গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং বিশ্ব রাজনীতি 

বিপ্লব দাস

 

 

                     

প্রায় ১০০ বছরেরও আগে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস বলেছিলেন, মানুষ যে হারে খনিজ জ্বালানিকে ব্যবহার করছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর আবহাওয়া গরম হয়ে ওঠার খুব সম্ভাবনা আছে। যেহেতু সেসময় পরিবেশ সচেতনতার কোনো ধারণা ছিল না তাই তখন তাঁর কথায় কেউ কান দেয়নি।না সমাজসেবক,না রাষ্ট্রনায়ক এমনকি তৎকালীন বিজ্ঞানীরাও।তারা তখন পার্থিব সম্পদগুলিকে মানবসভ্যতার উন্নয়নের কাজে লাগানোয় ব্যস্ত ছিলেন। বিশ শতকের তিন এবং চারের দশকে যখন সারা পৃথিবী্তে শিল্পের জোয়ার, পৃথিবীর ওপর কতৃত্ব কায়েম করতে গিয়ে মহাযুদ্ধ হচ্ছে তখন কিছু কিছু বিজ্ঞানী আশঙ্কা প্রকাশ করলেন পৃথিবীর উষ্ণতা ধীরে ধীরে বাড়ছে।

 

গ্লোবাল ওয়ার্মিং কি? কেন পৃথিবীর এমন পরিণতি? এর প্রতিকারের উপায় কি?- সবই আজকের পৃথিবীর বহু চর্চিত বিষয়। কিন্তু যে বিষয়গুলি নানা বিতর্কের নীচে ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে তা হল গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে বিশ্ব রাজনীতির জঘন্য কূটকৌশল। যেহেতু প্রতিটি দেশের সরকার নিজেদের টিকিয়ে রাখতে দেশের শিল্প এবং বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর ওপর প্রচন্ড ভাবে নির্ভরশীল তাই ধনী বাণিজ্যিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে দেশগুলি পৃথিবীর বিপদ ডেকে আনছে। সাধারন মানুষের অজ্ঞাতে চলছে ট্রাপিজের নানান খেলা।

 

স্টকহোম সম্মেলন

২০০৭ সালের মে মাস। ব্যাঙ্কক শহরে সারা মাস ধরে বিভিন্ন স্কুলের কঁচিকাঁচারা মিছিল করে, পোস্টারিং করে। তাদের সাথে হাত লাগায় কলেজ পড়ুয়ারা। উদ্যোক্তা শহরের কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এই বিপুল আয়োজনের একমাত্র কারন শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক  পরিবেশ সম্মেলন যাতে ১২০ টি দেশ অংশগ্রহন করছে। অতিথি অভ্যর্থনায় শহরের পোস্টার ফেস্টুনে লেখা হল সেভ দ্য আর্থ, সেভ দ্য ক্লাইমেট্‌, নো মোর গ্রিন হাউস গ্যাস

 

