রোম ভেনিসের গল্প

 

জিতা গোমেজ

 

২০০৬ এর মে মাসে গিয়েছিলাম পূন্যভূমি ভ্যাটিকান সিটিতে। সেই সাথে সুযোগ হয়েছিল রোম নগরী ভেনিস দেখার। আমার বাবা এবং মা অনেকদিন ধরেই ভাবছিলেন ইটালীতে যাবেন। হঠাৎ করেই আমার ছোটবোন সিদ্ধান্ত নিলাম আমরাও যাবো সাথে। আমার স্বামী কিশোর এবং বোনের স্বামী ব্লেইজ সংসার এবং সন্তানদের দেখশোনা করে সহযোগিতা করলো যেন আমরা নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে ঘুরে আসতে পারি। তাদের আন্তরিক অনুপ্রেরণা না পেলে আমাদের যাত্রা এতোখানি আনন্দময় হতো না। যাবার আগে প্রায় দেড় দুই মাস ভ্যাটিকান, রোম এবং ভেনিসের সম্পর্কে কিছু বই পড়ে নিলাম যাতে অল্প সময়ে অনেক কিছু দেখতে পারি। আমার স্যোশাল সিকিউরিটি অফিসের এক সহকর্মী প্রচুর বই, ছবি এনে দিলেন, সুবিধা অসুবিধার গল্প করলেন। আমাকে এতোখানি প্রস্তুত করে দেবার জন্য আমি সত্যিই তার কাছে ঋণী। কিছুদিন আগে তিনি গত হয়েছেন। এই লেখার পাঠকেরা হয়তো তীর্থে, ভ্রমণে বা কাজে রোমে যাবেন। তাদের যদি এই প্রবন্ধটি পড়ে কিছু প্রাচীন নিদর্শন দেখার সুবিধা হয় তাহলেই লেখাটি স্বার্থকতা পাবে।

 

ভ্যাটিকান সিটিতে প্রবেশ করলে এক শান্তিময়ভাব  আচ্ছন্ন করে সবাইকে। চারিদিকে  খৃষ্ট ভক্তরা দলে দলে প্রার্থনার মাধ্যমে ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে St. Peter’s Basilica – র দিকে। তীর্থযাত্রীদের মতই পর্যটকরাও ধর্মীয় গাম্ভীর্য রক্ষা করে চলে। সেন্ট পিটার গির্জা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে  সেইখানেই প্রায় ২০০০ বছর আগে সাধু পিটারকে হত্যা করা হয়েছিল। তার দেহাবশেষ সমাধিস্থ আছে ব্যাসিলিকার নিচে। ভ্যাটিকানের আছে নিজস্ব সৈন্য। তাদের পোষাকের নমুনা একেছিলেন মাইকেল এঞ্জেলো নিজেই। তার, এবং আরো অনেক বিখ্যাত শিল্পীর অবিস্মরণীয় শিল্পকর্ম প্রাচুর্যময় করেছে ব্যাসিলিকা এবং চত্বরটিকে। কুমারী মারিয়ার কোলে যীশু, মাইকেল এঞ্জেলোর বিখ্যাত পিয়েটা মূর্তিটি এতোই নিখুঁত যে চোখ ফেরানো যায় না। ব্যাসিলিকা থেকে বেরিয়ে চলে গেলাম সিসটিন চ্যাপেলে (Sistine Chapel), যার সম্পূর্ণ দেয়াল ও ছাদ ভরা চমৎকার সব রঙ্গীন চিত্রকর্ম। দিনের পর দিন কাঠের পাটাতনে চিত হয়ে শুয়ে খেয়ে না খেয়ে কখনো অসুস্থ হয়ে মাইকেল এঞ্জেলো আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে যে অনবদ্য শিল্পকর্ম আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন তা আরো বহুযুগ ধরে মানুষকে স্তম্ভিত করবে। দালানের বাইরে দেখেছি সেই বিখ্যাত চিমনি যার সাদা বা কালো ধোঁয়া দিয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয় নতুন পোপ মনোনয়নের। ভ্যাটিকান মিউজিয়াম এতো সুন্দর সব প্রাচীন সামগ্রীতে ভরা যে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে কয়েক বছর লেগে যাবে। উল্লেখযোগ্য লেগেছে খৃষ্টের জন্মের একশ বছর আগের তৈরি মূর্তি Lacoon, রাজা নিরোর বিশাল মার্বেল পাথরের স্নানের টাব এবং মোজাইক করা মেঝে। কারকেলার বিশাল স্নানের প্রাসাদে আরো এমন নিদর্শন পাওয়া যায়। হাজার হাজার বছর আগে কোন আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া কি করে মানুষ এতো নিখুঁত কারুকার্যময় মোজাইক অথবা দালানকোঠা তৈরি করতে পেরেছে ভেবে বিস্মিত হই।

