বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান ও যৌনতার নির্বাচন

মানব প্রকৃতির জৈববিজ্ঞানীয় ভাবনা -৩

 

 

অভিজিৎ রায়

 

ূর্ববর্তী পর্বের পর…

 

সংস্কৃতির ভুত’:

 আগেই বলেছি বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান সমাজ এবং সংস্কৃতির অনেক কিছু খুব পরিস্কার এবং বোধগম্যভাবে ব্যাখ্যা করলেও এর অনেক উপসংহার এবং অনুসিদ্ধান্ত এতই বিপ্লবাত্মক যে এটি অবগাহন করা সবার জন্য খুব সহজ হয়নি, এখনো হচ্ছে নাএর অনেক কারণ আছে কিছু কারণ আগের পর্বে ব্যাখ্যা করেছিএর মধ্যে একটা কারণ আমাদের মধ্যেকার জমে থাকা দীর্ঘদিনের সংস্কার।  

তবে ওটাই একমাত্র কারণ নয়  বিতর্কের মুল কারণ খুঁজলে দেখা যাবে, বিতর্কটা যতটা না সংস্কারের জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত অনুকল্প আর এর থেকে পাওয়া বিভিন্ন অনুসিদ্ধান্তের কারণে।             

মূল বিতর্কটা নিঃসন্দেহে মানব মনের স্বরূপ নিয়ে।  বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা রঙ্গমঞ্চে হাজির হবার আগে সার্বজনীন মানব প্রকৃতি বলে কিছু আছে কিনা সেটাই ঠিকমত আমাদের কাছে পরিস্কার ছিলো নাযেমন, স্প্যানিশ লিবারেল দার্শনিক হোসে ওর্তেগা গ্যাসেট মানব প্রকৃতির অস্তিত্ব অস্বীকার করে বলতেন, Man has no nature, what he has is history’ব্রিটিশ-আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ অ্যাশলে মন্টেগু বলতেন, মানুষের সহজাত স্পৃহা (instinct) বলে কিছু নেই; কারণ তার সব কিছুই তার চারপাশের সমাজ-সংস্কৃতি থেকেই শেখা।  কেউ বা আবার মানব প্রকৃতিকে স্বীকার করে নিলেও তাকে একেবারেই কাঁচামালের মত আদিম মনে করতেনযেমন প্রখ্যাত নৃতাত্ত্বিক মার্গারেট মীড বলতেন, Human nature is the rawest, most undifferentiated of raw material। 

বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা এসে মানব প্রকৃতি নিয়ে এই প্রচলিত ছকটিকেই উলটে দিয়েছেন ব্যাপারটা একটু খোলসা করা যাক।  একজন শৈলচিকিৎসক যখন হাসপাতালে অপারেশনের জন্য আসা কোন রোগীর পেটের ভিতর ছুরি চালাবেন বলে ঠিক করেন তখন তিনি জানেন যে,  পেট কাটলে এর ভিতরে কি পাওয়া যাবে।  পাকস্থলি, বৃহদান্ত্র, ক্ষুদ্রান্ত্র, অগ্ন্যাশয় ইত্যাদি।  পাকস্থলির জায়গায় পাকস্থলি থাকে, আর অগ্ন্যাশয়ের জায়গায় অগ্ন্যাশয়অন্য রোগীর ক্ষেত্রেও পেট কেটে চিকিৎসক পাকস্থলির জায়গায় পাকস্থলি দেখবার প্রত্যাশাই করেনএটাই স্বাভাবিক বিভিন্ন রোগীর পাকস্থলিতে পার্থক্য থাকতে পারে কারোটা মোটা, কারোটা চিকন, কারোটা দেখলেই হয়ত বোঝা যাবে ব্যাটা আমাশা রুগি, কারোটা আবার স্বাস্থ্যকরবৈশিষ্ট্যে পার্থক্য যাই থাকুক না কেন, মানুষের পাকস্থলি দেখে কারো গরুর কিংবা ঘোড়ার পাকস্থলি বলে ভুল হবে নাকারণ মানুষের পাকস্থলির একটা প্রকৃতি আছে, যেটা গরুর পাকস্থলি থেকে আলাদা আমি অবশ্য গরুর পাকস্থলি বিশেষজ্ঞ নই, যিনি বিশেষজ্ঞ যেমন পলাশি বাজারের সলিমুল্লাহ কসাই- তিনি খুব ভাল করেই আমাদের দেখিয়ে দিতে পারবেন গরুর পাকস্থলি কেমন হয়, খাসিরটা কেমন, ভেড়ারটা কেমন আর মুরগীরটা কেমন।  ঠাটারিবাজারের নিত্যানন্দ কসাই হলে তার লিস্টে শুয়োরের পাকস্থলিও চলে আসতে পারে।  সলিমুল্লা কিংবা নিত্যানন্দ কসাইয়ের অভিজ্ঞ চোখকে খাসির পাকস্থলির নামে শুয়োরের পাকস্থলি বলে চালানোর চেষ্টা করে ধোঁকা দেয়া যাবে না।  কারণ তারা জানেন, খাসির পাকস্থলির প্রকৃতি শুয়োরেরটা থেকে সম্পূর্ণ আলাদাএকই কথা মানুষের পাকস্থলির জন্যও প্রযোজ্যএকথা বলা ভুল হবে না যে, মানুষের পাকস্থলির প্রকৃতিই অন্যপ্রানীর পাকস্থলি থেকে তাকে আলাদা করে দিচ্ছে।   

বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, পেটের ভিতরে পাকস্থলির যেমন একটা প্রকৃতি আছে, তেমনি মানুষের মনেরও আলাদা একটা প্রকৃতি আছে যেটা অন্য প্রানী থেকে আলাদাউদাহরণ দেয়া যাকমানুষের খুব কাছাকাছি প্রজাতি শিম্পাঞ্জী শিম্পাঞ্জীর সাথে মানুষের জিনগত মিল শতকরা ৯৯ ভাগকাজেই ধরে নেয়া যায় শিম্পাঞ্জীর সাথে মানুষের অনেক কিছুতেই মিল থাকবেকিন্তু যতই মিল থাকুক না কেন –  সার্বজনীনভাবে মানব প্রকৃতি শিম্পাঞ্জীর প্রকৃতি থেকে আলাদা হবে বলে আমরা ধরে নিতে পারি, অনেকটা উপরের উদাহরণের পাকস্থলির প্রকৃতির মতই কিছু উদাহরণ হাজির করিশিম্পাঞ্জী সমাজে মেয়ে শিম্পাঞ্জীরা বহুগামী হয় তারা যত ইচ্ছা ছেলেদের সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের আসলেই কোন বাছ বিচার নেইপুরুষ শিম্পাঞ্জীরা আবার অন্য মেয়ে শিম্পাঞ্জী (যাদের সাথে এখনো দৈহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় নাই) তাদের বাচ্চাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে।  এ ধরণের কোন প্যাটার্ন আমাদের মানব সমাজে চোখে পড়ে নাচোখে না পড়াই স্বাভাবিক, কারণ মানুষের প্রকৃতি শিম্পাঞ্জীদের প্রকৃতি থেকে আলাদা 

বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীদের কথামত আমরা জানলাম মানব প্রকৃতি বলে একটা কিছু তাহলে আছে, যেটা অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা কিন্তু কেমন সে প্রকৃতি? সমাজ বিজ্ঞানী  কিংবা নৃতাত্ত্বিকরা অনেকদিন ধরেই এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন, তা আমরা জানিতারা বলেন এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে মানব সমাজের সংস্কৃতিতেসমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা এমিল ডার্খেইম কোন সার্বজনীন মানব প্রকৃতির জন্মগত প্রকরণকে অস্বীকার করে তাকে ব্ল্যাঙ্ক স্লেটের সাথে তুলনা করেছিলেন।  তার মতে সাংস্কৃতিক বিভাজনই মানব প্রকৃতিকে তুলে ধরার একমাত্র নিয়ামককাজেই মানব প্রকৃতি বিষয়ে যে প্রশ্নই করা হোক না কেন এর উত্তর আমাদের খুঁজে নিতে  হবে সংস্কৃতিতেমেয়েদের তুলনায় ছেলেরা বেশি সহিংস কেন  – এর উত্তর হল – সংস্কৃতিই এর কারণছেলেরা কেন সত্তুর বছরের বুড়ির চাইতে বিশ বছরের ছুঁড়ির প্রতি বেশি আকর্ষিত বোধ করে কিংবা লালায়িত হয় এর উত্তর হচ্ছে সংস্কৃতি।  ছেলেরা কেন মেয়েদের চেয়ে বেশি পর্ণগ্রাফি দেখে, কিংবা বহুগামী উত্তর একটাই সংস্কৃতি! Omnia cultura ex cultura! 