পৃ্থিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বিজ্ঞানীরা চিন্তিত হয়েছেন বিশ শতকের তিনের দশক থেকে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সব চিন্তাভাবনা কুক্ষিগত ছিল নির্দিষ্ট কয়েকজন বিজ্ঞানীর গন্ডির মধ্যেই। ১৯৭০ সালে আমেরিকার হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র প্রথম ওজোন স্তরের ছিদ্র বিষয়ে শো্রগো্ল শুরু করেন। এই সুত্রে ক্যালিফোর্নিয়ায় এক বিশাল মিছিল বের হয় ওই বছরেরই ২২ এপ্রিল। সেই সময়ে ওই ছাত্রটি হাঙ্গামা না বাধালে আমরা হয়ত একটু পিছিয়ে পড়তাম। পৃথিবীর ক্যান্সারটি ধরা পড়তে আরও দেরী হয়ে যেত। ক্যালিফোর্নিয়ার মিছিল রাষ্ট্রপুঞ্জকে চিন্তা করতে বাধ্য করায়। রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৪ জুন ১১৫ টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সুইডেনের স্টকহো্ম শহরে সম্মেলন করেন। সেখানে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র রক্ষার্থে ১৫০ টি পরিকল্পনা এবং ২৬ টি নীতি গ্রহন করা হয়। স্থানাভাবে মাত্র ৪ টি নীতির উল্লেখ করছি যেগুলি সরাসরি গ্লোবাল ওয়ার্মিংএর সাথে সম্পর্কযুক্ত। যদিও ভূ-উষ্ণায়ন, বাস্তুতন্ত্র, জলবায়ু পরিবর্তন সব একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তাই সব নীতিগুলি উল্লেখ করতে পারলেই ভাল হত। যাই হোক, ১ নং নীতিটি ছিল– স্বাধীনতা, সমতা, মর্যাদা এবং জীবনধারনের উপযুক্ত সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ একটি মৌলিক অধিকার বিশেষ। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য পরিবেশ রক্ষা করা মানুষের এক পবিত্র কর্তব্য। তাই যে সব নীতি বা মতবাদ বর্ণবৈষম্য, জাতিবৈষম্য ও হানাহানি, সামাজিক বিভেদ, ঔপনিবেশিকতা, অন্যায়, অত্যাচার এবং বিদেশী প্রভুত্ব কে মদত দেয় তাকে দূর করতে হবে। ৬ নং নীতি এতে বলা ছিল কোনো প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন বিষাক্ত গ্যাস বা তাপ যা পরিবেশের পক্ষে নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব নয় এবং মনুষ্ব্য বাস্তুতন্ত্র সহ অন্যান্য বাস্তুতন্ত্রের অপূরনীয় ক্ষতি করছে তা যেন পরিবেশে বর্জিত না হয়। ২৩ নং নীতি– আন্তর্জাতিক বা জাতীয় স্তরে পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন মান ও সূচক দেশের পরিস্থিতির বিচারে প্রয়োগ করতে হবে।

 

বড় গোলমেলে নীতি তো। এরকম কয়েকটি নীতির জন্যই আমেরিকায় ঠান্ডা পানীয়ে কীটনাশকের মাত্রা আর আমাদের মত উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশে মাত্রা অন্য। ইউরোপের দেশগুলিতে যানদূষণের নিয়মে কড়াকড়ি অথচ এখানে নিয়ম মেনে চললেও গাড়িগুলি এত বেশি বিষাক্ত গ্যাস বের করবে যে বলার নয়। আন্তর্জাতিক নীতিগুলি এরকম না হওয়াই উচিত। উন্নত দেশের মানুষের মত একই রকমের ফুসফুস হৃৎপিন্ড সম্বলিত হয়েও আমাদের মধ্যে কি এমন অতিরিক্ত ক্ষমতা রয়েছে যাতে টন্ টন্ কার্বন-মনোক্সাইড গ্রহণ করতে পারবো? নিয়ম একটাই হবে এটাই বাঞ্ছনীয়।অনুন্নত দেশগুলিকে বাবা বাছা করে নিয়ম মানানোর জঘন্য খেলা বন্ধ করা উচিৎ নয় কী? নিয়মগুলি মানতে গেলে কী কী কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে সেটা দেশগুলির নিজস্ব কাঠামোর উপর নির্ভর করবে।

 

২৬ নং এবং সবশেষ ণীতিটি– পারমানবিক অস্ত্র ও অন্যান্য বিধ্বংসী ক্রিয়াকলাপ থেকে মানুষ ও তার পরিবেশকে মুক্ত রাখতে হবে। এ ধরনের অস্ত্র ধ্বংস ও বিলোপের জন্য রাষ্ট্রগুলি দ্রুত আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করবে।

 

হায় যদি এমন হত। ১৯৭২ এর জুন থেকে ২০০৯ এর এপ্রিল। ৩৭ বছর কেটে গেছে। প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা আপনারা এই নীতিটির কোনো কার্যকারিতা দেখেছেন কী?

