পদ্মরাগ

বেগম রোকেয়ার লেখা একমাত্র উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’ নারীবাদের বিভিন্ন ভাবনার প্রতিফলনের সাথে বাংলার লোক সংস্কৃতির অনেক স্বাক্ষর রয়েছে। সিদ্দিকা তথা পদ্মরাগ——— যার আসল নাম জয়নব বেগম রোকেয়ার নারীবাদী চেতনার এক বলিষ্ঠ্য প্রকাশ। এ উপন্যাসের পরিণতি পাঠককে ভাবায়, কাঁদায় ও চিন্তায় ভাসায় বৈকি? পদ্মরাগ ভাঙ্গে তবু মচকায় না। সে নিয়তিকে জয় করে রোকেয়ারই ইচ্ছা শক্তির জোরে। এ উপন্যাসে বিভিন্ন পরিচ্ছেদে ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে গেছে লোক জীবনের রীতি-নীতি, আদব- কায়দা, অভিজ্ঞতা ও চিন্তা-চেতনা।

‘গঙ্গাস্নান’ করে পবিত্র হওয়া আবহমানকাল ধরে হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিশ্বাস। এ বিশ্বাসের খবর অসাম্প্রদায়িক বেগম রোকেয়ার জানা ছিল বলেই সপ্তম পরিচ্ছেদে লিখেছেন—- “ ‘তারিণী-ভবন’ গঙ্গা— ইহাতে এক ডুব দিলেই সকলে পবিত্র হইয়া যায়।‘ গঙ্গাস্নানের সাথে সেবাশ্রমকে তুলনা করে লৌকিক জীবনবোধের জয়গান গেয়েছেন।

‘মহাভারত অশুদ্ধ করা’ নিয়ে প্রচুর লোকোক্তি রয়েছে যার প্রতিফলন দশম পরিচ্ছেদেঃ ‘ তুমি দ্বিতীয় বিয়ে করিলে মহাভারত অশুদ্ধ হইবে না’।

বাংলার সামন্ত সমাজের বলির শিকার লতীফ। লতীফের দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি হওয়ার অবস্থা বুঝাতে রোকেয়া বলিদানের ছাগল শব্দটি ব্যবহার করেছেন । কোরবানীর খাসী ও বলিদানের ছাগল সমার্থক শব্দ হলেও সচেতনভাবে বলিদানের ছাগল শব্দটি লেখার পেছনে তাঁর পাঠক হিসেবে কী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কথাই বিবেচনায় ছিল? অথবা তখনকার লোকজ সমাজ ধর্মভিত্তিক ভাষা চর্চা হয়তো আত্মস্থ করেনি।

পদ্মরাগের একাদশ পরিচ্ছেদে মনোবিশ্লেষণে প্রবাদ ব্যবহার করেছেন——- ‘বেল পাকিলে কাকের বাপের কি?’ য়ার আমরা বলি “গাছে বেল পাকিলে কাকের কি?’

বিভিন্ন অবস্থা বুঝাতে বিস্তৃত বর্ণনা না দিয়ে বহুল প্রচলিত বাগধারা ও প্রবাদ ব্যবহার করে সংক্ষেপেই পরিস্থিতি বুঝিয়েছেন, যেমন দ্বাদশ পরিচ্ছেদেঃ ‘ দিদির কথাই বেদবাক্য’, ‘শাপে বর।’ অথবা ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’ ।

চতুর্দশ পরিচ্ছেদে—— স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনেও ঊষা রাণীর শাঁখা পরা নিয়ে “ছাড়ব না হাতের শাঁখা, ঐটি সধবার নিশানা!” লোক বিশ্বাসের নমুনা; যা আরেকটি প্রবচন মনে করিয়ে দেয় –
‘স্বামী নাই পুত্র নাই কপাল ভরা সিঁন্দুর
বেড়া নাই দুয়ার নাই ঘর ভরা ইঁন্দুর।‘

মতিচুর দ্বিতীয় খন্ডের ‘জ্ঞানফল’ নামক রূপকথায় মতো বেগম রোকেয়া মহাভারতের রচনাশৈলীর অনুকরণে ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে দুই লাইন পয়ার লিখেছেনঃ
‘ হেলেন- বিবাহ কথা অনল যেমতি
ব্যথিতা সকিনা ভণে শুনে দয়াবতী।’

এখানকার ‘আরসী আনছি, কাঁকই আনছি। চুল বান্ধনের ফিতা আনছি!’ আরসী (আয়না), কাঁকই (চিরূণী) আর বান্ধন (বাঁধার) আঞ্চলিক শব্দত্রয় দিয়ে তৈরী বাক্যটিতে বেগম রোকেয়ার লোকভাষা ব্যবহারের নমুনা পাই ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে।

‘রাঁধা- উননে ফু-পাড়া আর কাঁদার’ চিত্র গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিকতার সাথে সম্পৃক্ত।

বেগম রোকেয়া তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের সংলাপে প্রবাদ, প্রবচন ব্যবহার করে চর্রিত্রগুলোকে আমাদের আপন করিয়ে ছেড়েছেন। যেমনঃ ষোড়শ পরিচ্ছেদেঃ ‘উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে’ চাপানোর চর্চার উদাহরণ তো আমাদের সমাজে যত্রতত্র।

তাছাড়াও,রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিণী লোকজীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বলেই রোকেয়া তাঁর উপন্যাসের সপ্তদশ পরিচ্ছেদের চরিত্রের সংলাপ—
চারুঃ ‘ আমি দশভুজা দূর্গা হইলে বেশ হইত!’’
পাল্টা সংলাপ—-
ঊষাঃ ‘আমি কিন্তু দশমুন্ড রাবণ হইতে চাই– তাহা হইলে এক একটা মাথাকে এক একটা বিষয় চিন্তা করিবার ভার দিতাম!’