সমাজবিজ্ঞানের পুরোধা এমিল ডার্খেইম যে ইটের গাথুঁনি দিয়ে গিয়েছিলেন তাতে সংস্কৃতির প্রাসাদ বানাতে এবারে এগিয়ে এলেন নৃতাত্ত্বিকেরানৃতত্ত্ববিদের জনক বলে যাকে অভিহিত করা হয় সেই – ফ্রানজ বোয়া এবং মার্গারেট মীড ছিলেন এদের মূল কান্ডারী ফ্রানজ বোয়া যে মতবাদ প্রচার করলেন তাতে সকলের মনে হল, মানুষের প্রকৃতি বুঝি একেবারেই নমনীয়এতে জন্মগত কোন বৈশিষ্ট্যের কোন ছাপ নেই, কোনদিন ছিলোও নাসব কিছুই সংস্কৃতিনির্ভরআর বোয়ার প্রিয় ছাত্রী  নৃতত্ত্বের রাণী মার্গারেট মীড আদিম স্যামোয়া জাতির মেয়েদের নিয়ে এমন এক আদর্শিক  সমাজ কল্পণা করে ফেললেন, যার বাস্তব অস্তিত্ব আসলে পৃথিবীর কোথাওই নেই।  মিডের স্যামোয়া যেন আক্ষরিক অর্থেই হচ্ছে স্বর্গের প্রতিরূপসেখানে কারো মধ্যে নেই কোন ঝগড়া,  নেই কোন ঘৃণা,  ঈর্ষা কিংবা হিংসাযৌনতার ক্ষেত্রে তাদের আচরণ  একেবারে স্বতস্ফুর্ত সেখানকার মেয়েরা বহুগামী, যৌনতার ব্যাপারে পুরোপুরি স্বাধীন যখন ইচ্ছে স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে প্রিয় মানুষের সাথে সম্পর্ক করে নিতে পারেতারা স্বাধীনভাবে যেটা চায় সেটা করতে পারেমীডের অনুকল্প ছিলো, স্যামোয়া জাতির সংস্কৃতিই তাদের মেয়েদের এমন স্বতস্ফুর্ত আর স্বাধীন করে তুলেছেএ থেকে মীড সিদ্ধান্তে আসেন, বংশগতি নয় বরং সংস্কৃতিই ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে   মার্গারেট মীড তার চিন্তাধারা ব্যক্ত করে ১৯২৮ সালে  ‘Coming of Age in Samoa’ নামের যে গ্রন্থ রচনা করেন সেটি সংস্কৃতিভিত্তিক প্রাসাদের এক অগ্রগন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হয় কিন্তু পরবর্তীতে ডেরেক ফ্রিম্যানসহ অন্যান্য গবেষকদের গবেষণায় প্রমানিত হয় যে, মীডের অনুকল্পগুলো স্রেফ উইশফুল থিংকিং ছাড়া আর কিছু ছিলো না গবেষকেরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে,  মীডের গবেষণা ছিলো একেবারেই সরল এবং মীড স্যামোয়ান মেয়েদের দ্বারা নিদারূণভাবে প্রতারিত হয়েছিলেনফ্রিম্যানের গবেষণা থেকে বেরিয়ে এলো, স্যামোয়ান্ জাতির মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, ঘৃণা, হত্যা লুন্ঠন- আর দশটা জাতির মতই প্রবলভাবে বিদ্যমান, সরলমনা মীড সেগুলো দেখতেই পাননিসেজন্যই ম্যাট রীডলী তার এজাইল জিন বইয়ে মীডের গবেষণা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেন, ‘Her failure to discover the cultural determinism of human nature is like the dog that failed to bark’ 

আসলে সংস্কৃতির বিভাজনের কথা ঢালাও ভাবে সাহিত্য, সংস্কৃতিতে আর নৃতত্ত্বে উল্লিখিত হয় বটে, কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় এই বিভাজন মোটেই বস্তুনিষ্ঠতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয় নাব্যাপারটা নৃতত্ত্ববিদ আর সমাজবিদদের জন্য এক নিদারূন লজ্জার ব্যাপারএকটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, সংস্কৃতির যত বিভাজনই থাকুক না কেন, প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই দেখা যায়, মানুষেরা একইভাবে রাগ অনুরাগ, হিংসা, ক্রোধ প্রকাশ করে থাকেপশ্চিমা বিশ্বের আলো ঝলমলে তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা থেকে শুরু করে পৃথিবীর আনাচে কানাচে যত গহীন অরন্যের যত নাম না জানা গোত্রের মধ্যেই অনুসন্ধান করা হোক না কেন দেখা যাবে নাচ, গান, ছবি আঁকার ব্যাপারগুলো সব সংস্কৃতিতেই কম বেশি বিদ্যমানকেউ হয়ত গুহার পাথরে হরিণ শিকারের ছবি আঁকছে, কেউ পাথরে খোদাই করে মূর্তি বানাচ্ছে, কেউ নদীর ধারে বসে পাল তোলা নৌকাকে ক্যানভাসে উঠিয়ে আনছে, কেউবা আবার মাটির পটে গড়ে তুলছে অনবদ্য শিল্পকর্ম।   সংস্কৃতির বিবিধ উপাদান যোগ হবার কারণে ব্যক্তি কিংবা সংস্কৃতিভেদে চিত্রকল্পের প্রকাশ ভঙ্গিতে হয়ত পার্থক্য আছে কিন্তু চিত্র প্রকাশের বিমূর্ত স্পৃহাটি সেই একই রকম থেকে যাচ্ছেশুধু ছবি আঁকা নয়, নাচ-গানের ক্ষেত্রেও আমরা তাই দেখবএক দেশে কেউ একতারা হাতে বাউল গান গেয়ে চলছে তো আরেকজন অন্য দেশে নিবিষ্ট মনে পিয়ানো বাজিয়ে চলছেকেউবা চোখ মুদে সেতার বাজাচ্ছে তো কেউবা গিটার কিংবা কেউ সন্তুরযে একেবারেই আলসে সে হয়ত পড়াশুনা করার টেবিকেই ঢোল বানিয়ে তাল ঠুকছে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথেএক সংস্কৃতিতে কেউ হয়ত ডিস্কো নাচ  নাচছে, অন্য জায়গায় সেরকমই একজন কেউ ভরত নাট্যম, আরেক জায়গায় কেউ ল্যাটিন ফিউশন, কেউবা কোন অচেনা ট্রাইবাল ড্যান্সনাচের রকম ফেরে কিংবা মূদ্রায় পার্থক্য থাকলেও সংস্কৃতি নির্বিশেষে নাচ-গানের অদম্য স্পৃহাটি কিন্তু এক সার্বজনীন মানব প্রকৃতিকেই উর্ধ্বে তুলে ধরছেএই ব্যাপারটির তাৎপর্য উপলব্ধি করেই ডি.ই ব্রাউন তার ‘Human Universals’ গ্রন্থে বলেছেন It is the human universals not the differences that are truly intriguing।   

 

নারী ও পুরুষ:

আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা আরো বলেন, ডারউইনের সেক্সুয়াল সিলেকশন বা যৌনতার নির্বাচন বিবর্তন প্রক্রিয়ায় মূল ভূমিকা রেখে থাকে তবে এর একটি প্রভাব আমাদের দীর্ঘদিনের মানসপট নির্মাণেও অবশ্যাম্ভাবীরূপে পড়বেযৌনতার উদ্ভবের কারণে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে নারী-পুরুষ একই মানব প্রকৃতির অংশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হয়ছে এক ধরণের মনোদৈহিক পার্থক্য জৈববৈজ্ঞানিক পথেইনারীদের জননতন্ত্রের প্রকৃতি পুরুষদের জননতন্ত্র থেকে আলাদামেয়েদেরকে যে ঋতুচক্র, নয়মাস ব্যাপী গর্ভধারণসহ হাজারো ঝুট-ঝামেলা পোহাতে হয় পুরুষদের সেগুলো কোনটিই করতে হয় নাএকটি পুরুষ, তাত্ত্বিকভাবে হলেও যে কোন সময়ে এই পৃথিবীর বুকে অসংখ্য নারীর গর্ভে অসংখ্য সন্তানের জন্ম দিতে পারে (কুখ্যাত চেঙ্গিস খানের মত কেউ কেউ সেটা করে দেখিয়েছেও)কিন্তু একটি মেয়ে একবছরে শুধু একটি পুরুষের শুক্রানু দিয়েই গর্ভ নিশ্চিত করতে পারে এর বেশি নয়আসলে কেউ যদি বলেন, জৈববৈজ্ঞানিক দিক থেকে বিচার করলে যৌনতার উদ্ভবই হয়েছে আসলে নারী-পুরুষে পার্থক্য করার জন্য এটা বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না এই পার্থক্যের প্রভাব ছেলে মেয়েদের মানস জগতেও  পড়েছে, পড়েছে সমাজেও।  কোন গবেষকই এখন অস্বীকার করেন না যে যৌনতার বিভাজন নারী পুরুষে গড়ে দিয়েছে বিস্তর পার্থক্য শুধু দেহ কাঠামোতে নয়, তার অর্জিত ব্যবহারেও।   সেজন্যই গবেষক ডোনাল্ড সিমন্স বলেন, 

Men and women differ in sexual natures because throughout the immensely long haunting and gathering phase of evolutionary history of sexual desires and dispositions that were adaptive for either sex were for either sex were for the other tickets to reproductive oblivion.

 মানব সভ্যতার যে কোন জায়গায় খোঁজ নিলে দেখা যায় – ছেলেরা সংস্কৃতি নির্বিশেষে মেয়েদের চেয়ে চরিত্রে বেশি ভায়োলেন্ট বা সহিংস হয়ে থাকে, মেয়রা বাচনিক যোগাযোগে (ভার্বাল কমিউনিকেশন) ছেলেদের চেয়ে বেশি পরিপক্ক হয়পলিগামি বা বহুগামীত্বের ব্যাপারটা মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের মধ্যে অধিকতর প্রবলভাবে দৃশ্যমানসম্পর্কের মধ্যে প্রতারণা বা চিট্‌ ব্যাপারটাও কিন্তু মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা বেশি করে থাকেআবার মেয়েরা প্রতারণা ধরতে অধিকতর দক্ষ।  পর্নোগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের মধ্যে বেশিকিন্তু মেয়েরা আবার ছেলেদের তুলনায় লাভ স্টোরিরর বেশি ভক্তসিরিয়াল কিলারের সংখ্যা ছেলেদের মধ্যে বেশি, মেয়েদের মধ্যে খুবই কম সংস্কৃতি নির্বিশেষে পুরুষদের টাকা পয়সা, স্ট্যাটাস ইত্যাদর মাপকাঠিতে বিচার করা হয়, আর মেয়েদের সৌন্দর্যেরনৃতত্ত্ববিদ মেলভিন কনোর খুব পরিস্কার করেই বলেন  

ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বেশি সহিংস, আর মেয়েরা অনেক বেশী সংবেদনশীল অন্ততঃ শিশু এবং নাবালকদের প্রতিএই ব্যাপারটা উল্লেখ করলে একে যদি গতানুগতিক কথাবার্তা (cliché) বলে কেউ উড়িয়ে দিতে চান সেটা এ সত্যকে কিছুমাত্র দমন করবে না 

ব্যাপারগুলো সঠিক নাকি ভুল, কিংবা উচিৎ নাকি অনুচিৎ সেটি এখানে বিচার্য নয়, বিচার্য হচ্ছে আমাদের সমাজ কেন এইভাবে গড়ে উঠেছে – যে সংখ্যাগরিষ্ট মন মানসিকতা একটি নির্দিষ্ট ছকে সবসময় আবদ্ধ থাকে? এখানেই মানব প্রকৃতি বিশ্লেষণে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান যতটা সফল, সমাজবিজ্ঞান ততটা নয় 

কেন সংস্কৃতি-নির্বিশেষে ছেলেরা সম্পর্কের মধ্যে থাকা অবস্থায় তার সঙ্গীর সাথে বেশি প্রতারণা করে কিংবা কেন পর্ণগ্রাফির বেশি ভক্ত – এটি জিজ্ঞাসা করলে সমাজবিজ্ঞানী কিংবা নারীবাদীদের কাছ থেকে নির্ঘাত উত্তর পাওয়া যাবে যে, যুগ যুগ ধরে মেয়েদের সম্পত্তি বানিয়ে রাখা হয়েছে, তারা শোষিত – এই মনোবৃত্তি তারই প্রতিফলনকিন্তু যে সমস্ত সমাজে ছেলে-মেয়েদের পার্থক্যসূচক  মনোভাবের মাত্রা কম – সেখানে কি তাহলে এ ধরণের ঝোঁক নেই? না তা মোটেও নয় এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে ইসরায়েলের কিবুৎজ (Kibbutz) শহরের একটি পরীক্ষামূলক গবেষণায়সমাজে বিদ্যমান সমস্ত রীতি বা ট্যাবু আসলে জন্মগত নয়, বরং সংস্কৃতি থেকেই উদ্ভুত এই ধারণা থেকে সেখানকার অধিবাসীরা ঠিক করেছিলো সমস্ত যৌনতার প্রভেদমূলক পার্থক্যকে ওই শহর থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হবেতার প্রক্রিয়া হিসেবে সেখানকার মেয়েদেরকে ছেলেদের মত ছোট ছোট চুল রাখতে উৎসাহিত করা হল, আর ছেলেদেরকে সেখানো হল সহিংসতা ত্যাগ করে কিভাবে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা যায়! যে সমস্ত মেয়েরা টম বয় হয়ে জীবন কাটাতে চায়, তাদের  পিঠ চাপরে সাধুবাদ জানানো হল, ছেলেরা যেন ঘরের কাজ আর মেয়েরা যেন বাইরের কাজে দক্ষ হয়ে ওঠে সেজন্য যথাযথ ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হলঅর্থাৎ সব মিলিয়ে কিবুৎজ সে সময় গন্য হয়েছিল আদর্শবাদীদের স্বর্গ হিসেবে যেখানে ছেলে মেয়েদের মধ্যে কোন বিভেদ নেই কিন্তু তিন প্রজন্ম পরে দেখা গেল সেই আদর্শ কিবুৎজ পরিণত হয়েছে  সবচেয়ে সেক্সিস্ট বা যৌনবৈষম্যবাদী শহর হিসেবে সেখানকার মানুষজন আদর্শবাদীদের স্বপ্ন ধূলিস্ম্যাৎ করে ফিরে গিয়েছিলো সেই চিরন্তন গৎবাধা জীবনে অভিভাবকদের আদর্শবাদী নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানেরাছেলেরা দেখা গেল, অভিভাবকদের দেখিয়ে দেয়া পথ অস্বীকার করে বেশি পদার্থবিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং গনিত পড়তে শুরু করেছে, মেয়েরা বেশি যাচ্ছে মেডিকেলেতারা নার্সিং-এ কিংবা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশিছেলেদের ঘরের কাজ করার যে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু দেখা গেল মেয়েরাই শেষপর্যন্ত ঘর দোর গোছানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে দায়িত্ব তুলে নেয়ার পেছনে কারণ হিসবে তারা বলল, আরে ছেলেরা ঠিকমত বাসাবাড়ি পরিস্কার রাখতে পারে না।  আর অন্যদিকে ছেলেরা বললো, আরে যত ভালভাবেই করি না কেন বউইয়ের মর্জি মাফিক কিছুতেই হয় না।   ব্যাপারটা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এ ধরণের বিভক্তিগুলোকে যতই অস্বীকার করে সাম্যের পথে সমাজকে ঠেলে দেয়া হয়, বিদ্যমান জৈববৈজ্ঞানিক পার্থক্যগুলো সে সমাজে তত প্রকট হয়ে উঠে ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়