 

১৯৭২ থেকে ১৯৯১ সাল

স্টকহোম সম্মেলন অবশ্য একটি কাজ করে। পরিবেশের সমস্যাগুলি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। ফলস্বরূপ বিজ্ঞানীরা পরিবেশ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন ব্যক্তিগত ভাবে কিংবা সংস্থাগত ভাবে। নানা দেশে ঝটপট অনেকগুলি পরিবেশপ্রেমী সংস্থা গড়ে ওঠে।

 

জলবায়ুর পরিবর্তন বিষয়ক আলোচনার জন্য ১৯৭৯ তে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতে প্রথম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হয়। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮০ তে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে শিল্প এবং জলবায়ু শিরোনামে আর একটি সম্মেলন হয়। আলোচনার বিষয় জেনেভা সম্মেলনের মতই ছিল। ওজোন স্তরের ছিদ্র এবং তার রক্ষার্থে প্রথম আন্তর্জাতিক মানের সভা হয় ভিয়েনাতেই ১৯৮৫ সালে। ইতিমধ্যেই এই ধারনাটি আন্তর্জাতিক মহলে ছড়িয়ে গেছে যে ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের মত গ্যাসগুলির অবাধ নির্গমনে ওজোন স্তরে ক্ষতি হচ্ছে। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে ইউনাইটেড নেশনস এনভায়োরমেন্ট প্রোগ্রাম-এর উদ্যোগে ৩৫ টি উন্নত দেশের প্রতিনিধিরা কানাডার মন্ট্রিল শহরে মিলিত হন। ওজোন স্তরের দুরবস্থা বিষয়ক একটি চুক্তিপত্রের খসড়া সেখানে তৈ্রী করা হয়। ওজোন স্তর সংক্রান্ত এটিই প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ বলে গন্য করা হয়ে থাকে। খসড়াতে বলা ছিল ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের ব্যবহার রোধ করতে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এই যৌগটির উৎপাদন একেবারেই বৃদ্ধি করা হবেনা। ১৯৯৩ সালের মধ্যে উৎপাদন মাত্রা ২০ শতাংশ এবং ১৯৯৮ সালের মধ্যে আরও ৩০ শতাংশ কমিয়ে ফেলা হবে। এছাড়া অন্যান্য ক্ষতিকারক যৌগগুলি যেমন ক্লোরিন, ব্রোমিন ইত্যাদির মুক্ত অবস্থায় বাতাসে নির্গমনের হার ১৯৯৯ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ কমিয়ে নেওয়া হবে। নীতি-লক্ষ্যমাত্রা-ঘোষণা সবই হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ৩৫ টি দেশের মধ্যে মাত্র ৩০ টি দেশ খসড়াতে স্বাক্ষর করে। তাছাড়া অতীব ক্ষতিকারক রাসায়নিক যৌগ ক্লোরোফ্লূরোকার্বনের বিকল্প রাসায়নিক যৌগ আবিস্কার করার সিদ্ধান্ত হলেও যে সমস্ত দেশ বিকল্প উপায় বের করে তারা নিজেদের আবিস্কারকে সম্পূর্ণ গোপন রাখে।

 

১৯৮৮ সালে কানাডার টরেন্টো শহরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় কার্বন ডাই- অক্সাইডকে রোখার উদ্দেশ্যে। সেখানে স্থির হয় আগামী ২০০৫ সালের মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের হার কমপক্ষে ২০ শতাংশ কমিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু বাধ সাধে আমেরিকার মত উন্নত দেশগুলি। তাদের বক্তব্য ছিল, বিজ্ঞানীরা কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে বলছেন। অবস্থা এতটা সঙ্গীন নয়। তাই এখনই এত কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে কলকারখানার ঝাঁপ বন্ধ করার কোনো যুক্তি নেই।

 

তবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ইতিহাসে ১৯৮৮ সালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ইউনাইটেড নেশনস এনভায়োরনমেন্ট প্রোগ্রাম এবং ওয়ার্ল্ড মেটিওরোজিক্যাল অর্গানাইজেশন-এর উদ্যোগে গ্রিন হাউস গ্যাসগুলির প্রভাব নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করতে ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আই পি সি সি নামে একটি সংস্থা গড়ে ওঠে।

 

১৯৮৯ সালে দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়, একটি হেলেসিঙ্কি সম্মেলন অন্যটি হেগ সম্মেলন। প্রথমেরটি মার্চ মাসে, দ্বিতীয়টি মে মাসে। কিন্তু দুটি সম্মেলনেই উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য আসেনি।

 