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ রোকেয়ার যাপিত জীবনের আশপাশ থেকেই নেয়া প্রবচনঃ
‘পন্ডিতে বুঝিতে পারে দু’ চারি দিবসে,
মুর্খেতে বুঝিতে নারে বৎসর চল্লিশে।‘

লোকোক্তিতে সংস্কৃত ব্যবহারও ছিল পরিচিত প্রচলন। দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদে একটি লোকোক্তির ব্যবহার——- ‘মৌনং সম্মতি- লক্ষণং’ বলিয়া ধরা পড়িবেন।’
চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদে নদীমাতৃক বাংলাদেশের লোকের নদীর জল পরিমাপের লোকাভিজ্ঞতার ফলাফল “হরে দরে হাঁটু জল’ বাক্যটি।

“ঢেঁকির আর অন্য কাজ কি আছে?’——— সংলাপটি ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানা ছাড়া যে কাজ নেই প্রবাদটিই মনে করিয়ে দেয়।

সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদে বেগম রোকেয়া তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ইহজাগতিক চেতনার পরিবর্তে লৌকিক জীবনাচারকে——— লোক বিশ্বাসকে তুলে ধরেছেন। এটি হয়তো বা চরিত্র উপস্থাপনের স্বার্থে –সৃষ্ট চরিত্রকে বাস্তবানুগ করতেই করেছেনঃ
‘সতীর দেবতা, পতি জীবনের সার,
তেঁই যাচি পূজিবারে চরণ তোমার’

অন্যান্য লেখা
‘ভ্রাতা- ভগ্নী’ লেখাটি সংলাপ নির্ভর। এক ভাই ও দুই বোনের কথোপকথনে অনেকগুলো প্রবাদ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনঃ
“ টাকা হইলে বাঘের দুধ পাওয়া যায়।“
“ গোষ্ঠির নিকট ফষ্ঠি’’
‘পুত্রের স্নেহ ততদিন পর্যন্ত, যে পর্যন্ত সে স্ত্রীলাভ না করে, আর কন্যার স্নেহ কখনও হ্রাস হয়না।’
‘যেখানে বাঘের ভয়, সেইখানে রাত হয়’
“তুমি আর ক্ষীরে লুন দিও না।“
‘এ নেড়ামাথা লইয়া বেলতলায় আর যাইব না।‘
‘ধরাখানা সরা হেন দেখ’
‘বাহুবলই বল’
‘পড় বাবা মতীজান’
‘নীলকন্ঠের ন্যায় সে বিষ কণ্ঠে ধারণ করিতে হইবে’——– শেষেরটি পৌরাণিক কাহিনীর উদাহরণ।

তাছাড়া, ‘তিন কুড়ে’ নামক গল্প যে আমাদের লোক গল্প তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

‘পরী ঢিবি’ গল্পে রূপকথার মোড়কে রকউড কলেজের ছাত্রীদের পরী হিসেবে উপস্থাপন করে বেগম রোকেয়া পাহাড়ের উপত্যকায় তাদের স্বাধীনভাবে পিকনিক উপভোগের চিত্র এঁকেছেন। এও তাঁর নারীর স্বাধীন সত্ত্বা প্রকাশের এক ধরণের কলা কৌশল যা লোকসাহিত্য ভান্ডারের রত্নের আভা নিয়ে নিজের অলংকারে বসিয়েছেন।

লোক সাহিত্য মাত্রই ব্যক্তির সৃষ্টি সমষ্টির সম্পদে পরিণত হয়। ব্যক্তির মালিকানা জাতীয় ঐতিহ্যে বিলীন হয়ে জাতীয়ভাবেই এর অংশীদারিত্ব থাকে। এর অস্তিত্ত্ব মৌখিকভাবে জন থেকে জনে বিস্তৃতি ঘটে। লোক অনুষ্ঠানে লোকের মুখে মুখে ব্যবহৃত হয়,গীত হয়, লোকের অন্তরে অন্তরে প্রীত হয় এ সাহিত্য। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এ সব সংগ্রহের ও এর লিখিত রূপ দেয়ার উদ্যোগ চলছে। বিশেষ করে ঊনিশ শতকে এর জোয়ার এসেছিল। আর জোয়ারের জল বেগম রোকেয়ার মনও হয়তো বা ভিজিয়েছিল।

অনেক লেখক নিজেদের রচনায় প্রাসঙ্গিকভাবে লোক প্রবাদ, প্রবচন, ছড়া,গাঁথা, গল্প, লোকোক্তি ব্যবহার করে এদের শাশ্বত আবেদনকে প্রাকৃত জীবন থেকে নাগরিক সমাজে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে দিয়েছেন। বেগম রোকেয়ারও তাঁদেরই একজন এবং এ সবের বিস্তৃততে তাঁর অবদান আমাদের অন্তরে বিরাজমান থাকবে। তিনি লোক সংস্কৃতি ও লোক জীবনের জারিত রসে আন্দোলিত ও উদ্বেলিত হয়েছিলেন।

শেষ।