এত রক্ত কেন ?

গত ১৮ আগস্ট বাঁকুড়া জেলার সারাঙ্গপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে প্রতি বছরের মত এবারও মনসা পুজো উপলক্ষ্যে পশুবলি সঙ্ঘটিত হল। মানভুমের জেলাগুলিতে মনসা পুজোয় পশুবলি সেরকম কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা নয়। হাজার হাজার মনসার থানে লাখে লাখে পাঁঠা, ভেড়া, মুরগি, হাঁস বলি দেওয়া হয়ে থাকে। আর সারা বছরে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কত কোটি পশু বলি হয় তার ইয়ত্তা নেই। সমস্যাটি হয়ে ছিল এবারে। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় যেখানে ছোটো ছোটো শিশুরা পড়াশোনা করে সেখানে পশুবলির মত নৃশংস অপরাধটি কেন হবে এই প্রশ্ন নিয়ে যুক্তিবাদী সমিতির তরফ থেকে ঐ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে চিঠি দেওয়া হয় ১ লা আগস্ট। সাথে সাথে পশুবলি বন্ধ করে ভারতীয় আইনকে মান্য করার অনুরোধও জানানো হয় ওই চিঠিতে। চিঠির প্রতিলিপি পাঠানো হয় নিত্যানন্দপুর গ্রাম পঞ্চায়েত, গঙ্গাজলঘাটি থানা, গঙ্গাজলঘাটির বিডিও, বাঁকুড়া জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শককে। যুক্তিবাদী সমিতির লক্ষ্য ছিল এই লড়াইটিকে একটি দৃষ্টান্ত রূপে তৃলে ধরে বাকি ক্ষেত্রে পশুবলির বিরুদ্ধে লড়া। চিঠি পাওয়া মাত্রই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গ্রামের ষোলোআনার মাতব্বরদের সাথে আলোচনায় বসে। রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট সেই মাতব্বরদের রায় পুজো এবং পশুবলি যেমন হচ্ছিল তেমনই হবে কোন নড়চড় হবেনা। গত কয়েক বছরে ওই এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমিতির ভালোই ‘বেস’ তৈরি হয়েছিল যার ফলে গাঁয়ের যুব সম্প্রদায়ের একাংশ পশুবলির বিপক্ষে। কিন্তু প্রতাপশালী মোড়ল শ্রেনীর রক্তচক্ষু প্রদর্শনের কাছে তারা নেহাতই শিশু। যুক্তিবাদী সমিতির তরফ থেকে থানায় যোগাযোগ করা হলে থানা জানিয়ে দেয় তারা এ বিষয়ে কিছু করতে অপারক। বেশ, ধরা হল এলাকার উদ্যোগী বিডিওকে। বিস্তর আলোচনার পর বিডিও সাহেবও পিছপা হলেন। বিদ্যালয় পরিদর্শক, গ্রাম পঞ্চায়েত সর্বত্রই চালাকি করে পিছলে যাওয়া উত্তর। একটি বে-আইনী এবং সামাজিক অপরাধ বন্ধ করতে প্রশাসনের দরজায় দরজায় বারে বারে হত্যে দেওয়ার পরেও যুদ্ধটি শেষ হল একরাশ হতাশাকে সম্বল করে।
তন্ত্রে বলা হয়েছে, দেহস্থ আত্মা উষ্ণ শোনিতের দ্বারা সঞ্জীবিত থাকেন; শোনিত ঠান্ডা হইলে আত্মাকেও দেহ ত্যাগ করিতে হয়; সুতরাং আত্মাকে ভোগ দিতে হলে উষ্ণ শোনিতই সর্বোৎকৃষ্ট ভোগ। মুন্ডমালাতন্ত্র ও বৃহৎসারতন্ত্রে আছে, শক্তির উদ্দেশ্যে ছাগ বলি দিলে বাগ্মী হয়, মেষ বলি দিলে কবি, মহিষ বলিতে সম্পদ বৃ্দ্ধি, মৃগ বলি দিলে মোক্ষফল ভাগী হওয়া যায়, গোধিকা বলি দিলে মহাফল লাভ করা যায়, নরবলি দিলে মহাসমৃদ্ধি লাভ হয়, অষ্টসিদ্ধির অধিকারী হওয়া যায়। বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, সৌর এবং গাণপত্য-হিন্দু ধর্মের এই পাঁচটি ধারার মধ্যে কেবলমাত্র শাক্তদের মধ্যে বলির রেওয়াজ আছে। ভারতীয় ইসলামীদের মধ্যে শিয়া এবং সুন্নি দুই সম্প্রদায়ই বকরিদের সময় গরু, উঁট, দুম্বা কুরবানি দেয়। ধর্মের ধ্বজাধারীরা প্রচার করে থাকেন, ধর্মীয় কারনে পশুবলি দিলে মানসিক শক্তির বিকাশ হয়। তারা যুক্তি রূপে টেনে আনেন তন্ত্রের কথা। অথচ পুজোর নামে এই নৃশংস প্রথা কোনো ভাবেই মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করেনা বরং দুর্বল এবং অবলা প্রানীদের যে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় এতে খুনী মানসিকতার জন্ম নেয়। বিশেষত শিশুমনে বলিপ্রথার কু প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এ থেকে মানসিক রোগ, ভীতি, হিংস্রতা বৃদ্ধি, নিদ্রাহীনতা হতে পারে। সারা পৃ্থিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের এমনটাই অভিমত। আমাদের আলোচ্য বিদ্যালয়টির শিশুগুলি মনের ওপর কি ঘটছে তা সহজেই অনুমেয়।
এখন দেখা যাক ধর্মীয় কারনে পশুবলির বিরুদ্ধে আমাদের দেশের আইন কি বলছে?