রিও সম্মেলন

গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে আজ অবধি যত সভা-সম্মেলন হয়েছে রিও সম্মেলন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং বিতর্কিত। এটিকে প্রথম বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলন বলা হয়ে থাকে। ১৯৯২ সালের ৩ জুন থেকে ১৪ জুন ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনিরোতে ১৭৮ টি দেশের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রপুঞ্জের ডাকে জড়ো হন। দুঃখের কথা সম্মেলনের ঠিক আগে আগে যে সমস্ত প্রস্তুতি সভা হয়েছিল সেখানে অংশগ্রহনকারী দেশগুলি নিজ নিজ স্বার্থ অনুযায়ী স্পষ্টত দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি উত্তর ব্লক দ্বিতীয়টি দক্ষিণ ব্লক। দক্ষিণ ব্লকে ছিল ব্রাজিল, চিন, ভারতের মত অন্নুনত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি যাদের সরাসরি অভিযোগ-উন্নত এবং ধনী দেশগুলির জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৬ শতাংশ কিন্তু তারা ব্যবহার করে পৃথিবীর মোট খাদ্যবস্তুর ৬০ শতাংশ, মোট শক্তির ৭০ শতাংশ এবং শিল্পে ব্যবহার্য কাঠের ৮০ শতাংশ। গ্রিন হাউস গ্যাস বৃদ্ধিতে উন্নত দেশগুলির দায়িত্ব বেশি তাই পরিবেশকে সুস্থ করার কর্মসূচিতে তাদেরই অর্থ ব্যয় করতে হবে।

 

 এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, দক্ষিণ ব্লকের এমন অভিযোগের সারবত্তা রয়েছে। কোন কোন দেশ কত পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন করে তার একটি আনুমানিক তালিকা পেশ করছি।

 

উন্নত দেশ

অনুন্নত দেশ

আমেরিকা

১৪৩ কোটি টন

চিন

৮৪  কোটি টন

 

রাশিয়া

৪১  কোটি টন

ভারত

২৫  কোটি টন

 

জাপান

৩১  কোটি টন

দক্ষিণ কোরিয়া

১০  কোটি টন

 

জার্মানি

২৪  কোটি টন

দক্ষিণ আফ্রিকা

.৫  কোটি টন

 

ব্রিটেন

১৫  কোটি টন

মেক্সিকো

.৪  কোটি টন

 

কানাডা

১২  কোটি টন

ইরান

.৬  কোটি টন

 

ইটালি

১১  কোটি টন

ব্রাজিল

.৫  কোটি টন

 

 

 

 

 

 

 

 

(১৯৯৫ সালের অর্থাৎ রিও সম্মেলনের কাছাকাছি সময়ের একটি বছরের হিসেব এটি। তথ্যসুত্রঃ-ক্লাইমেটোলোজিঃ সবিন্দর সিং; পৃষ্ঠা ৩৮৫)

 

রিপোর্ট দেখে বোঝা যায় পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানিদের ভূমিকা কতখানি।তাই দক্ষিণ ব্লকের অভিযোগ ফেলে দেওয়ার মত নয়।

দক্ষিণ ব্লকের অভিযোগের কর্ণপাত না করে উত্তর ব্লক অথাৎ জি-৮ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি যেমন-আমেরিকা, ব্রিটেন, ইতালি, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান, জার্মানি, রাশিয়া এই সম্মেলনে বলে পৃথিবীর সমস্ত দেশের কাছেই বিপদ আসন্ন তাই ২০০৫ সালের মধ্যেই সব দেশকে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ অন্তত ২০ শতাংশ কমাতে হবে এবং সব দেশকে কাঠ ও কয়লার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কেননা কাঠ এবং কয়লা থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হবার সম্ভাবনা থাকে।

 

এর জবাবে দক্ষিণ ব্লক জানিয়ে দেয় তাদের পক্ষে উত্তর ব্লকের আবদার মানা সম্ভব নয়। কেননা তারা উন্নয়নশীল বা অন্নুনত দেশ। আরও বেশি জ্বালানি ব্যবহার না করলে তাদের শিল্পোন্নতি থমকে জাবে। ২০ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস কমাতে গেলে তারা প্রচন্ড ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বরং উন্নত দেশগুলি গত ৫০ বছর ধরে প্রচুর গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপন্ন করে এসেছে, তাই সেখানেই লাগাম ধরা উচিৎ।

 

