বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন -১
-ম. আখতারুজ্জামান


মডারেটরের নোট : প্রফেসর ড. ম. আখতারুজ্জামান বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস) এবং বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশন এর সভাপতি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন, কাজ করেছেন বিভাগীয় চ্যায়ারম্যান হিসেবেও। তিনি বায়োটেকনলজী গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রাক্তন পরিচালক। দেশ বিদেশের প্রখ্যাত জার্নালে তার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এ শিক্ষক অবসর নেবার আগপর্যন্ত নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সাইটোজেনেটিক্স গবেষণাগারের প্রধান হিসেবে। গবেষণার পাশাপাশি তিনি বাংলায় বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রেও একজন শীর্ষস্থানীয় কান্ডারী। পাঠকদের হয়তো মনে আছে যে, আমরা বিগত ডারউইন দিবস উপলক্ষে ড. ম. আখতারুজ্জামানের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিলাম মুক্তমনার পাতায়, যা পাঠকনন্দিত হয়েছিলো।  বরেন্য এ শিক্ষাবিদ আমাদের সাইটের জন্য ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে একটি লেখা লিখতে সম্মত হয়েছেন। পুরো রচনাটি তিনটি ভাগে মুক্তমনায় প্রকাশিত হবে। লেখাটির মূল অংশ বাকবিশিস-এর ২৫তম প্রতিষ্ঠ বার্ষিকী উপলক্ষে ৪ঠা জুন ২০০৯ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবন সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত সেমিনারে পঠিত হয়েছিলো। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর নজরুল ইসলাম এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মাকসুদ।

আমরা ড. ম. আখতারুজ্জামানকে আমাদের মুক্তমনা ব্লগে পেয়ে আনন্দিত বোধ করছি।


বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৪০৯টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে (ব্যানবেইস, ২০০৫ এবং সরকারী প্রতিবেদন “কলেজ শিক্ষা সংস্কার”, ২০০৮) । এগুলোর মধ্যে ৩১টি পাবলিক বা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, ৫৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১টি সম্মান ও মাস্টার্স কলেজ (তন্মধ্যে সরকারী ১০২টি), এবং ১৭৫টি কামিল মাদ্রাসা (সরকারী মাত্র ৩টি)। ২০০৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়ার মন্ত্রীসভা ফাজিল ও কামিল ডিগ্রিকে যথাক্রমে ডিগ্রি ও মাস্টার্স-এর মর্যাদা দেয়। সে বছরই সরকার কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি, দাওরা ডিগ্রিকে, ইসলামিক ইতিহাস/আরবী সাহিত্যে মাস্টার্স-এর মর্যাদা দেয়। দাওরা ডিগ্রি প্রদানকারী মাদ্রাসার সঠিক সংখ্যা জানা নেই। এগুলোর বাইরে আরো অল্প কিছু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে।

কথা হলো, মাত্র চার শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের প্রয়োজন জন্য পর্যাপ্ত কিনা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প, ১৪ মে, ২০০৯) মতে, ২০০১ সালে আমাদের দেশে ১৫-২৪ বছর বয়সী নাগরিক ছিল ২ কোটি ৪০ লক্ষ। তার মধ্যে মাত্র ৪%-এর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থান হয়েছিল। অন্যান্য দেশে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পাচ্ছে : ভারতে ১১.৯%, মালয়েশিয়ায় ২৯.৩%, থাইল্যান্ডে ৩৭.৩%এবং উন্নত বিশ্বে ৫০%। ২০০৭ সালে বাংলাদেশে ইন্টারমেডিয়েট পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মাত্র ১৯.৭৭% উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। মঞ্জুরি কমিশনের আরো একটি মন্তব্য প্রণিধানযাগ্য। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছিল ধনী শ্রেণীর সন্তানেরাই।