  

চাহিদায় পার্থক্য, পার্থক্য মানসিকতাতেও 

মনোবিজ্ঞানীরা অনেকেদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলেন যে, ছেলে মেয়েদের পারস্পরিক চাহিদা পছন্দ, অপছন্দে যেমন মিল আছে, তেমনি আবার কিছু ক্ষেত্রে আছে চোখে পড়ার মতই পার্থক্যএটা হবার কথাই।  নারী পুরুষ উভয়কেই সভ্যতার সূচনার প্রথম থেকেই  ডারউইন বর্নিত সেক্সুয়াল সিলেকশন নামক বন্ধুর পথে নিজেদের বিবর্তিত করে নিতে হয়েছে, শুধু দৈহিকভাবে নয় মন মানসিকতাতেওদেখা গেছে, ছেলেরা আচরণগত দিক দিয়ে  মেয়েদের চেয়ে অনেক প্রতিযোগিতামূলক (competitive) হয়ে থাকেছেলেদের স্বভাবে প্রতিযোগিতামূলক হতে হয়েছে কারণ তাদের বিভিন্ন  গোত্রের সাথে প্রতিযোগিতা করে, যুদ্ধ বিগ্রহ করে বাঁচতে হয়েছে আদি কাল থেকেইযারা এ ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে টিকে থাকতে পেরেছে তারাই অধিক হারে সন্তান সন্ততি এ পৃথিবীর বুকে রেখে  যেতে পেরেছে।   

আধুনিক জীবনযাত্রাতেও পুরুষদের এই প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতাকে একটু চেষ্টা করলেই ধরা যাবেএকটা মজার উদাহরণ দেইআমেরিকার একটি জরিপ থেকে দেখা গেছে পরিবার নিয়ে লং  ড্রাইভিং এ বেড়িয়ে  কখনো পথ হারিয়ে ফেললে পুরুষেরা খুব কমই পথের অন্য মানুষের কাছ থেকে চায়তারা বরং নিজেদের বিবেচনা থেকে দেখে নিজেরাই পথ খুঁজে নিতে তৎপর হয়, না পারলে বড়জোর ল্যান্ডমার্ক, ম্যাপের দারস্থ হয়, কিন্তু কাউকে জিজ্ঞাসা করে নাআর অন্যদিকে মেয়েরা প্রথমেই গাড়ী থামিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করে নেয়আসলে পুরুষেরা গাড়ী থামিয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পছন্দ করে না, কারণ তাদের আত্মভরি মানসিতার কারণে ব্যাপারটাকে তারা যুদ্ধে পরাজয় হিসবে বিবেচনা করে ফেলে নিজেদের অজান্তেইআর মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তাদের মানসপটে এত প্রবলভাবে রাজত্ব করে না বলে তারা সামাজিক সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছুতে উদগ্রীব থাকে।  শুধু ড্রাইভিংই একমাত্র উদাহরণ নয়; পুরুষেরা অর্থ, বিত্ত আর সামাজিক প্রতিপত্তির প্রতি যে বেশি আকৃষ্ট তা যে কোন সমাজেই প্রযোজ্য।  এটাও এসেছে দীর্ঘদিনের প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা থেকে 

এখন কথা হচ্ছে, পুরুষেরা মেয়েদের চেয়ে কেন বেশি সহিংস কিংবা কেন তাদের মন মানসিকতা এত বেশী প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গড়ে উঠেছে? বিবর্তনীয় বিজ্ঞানীরা বলেন, পুরুষেরা এক সময় ছিলো হান্টার বা শিকারী, আর মেয়েরা ফলমূল সংগ্রাহকপ্রয়োজনের তাগিদেই একটা সময় পুরুষদের একে অন্যের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে; অন্য গোত্রের সাথে মারামারি হানাহানি করতে হয়েছে; নিজের সাম্রাজ্য বাড়াতে হয়েছে;  অস্ত্র চালাতে হয়েছে।  তাদেরকে কারিগরী বিষয়ে বেশি জড়িত হতে হয়েছে আদিম সমাজে অস্ত্র চালনা, করা শিকারে পারদর্শী হওয়াকে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে  বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক হিসবে চিহ্নিত করা হতযারা এগুলোতে পারদর্শী হয়ে উঠেছে তারাই অধিক হারে সন্তান সন্ততি এ পৃথিবীতে রেখে যেতে পেরেছে, যারা এগুলো পারেনি তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে পৃথিবীতে মানব সভ্যতার ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যাবে পুরুষেরা শুধু আত্মরক্ষা করতেই যুদ্ধ করেনি, যুদ্ধ করেছে সাম্রাজ্য বাড়াতে আর সম্পত্তি আর নারীর দখল নিতে এখনো এই মানসিকতার প্রভাব বিরল নয়।  এর বাস্তব প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়ছেন ভেনিজুয়ালার  আদিম ট্রাইব  ইয়ানোমামো (Ya̧nomamö)দের নিয়ে গবেষণা করে নৃতত্ত্ববিদ নেপোলিয়ন চ্যাংনন এই ট্রাইব নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে খুব অবাক হয়েই লক্ষ্য করেন,  

এরা শুধু সম্পদ আহরণের জন্য যুদ্ধ করেনা, এরা যুদ্ধ করে নারীদের উপর অধিকার নিতেও 

দেখা গেল ট্রাইবে যতবেশি  শক্তিশালী এবং সমর-দক্ষ পুরুষ  পাওয়া যাচ্ছে, তত বেশি তারা নারীদের উপর অধিকার নিতে পেরেছে।  আসলে যতই অস্বীকার করা হোক না কেন, কিংবা শুনতে আমাদের জন্য যতই অস্বস্তি লাগুক না কেন,  গবেষকরা ইতিহাসের পাতা পর্যালোচনা আর বিশ্লেষন করে বলেন, বিশেষতঃ প্রাককৃষিপূর্ব সমাজে সহিংসতা এবং আগ্রাসনের মাধ্যমে জোর করে একাধিক নারীদের উপর দখল নিয়ে পুরুষেরা নিজেদের জিন ভবিষ্যত প্রজন্মে ছড়িয়ে দিয়েছিল।  পুরুষদের এই সনাতন আগ্রাসী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়  আজকের সমাজে ঘটা যুদ্ধের পরিসংখ্যানেওএখনো চলমান ঘটনায় চোখ রাখলে দেখা যাবে –  প্রতিটি যুদ্ধেই দেখা যায় অসহায় নারীরা হচ্ছে যৌননির্যাতনের প্রথম এবং প্রধান শিকার।  বাংলাদেশে, বসনিয়া, রুয়ান্ডা, আলবেনিয়া, কঙ্গো, বুরুন্ডিয়া, প্যালেস্টাইন, ইরাক, ইরান সহ প্রতিটি যুদ্ধের ঘটনাতেই সেই নগ্ন সত্যই বেরিয়ে আসে যে,  এমনকি আধুনিক যুগেও নারীরাই থাকে যুদ্ধের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যবস্তু।  

yacca7nomamo 

ছবি – ইয়ানোমামো গোত্রের পুরুষেরা পার্শ্ববর্তী গ্রাম আক্রমনের আগে এভাবেই সমরশিক্ষা গ্রহণ এবং নিজেদের মধ্যে প্রদর্শন করে থাকে।  (ছবি সায়েন্টিফিক আমেরিকানের সৌজন্যে)