এর পরেই পরিবেশের দুরবস্থার জন্য দক্ষিণ ব্লক আঙুল তোলে উত্তর ব্লকের যথেচ্ছ প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার এবং অপচয়ের প্রবনতার দিকে। আর উত্তর ব্লক অভিযোগ করে অন্নুনত দেশগুলির জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং নির্বিচার অরণ্য ধ্বংসই গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর মূল কারন।

 

বাদ-অনুবাদের চাপান উতোরে রিও সম্মেলন শেষ হয়।সম্মেলনের মূল লক্ষ্যগুলি অর্থাৎ ওজোন হোল বন্ধ করা এবং গ্রিন হাউস গ্যাসের উৎপাদন কমানোর কোনো সমাধান হয়নি। উন্নত দেশগুলি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা জাতীয় আয়ের ০∙৭০ শতাংশ পরিবেশ পরিচ্ছন্ন করার কাজে অন্নুনত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ঋণ হিসেবে দেবে। কিন্তু কোথায় কী। সেই সহায়তা কদিন বাদে নেমে দাঁড়ায় মাত্র ০∙২৭ শতাংশে। তবে জাপান এবং ইউরোপীয় দেশগুলি কথা দিয়েছিল কার্বন ডাই-অক্সাইডের উৎপাদন ২০০০ সালের মধ্যে নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত নামিয়ে আনার চেষ্টা করবে। জার্মানি বলে তারা ২০০০ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ কমাবে। আর আমেরিকা? এখানেও নিজের গোঁ ধরে রাখে এবং কোনো সময়সীমা নির্ধারনে রাজি হয়নি।

 

দ্বিতীয় বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলন

রিও সম্মেলনের পরে ১৯৯৫ সালে বার্লিনে, ১৯৯৬ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে দুটি সম্মেলন হয় বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের হার কমানোর জন্য। কিন্তু দুটি সম্মেলনই ব্যর্থ হয়ে যায় স্রেফ ঐক্যমতের অভাবে। ১৯৯৭ সালের ২৩ জুন থেকে ২৭ জুন আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে ১৭০ টি দেশের প্রতিনিধিরা বসেন যেখানে ৭০ টি দেশের প্রধানমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন।এটিকে প্লাস ফাইভ শীর্ষ সম্মেলন বলা হয়ে থাকে।কারন রিওর ঠিক পাঁচ বছর পর এটি হয় এবং এর মুল উদ্দেশ্য ছিল রিও সম্মেলনের অমীমাংসিত বিষয়গুলি ফের আলোচনা করা। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৭ এই পাঁচ বছরে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, অরণ্য ধ্বংসের হার কমেনি। দেশে দেশে হু হু করে জনসংখ্যা বেড়েছে জেনেও আমেরিকার মত একটি অন্যতম শক্তিশালী দেশের অনমনীয়তার  কারনে দ্বিতীয় বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলনটি শেষ হয় নিরেট শুন্য হাতে নিয়ে। অথচ এমন হওয়া উচিৎ ছিল না কেননা ততদিনে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের গবেষনার ফলে সারা পৃথিবী জেনে গিয়েছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর পরিণতি কি ভয়াবহ। গ্রীষ্মের দাপট বেড়ে যাবে, উত্তাপ বেড়ে যাওয়ায় মেরু প্রদেশ এবং তুষারিত পর্বতমালাগুলির বরফ যাবে গলে,আর অতিরিক্ত জলরাশি বৃদ্ধি করবে সমুদ্রের জলস্তরকে। ফলস্বরূপ পৃথিবী জুড়ে থাকা বিস্তীর্ন সমুদ্র উপকূল যাবে ভেসে। বরফ গলা জল না থাকায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মিসিসিপি-মিসৌ্রি সমস্ত নদী জলবহন কমে যাবে। নদী কে কেন্দ্র করে থাকা মানবসভ্যতা চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। গরম বেড়ে যাওয়ায় নিরক্ষীয় অঞ্চলের রোগ জীবানুগুলি পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়বে এবং ব্যাপক হারে মহামারী দেখা দিতে পারে। ওজোন স্তরের ক্রমাগত ক্ষয়ের কারনে ক্যান্সারের মত মারাত্মক রোগগুলি বেড়ে যাবে। উষ্ণতর পরিবেশে নতুন নতুন জীবানুর আবির্ভাব ঘটবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃষির ফলন কমে যেতে পারে। উষ্ণতা বৃদ্ধি-জলস্তর বৃদ্ধি-জলীয় বাষ্পের শক্তি বৃদ্ধি এই সিকোয়েন্সে সাইক্লোন, টর্নেডো, সুনামি সব দূর্যোগ বৃদ্ধি পাবে এবং আরো মারাত্মক হারে। এত কিছু জানা সত্বেও দেশে দেশে সমন্বয়তার অভাব আমাদেরই বিপর্যয় ডেকে আনছে।

