পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি না থাকায় দেশের শিক্ষাসম্পর্কিত কর্মকাণ্ডগুলোর অধিকাংশ চলছে নির্বাহী আদেশ দ্বারা। নির্বাহী আদেশের সুবিধা হলো তড়িৎগতিতে, চাহিদানুযায়ী ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনুকূল সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। অসুবিধা হলো, একাধিক সিদ্ধান্তের মধ্যে ধারাবাহিকতা থাকে না, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অনুসারে পরিচালিত হয়, আদেশের বিপরীতে তাত্ত্বিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে না এবং আদেশটা কতোটুকু লাগসই, যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত- তা যাচাইয়েরও উপায় থাকে না। এ ধরনের নির্বাহী আদেশের বলে দৈনন্দিন বা রুটিন কাজ চলতে পারে, কিন্তু মানবসম্পদ উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত ক্ষেত্রগুলোতে নির্বাহী আদেশ কখনোই কাজের কিছু বলে মনে হয় না।

এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে এসএসসি পাশের পর শিক্ষার্থীদের কলেজে ভর্তির বিষয়টি। গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর পর প্রথম দু’বছর কলেজে ভর্তি নিয়ে সমস্যা হয় নি। পরের বছরগুলো থেকে নানা সমস্যা দেখা দিতে থাকে। হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ‘মেধাবী’ হয়ে যাওয়ার চাপ কলেজগুলো সামলাতে পারে নি। যেহেতু উচ্চশিক্ষাস্তরে (কলেজকে যদিও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবেই ধরার কথা, কিন্তু অনেকে একে উচ্চশিক্ষার সাথে মিলিয়ে ফেলেন) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, কিংবা বলা ভালো, ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম, তাই সমস্যাটি প্রথম থেকেই লেজেগোবরে মিশে যায়। গোল্ডেন ৫ (এই বস্তুটা কি বাংলাদেশের আবিষ্কার?) পাওয়া একজন শিক্ষার্থী নিশ্চয়ই কামারপাড়া ডিগ্রি কলেজের চেয়ে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হতে চাইবে!

বিগত বছরগুলোতে সমস্যাটার একটা দারুণ উদ্ভাবনীমূলক সমাধান (!) বের করেছিলেন নির্বাহী আদেশ দানকারী কর্তাব্যক্তিরা। এসএসসিতে সমমানের ফলাফলকারীদের মধ্যে বয়সে অপেক্ষাকৃত জ্যেষ্ঠকে ভর্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিলো। তাঁদের যুক্তি- যাদের বয়স কম তারা পরবর্তী বছরে চান্স পাওয়ার একটা সুযোগ বেশি পাবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ যুক্তি পত্রিকায় প্রকাশের পর কেউ যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ‘হোয়াট ইজ দ্য ডিফারেন্স বিটুইন লজিক অ্যান্ড ফ্যালাসি’ শিরোনামে কোর্স করানোর অফার দিতো, তাহলে অত্যন্ত আমোদিত হতাম। এই সিদ্ধান্তের মানে দাঁড়ায়- সে বছর যারা ভর্তি হতে পারবে না, তাদেরকে পরবর্তী বছরে আরও হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। এতে তাদের সম্ভাবনা যে আরও কমে যায়, সেই বোধটুকুও বোধহয় সিদ্ধান্তদাতাদের ছিলো না। সবচেয়ে বড় কথা, সিদ্ধান্তটা উল্টো হলেও একটা যুক্তি থাকে যে, যারা বয়সে ছোট তারা বড়দের চেয়ে কম সময়ে লেখাপড়া করে এই জায়গাটায় উঠে এসেছে; সুতরাং এই কৃতিত্বের কারণে ভর্তির ক্ষেত্রে তারা অগ্রাধিকার পাওয়ার উপযুক্ত। সহপাঠীদের চেয়ে বেশি বয়সী থাকা অকৃতিত্বেরই (ব্যতিক্রম ছাড়া) তো ব্যাপার, নাকি?

