বিক্ষিপ্ত ভাবনা -১ 

তৃতীয় নয়ন

 

 

মুক্তমনা সমাজের মধ্যে যুক্তিবাদ ও মুক্তচিন্তা প্রচার ও প্রসারের জন্য অনেকদিন থেকেই চেষ্টা করে আসছে। নানা  সময়ে নানা জনের বহু চিন্তা জাগানো লেখায় মুক্তমনা সমৃদ্ধ হয়ে  আসছে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেই বা কত সংখ্যক মানুষ মুক্তমনা সাথে পরিচিত? আমরা যতই মুক্তচিন্তা বা যুক্তিবাদ বলে  আস্ফালন করি না কেন বাস্তবতার কথা ভেবে দেখতে হবে। সেই বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এই মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদ ব্যাপারটি একবারেই অনুপস্থিত। এর একটি কারণ হতে পারে বাংলাদেশে সিংহভাগ মানুষেরই যেখানে প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রাম করতে করতে, জীবনের নুন্যতম প্রয়োজ়ন মেটাতেই  প্রানান্তকর অবস্থা সেখানে তাদের এইসব বিষয় ভেবে দেখার সময় ও সু্যোগ কোথায়? যে মানুষটির দিন শুরু হয় নানারকম চিন্তা দিয়ে, নিজের ও পরিবারের সদস্যদের রুটি রুজির সন্ধানেই যার সংগ্রাম, বাড়ি ভাড়া পরিশোধের চিন্তা, ছেলে-মেয়ের আবদার রক্ষা, তাদের পড়ালেখার খরচ, তাদের জীবনের প্রতিষ্ঠিত করার চিন্তা, নিজের পেশাগত জীবনে নানা ব্যস্ততা, আনুষ্ঠানিকতা, সামাজিকতা, নিজের অবস্থান উন্নত করা- এতসব কিছু করে আর এসব আদর্শবাদি চিন্তা বা মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ, সমাজ পরিবর্তন নিয়ে ভাবা  বা ওয়েবসাইটের এই বিশাল বিশাল আর্টিকেলগুলো পড়া কি সম্ভব? একজন মানুষ একা কিই বা আর করতে পারে? জানি, এর কোন সমাধান নেই। সব কিছুর মধ্য দিয়েই সব কিছু চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তারপরও প্রশ্নগুলো রাখলাম।   পারিপাশ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষের উপর ব্যপক প্রভাব ফেলে। কম্পিউটারের সামনে বসে মুক্তমনা ওয়েবসাইট ব্রাউজ করে এর প্রতিদিনকার আর্টিকালগুলি পড়তে ভালই লাগে। মনে হয়, নাহ! সমাজ বদলাতে হবে। ঠিকই বলেছেন লেখক। কিন্তু বাস্তবে কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠে গিয়ে ঘর থেকে বাইরে গেলে সবার সাথে interact করলে বোঝা যায় বাস্তবতা কত কঠিন। তখন আর মুক্তমনার লেখকদের সমমনা লোকদের টিকি ও  দেখা যায় না। তাদের হয়তো মাইক্রোস্কপ দিয়ে খুজ়তে হবে। তখন মনে হয় অন্য গ্রহে চলে এসেছি। কেমন যেন একটা শুন্যতায় ভুগি ঐ মুহুর্তে। অবশ্য এটি শুধু মুক্তমনার ক্ষেত্রেই হয় না, অন্য অনেক কিছুর ক্ষেত্রেই হয়। কতজন কত বইপত্র, আর্টিকেলই তো লিখেন ; কত বুদ্ধিজীবি কত প্রবন্ধই তো লিখেন পত্রিকার কলামে, কত আদর্শের কথাই তো শুনি চারদিকে, কত স্বপ্নের কথাই তো শুনি ও পড়ি। কিন্তু তার কত শতাংশ বাস্তবায়িত হয়? সাধারণ মানুষ এসব কতটুকুই বা পাত্তা দেয়? শেষমেশ দেখা যায় , সমাজ যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে; সমাজ তার নিজস্ব ঘুণেধরা সংস্কার অনু্যায়ীই চলছে। ঘুরেফিরে সেই একই চিত্রই দেখা যায়। মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ এসব কেবল বইয়ের পাতা কিংবা ওয়েবসাইটের সার্ভারেই সংরক্ষিত হয়ে থাকে।

 

 