 

ভ্যাটিক্যান লাইব্রেরীতে রয়েছে প্রচুর দূর্লভ প্রাচীন বই। Gallery of Map  এ আজ থেকে পাঁচশ বছর আগের হাতে আঁকা পৃথিবীর যে মানচিত্রগুলো শোভা পাচ্ছে তা আধুনিক যুগের পরীক্ষার মাধ্যমেও নির্ভুল প্রমানিত হয়েছে। St. Peter’s  এর উলটো দিকেই রয়েছে বিরাট এক প্রাসাদ। রাজা হেডারিয়ান যীশুর জন্মের ১২৩ বছর পরে এই স্থাপত্যের কাজ শুরু করেন তার নিজের মরদেহ ধারণের জন্য। রোম শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে থেকে দেখা যায় এই প্রাসাদটি। পরবর্তীতে এটিকে নামকরণ করা হয় Castle of St. Angelo। দুদিকে সারি সারি দূতের মূর্তি সজ্জিত একটি সেতু আছে প্রাসাদটির সামনে।

 

জানি না অপ্রাসঙ্গিক হবে কিনা, তবুও লিখছি রোমে দেখা কিছু বাংলাদেশী ভাইদের কথা। পরিচয় পেয়ে বলেছিলাম, আপনারা কি জানেন আপনারা কত ভাগ্যবান যে পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরে বাস করছেন? হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের মাঝে আপনাদের বসবাস। উত্তরে জানালেন তারা, বিশ্বাস করুন, জীবিকার তাগিদে এতোই ব্যস্ত থাকতে হয় যে একদন্ড সৌন্দর্য্য উপভোগের সুযোগও মেলে না। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বাস্তবেই দেখলাম কখনো তারা নাভোর্নার চত্বরে কখনো কলোসিয়ামের অথবা প্যান্থিয়নের সামনে খেলনা অথবা ব্যাগ বিক্রি করছেন। পুলিশের বাঁশি শুনলেই সব জিনিষ গুছিয়ে ছুটে যাচ্ছেন অন্য গন্তব্যে।

 

অগনিত গির্জায় শোভিত রোম নগরী। তার মধ্যে ল্যাটেরেনো (Laterano), ম্যাগলিও (Maggliore) সাধ্বী এগনেস এর গির্জা বিশেষভাবে পরিচিত। ল্যাটেরানোর মাঝেই রয়েছে সেই পূন্য সিঁড়ি যা দিয়ে যীশু খৃষ্টকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পিলাতের সামনে বিচারের উদ্দেশ্যে। এতো গির্জার মাঝেও আমার মন কেড়েছে সাধু পৌলের গির্জা। অনাড়ম্বর সবুজ চত্বরে ঘেরা এই গির্জাটি মনের মাঝে যে প্রশান্তির ছায়া ফেলেছিল তা তুলনাহীন। রোম নগরীকে সজ্জ্বিত করে রেখেছে অপূর্ব সব মূর্তিময় ফোয়ারা আর চত্বর। কোলোনা, ডিকাম্পো ফিউরি, ভেনেজিয়া এমনি কিছু চত্বর। সবচেয়ে সুন্দর নাভো্রনা। যার ঠিক মাঝখানটিতে রয়েছে শিল্পী বারনিনির নদী নামে মূর্তিময় ফোয়ারা। আমি আশ্চর্য হয়েছি জেনে তার একটি নদী গঙ্গা। শিল্পী সেলভির তৈরী মধ্যযুগীয় ট্রেভি ফোয়ারার (Trevi)  কথা ভুলতে পারি না। বহু ছায়াছবিতে এই ফোয়ারাটি ব্যবহার করা হয়েছে। কথিত আছে পেছনে ফিরে ফোয়ারাটিতে পয়সা ফেললে রোমে আবার ফিরে যাওয়া নিশ্চিত হবে। আধুনিক দালানকোঠার মাঝে কারুকার্যময় অপূর্ব ঐতিহাসিক ফোয়ারার সহাবস্থান বুঝি শুধু রোম নগরীতেই সম্ভব।