 

কিয়োটো  প্রোটোকল

১৪৯ টি দেশ আবার মিলিত হয় ১৯৯৭ সালের ১ ডিসেম্বর জাপানের কিয়োটো শহরে। বেশিরভাগ দেশের ঐক্যমতের ভিত্তিতে সেখানে একটি চুক্তি করে হয়েছিল।সেই চুক্তি বলবৎ করতে লেগেছে দীর্ঘ আটটি বছর। ২০০৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে বলবৎ হয়। ১৪৯ টি দেশের মধ্যে ২০০৮ সাল অবধি মাত্র ১৪১ দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। চুক্তি অনুযায়ী- আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপান ১৯৯০ সালে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন করত তা থেকে যথাক্রমে ৭ শতাংশ, ৮ শতাংশ এবং ৬ শতাংশ কমাতে বাধ্য থাকবে। প্রস্তুতির জন্য তাদের ৩ বছর সময় দেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে ২০০৮ সাল থেকে কাউন্ট ডাউন শুরু,চলবে ২০১২ সাল পর্যন্ত। তবে উন্নয়নশীল এবং অন্নুনত দেশগুলিকে কোনো মাত্রা বা সময়সীমাতে বেঁধে দেওয়া হয়নি। তারা নিজেদের বিকাশের ধারা অক্ষুন্ন রেখে যতটুকু পারবে করবে এমনটা স্থির হয়েছে।

 

যথারীতি আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া চুক্তি মানতে রাজি ছিলনা। তাদের সাফ বক্তব্য ভারত এবং চিন উন্নয়নশীল দেশ বলে তাদেরকে চুক্তির আওতা থেকে বাদ দেওয়া হবে কেন? কেননা ওই দুটি উন্নয়নশীল দেশ মিলে মোট গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রায় ১৪ শতাংশ উৎপন্ন করে।

 

সত্যি বলতে কি আমেরিকার এই যুক্তি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কিয়োটো প্রোটোকলের সমসাময়িক একটি রিপোর্ট বলছে, জীবন ধারনের স্বাচ্ছন্দ্য কম থাকায় উন্নয়নশীল দেশে মাথাপিছু বার্ষিক গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হয় মাত্র ২৪০০ কেজি। যেখানে উন্নত এবং ধনী দেশের স্বাচ্ছন্দ্য এবং ভোগ বিলাসের উপকরণ মেটাতে মাথাপিছু বার্ষিক নির্গমন প্রায় ১১৯০০ কেজি। গোলমাল পাকায় জনসংখ্যা নিয়ে। এই সব গরীব দেশগুলির জনসংখ্যা এত বেশি যে মাথাপিছু কম হলেও সারা দেশে মোট গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন অনেক বেশি হয়ে যায়।ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ এদের দায়িত্ব অস্বীকার করা যায়না।

 