 এদিকে পুরুষেরা যখন হানাহানি মারামারি করে তাদের পুরুষতান্ত্রিক জিঘাংসা চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হয়েছে,  অন্য দিকে, মেয়েরা দায়িত্ব নিয়েছে সংসার গোছানোরগৃহস্থালীর পরিচর্যা মেয়েরা বেশি অংশগ্রগণ করায় তাদের বাচনিক এবং অন্যান্য যোগাযোগের ক্ষমতা ছেলেদের চেয়ে অনেক বেশি বিবর্ধিত হয়েছেএকটি ছেলের আর মেয়েদের মস্তিস্ক বিশ্লেষণ করে গঠনগত যে বিভিন্ন পার্থক্য পাওয়া গেছে, তাতে বিবর্তনীয় অনুকল্পই সঠিক প্রমাণিত হয় ছেলেদের ব্রেনের আকার গড়পরতা মেয়েদের মস্তিস্কের চেয়ে অন্ততঃ ১০০ গ্রাম বড় হয়,কিন্তু ওদিকে মেয়েদের ব্রেন ছেলেদের চেয়ে অনেক ঘন থাকে।  মেয়েদের মস্তিস্কে কর্পাস ক্যালোসাম এবং এন্টেরিয়র কমিসুর নামক প্রত্যঙ্গ সহ টেম্পোরাল কর্টেক্সের যে এলাকাগুলো ভাষা এবং বাচনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহায়তা করে বলে মনে করা হয়, মেয়েদের ক্ষেত্রে সেগুলো ছেলেদের চেয়ে অন্ততঃ ২৯ ভাগ বিবর্ধিত থাকেশুধু তাই নয়, মেয়েদের মস্তিস্কে রক্তসঞ্চালনের হার ছেলেদের ব্রেনের চেয়ে শতকরা ১৫ ভাগ বেশি থাকে।  

 male_female_brain_difference

ছবি বিজ্ঞানীরা ছেলে এবং মেয়েদের মস্তিস্ক বিশ্লেষণ করে গঠনগত বিভিন্ন পার্থক্য লক্ষ্য করেছেন   (ছবি সায়েন্টিফিক আমেরিকানের সৌজন্যে)

 

মস্তিস্কের গঠ্নগত পার্থক্যের প্রভাব পড়ে তাদের অর্জিত ব্যবহারে, আর সেই ব্যবহারের প্রভাব আবার পড়ে সমাজেঅভিভাবকেরা সবাই লক্ষ্য করেছেন, মেয়ে শিশুরা ছেলে শিশুদের চেয়ে অনেক আগে কথা বলা শিখে যায় – একই রকম পরিবেশ দেয়া সত্ত্বেও  ছেলেদের বাচনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রগুলো গড়পড়তা মেয়েদের মত উন্নত না হওয়ায় ডাক্তাররা লক্ষ্য করেন পরিণত বয়সে ছেলেরা সেরিব্রাল পালসি, ডাইলেক্সিয়া, অটিজম এবং মনোযোগ-স্বল্পতা সহ বিভিন্ন মানসিক রোগে বেশি আক্রান্ত হয় এ ধরনের আরো পার্থক্য আছেব্যবহারিক জীবনে দেখা যায় ছেলেরা যখন কাজ করে অধিকাংশ সময়ে শুধু একটি কাজে নিবদ্ধ থাকতে চেষ্টা করে, এক সাথে চার পাঁচটা কাজ করতে পারে না,  প্রায়শই গুবলেট করে ফেলেআর অন্যদিকে মেয়েরা  অত্যন্ত সুনিপুন ভাবে ছয় সাতটা কাজ একই সাথে করে ফেলে।  এটাও হয়েছে সেই হান্টার গ্যাদারার পরিস্থিতি দীর্ঘদিন মানসপটে রাজত্ব করার কারণেইশিকারী হবার ফলে পুরুষদের স্বভাবতই শিকারের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হত, ফলে তাদের মানসজগত একটিমাত্র বিষয়ে ফোকাসড্‌ হয়ে গড়ে উঠেছিল, আর মেয়েদের যেহেতু ঘরদোর সামলাতে গিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে হাজারটা কাজ করে ফেলতে হত, তারা দক্ষ হয়ে উঠেছিল একাধিক কাজ একসাথে করাতে।  

 আরো কিছু পার্থক্য উল্লেখ করা যাকছেলেদের মস্তিস্কের প্যারিয়েটাল কর্টেক্সের আকার মেয়েদের মস্তিস্কের চেয়ে অনেক বড় হয় বড় হয়  অ্যামাগদালা নামের বাদাম আকৃতির প্রত্যঙ্গের আকারও  এর ফলে দেখা গেছে ছেলেরা জ্যামিতিক আকার নিয়ে নিজেদের মনে নাড়াচাড়ায় মেয়েদের চেয়ে অনেক দক্ষ হয় তারা একটি ত্রিমাত্রিক বস্তুকে সামনে থেকে দেখেই নিজেদের মনের আয়নায় নড়িয়ে চড়িয়ে ঘুরিয়ে ঘারিয়ে বুঝে নিতে পারে বস্তুটি, পেছন থেকে, নীচ থেকে বা উপর থেকে কিরকম দেখাতে পারে।  জরিপ থেকে দেখা গেছে,   ছেলেরা গড়পরতা  বিমূর্ত এবং স্পেশাল কাজের ব্যাপারে বেশী সাবলীল, আর মেয়েরা অনেক বেশী বাচনিক এবং সামাজিক কাজের ব্যাপারেহয়ত এজন্যই ছেলেরা অধিক  হারে স্থাপত্যবিদ্যা কিংবা প্রকৌশলবিদ্যা পড়তে উৎসুক হয়, আর মেয়েরা যায় শিক্ষকতা, নার্সিং, কিংবা সমাজবিদ্যায়এই ঝোঁক সংস্কৃতি এবং সমাজ নির্বিশেষে একই রকম দেখা গেছে।  এই রকম সুযোগ দেয়ার পরও বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েরা বড় হয়ে বুয়েটের চেয়ে মেডিকেলে পড়তেই উদ্গ্রীব থাকে কোন সংস্কৃতিতেই ছেলেরা খুব একটা যেতে চায় না নার্সিং-এ, মেয়েরা যেমনিভাবে একটা গ্যারেজ মেকানিক হতে চায় না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা কি কেবলই মেয়েরা শোষিত কিংবা পিছিয়ে পড়া বলে, নাকি বিবর্তনীয়  সিলেকশন প্রেশার তাদের মধ্যে অজান্তেই কাজ করে বলে?

 

সব টাকমাথা পয়সাওয়ালা লোকের ঘরে সুন্দরী বউ দেখি কেন?                                       

কলেজ জীবনে ক্লাস বাং মেরে নিউমার্কেটে ঘুরার অভিজ্ঞতা বোধ হয় কমবেশি সব ছাত্রেরই আছেআমারও ছিলো পুরোমাত্রায়একটা পুরো গ্যাং নিয়ে চলে যেতাম ওই গ্যাং এর একটা অংশ আবার সুন্দর মেয়ে দেখায় সদা ব্যস্ত থাকতো। কিন্তু দেখলে কি হবে, পোড়া কপাল, যত বেশি সুন্দরী মেয়ে তত বেশী টাক মাথা, বয়স্ক,  হোদল কুৎকুতে স্বামী নিয়ে ঘুরছে। শেষ মেষ এমন হল যে, টাকমাথা আবলুস বাবা টাইপের কাউকে বলিউডের নাকিয়াদের মত মেয়ে নিয়ে ঘুরতে দেখলেই আমরা ধরে নিতাম ব্যাটার হয় ম্যালা পয়সা, নইলে ব্যাটা সমাজে বিরাট কেউকেটা কেউ হবে।  মজার ব্যাপার হল – পরে  দেখা যেত আমাদের অনুমান নির্ভুল হত প্রায় সবক্ষেত্রেই। আসলে ক্ষমতাবান পুরুষেরা যে সুন্দরী তরুনীদের প্রতি বেশি লালায়িত হয়, আর সুন্দরীরা পয়সা আর স্ট্যাটাসওয়ালা স্বামীর প্রতি এটা সব সমাজেই এত প্রকট যে এটা নিয়ে গবেষণা করার কেউ প্রয়োজনই বোধ করেননি কখনো।  এজন্যই ন্যান্সি থর্নহিল  বলেন,

                                                 

‘Surely no one has ever seriously doubted that men desire young, beautiful women, and that women desire wealthy high status men’.