২.
এবার রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে। জিপিএ পদ্ধতির নিয়মানুসারে, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক কর্তৃক আবিষ্কৃত গোল্ডেন, সিলভার, তামা, সীসা, রূপা নামধারী জিপিএ ৫-এর সাথে ‘পানসে’ অর্থাৎ শুধু জিপিএ ৫-এর কোনো পার্থক্য থাকা উচিত না। পদ্ধতি অনুসারেই যেখানে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের জন্য বেশ ক’টি ভাগ করা হয়েছে, সেখানে সেগুলোরও ভেতরে নতুন ভাগ করে একই গ্রুপের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা উচিত নয়। এই যুক্তি ঠিক থাকলে শুধু গোল্ডেন ৫ নয়, ৪৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীর সবার অধিকার আছে পছন্দের কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়ার। যেহেতু সে অনুসারে ‘ভালো’ কলেজগুলোতে সিট নেই, তাই কর্তৃপক্ষকে ভর্তির ক্ষেত্রে এবারও একটি নতুন ক্রাইটেরিয়া বেছে নিতে হয়েছে। কর্তৃপক্ষকে সাধুবাদ জানাতেই হয় কারণ তারা বেশি বয়সী শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার ফালতু নিয়মটাকে বাদ দিয়েছে।

এই নতুন ক্রাইটেরিয়াতে প্রথমে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ভালো করেছে তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। যদি এতেও সমস্যা হয়, তাহলে বোর্ড থেকে শিক্ষার্থীর নম্বর এনে যে বেশি নম্বর পেয়েছে, তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়ালো? নম্বর পদ্ধতির অসুবিধাগুলো দেখিয়ে যে জিপিএ পদ্ধতি চালু করা হলো, সব মিলিয়ে সেই উল্টো পথের যাত্রাই কি আবার চালু হলো না?

গ্রেডিং পদ্ধতিতে ৮১ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীর সাথে ১০০ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীর কোনো পার্থক্য নেই। এটা নিয়েও বিতর্ক আছে। সেই বিতর্ককে এড়িয়ে পদ্ধতিটাকে যদি ঠিক ধরি, তাহলে কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ৮১ ও ১০০ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীকে সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সেটা না করে একই মূল্যায়ন ব্যবস্থার অধীনে শিক্ষার্থীকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভিন্নতর উপায়ে মূল্যায়িত করা হচ্ছে কেন?

৩.
এর সুনির্দিষ্ট ও সরাসরি উত্তর আমার কাছে নেই, কর্তাব্যক্তিদের কাছে আছে কিনা জানি না। কিংবা এর আশু সমাধান কী হতে পারে- সে বিষয়ে তাড়াহুড়াপূর্ণ কোনো বক্তব্য আমার নেই, থাকা উচিতও নয়। শিক্ষার একটা পর্যায় বা স্তরের সাথে আরেকটা পর্যায় বা স্তর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট একটা স্তরকে হঠাৎ করে গুরুত্ব দিতে গেলে এর প্রভাব অন্যটার ওপর পড়বেই। গণপরীক্ষায় নকলবিরোধী অভিযানের সময় থেকে অভিযানটাকে মাহাত্ম্য দেওয়ার জন্য তৎকালীন বিএনপি সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাশের হার বাড়িয়ে দেয়। সে সময় খাতা দেখায় কড়াকাড়ি না করা, কম নম্বর পেলে কীভাবে বেশি নম্বর দেওয়া যায় ইত্যাদি বিষয়ে বোর্ড থেকে পরীক্ষকদের বিশেষ নির্দেশনাও দিয়েছিলো বলে শোনা যায়। আর এদেশে গুণগত শিক্ষাটাকে যেহেতু সরাসরি পাশের হারের সাথে সম্পৃক্ত করে ফেলা হয়, তাই বিএনপি সরকার জোরেশোরে প্রচার করতে থাকে যে, তাদের সময়ে শিক্ষার মান বেড়েছে।

