বিচারপতি বা বিচারকরা হলেন সমাজ, দেশ বা রাষ্ট্রের মাথা। তারাই নীতি-নৈতিকতা-বিধান ঠিক রাখার দায়িত্বে। কিন্তু কোন দেশে যদি সেই বিচারপতি বা বিচারকরাই দায়িত্বহীন হন, নীতি-নৈতিকতা হারান, অপরাধমুক্তির বদলে নিজেরাই অপরাধ করেনÑ তাহলে সেই দেশ-রাষ্ট্র বা সমাজের কোন্ দূগর্তি হবে তা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। এক কথায়, বিচারকরা অবিচারক হলে সে দেশ অধঃপাতে যেতে বাধ্য। সে দেশ বাধ্য অপরাধপ্রবণ, অন্যায়-অবিচারপ্রবণ, দুর্নীতিপরায়ন এবং নীতি-নৈতিকতাবিহীন হতে।

এখানে গত ২৪ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবে সিটিজেন রাইটস মুভমেন্ট আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তারা সংবাদ সম্মেলনে এক শ্রেণির বিচারপতির কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় বিব্রতবোধকারী বিচারপতিরা বিতর্কিত। ওই বিচারপতিদের বিচার বিভাগে বহাল রাখা উচিত হবে না। তারা দেশ ও জাতির শত্র“। তাদের অপসারণ করতে হবে।

তারা আরও বলেছেন, সুপ্রিমকোর্ট ও একজন বিচারপতির সম্মান অক্ষুণœ রাখার স্বার্থে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের ফরমায়েশি প্রতিবেদন উপস্থাপনাকারী বিচারপতিদেরও অপসারণ ও বিচারের মুখোমুখী করা জরুরি।

সিটিজেন রাইটস মুভমেন্ট যে অভিযোগে বিচারপতিদের বিচার এবং শাস্তি দাবি করেছে, সে অভিযোগ শুধু কয়েকজন বিচারপতিকে নিয়ে নয়। গত ২০ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি যে বিচার বিভাগীয় কমিশনের (২০০৭ সালের আগস্টে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনা সংক্রান্ত) প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেÑ সেই বিচারপতি গংও এর অংশ। ওই কমিশন একটি অসভ্য শক্তিকে রক্ষা করতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে এবং ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনাকে ভিন্নখাতে দেখিয়েছে। এর রকম আরও ঘটনা রয়েছে।

আমরা বিগত তথাকথিত এক-এগারোর সময় এসব বিস্তর দেখেছি। অনেক বিচারকই তখন সাদা পোশাকের ইচ্ছা পূরণ করতে বিচারের নামে অবিচার করেছেন। আদালত বসানোর নামে অবিচারের দোর্দণ্ড রাজত্ব কায়েম করেছেন এবং অশুভ শক্তির অশুভ রাজত্বে সহায়তা করেছেন। আমরা দেখেছি বিচারালয় নিয়ে কী ন্যাক্কারজনক খেলা খেলা হয়েছে। নিম্ন আদালত রায় দিচ্ছে এক, হাইকোর্ট রায় দিচ্ছে আরেক, আবার সুপ্রিম কোর্ট রায় দিচ্ছে অন্য আরএক। তখন যে কোন মানুষ চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারতেন, নিম্ন আদালত-বিশেষআদালত-দুদক বা সংসদ ভবনের আদালত রায় দেবে সাদা পোশাকপড়াদের অনুকূলে। আর হাইকোর্টে সে রায় স্থগিত হলেও হতে পারে, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট পুনরায় সাদাপোশাকীদের খুশী হবার মতো রায় দেবে। এইভাবে বিচারের নামে, রায়ের নামে চলেছে হাস্যকর নোংরামী। যা দেখে সভ্য মানুষ তথা বিশ্ব লজ্জায় হতবাক হয়েছে। অথচ লজ্জা পায়নি ওইসব বিচারক নামের অবিচারকরা, কিংবা তাদের বন্দুকবাজ প্রভূরা। দুইয়ে মিলে এখানে এক ত্রাসের রাজত্ব, অসভ্যতার রাজত্ব এবং মানুষ্য মোড়কে পশুত্বের ব্যবস্থাপনা কায়েম করা হয়েছিল। কতো নীচে নামলে এমন হয়! যারা এর হোতা এবং যারা এর সহযোগী বা এসব কিছুর জন্য দায়ী তাদের কি ক্ষমা করা যেতে পারে? তাদেরকে বিচার এবং শাস্তি না দিয়ে কি চলতে পারে? কেননা, বিচার এবং শাস্তি না দিলে এগুলোকে মেনে নেওয়া হয়,, তাদের অপরাধকে গ্রহণ করা হয়, বৈধতা দেওয়া হয়, ইন্ধন যোগানো হয় এবং সমাজে একে সংরক্ষিত করা হয়। যা ভবিষ্যতের জন্য বহাল থেকে আবারও আঘাত হানতে বাধ্য।