 

কিন্তু সনাতন সমাজবিজ্ঞানীরা আপত্তি করেছেনতাদের অনুমান ছিলো সব সংস্কৃতিতে নিশ্চয় এ ধরণের স্টেরিওটাইপিং নেই।  এখন এদের অনুমান সঠিক না কি ভুল তা পরীক্ষা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিলেন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক  ডেভিড বাস।  তিনি  ৩৩ টি দেশে সমীক্ষা চালিয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, সঙ্গী নির্বাচনের সময়  ছেলেরা গড়পরতা দয়া, বুদ্ধিমত্তা আশা করে, কিন্তু পাশাপাশি প্রত্যাশা করে  তারুন্য এবং সৌন্দর্য।  অন্যদিকে মেয়ারাও গড়পরতা ছেলেদের কাছ  থেকে দয়া, বুদ্ধিমত্তা আশা করে ঠিকই, পাশাপাশি সঙ্গীর কাছ থেকে আশা করে ধন সম্পদ আর স্ট্যাটাস।  অধ্যাপক  বাস প্রথমে আমেরিকায় সমীক্ষা চালালেন। দেখা গেল, আমেরিকায় মেয়েরা যত ভাল চাকরীই করুক না কেন,  তারা আশা করে তার স্বামী তাদের চেয়ে বেশি  রোজগার করবে নাইলে ব্যাপারটা এনাফ কুল্‌ হবে না।  ম্যাচ ডট কম এর মত সাইটগুলোতে দেখা যায় মেয়েরা তার হবু সঙ্গীর স্ট্যাটাস এবং প্রতিপত্তির প্রতি আগ্রহী হয় ছেলেদের  চেয়ে ১১ গুন বেশি। এমনকি একটি পরীক্ষায় অধ্যাপক বাস একই লোককে কখনো বার্গার কিং বা ম্যাকডোনাল্ডসের কর্মীর পোষাক পরিয়ে, কখনোবা বিরাট কোন কোম্পানির সিইও সাজিয়ে পরীক্ষা করলেন । দেখা গেল, নিম্ন স্ট্যাটাসের পোশাক পরা লোকের সাথে মেয়েরা প্রাথমিকভাবে কোন ধরণের সম্পর্ক করতেই রীতিমত অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।  অথচ একই লোককে বড় স্ট্যাটাসের কোন পোশাক পরিয়ে বাইরে নেয়া হলেই মেয়েরা তার প্রতি উৎসুক হয়ে উঠছে।  কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে সেরকম প্রবণতা লক্ষ করা যায়নি। অর্থাৎ, ছেলেরা সঙ্গি নির্বাচনের ক্ষেত্রে মেয়েদের স্ট্যাটাস নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন নয়, যতটা তারা উদ্বিগ্ন একটি মেয়ের দৈহিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে।  প্রথমে যখন বাসের ফলাফল  বৈজ্ঞানিক সাময়ীকিতে প্রকাশিত হল, সেটা উড়িয়ে দেয়া হল এই বলে আরে ওটা আমেরিকার পঁচে যাওয়া ভোগবাদী সংস্কৃতির নিদর্শন।  অন্য জায়গায় নিশ্চয় এরকম হবে না।  অন্য জায়গার ঘটনা বুঝতে বাস ইউরোপীয় দেশগুলোতে তার সমীক্ষা চালালেন। সেখানেও একই ধরণের ফলাফল বেড়িয়ে আসলো ছেলেরা মেয়েদের সৌন্দর্যের প্রতি বেশি মনোযোগী, আর মেয়েরা ছেলেদের স্ট্যাটাসের- তা সে হল্যান্ডেই সমীক্ষা চালান হোক, কিংবা জার্মানীতে।  এবারে বলা হল ইউরোপীয় সংস্কৃতি অনেকটা আমেরিকার মতই।  সেখানে তো এরকম ফলাফল আসবেই।  এবারে অধ্যাপক বাস  ছয়টি মহাদেশ এবং পাঁচটি দ্বীপপুঞ্জের  ৩৭ টি ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা ১০০৪৭ জন লোকের উপর সমীক্ষা চালালেন একেবারে আলাস্কা থেকে শুরু করে সেই জুলুল্যান্ড পর্যন্ত।  প্রতিটি সংস্কৃতিতেই দেখা গেল মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে আর্থিক প্রতিপত্তিকে অনেক বেশী গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে।  জাপানে এই পার্থক্য সবচেয়ে বেশী পাওয়া গেল আর হল্যান্ডে সবচেয়ে কম কিন্তু তারপরেও সংস্কৃতি নির্বিশেষে নারী-পুরুষের চাহিদার পার্থক্য কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।   

নারীপুরুষের এ ধরণের চাহিদার পার্থক্য আরো প্রকট হয়েছে  নারী-পুরুষদের মধ্যকার যৌনতা নিয়ে ফ্যান্টাসি কেন্দ্রিক গবেষনাগুলোতেও।  ব্রুস এলিস এবং ডন সিমন্সের করা ইউনিভারসিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণায় বেড়িয়ে এসেছে যে, পুরুষ এবং নারীদের মধ্যকার যৌনতার ব্যাপারে ফ্যান্টাসিগুলো যদি সততার সাথে লিপিবদ্ধ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে তিনজনের মধ্যে একজন পুরুষ একাধিক নারীর সাথে যৌনতার ফ্যান্টাসিতে ভোগে, এমনকি সারা জীবনে  তাদের পার্টনারের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে কল্পনা করে তারা আমোদিত হয়ে উঠে- আর মেয়েদের মধ্যে সে সংখ্যাটা মাত্র ৮ ভাগ। এলিস এবং সিমন্সের সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অর্ধেক সংখ্যক নারীরা অভিমত দিয়েছে, যৌনতা নিয়ে কল্পনার উদগ্র সময়গুলোতেও তারা কখনো সঙ্গী বদল করে না, অন্য দিকে পুরুষদের মধ্যে এই সংখ্যাটা মাত্র  ১২ ভাগ।  মেয়েদের যৌনতার ফ্যান্টাসিগুলো তার নিজের পরিচিত যৌনসঙ্গিকে কেন্দ্র করেই সবসময় আবর্তিত হয়, আর অন্যদিকে পুরুষদের যৌনতার ফ্যান্টাসিগুলো সময় সময়  সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়েকে নিয়েও উথলে ওঠে । একারণেই গবেষক এলিস এবং সিমন্স Journal of Sex Reserch নামক জার্নালে প্রকাশিত তাদের গবেষণাপত্র Sex differences in sexual fantasy: an evolutionary psychological approachএ এই বলে উপসংহার টেনেছেন  

পুরুষদের যৌনতার বাঁধন-হারা কল্পনাগুলো হয়ে থাকে সর্বব্যাপী, স্বতঃস্ফুর্ত, দৃষ্টিনির্ভর, বিশেষভাবে যৌনতাকেন্দ্রিক, নির্বিচারী, বহুগামী এবং সক্রিয়। অন্যদিকে মেয়েদের যৌন অভিলাস অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক,  আবেগময়, অন্তরংগ এবং অক্রিয়।

ছেলে মেয়েদের যৌন-অভিলাসের পার্থক্যসূচক এই প্রবণতার প্রভাব পড়েছে আজকের দিনের বানিজ্যে এবং পন্য-দ্রব্যে।  এমনি একটি দ্রব্য হচ্ছে পর্নগ্রাফি অন্যটি হল রোমান্স নভেল।  পর্নগ্রাফির মুল ক্রেতা নিঃসন্দেহে পুরুষ। পুরুষদের উদ্গ্র এবং নির্বিচারী সেক্স ক্রেজের চাহিদা পূর্ণ করতে বাজারে ইন্টার্নেট সয়লাব হয়ে আছে  সফট পর্ন, হার্ড পর্ন, থ্রি সাম, গ্রুপ সেক্স সহ হাজার ধরণের বারোয়ারি জিনিসপত্রে। এগুলো পুরুষেরাই কিনে, পুরুষেরাই দেখে।  মেয়েরা সে তুলনায় কম। কারণ, মেশিনের মত হার্ডকোর পর্ন পুরুষদের তৃপ্তি দিলেও মেয়েদের মানসিক চাহিদাকে তেমন পুর্ণ করতে পারে না। সমীক্ষায় দেখা গেছে নারীর নগ্ন দেহ দেখে পুরুষেরা যেমন সহজেই আমোদিত হয়, মেয়েরা তেমনি হয় না।  কারণ – মেয়েদের অবারিত সেক্স জাগ্রত করতে দরকার  অবারিত ইমোশন!   