তখন থেকেই এ ধারাবাহিকতা চলে আসছে। শুধু তাই নয়, পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক ও বর্তমান মহাজোট সরকারের সময়ও জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বানের পানির মতো বেড়েই চলেছে। সম্ভবত এদিক দিয়ে পূর্ববর্তী সরকারকে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটা তাড়না কাজ করছে বর্তমান সরকারের মধ্যে। কিংবা এও হতে পারে, এতোদিন ধরে বিপুল হারে জিপিএ ৫ পাওয়ার ধারাটা বর্তমান সরকার হঠাৎ করে থামাতে চাইছে না। কিন্তু তারা যে এ ব্যাপারে সচেতন, সেরকম কোনো আলামতও দেখা যায় নি।

ফলে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সরকারকে কলেজ ভর্তির জন্য একটা নীতিমালা তৈরি করতে হয়েছে। এই নীতিমালা এখন মোটামুটি প্রতিবছর তৈরি হচ্ছে এবং এক বছরের নীতিমালার সাথে আরেক বছরের নীতিমালার কোনো মিল নেই। বয়সের কারণে যে শিক্ষার্থী গত বছর ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারে নি, বয়সপ্রথা উঠিয়ে দেওয়ায় তার কী অব্স্থা হবে সেটা নিয়ে বোধহয় কেউ ভেবেও দেখে নি। কম বয়সে মেধাবী হওয়ার কারণে সে তো দুটি বছরেই বঞ্চিত হলো!

যে কোনো পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার জন্য একটি আপাত স্থায়ী নীতিমালা দরকার- যে নীতিমালা প্রণীত হবে শিক্ষার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী স্তরের কাঠামোবিন্যাস, আঙ্গিকগত দিক ও চাহিদাকে সমন্বয় করে। এর জন্য প্রথমে গণহারে নম্বর দেওয়ার পদ্ধতিটা বাতিল করা দরকার। লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৪৫ হাজার জিপিএ ৫ পেতেই পারে, কিন্তু ইনপুট ও প্রসেসের সাথে আউটপুটের সম্পর্ক বিবেচনা করলে এখানে এই সংখ্যাটিকে বাস্তবসম্মত বলা যায় না।

শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন ও মার্কিং পদ্ধতিটা কী হবে সে সম্পর্কে এখনই একটি সুনির্দিষ্ট অবস্থানে পৌছা দরকার। তারপর কোন স্তরে কী পরিমাণ শিক্ষার্থী থাকতে পারে, থাকা উচিত, পরবর্তী স্তরের সম্ভাব্য চাহিদা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে সেখানে কীভাবে শিক্ষার্থীদের সুষমভাবে এবং চাহিদানুযায়ী পাঠানো যায়, সেটি ঠিক করা উচিত। বলা বাহুল্য, শিক্ষার সাথে সম্পর্কহীন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, সচিব বা আমলাদের দিয়ে এ কাজটি কখনোই করা ঠিক হবে না (এখন আসলে তাই হচ্ছে); কারণ তাঁরা একেকজন আসেন একেক ক্ষেত্র, মন্ত্রণালয় বা বিভাগ থেকে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর ক্ষেত্র, মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বদল হয়। যারা স্থায়ীভাবে এগুলো নিয়ে কাজ করছেন, এই দায়িত্বটা শুধু তাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত।

দেশে নতুন শিক্ষানীতি তৈরি হচ্ছে। এতে এ সম্পর্কিত সুপারিশ ও দিকনির্দেশনা থাকার কথা। শিক্ষানীতি প্রণীত হলে অন্য অনেক কাজের পাশাপাশি সরকারের উচিত হবে এ সম্পর্কিত একটি আপাত স্থায়ী নীতিমালা তৈরি করা যা মোটামুটি কয়েক বছর পর পর পর্যালোচনা করা হবে এবং পরিবর্তিত সময় ও চাহিদার সাথে মিল রেখে প্রয়োজনে বদলানো হবে।

আর যদি সেটি না করে বর্তমানের মতো নির্বাহী আদেশে সব কাজ করা হয়, তাহলে বছর দশ-পনের পর দেশে জিপিএ ৫-এর বন্যা বইবে, কিন্তু সেখান থেকে কোনো পলিমাটি পাওয়া যাবে না।