The prevention of cruelty to animals act, 1960 অনুসারে, প্রকাশ্যে পশুবলি নিষিদ্ধ। কোন প্রত্যক্ষদর্শী ওই বলির বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জানালে মন্দিরের পূরোহিত সমেত পূজো কমিটির কর্মকর্তা ও বলি দানে অংশগ্রহনকারীদের গ্রেপ্তার করা হবে। আবার Wild life protection act অনুসারে যে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী প্রানী হত্যা দন্ডণীয় অপরাধ। জেল এবং জরিমানা দুটোই হতে পারে। Public nuisance act অনুসারে কোনো ব্যক্তির চোখের সামনে বলি দেওয়া যায় না।
ভাবলে অবাক হতে হয়, পশুবলির বিরুদ্ধে এতগুলি জোরালো আইন থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত আমাদের দেশে দুর্গা, কালি, মনসাপুজো, ইদের কুরবানীর সময় কত কত পাঁঠা, ভেড়া, গরু, উঁট নির্বিচারে বলি দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে উঁটের মত একটি বিরল প্রজাতির প্রানীকে কুরবানির সময় অকারনে হত্যা করা পরিবেশের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক। আর দেশের নির্লজ্জ সরকার ধর্মের দোহায় দিয়ে এইসব বে-আইনী প্রথাকে পশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে ভারতীয় আইন ব্যবস্থাকে কদর্য রূপে বলাৎকার করছে। স্বাধীনোত্তর ভারতে কোনোদিনই সরকার আইনগুলিকে বাস্তবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেনি। এক্ষেত্রে বামপন্থী ডানপন্থী সব শেয়ালেরই এক রা। আমাদের রাজ্যে ৩২ বছর একটি কমিউনিষ্ট সরকারের শাসন চলার পরেও পশুবলি বন্ধে প্রশাসনিক স্তরের কোনো উদ্যোগ নেই। বরং তাদের জমানায় প্রতিটি থানায় বামপন্থী পুলিশ ইউনিয়নের উদ্যোগে ফি বছর ঘটা করে কালি পুজো হয় যাতে পশুবলিও হয়ে থাকে। গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় কমিউনিষ্ট নেতাদের পরিচালনায় হয়ে থাকা পুজ়োয় শয়ে শয়ে প্রানী হত্যা হয়ে থাকে। তাতে তাগা-তাবিজ-আংটি ধারী মার্কসবাদী বুলি কপচানো কমিউনিষ্ট নেতাদের ‘জয় মা’ ‘জয় মা’ ধ্বনিও শোনা যায়। কতদিন? আর কতদিন এমন ভন্ডামি চলবে? রাজ্যের মানুষ কী এতই বোকা? চিরটা কাল প্রতারনা সহ্য করে যাবে? এই প্রতারকদের ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলার দিন কি এখন আসেনি?
কোনো এক কালে নরবলির প্রচলন ছিল, সতীদাহপ্রথা ছিল। শুধুমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধিতে এই প্রথাগুলি দূর হয়নি, হয়ওনা। জনসচেতনতা এবং কঠোর আইনের সঠিক প্রয়োগে এই কুপ্রথাগুলিকে আমরা প্রায় বিদায় করতে পেরেছি। কিছু কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে আইনের যথাযথ প্রয়োগ একান্তই জরুরী, যেমন- দূষণরোধ, চোলাইঠেক বন্ধে, ডাইনিপ্রথা রোধ, পশুবলি রোধ ইত্যাদি। আমাদের সরকার সব গুলি ক্ষেত্রেই পরাজিত। উলটে আমাদের মত যে সব সংঘঠন জনসচেতনতার কাজটুকু করতে যায় তারা প্রশাসনিক উদাসীনতা এবং রাজ্যের শাসক দলের সরাসরি বিরোধীতার শিকার হয়। তবুও আশা ছাড়া যায় না। একবুক আশা নিয়েই বর্ধমানের বিখ্যাত সর্বমঙ্গলা মন্দিরে ২০০৫ সালে গিয়েছিলাম, যেখানে ৩০০ ওপর পাঁঠা বলি হত সেবার সংখ্যাটি নেমে এসেছিল ২০ টি তে। কমলাকান্ত কালিবাড়ির ২০ টি পশুবলি কমে দাঁড়িয়েছিল ২ টি তে। রক্ষাকালিবাড়িতে কর্তৃপক্ষ পোস্টার দিলেন ‘জনমতের কারনে এবার বলি বন্ধ করা হল’। রবীন্দ্রনাথও তো বলিপ্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন। আমাদের হয়েই লিখে গেছেন বিসর্জনের মত নাটক। শুধুমাত্র ২৫ বৈশাখ আর ২২ শ্রাবনে গদগদ ভঙ্গিতে কবিতা পাঠেই তাঁকে সম্মান জানানো শেষ হয়ে যায়? তাঁর চিন্তা ধারাকে সম্মান জানাতে আমরা এটুকু করতে পারিনা?