 

রোমের ঐতিহ্য তার প্রাচিনতম অংশ রোমান ফোরাম (Roman Forum)। অবিশ্বাস্য লাগে যে, ৩ হাজার বছরের পুরনো শহর আজও পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে মানুষকে হারানো দিনের সমৃদ্ধির কথা শোনায়।

 

ক্যান্সটানটিনের তোড়নের পাথুরে গায়ে হাত রেখে সর্বশরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। হঠাৎ মনে হলো আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে এমনি করে হয়তো কারো হাত এই পাথরটি ছুঁয়েছিল। এই পথেই একদিন হেঁটে গেছে রোমানবাসী উপাসনায়, বাজারে বা কাজে। গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রকে লালন করা হতো এই সেনেটেই। আর এইখানেই একদিন ব্রুটাসের হাতে নিহত হয়েছিল বিখ্যাত শাসক জুলিয়াস সিজার। তার কবরটি এখনও রয়েছে ফোরামে। বেনহুর ছায়াছবিটি অনেকেই হয়তো দেখেছেন। সেই গল্পটিতে একটি ঘোড় দৌড়ের মাঠ দেখানো হয়। ফোরামের কাছেই রয়েছে প্রাচীন সেই সার্কাস মাক্সিমাস (Maximus) মাঠটি। ঐতিহাসিক শহরের রয়েছে পাথরের বৃহৎ চাকতি যার পুরোটা জুড়েই রয়েছে একটি মুখ। কথিত আছে, সেই কালে বিশ্বাস করা হত মুখটিতে হাত ঢুকিয়ে মানুষের সত্যবাদিতা যাচাই করা যায়। মিথ্যেবাদীদের হাতটি কেটে ভেতরে রয়ে যেত।

 