কাজেই মানোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংখ্যক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরির কথা ভাবতে হবে। ভারতের সমান পর্যায়ে পৌঁছাতে হলেও আমাদের এ রকম প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তিন গুণ বৃদ্ধি করে ১২০০টিতে উন্নীত করতে হবে। আর ধনী নয় – এমন মানুষের সন্তানদের পড়ার সুযোগ করে দেবার কথাও ভাবতে হবে। কারণ, মেধা শুধু বিত্তবানদের ঘরে বিরাজ করে না।

মান যথেষ্ট নয়

আমাদের এই চার শতাধিক প্রতিষ্ঠানের মান কিরূপ তা জানার সহজলভ্য উৎস হচ্ছে ইন্টারনেট। ইন্টারনেটে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান নির্ণয়কারী বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়। নানাভাবে তালিকা তৈরি করা হয়। বিশ্বের সেরা ১০,০০০, ৫০০০, ১০০০, এবং ১০০ প্রতিষ্ঠানের তালিকা যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় পৃথিবীর আঞ্চলিক সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা।

কিছু দিন আগে একটি প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে আমাদের একটি টেলিভিশন চ্যানেল “বাংলাদেশের অক্সফোর্ড” বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অবস্থান ৪৯২২তম বলে প্রচার করে। সে প্রতিষ্ঠানটির নাম কি, তা বলা হয়নি। কতটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এ অবস্থান, তাও বলা হয়নি। এটা কি সারা বিশ্বের না আঞ্চলিক কোন তালিকা, তাও উল্লেখ করা হয়নি। আমি ইন্টারনেটে এমন কোন তালিকা পাইনি। এ অবস্থান যদি ১০,০০০-এর মধ্যে হয়ে থাকে, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান প্রথমে যতটা হতাশাজনক মনে হয়েছিল, হয়ত ততটা নয়। আর এ অবস্থান ৫০০০-এর মধ্যে হলে নিশ্চয়ই উদ্বেগের বিষয়। দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ১০০টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি তালিকায় (ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটিজ ) বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম আছে – বাংলাদেশ প্রকৌশল ও টেকনোলিজি বিশ্ববিদ্যালয় বা “বুযেট” (২৯তম) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (৪৩তম)। এ তালিকায় পশ্চিমবঙ্গেরও দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রয়েছে – যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (৬১তম) এবং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (৮৮তম)। তার মানে এই নয় যে সারা ভারতের তুলনায় আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা ভাল। আসলে আমাদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। ৪০৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২টি এ তালিকায় স্থান পেয়েছে। অপর দিকে উক্ত তালিকায় ১ম স্থান থেকে অনেকগুলো অবস্থান ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে। সে তালিকায় বেশ কয়টি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অবস্থান আমাদের উক্ত দুটি সেরা প্রতিষ্ঠানের থেকে অনেক উপরে। এ উপাত্ত থেকেই আমরা আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান কি, তা অনুধাবন করতে পারি।

মানোন্নয়নের লক্ষ্য

উচ্চশিক্ষার মান নির্ণয় করতে হলে প্রথমেই ঠিক করতে হবে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য কি। কেননা, এ লক্ষ্য পরণের নিরিখেই প্রতিষ্ঠানের মান নির্ণয় করা উচিত। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার তেমন কোন লক্ষ্য নেই। ছিল একটা লক্ষ্য। সেটি স্থির করেছিল ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন (১৯৭৩)। বিগত দিনের প্রতিক্রিয়াশীল সরকারগুলো সেটি পরিত্যাগ করে। চালু হয় শিক্ষার মুক্ত বাজার। শিক্ষা হয়ে উঠে মুনাফা ও ব্যবসার পণ্য। কোন রকমে একটি ডিগ্রি পাওয়া, এর মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করা এবং চাকুরি লাভই হয়ে পড়ে উচ্চশিক্ষার মল লক্ষ্য। উচ্চশিক্ষাকে বিগত দিনের সরকারগুলো কিভাবে বাণিজ্যে পরিণত করেছিল, তা নিয়ে অনেক কথা আছে। অন্য কোন সুযোগে তা আলোচনা করা যাবে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে জাতীয় লক্ষ্যের সঙ্গে সাযুজ্যহীন উচ্চশিক্ষা কোন মানসমম্মত শিক্ষা হতে পারে না। সর্বোপরি উচ্চশিক্ষার একটি সার্বজনীন লক্ষ্য আছে। সেটি উচ্চশিক্ষার মান বিচারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চাই। তবে এ উদাহরণটি হবে সারা বিশ্বের সেরা উচ্চশিক্ষার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।