অতীতে আঘাত হানার জন্য যাদের রক্ষা করা হয়েছে তারা শুধু বিগত এক-এগারোতেই দেখা দেননি, আগের বিএনপি-জামায়াত জোটের হত্যাযজ্ঞ, সংখ্যালঘু নির্যাতন, জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ, গ্রেনেড হামলা এবং মামলায় দেখা দিয়েছেন। দেখা দিয়েছেন বারবার, অনেকবার। যখনই ক্ষমতা অসভ্যদের হাতে থেকেছে, তখনই অবিচারকরা তাদের হয়ে বিচারকের ভূমিকায় নেমে সমাজ, সভ্যতা, রাষ্ট্র, দেশ, সংবিাধান, আইন-কানুনকে কুড়ে খেয়েছেন, ক্ষত-বিক্ষত করেছেন।

আমরা আমাদের সর্বশেষ বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছিরকেও দেখেছিÑ যিনি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের একইসঙ্গে দুটি পদে থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্চ করে দায়ের করা রিট আবেদনের শুনানিতে বিতর্কিত ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ওই রিট আবেদনের শুনানি করতে দেননি। ফলে দেশকে কথিত এক-এগারো বা দুই বছরের জরুরি অবস্থার শিকার হতে হয়েছে। ক্ষত-বিক্ষত-বিদ্ধস্ত হয়েছে রাষ্ট্র-দেশ-সমাজ-সভ্যতা। এখনও দেখতে পাবো, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের দায়ের করা আপিল প্রত্যাহার করে নিয়েছে বর্তমান সরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সেই আপিলের নিষ্পত্তি না করে বিএনপি মহাসচিবের লিভ টু আপিল দায়েরের অনুমতি দিয়ে ফের জে আর মোদাচ্ছিরের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আপিল বিভাগ।

তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্ত, চার লাখ মা-বোনের সম্ভম এবং গোটা দেশের সহায়-সম্পদ হারানোর বিনিময়ে আমরা এই বাংলাদেশ পেয়েছিলাম। মহান জনযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে আমরা অর্জন করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সংবিধান। পেয়েছিলাম দেশ পরিচালনার চার মূলনীতি। এক সাগর রক্ত আর নজীরবিহীন ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে আমরা যে নীতি প্রতিষ্ঠিত করেছিলামÑ তা বাতিল করা বা পরির্বতন করার ক্ষমতা কারও ছিল না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শত্র“দের হয়ে সেই কাজটি করেছেন এক শ্রেণির বিচারপতি। তাদের হাতেই সংবিধানরক্ষার দায়িত্ব ছিল, অথচ তারাই সে সংবিধানকে হত্যা করেছেন। বিচাপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে সূচনা করেছেন কালো সেই অধ্যায়ের। এ কালো অধ্যায়ে যুক্ত হয়েছেন বিচারপতি এম এ সাত্তার, বিচারপতি মুনিম, বিচারপতি রউফ, বিচারপতি এম এ আজিজসহ অনেকে। বিচারপতি হয়ে তারা শপথ ভঙ্গ করেছেন, অবিচারকের ভূমিকা পালন করেছেন। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই শপথ ভঙ্গের যাত্রা শুরু হয়েছে। দেয়া হয়েছে, ১৫ আগস্ট থেকে সকল হত্যাকাণ্ড ও সামরিক ফরমান এবং সংবিধানের সংশোধনসহ অশুভ শক্তির সকল কাজের বৈধতা। এখানে কখনও হীন ব্যক্তিগত স্বার্থে, কখনও লোভে, কখনও উচ্চাভিলাষে, কখনও বন্দুক দেখে বিচারপতিরা হয়েছেন তাদের নীতি-নৈতিকতা-দায়-দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত। আর এর কারণেই সংবিধান রক্ষা হয়নি। তার বদলে হয়েছে সংবিধান ক্ষত-বিক্ষত। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত বিচারপতিরা ইতিহাসের সবচেয়ে যঘন্য ভূমিকা পালন করে দেশ ও জাতির মহাসর্বনাশ করেছেন।

আসলে এই শ্রেণির বিচারকরা বিচারকের পদে থেকেছেন বটে, কিন্তু তারা কখনই বিচারক হতে পারেননি। পারেননি বলেই তাদের গর্ভে জন্ম নিয়েছে একের পর এক বিচারক নামের অবিচারকরা। এদের কারণে গোটা জাতির জীবনে নেমে এসেছে যতো দূর্দশা। কিন্তু আজ এদের কি ছেড়ে দেওয়া উচিৎ? উচিৎ কি এদের আর বাঁচিয়ে রাখা? মনে হয়, এখন শিক্ষা নেবার সময় এসেছে। সময় এসেছে বিচারপতিদের বিচার করার, শাস্তি দেবার।

শেষ কথা হলো, যে পঞ্চম সংশোধনীতে সম্মতি দিয়ে বিচারকরা মুক্তিযুদ্ধের সংবিধানকে হত্যার লক্ষ্যে রক্তাক্ত-ক্ষত-বিক্ষত করেছিলেন, ’৭২-এর ঐতিহাসিক সংবিধানকে পরিবর্তন করেছিলেন। সেই কূখ্যাত পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ইতিহাসের পাতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন গৌরবে, সৌরভে এবং যুগান্তকারী হিসেবে। জাতি চিরকাল তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তাঁর মতো আরো অনেক রায় দিয়ে, বা বিচারকের ক্ষেত্রে যাঁরা দায়িত্বশীল ভূমিকা রেখেছেনÑ তাঁরাও চিরকাল সম্মান ও গৌরবের মানুষ হয়ে থাকবেন। হীনদের বিপরীতে মহানরাও আছেনÑ এটা তারই প্রমাণ। যাঁরা অসাংবিধানিক শাসনকে বে-আইনি বলেছেন, সামরিক শাসনকে নাকচ করেছেন, জাতিরজনক হত্যার বিচার করেছেন, ভবিষ্যতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেনÑ তারা বাঙালি জাতির অহংকার হয়ে থাকবেন। আর ধিকৃত হবেন বিচারকের আসনে বসে অবিচারকারীরা, বিচার করতে গিয়ে বিব্রত হওয়ারা।

তবে এখানে ধিক্কার দিয়ে, নিন্দা জানিয়ে, কিংবা কঠোর সমালোচনা করে বসে থাকলে কাজের কাজ কিছুই করা হবে না। যারা সরকারের আছেনÑ তাদের এখানে বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বার্থে কাজের কাজটিই করতে হবে। বিচার করতে হবে, শাস্তি দিতে হবে ওই ধিকৃতদের। এটাও আজকের অন্যতম প্রধান প্রত্যাশা।

[২৮ আগস্ট ২০০৯ ঢাকা, বাংলাদেশ]

আবুল হোসেন খোকন : সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট।