ছাড়ে না এবং ঈশ্বরের প্রয়োজনও তাদের ফুরিয়ে যায় না।

মানুষে মানুষে ছোট পরিবার হয়, পরিবার থেকে সমাজ হয়, বিভিন্ন গোত্র হয়। গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ হয় পানির জন্য, খাবারের জন্য, নারীর জন্য, ক্ষমতার জন্য, সর্বোপরি বেঁচে থাকার জন্য। সেই যুদ্ধে জেতার জন্য ঈশ্বরের প্রয়েজনীয়তা নুতন করে অনুভিত হয়। ধীরে ধীরে সভ্যতার বিকাশ ঘটে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাজ, গোত্র, মিলে রাষ্ট্র গঠিত হয়। রাষ্ট্র মানুষের দায়িত্ব নেয়। মানুষ কাজ করে নিজের জন্য এবং রাষ্ট্রের জন্য। মানুষ এখন অনেক সংগঠিত। মানুষের হাতে ব্যবহার করার জন্য অনেক নুতন যন্ত্র, যা দিয়ে সহজেই পর্যাপ্ত ফসল ফলানো সম্ভব হয়। এই প্রথম কিছু মানুষের হাতে বাড়তি সময় থাকে চিন্তা করার জন্য। মানুষ চিন্তা শুরু করে। প্রশ্ন করে কে আমি? কে আমাকে সৃষ্টি করেছেন? ঈশ্বর কে? ঈশ্বরের অবস্থান কোথায়? দেখা যায় ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ধারনা মোটেই পরিষ্কার নয়। কিন্তু ঈশ্বরের প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে। ঈশ্বরকে তারা অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখাতে সাহস পায়না। তাই ঈশ্বরকে সংজ্ঞায়িত করা তাদের বিশেষ প্রয়োজন। ঠিক এরকম একটি সময়ে মানুষ ঈশ্বরকে কল্পনা করে, রুপায়িত করে এবং হরেক রকমের বিশেষণে ভুষিত করে। কিন্তু রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সে সংজ্ঞা, বিশেষণ ভিন্ন হয়। যার দরুণ পূর্বে যে যুদ্ধ ছিল শুধু রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্র, তা এখন হল ঈশ্বর বনাম ঈশ্বর। এই ঈশ্বর বনাম ঈশ্বরের যুদ্ধ আজো সভ্য সমাজে বংশ পরম্পরায় আমরা বয়ে চলছি।

যুদ্ধ মানুষকে আরো অমানুষ করে দেয়। মানবের যে মানবীয় গুণগুলো মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীবে পরিনত করে সে গুণগুলো চাপা পড়ে গেল যুদ্ধের মানসিকতার ফলে। হিংসা, বিদ্বেষ, শ্রেনীভেদ বহুগুনে বেড়ে গেল এবং তা মানুষের চরিত্রের অংশ হয়ে গেল। এর মাঝেও বিক্ষিপ্ত কিছু মানুষ সর্বদা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, যাদের আমারা বলে থাকি দার্শনিক। কিন্তু ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষের তুলনায় সে সংখা ছিল এতই নগন্য যে তারা শুধু ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল। এর মাঝে কিছু ঈশ্বর প্রেরিত দাবীকৃত কিছু পুরুষ এর আগমন ঈশ্বরের মহিমাটিকে আরো কয়েকগুনে বৃদ্ধি করে দিল এবং বলা যায় আমাদের ধর্মের সাম্যবস্থায় যাওয়াটিকে সহস্র বছর পিছিয়ে দিল। বলাই বাহুল্য ঈশ্বরের হাত ধরে তাদের সাম্রাজ্য সারা বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়লো অগনিত মানুষের প্রানের বিনিময়ে। যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা, শোষনের প্রয়োজনীয়তা আর দূর্বল মানুষের ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা কখনই বিলীন হয়নি মানুষের মন থেকে।