মুক্তমনা যতই ধর্মের বেড়াজাল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, বাস্তবতা হলো ধর্ম এখনো এদেশের সমাজে সাদরে গৃহিত। ধার্মিকেরা এখনো সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। ধর্ম মানলে সমাজে এখনো  স্থুল বাহবা পাওয়া যায়। ধর্মকে এখনো সবাই ভয় পায়। ধর্ম প্রকৃতপক্ষে মেনে চলছে খুব কম মানুষ কিন্তু ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, দুর্বলতা এখনো এই সমাজে প্রবলভাবে বিদ্যামান। প্রকাশ্যে ধর্ম নিয়ে সমালোচনামূলক আলোচনা এখনো দুঃসাধ্য।  আমার  আম্মু আমাকে প্রায়ই বলেন যে, নামাজ পড়োনা কেন? তোমাকে এত নামাজ পড়তে বলি, তুমি পড়ো না। নাস্তিক হয়ে যাচ্ছো। আমি কি উত্তর দিব ভেবে পাই না। কারন আমার কাছে যুক্তি আছে কেন নামাজ পড়িনা। কিন্তু সেই যুক্তি দিয়ে আম্মুর সাথে তর্ক করতে গেলে তাঁর সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। খুবই কঠিন একটা পরিস্থিতি। সবসময় এজন্য ভয়ে ভয়ে থাকি আম্মুর কাছে গেলে কখন আবার নামাজ পড়ার কথা বলেন! আমাদের দেশে  যেকোন অনুষ্ঠানে বা সভা-সেমিনারের শুরুতে এখনো কোরান তেলওয়াত দিয়ে শুরু করা হয়। তখন মনে হয় , তাহলে এত মুক্তমনা, মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদের দরকার কি? আমরা তো ঘুরেফিরে সেই ধর্মের কাছেই আত্নসমর্পন করছি।   আসলে কিইবা করার আছে আমাদের! আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে ঐ মুহুর্তে সভায় উপস্থিত একজন মুক্তমনা, যুক্তিবাদি ব্যক্তির – যিনি প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস করেননা, যিনি মনে করেন ধর্মগ্রন্থের বিধি-নিষেধ, অনুশাসন মানব সভ্যতার প্রগতির পথে অন্তরায় – তার কি করা উচিত? তিনি কি উপস্থিত সভায় দাঁড়িয়ে  বলতে পারবেন “ আমরা ধর্মনিরপেক্ষ , অসাম্প্রদায়িক। কোরান তেলওয়াতের কোন প্রয়োজন নেই?  আমরা মুখে  যতই ধর্মনিরপেক্ষতা আর অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলি না কেন বাস্তবে তো এদেশে বুদ্ধিজীবি, সুশীল সমাজ, প্রগতিশীল, অপ্রগতিশীল সকলে ইসলামকে খুব সমীহ করে চলে। ইসলামের সরাসরি বিরোধিতা করার সাহস এদেশে খুব কম লোকেরই রয়েছে। তসলিমা নাসরিন এক্ষেত্রে একজন কিংবদন্তী। যা হোক, এদেশে ইসলামের বিন্দুমাত্র সমালোচনা সহ্য করা হয় না। ইসলাম সম্পর্কে টু শব্দ করলে তার টুটি চেপে ধরা হয়। মাঝে মাঝে আমি yahoo chat room এ বাংলাদেশের রুমগুলোতে গিয়ে ইসলাম নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করি। ইসলামের বিভিন্ন অনুশাসন নিয়ে প্রশ্ন করি। ধর্মের অনেক কদর্য রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করি। কিন্তু বিধি বাম! খুব কম মানুষেরই সমর্থন পাই। সবাই আমাকে সতর্ক করে দেয় ইসলাম নিয়ে  যেন আমি কোন কথা না বলি। Islam is the greatest and most scientific religion. ইসলামের কোন সমালোচনা নয়। যেন ইসলাম এক মহার্ঘ্য। তাকে ধরা যাবে না। ছোঁয়া যাবে না। তাকে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিতে হবে। অনেকে অকথ্য ও হিংস্র ভাষায় আমাকে আক্রমন করে।

 

 

 

আমরা প্রায়ই বলি আমরা একবিংশ শতাব্দীতে বাস করছি। বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষতার স্বর্ণ শিখরে আরোহন করেছি।  আধুনিক যুগে বাস করছি। কিন্তু আমাদের মনমানসিকতা সত্যিই কতটুকু আধুনিক হয়েছে? কতটুকু সংস্কারমুক্ত হয়েছে? ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, থ্রিজি, ওয়াইফাই, ওয়াইম্যাক্স,  উইন্ডোজ ভিস্তা, আইফোন, আইপড, ম্যাকবুক প্রভৃতি বিজ্ঞানের সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যাবহার করেও আমরা মনের মধ্যে পুষে রাখি মধ্যযুগীয় সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামি। যার কারনে একদিন yahoo chat এ এক ব্যক্তিকে  আপাদমস্তক বোরখা পরিহিতা (শুধু দুই চোখ খোলা) একজন নারীর ছবি দেখিয়ে বললাম, কেমন লাগছে একে? উত্তরে বললো, ভাল। প্রত্যেক মুসলমান মেয়ের এরকম বোরখা পরা উচিত! আমি বিস্ময়ে থ হয়ে গেলাম! প্রশ্ন করলাম কেন? বললো, আল্লাহ বলেছেন। তার বিধান লংঘন করা যাবে না। অবশ্য অমুসলিম মেয়ে হলে বোরখা পরা লাগবে না কি অবলিলায় বিনা যুক্তিতে কথাটি বলে দিল। আমি নিজে এ কথাটি বললে আমার নিজের মনেই প্রশ্ন জাগতো। কিন্তু তার মনে কোন প্রশ্ন জাগলোনা। সে শুধু বলে সে মুসলমান। মুসলমান হিসেবে আত্নপরিচয় তুলে ধরে সে এক ধরণের hallucination  এ ভুগছে। ভাবখানা এমন যে ইসলাম যদি বলে গোবর খাওয়া ভাল, তাহলে সত্যিই সেটা ভাল। যেহেতু ধর্ম বলেছে। ধর্মের বিধানের বিরোধিতা করা যাবে না। কোন প্রশ্ন করা যাবে না। বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হবে পছন্দ না হলেও। অথচ ঐ ব্যক্তি নিজের জীবনাচারে  মোটেই ধার্মিক নয়, ধর্ম নিয়ে সে গত এক বছর কিছু ভেবেও দেখে নি। সে বিশ্বের অনেক কিছুই দেখেছে, অনেক দেশ ভ্রমন করেছে, বিশ্ববাস্তবতা সম্পর্কে সে অবগত। কিন্তু তারপরও সে সংকীর্ণতা থেকে বের হতে পারছেনা। এই হচ্ছে আমাদের সংস্কারমুক্ত মানসিকতা (!) এতকাল শুনে এসেছি গ্রামের মানুষের অনেক কুসংস্কার থাকে। ঝাড়-ফূক, মজ়া পুকুড়ের আলো ভুতের আলো এইসব গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে ।  কিন্তু আমরা তথাকথিত শহরবাসিরা কি খুব বিজ্ঞানমনস্ক? বিনা যুক্তিতে আমরা বলছি একদল মেয়েকে বোরখা পরতে হবে আরেক দল মেয়ের বোরখা পরা দরকার নাই। গায়ের উপর একটি বস্তা উল্টো করে চাপিয়ে রাখতে হবে! খোদার নির্দেশ!   উপরোক্ত ঘটনাটি কি প্রমান করে না যে আমরা শহরবাসিরাও কুসংস্কারে গ্রামবাসীর মতই ষোল আনা? মজার ব্যাপার হলো ঐ ব্যক্তি yahoo chat এ এসেছে মেয়ে খুজতে। তার একজন গার্ল ফ্রেন্ড দরকার। ডেটিং করতে চায়। আমাকে জিজ্ঞাস করে আমি ছেলে নাকি মেয়ে। এই বলে আমাকে সে কিছু পর্নো ছবি সেন্ড করতে উদ্যত হয়। তো বলুন, এই ধরণের লোকদের কি বলবো? আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারিনা! এরকম মানুষ সমাজে একটা নয় দুইটা নয়, ভুড়ি ভুড়ি। এরা খুব ভাল করেই, জানে, বোঝে, উপলব্ধি করে যে ধর্ম অক্ষরে অক্ষরে  মানতে গেলে জগৎ অচল হয়ে পরবে। তা সত্বেও এরা ধর্মকে অস্বীকার করতে চায় না। ধর্মকে এরা ভয় পায়। কিন্তু ভয় পেয়ে নিজেরা যে খুব ধর্ম মানে তাও নয়। এরা মনে করে ধর্ম নিয়ে ঘাটাঘাটি না করাই ভাল।

 


 তৃতীয় নয়ন, বাংলাদেশ নিবাসী মুক্তমনা সদস্য; ইমেইল –