কার্বন ব্যাবসা

কথাটি কার্বন ট্রেডিং নামে বিশ্ব বাজারে পরিচিত। কিয়োটো প্রোটোকলে একটি নতুন নিয়ম চালু করা হয় যাতে শিল্পের অগ্রগতি রোধ না হয় আবার কার্বন ডাই-অক্সাইডের মত গ্রিন হাউস গ্যাসগুলিও কম পরিমাণে নির্গত হয়। কিয়োটো প্রোটোকলে কি হয়েছিল?প্রতিটি দেশের কার্বন ডাই-অক্সাইড নিসঃরণ একটি সীমার মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, তাই তো? এবার যে দেশ তার নির্ধারিত সীমার চেয়ে কম পরিমাণ কার্বন ছড়াবে সেই অনুপাতে তার নামে কার্বন ক্রেডিট জমা হবে। ওই ক্রেডিট সে বিশ্ব বাজারে বিক্রি করতে পারে। কিনবে কারা ?যারা নিজের সীমার চেয়ে বেশি পরিমাণ কার্বন ছড়াতে চায় তারা। কার্বন কেনাবেচার বাজারে মধ্যস্থতা করবে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। অনেকটা শেয়ার মার্কেটের মত এই কার্বন বাজার সারা পৃথিবীর মোট গ্রিন হাউস গ্যাস কমাতে পারবে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। শুধুমাত্র কার্বন ট্রেডিং-এর নিয়ম কানুন তৈ্রি করতে ১৯৯৮ সালের জুন মাসে জার্মানির বন শহরে এবং নভেম্বরে আর্জেন্টিনার বুয়েন্স এয়ার্সে দু-দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করা হয়।

 

একুশ শতকে

কিয়োটো প্রোটোকলের প্রস্তাবকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাচ্ছিল্য করলে বিশ্বময় ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়।তখন স্থির হয় আমেরিকাকে বাদ দিয়েই কি করে কিয়োটো প্রস্তাব কার্যকর করা যায় তার চেষ্টা করা হবে। সেই লক্ষ্যে ১০ নভেম্বর, ২০০১ সালে মরক্কো তে একটি আলোচনা সভা বসে। কার্বন ট্রেডিং নিয়ে এখানে চুলচেরা বিশ্লেষন চলে। শুধু তাই নয়,কোনো দেশ পরিবেশ সংক্রান্ত দ্বায়িত্ব লঙঘন করলে তাকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে একটি প্রস্তাব আনা হয়।

 

 ততদিনে সহনশীল উন্নয়নের মতবাদ টি জনপ্রিয় হয়েছে। প্রাকৃ্তিক সম্পদ কৃপণতার সাথে ব্যবহার করে এবং কম পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপন্ন করে কিভাবে অর্থনৈ্তিক বিকাশের ধারা অক্ষুন্ন রাখা যায় তার দিশা খুঁজতে ২০০২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহেনেসবার্গ শহরে একটি বিশ্ব শীর্ষ সম্মেলন বসে। সেখানে যেসব বিষয়ে সমাধান সূত্র বের হয় তাতে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ সায় দেয় কেবল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের অনুপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। একুশ শতকে লক্ষ্যণীয় যে প্রতিটি আলোচনার সিদ্ধান্তগুলির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। জোহেনেসবার্গ সম্মেলন, ২০০২ সালের নভেম্বরে দিল্লি এবং ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে বুয়েন্স এয়ার্সের আবহাওয়া সংক্রান্ত বিশ্ব সম্মেলনের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রগুলি স্বঃতপ্রণোদিত ভাবে সমর্থন করে।

 

২০০৭ সালে আই পি সি সি চার-চারটি সম্মেলন করে। ২ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং গ্রুপ-১ এর সামারি ফর পলিসি মেকার্স রিপোর্টটি বের হয়।৬ এপ্রিল ওয়ার্কিং গ্রুপ-২ এর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।ওয়ার্কিং গ্রুপ-৩ এর রিপোর্ট প্রকাশ পায় ৪ মে। এই সূত্রে তাইল্যান্ডের ব্যাঙ্কক শহরে ১২০ টি দেশের ৪০০ প্রতিনিধি মিলে একটি সম্মেলন করেন। আর সিন্থেসিস রিপোর্ট পেশ হয় ১৭ নভেম্বর।

 

১৭ বছর লাগাতার কাজ করে যাওয়ার পর ২০০৭ সালে আই পি সি সি কে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

আমরা এখন তাকিয়ে আছি বিশ্বের তাবড়-তাবড় পরিবেশবিদদের দিকে। ভয়ঙ্কর বিপদের ত্রাতা রূপে তারাই একমাত্র আমাদের রক্ষা করতে পারেন। তবে রাষ্ট্রনায়ক এবং শিল্পপতিরা সদর্থক ভূমিকা না নিলে তাদের কিছুই করার নেই।

 

 BIPLAB DAS

SCIENCE AND RATIONALISTS ASSOCIATION OF INDIA

(JUKTIBADI SAMITI)

 

 Contact:    [email protected]

 [email protected]