তারপর শুরু হয় সভ্যতার নুতন যুগ। বিজ্ঞানের যুগ, যুক্তির যুগ। মানুষ বিজ্ঞানকে চিন্‌তে শুরু করেছে। মানুষ যুক্তিকে বুঝতে শুরু করেছে। মানুষ শুধু প্রশ্ন করতে শিখেনি, মানুষ শিখেছে কিভাবে ধারাবাহিক ভাবে প্রশ্ন করে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়া যায়। মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু আবিষ্কার করতে শুরু করেছে। এক একটি বিজ্ঞানের আবিষ্কার তাকে আরেকটি নুতন আবিষ্কারের নেশায় মাতিয়ে তুলে। কিছু মানুষ এখন আর নিজেদের নিয়ে চিন্তা করে না। তারা সমগ্র মানবকূলের কথা চিন্তা করে। বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কার তাই মানুষের জীবন ধারাকে বদলে দিল। গাড়ি হল, জাহাজ হল, কল কারখানা হল। পৃথিবী গতিময় হল, পৃথিবী ছোট হয়ে এল, একে অপরের কাছাকাছি হল, ধর্ম ভাষা সংস্কৃতির আদান প্রদান হল। কিন্তু মানুষের মাঝে লুকায়িত স্বার্থপরতার বীজ কখনই দূর হয়নি। তাই বিজ্ঞানের অগ্রগতি সত্বেও কিছু মানুষের হঠকারিতার জন্য শুরু হল নুতন সমস্যা, যার নাম সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদের নেশায় এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিল। এই সাম্রাজ্যবাদ এসেছে কখনো পুজিবাদী রাষ্ট্র থেকে, কখনো সমাজতন্ত্রবাদী রাষ্ট্র থেকে আবার কখনো ধর্মবাদী রাষ্ট্র থেকে। ধর্মবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পুজিবাদ, সমাজতন্ত্রবাদ সব সমার্থক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানের জয়যাত্রা কখনই থেমে থাকেনি। মানুষ যত বেশী জেনেছে, মানব ধর্ম তত বেশী সমৃদ্ধশালী হয়েছে। মানুষ জেনেছে কেন প্রতিদিন সূর্য অস্ত যায় আবার ঊদিত হয়, মানুষ জেনেছে কেন কালো মেঘ হয়, কেন বজ্রপাত হয়, কেন প্রাকৃতিক দূর্যোগ হয়, কেন মহামারী হয়। তাই ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে ফুরিয়ে এসেছে পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছে।

কিন্তু আজো মানুষের মাঝে সংঘাত রয়েছে। এখনো সাম্রাজ্যবাদ রয়েছে, শ্রেনী বিভেদ রয়েছে, শোষণ রয়েছে, অনিশ্চয়তা রয়েছে। আগে যে মানুষের অনিশ্চয়তা ছিল শুধু রাতের অন্ধকারে, কিংবা প্রাকৃতিক দূর্যোগে আজ সেটা ভর করেছে এক বেলা খাবার আয়োজনের অনিশ্চয়তায়, ক্যান্সার এইডস এর মত প্রানঘাতী রোগের অনিশ্চয়তায়, আত্মঘাতী বোমা হামলার মত অনিশ্চয়তায়। বিজ্ঞান এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আজো আমরা সকল রোগকে জয় করতে পারিনি, এবং যা পেরেছি তা সকল মানুষের দুয়ারে পৌছে দিতে পারিনি। তাই আজো মানুষ অসুস্থ হলে, প্রিয়জন মৃত্যুর মুখোমুখি হলে কিংবা অজানা বিপদের সম্মুখিন হলে ঈশ্বর এর উপর ভরসা করে। ঈশ্বরের প্রয়োজন আজো তাই ফুরিয়ে যায়নি অনেক মানুষের কাছে।

তাই বলে কি আমরা ঈশ্বর বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করবো? অবশ্যই নয়। তারা দুর্বল বলেইতো তাদের কাছে ঈশ্বর এর প্রয়োজনীয়তা এখনো রয়েছে। তাদের হাতটিকে যদি একটু সবল করে দেওয়া হয় তাহলে সে প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। তাই ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনাকারী সকল নিরীশ্বরবাদীদের বলবো- কল্পনার ঈশ্বরের সাথে যুদ্ধ করা চলে না। আপনার যুদ্ধ ঘোষনায় সে আরো বেশী ভীত হয়ে পড়বে এবং আরো বেশী করে ঈশ্বরকে আকঁড়ে ধরবে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যান বিপুল গতিতে, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করুন, দেখবেন তাদের ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে আজি হতে সহস্র বছর পরে।