রোম থেকে খুব সহজেই একটি ট্রেন নিয়ে চলে যাওয়া যায় ভেনিসে। ইচ্ছে করলে একই দিনে ফিরেও আসা সম্ভব। পৃথিবীর বুকে যে এতো চমকপ্রদ ভিন্ন ধরনের একটি শহর থাকতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। এই একটি মাত্র স্থান পৃথিবীতে যেখানে রাস্তা দিয়ে কোন যানবাহন চলে না। সেখানে গাড়ী, ঘোড়া, ট্রেন, বাস নেই, এমনকি একটা সাইকেলও নেই। সব যাতায়াতই করা হয় ছোট ছোট খাল দিয়ে নৌকোয় চড়ে। গন্ডোলা নামে এই জলযানগুলোর মাঝিরা সবাই একই ধরনের কাপড় আর টুপি পড়ে। খালের উপর দিয়ে আছে অজস্র ছোট ছোট সেতু। ইতালীর ভেনিস শহরটির গোড়াপত্তন হয় যীশুর জন্মের ৫০০ বছর পরে। সেই থেকে বিভিন্ন দেশের সভ্যতা এর উপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং তাদের নিজস্ব কৃষ্টির সম্ভারে ভূষিত করে। ভেনিসের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থানটি হলো সেন্ট মার্কের চত্বর (St. Marks)। বিশাল এলাকা জুড়ে চত্বরটির মাঝখানে রয়েছে সেন্ট মার্কের গির্জা। কথিত আছে, মিশর থেকে সাধু মার্কের দেহাবশেষ সংগ্রহ করে এই স্থানে পূনরায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল। ইউরোপের আর সব গির্জার চেয়ে সোনালী মোজাইক সজ্জ্বিত এই গির্জাটি একেবারেই অন্যরকম। ভেনিস যখন মধ্যযুগে ঐশ্বর্য্যে, প্রতিপত্তিতে শীর্ষস্থানীয় তখন বিভিন্ন দেশের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। হাজার হাজার বানিজ্য জাহাজ নোঁঙ্গর ফেলতো ভেনিসে। প্রতিটি জাহাজেই কিছু না কিছু উপহার আনা ছিল বাধ্যতামূলক। সেই কারণে সেন্ট মার্কে বিভিন্ন সভ্যতার আর সাংস্কৃতিক নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাইজেনটাইন ও ইসলামিক সভ্যতা। ডোজের (Doge) গোলাপী প্রাসাদ, বিশাল ঘড়ির প্রাসাদ সবই মন কেড়ে নেয়। সেন্ট মার্কের চত্বরের উলটো দিকে রয়েছে ১৭০০ সালের তৈরী সান্তা মারিয়া দেলা সালুতে নামে একটি সুন্দ গির্জা। ভয়ংকর প্লেগে যখন লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছিল মধ্যযুগে, তখন ভেনিসবাসীরা প্রতিজ্ঞা করে যে এই মহামারী থেকে মুক্তি পেলে তারা একটি গির্জা তৈরী করবে ধন্যবাদ দিতে। এই সেই গির্জা।

 

একটি সেতু না দেখলে ভেনিস দেখা অপূর্ণ থেকে যায়। তা হলো দীর্ঘশ্বাসের সেতু (Bridge of Sighs)। ডোজের, অর্থাৎ ততকালীন শাসকদের প্রাসাদে বিচারের পর কয়েদীদের একটি ছাদে ঢাকা বন্ধ সেতু দিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো কারাগারে। সেখানে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হতো অথবা আটকে রাখা হতো যাবৎজীবন। সেতুর ঝাঝরীকাটা ঘুলঘুলি দিয়ে কয়েদীরা শেষ বারের মত দেখতে পেত বাইরের পৃথিবী। ভেনিসের সৌন্দর্য্যের শেষ দৃশ্যটি একটি দীর্ঘশ্বাস হয়ে রয়ে যেত তাদের অন্তরে। সেই কারণেই নাম দীর্ঘশ্বাসের সেতু। রাতে ভেনিস সাজে আর এক মনমোহিনী সাজে। চারিদিকে প্রদীপের মত বাতি ঝিলমিল করে প্রতিবিম্ব ফেলে নদীর বুকে। মিষ্টি মধুর বাজনায় মুখরিত হয়ে থাকে সমস্ত প্রাঙ্গন আর ঘাট।

 

দেখতে দেখতে আমাদের ইতালীর ছোট সফর শেষ হয়ে এলো, আমরা ফিরে এলাম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আপন আপন জগতে। শুধু স্মৃতির পাতায় রোম আর ভেনিস অমর হয়ে থেকে গেল। ব্যক্তিগতভাবে স্মৃতি জিনিসটা আমার কাছে মূল্যবান। সবার কাছেই হয়তো। কারণ এটিই তো একমাত্র সম্পদ যা আজীবন থেকে যায়। আমার বাবা বলেন ভোগ একা করা যায় কিন্তু উপভোগ করতে হয় অনেকের সাথে। সেই কারণে বোধ হয় এই লেখা। এটি পড়ে যদি রোম, ভেনিসকে আমার মত করে কেউ পছন্দ করে উপভোগ করেন, তবেই লেখাটি সার্থকতা পাবে।