সে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের লক্ষ্য কতটুকু পরণ করতে পেরেছে, তা তলিয়ে দেখেছেন অনেকে। তাঁদের একজন হলেন বিজ্ঞানের প্রখ্যাত জার্নাল সাইন্স-এর প্রধান স¤ক্সাদক ব্র“স এলবার্টস (সাইন্স, ২৩ জানুয়ারি, ২০০৯)। তাঁর মতে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মল লক্ষ্য হবে এমন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা, যা দেশের উন্নয়নে নেতৃত্ব দিবে এবং তা করতে গিয়ে প্রতি পদে অন্যদের দ্বারা পরিচালিত হবে না। সে জন্যে শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক ও অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম হওয়া খুব জরুরী। কেননা, তা না হলে নেতৃত্বদানের এ গুণ অর্জন করা যায় না। তিনি মনে করেন, উচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত মার্কিন নাগরিকরা সাধারণভাবে এ দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। কারণ, বিজ্ঞান-বহির্ভত বিষয়ে উচ্চ ডিগ্রীপ্রাপ্তরা তো বটেই, এমনকি বিজ্ঞানে উচ্চ ডিগ্রীপ্রাপ্তরাও বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও জ্ঞানকে গ্রহণ করে থাকেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে প্রকাশিত সত্য বা ঐশ্বরিক বাণী  রূপে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এর কারণ কি? কেন এমন হয়? এলবার্টস মনে করেন, এর কারণ একটিই। জ্ঞান-চর্চায় প্রমান এবং যুক্তির  ব্যবহার কি করে করতে হয়, তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না শেখালে, সব কিছুকে প্রমান ও যুক্তির সাহায্যে যাছাই করার শিক্ষা না দেওয়া। তাঁর মতে, পশ্চিমা দুনিয়ার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমহে এ শিক্ষা দেওয়া হয় না। তিনি মনে করেন, এ কারণেই উচ্চশিক্ষিত আমেরিকানরাও উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না, সংস্কারমুক্তভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে না। এ কারণেই তাঁরা সাধারণত ডারউইনবাদ বা বিবর্তনবাদের মত বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কারকেও মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মার্কিন পদার্থবিদ ভিক্টর স্টেংগার-এর মতটি প্রণিধানযোগ্য । যুক্তি ও প্রমাণ ব্যবহার করা বা না করার মাপকাঠিতে তিনি মানুষের জ্ঞানের তিনটি প্রধান শাখা – ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের -মধ্যে পাথর্ক্য নির্ণয় করেছেন। ধর্মীয় বিশ্বাসে যুক্তি ও প্রমাণের দরকার নেই, ঐশী বাণীই যথেষ্ট। দর্শন ও বিজ্ঞান স্বর্গীয় বাণীতে আস্থাশীল নয়। দর্শন নির্ভর করে যুক্তির উপর, প্রমাণের উপর নয়। কিন্তু বিজ্ঞান নির্ভর করে যুক্তি ও প্রমাণের উভয়ের উপর। এ দুটির কোন একটি ছাড়া বিজ্ঞানের চলে না। বিজ্ঞান তো বটেই, মানুষের কোন জ্ঞানই অভ্রান্ত  নয়। হতে পারে না। জ্ঞান ভ্রান্ত না অভ্রান্ত, তা যাচাই করার একমাত্র বাটখারা বা উপায় হচ্ছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের এর প্রয়োগ শেখায় না, সেটি উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হতে বাধ্য।

দেশের কয়েকটি সেরা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, উক্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বহু পথ অতিক্রম করতে হবে, অনেক বাধাকে ডিঙাতে হবে।

চলবে…