আর মেয়েদের এই অবারিত ইমোশন তৈরি করতে বাজারে আছে রোমান্স নভেল। এই রোমান্টিক নভেলের মূল ক্রেতাই নারী।  দেদারসে প্রেম-পীরিতি-বিচ্ছেদের পসরা সাজিয়ে  শয়ে শইয়ে  বই সাড়া দুনিয়া জুড়ে বের করা হয় আর সেগুলো দেদারসে বিক্রি হতে থাকে সাড়া বছর জুড়ে, মূলতঃ মেয়েদের হাত দিয়ে।  বাংলাদেশে যেমন আছে ইমদাদুল হক মিলন, তেমনি আমেরিকায় সুসান এলিজাবেদ ফিলিপ্স, ভারতে তেমনি সুবোধ ঘোষ কিংবা নিহারঞ্জন গুপ্ত । প্রেম কত প্রকার ও কি কি তা বুঝতে হলে এদের উপন্যাস ছাড়া গতি নেই।  আমি শুনেছি, রোমান্স নভেলের জন্য  প্রকাশকেরা ইদানিংকালে বিশেষতঃ ঊঠতি লেখকদের নাকি বলেই দেয় কিভাবে তার উপন্যাস সাজাতে হবে, আর কি কি থাকতে হবে।  একটু প্রেম, অনুরাগ, কমিটমেন্ট, মান অভিমান,  বিচ্ছেদ, ক্লাইম্যাক্স তারপর মিলন। আবেগের পশরা বেশি থাকতে হবে, সে তুলনায় সেক্সের  বাসনা কম। বইয়ের নায়িকার সেক্সের সাথে আবার ইমোশন মিলিয়ে দিতে হবে, ইত্যাদি। এভাবে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে রোমান্স নভেলের ম্যানুফ্যাকচারিং।  মেয়েরা দেদারসে কিনছে, আবেগে ভাসছে, হাসছে, কখনো বা চোখের পানি ফেলছে। আর বই উঠে যাচ্ছে বেস্ট সেলার তালিকায়।  

আরো কিছু আনুষঙ্গিক মজার বিষয় আলোচনায় আনা যাক। পশ্চিমা বিশ্বে এক সময় প্লে বয়-এর পাশাপাশি একসময় প্লে গার্ল চালানোর চেষ্টা করা হয়েছিলোচলেনিমেয়েরা এ ধরণের পত্রিকা কেনেনি, বরং কিনেছে সমকামী পুরুষেরা ঢের বেশিছেলেরা শুধু কেন বল খেলবে আর মেয়েরা পুতুল – এই শিকল ভাঙ্গার অভিপ্রায়ে ভিন্ন ধরণের খেলনা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছিলো – চলেনিকারণ কি? কারণ হচ্ছে, আমরা যত আড়াল করার চেষ্টাই করি না কেন, ছেলে মেয়েদের মানসিকতায় পার্থক্য আছে – আর সেটা দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় ছাপ থাকার কারণেইএই ব্যাপারটিই প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ পত্রিকা ইন্ডিপেন্ডেন্টে এক মায়ের আর্তিতেসেই মা পত্রিকায় (নভেম্বর ২, ১৯৯২) তার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন  

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে আপনার পত্রিকার বিজ্ঞ পাঠকেরা কি বলতে পারবেন কেন একই রকমভাবে বড় করা সত্ত্বেও যতই সময় গড়াচ্ছে আমার দুই জমজ বাচ্চাদের মধ্যকার নারী-পুরুষজনিত পার্থক্যগুলো প্রকট হয়ে উঠছে? কার্পেটের উপর যখন তাদের খেলনাগুলো একসাথে মিলিয়ে মিশিয়ে ছড়িয়ে রাখা হয়, তখন দেখা যায় ছেলেটা ঠিকি ট্রাক বা বাস হাতে তুলে নিচ্ছে, আর মেয়েটা পুতুল বা টেডি বিয়ার।  

শুধু মানব শিশু নয়, মানুষের কাছাকাছি প্রজাতি ভার্ভেট মাঙ্কি নিয়ে গবেষণা করেও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন  তাদের হাতে যদি খেলনা তুলে দেয়া হয়, ছেলে বানরেরা ট্রাক বাস গাড়ি ঘোড়া নিয়ে বেশি সময় কাটায় আর মেয়ে বানরেরা পুতুল কোলে নিয়ে মানব সমাজে দেখা গেছে খুব অল্প বয়সেই ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে খেলনা নিয়ে এক ধরণের পছন্দ তৈরি হয়ে যায়, বাবা মারা সেটা চাপিয়ে দিক  বা না দিকদোকানে নিয়ে গেলে ছেলেরা খেলনা-গাড়ি কিংবা বলের দিকে  হাত বাড়াতে শুরু করে, আর মেয়েরা পুতুলের প্রতি।  এই মানসিকতার পার্থক্যজনিত প্রভাব পড়েছে খেলনার প্রযুক্তি, বাজার এবং বিপননে।  যে কেউ টয়সেরাসের মত দোকানে গেলেই ছেলে-মেয়েদের জন্য খেলনার হরেক রকম সম্ভার দেখতে পাবেন।  কিন্তু খেলনা গুলো দেখলেই বোঝা যাবে এগুলো যেন দুই ভুবনের দুই বাসিন্দাদের চাহিদাকে মূল্য দিতে গিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে বানানো। 

 male_female_toy

ছবি বিজ্ঞানীরা ভার্ভেট মাঙ্কি নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে খেলনার প্রতি পছন্দের প্রকৃতি ভিন্ন হয়, যা আমাদের মানব সমাজের ছেলে-মেয়েদের খেলনা নিয়ে স্টেরিওটাইপিং-এর সাথে মিলে যায়   (ছবি সায়েন্টিফিক আমেরিকানের সৌজন্যে)

 

 

ডকিন্সের সেলফিশ জিন তত্ত্ব দিয়ে ছেলে মেয়েদের এই মানসিক পার্থক্যকে খুব সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়সেলফিশ জিন তত্ত্ব সঠিক হলে, আমাদের দেহ জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে চাইবে জিন সঞ্চালনেপুরুষদের জন্য যেহেতু নয় মাস ধরে গর্ভধারনের ঝামেলা নেই, নেই অন্য আনুষঙ্গিক ঝামেলা মেয়েদের যেগুলো পোহাতে হয় গর্ভ ধারনের জন্য, সেহেতু তাদের মধ্যে একটা অংশ থাকেই  যারা মনে করে যত বেশি জিন সঞ্চালন করা যাবে ততই বেশি থাকবে ভবিষ্যত প্রজন্ম বেঁচে থাকার সম্ভাবনাতাই ইতিহাসে দেখা যাবে শক্তিশালী পুরুষেরা কিংবা গোত্রাধিপতিরা কিংবা রাজা বাদশাহ রা হেরেম তৈরি করে সুন্দরী স্ত্রী আর উপপত্নি দিয়ে প্রাসাদ ভর্তি করে রাখতপর্ণগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ পুরুষদেরই বেশি থাকে কিংবা পতিতাপল্লিতে পুরুষেরাই যায় – আদিম সেই  উদগ্র যৌনস্পৃহা মানসপটে রাজত্ব করার কারণেই হয়তো। 

 

যৌনতার নির্বাচন তরান্বিত করেছে নারী-পুরুষের পছন্দ অপছন্দ 

এ পর্বে আমরা দেখলাম ডারউইনের যৌনতার নির্বাচন শুধু মানব প্রকৃতি গঠনেই সাহায্য করেনি,  করেছে নারী-পুরুষের মানস জগৎ তৈরিতে পলে পলে একটু একটু করে। আসলে সত্যি বলতে কি যৌনতার নির্বাচনকে পুঁজি করে  পুরুষ যেমন গড়েছে নারীকে, তামনি নারীও গড়েছে পুরুষের মানসপটকে।  এক লৈঙ্গিক বৈশিষ্টগুলোর আবেদন তৈরি করেছে আরেক লিঙ্গের চাহিদা।  তৈরি এবং ত্বরান্বিত হয়েছে বিভিন্ন লিংগ-ভিত্তিক নানা পছন্দ অপছন্দ।  পুরুষ দির্ঘকাল ধরে যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছে বলে স্বভাবে হয়ে উঠেছে অনেক সহিংস। আবার নারীরাও একটা সময় পুরুষদের এই সহিংসতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, কারণ এ ধরণের পুরুষেরা ট্রাইবকে রক্ষা করতে পারত বহিঃশত্রুর হাত থেকে।  এ ধরণের সমর দক্ষ পুরুষেরা ছিলো সবার হার্টথ্রব এরা দিয়েছিলো নিজের এবং পরিবারের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা। এ ধরণের সাহসী পুরুষেরা নিজেদের জিন ছড়াতে পেরেছে অনেক সহজে, আমার মত কাপুরুষদের তুলনায়!  ফলে নারীরাও চেয়েছে তার সঙ্গিটি কাপুরুষ না হয়ে সাহসী হোক, হোক বীরপুরুষ!  এই ধরণের চাহিদার প্রভাব এখনো সমাজে দৃশ্যমান। ডেট করতে যাওয়ার সময় কোন নারীই চায় না তার সঙ্গি পুরুষটি উচ্চতায় তার চেয়ে খাটো হোক।  সম্পর্ক রচনার ক্ষেত্রে এ যেন এক অলিখিত নিয়ম, শুধু আমেরিকায় নয়, সব দেশেই! বাংলাদেশে বিয়ে করতে গেলে পাত্রের উচ্চতা পাত্রীর উচ্চতার চেয়ে কম দেখা গেলেই আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে গাই-গুই শুরু হয়ে যায় মুহূর্তেই।  খাটো স্বামীকে বিয়ে করতে হলে স্ত্রীরও মনোকষ্টের সীমা থাকেনা। হাই হিল জুতো আর তার পরা হয়ে ওঠে না।  আসলে দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় প্রভাব মানসপটে রাজত্ব করার কারণেই এটি ঘটে। লম্বা চওড়া  জামাই সবার আদরনীয়, কারণ একটা সময় লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যবান এই সব পূর্বপুরুষেরা রক্ষা করতে পেরেছিলো স্বীয় গোত্রকে, রক্ষা করেছিলো উত্তরপুরুষের জিনকে অন্যদের তুলনায় অনেকে ভালভাবে। সেই আদিম মানসপট আধুনিক মেয়েদের মনে রাজত্ব করে তাদের অজান্তেই! 

আবার পুরুষদের মানসজগতেও নারীদেহের কিছু বৈশিষ্ট নিয়ে উদ্গ্র আগ্রহ দেখা যায় সম্ভবতঃ বিবর্তনীয় তথা যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে মানসপট তৈরি হবার কারণেই। যে কোন দেশের সাহিত্যের পাতা উল্টালেই দেখা যাবে – নারীর পিনোন্নত স্তন, সুডোল নিতম্ব আর ক্ষীন কটিদেশ নিয়ে যুগের পর যুগ কাব্য করেছে পুরুষ সকল সংস্কৃতিতেই।  কারণ নারীদেহের এই বৈশিষ্টগুলোই সকল পুরুষের কাছে মহার্ঘ্য বস্তু। কিন্তু কেন? কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলেন, আদিম সমাজে পুরুষদের কাছে বৃহৎ স্তন এবং নিতম্বের মেয়েরা অধিকতর আদৃত ছিলো প্রাকৃতিক কারণেই। বিপদ সঙ্কুল জঙ্গুলে পরিবশে মেয়েদের বাচ্চা কোলে নিয়ে পুরুষদের সাথে ঘুরতে হত, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাইয়ে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখতে হত এলাকায় খাদ্যস্বল্পতা দেখা দিলে।  অতি আধুনিক কালের কৃষিবিপ্লবের কথা বাদ দিলে মানুষকে আসলেই শতকরা নব্বই ভাগ  সময় যুদ্ধ করতে হয়েছে খাদ্যস্বল্পতার বিরুদ্ধে। যে নারী দীর্ঘদিন খাদ্যস্বল্পতার প্রকোপ এড়িয়ে বুকের দুধ খাইয়ে বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে, তাদের টিকে গেছে অনেক বেশি হারে। কাজেই কোন নারীর বৃহৎ স্তন পুরুষদের  কাছে প্রতিভাত হয়েছে ভবিষ্যত-প্রজন্মের জন্য অফুরন্ত খ্যাদ্যের ভান্ডার  হিসবে। এ এক অদ্ভুত বিভ্রম যেন। এই বিভ্রম দীর্ঘদিন ধরে পুরুষকে করে তুলেছে পৃত্থুল স্তনের প্রতি আকর্ষিত। তারা লালায়িত হয়েছে, লুব্ধ হয়েছে এ ধরণের দৈহিক বৈশিষ্ট সম্পন্ন নারীর সাথে সম্পর্ক করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে জৈবিক তাড়নায়।  ঠিক একই ভাবে, বহিঃশত্রু যখন আক্রমণ করেছে তখন যে নারী বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে বাঁচতে পেরেছে, তাদের জিন রক্ষা পেয়ছে অনেক সহজে। এই পরিস্থিতির সাথে তাল মিলাতে গিয়ে নারীর কোমড় হয়েছে ক্ষীণ, আর নিতম্ব হয়েছে সুদৃঢ়।  আর এ বৈশিষ্টগুলো পুরুষদের কাছে হয়ে উঠেছে অনেক বেশি আদরনীয়।  সুদৃঢ় নিতম্বের প্রতি পুরুষদের আগ্রহের অবশ্য আরো একটি বড় কারণ আছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন বিগত পাঁচ মিলিয়ন বছরে  মানুষের মস্তিস্কের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে অবিশ্বস্য দ্রুততায়। ফলে এটি বাচ্চার জন্মের সময় তৈরি করেছে জন্মসংক্রান্ত জটিলতার।  এই কিছুদিন আগেও সাড়া পৃথিবীতেই বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাওয়া মায়েদের সংখ্যা ছিলো খুবই উদ্বেগজনকভাবে বেশি। ধারণা করা হয়,  সভ্যতার উষালগ্নে ক্ষীণ নিতম্ববিশিষ্ট নারীদের মৃত্যু অনেক বেশি হয়েছে বড় মাথাওয়ালা বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে। টিকে থাকতে পেরেছে  সুডোল এবং সুদৃঢ় নিতম্ব-বিশিষ্ট মেয়েরাই।  কারণ তারা অধিক হারে জন্ম দিতে পেরেছে স্বাস্থ্যবান শিশুর। ফলে দীর্ঘদিনের এই নির্বাচনীয় চাপ তৈরি করেছে নারী দেহের সুদৃঢ় নিতম্বের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক উদগ্র কামনা!

( চলতেও পারে… )