কাহনঃ বাংলা আবৃত্তি আর বাক শৈলী

ক্যাথেরীনা রোজারিও কেয়া

পর্ব

 

বলছিলাম অনুশীলনের কথাঅনুশীলন করে ভোকাল কর্ডের কম্পনাংক বাড়ানো যায়, উচ্চারন শুদ্ধ হয়, শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রনে আসেতবে অবিকল একজনের মত কণ্ঠস্বরে বানান সম্ভব নয়, তাই নিজের মত করে নিজ কণ্ঠের অনুশীলন শ্রেয়ডঃ অমিতাভ চট্রোপাধ্যায় বলছেন অযথা চীকার করে কথা বলবেন নাধূমপান, ধূলোবালি এড়িয়ে চলুন হঠা গরম বা ঠান্ডা কিছু খাবেন না বা ওরকম পরিবেশে যাবেন নানাক, কান, গলা বা দাঁতের অসুখ থাকলে ডাক্তার দেখাননিজের গলাকে চিনুন, ভোকাল কর্ডের অবলীলায় কোন পর্যন্ত যায় জেনে নিনসকালে লব জলে গার্গল করুন, বেশি দিন গলা বসে থাকলে ডাক্তার দেখান  

 

এই হল আপনার প্রস্তুতি পর্ব 

 

একটি ঘরে মোমবাতি জালিয়ে বসুন, নিঃশ্বাস নিন এবং ছাড়ুন যদি মোমবাতির শিখাটি নিঃশ্বাস ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে ওঠে তবে তার অর্থ হলো চর্চা করতে হবে প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণেরকড়ে আঙ্গুল দিয়ে কান ফুঁটো আটকে আ শব্দ করুননিজের কণ্ঠস্বর কম্পমাণ মনে হলে অনুশীলন করতে হবে কণ্ঠকে অকম্পিত করারএছাড়া আরো অনেক ব্যায়াম রয়েছেআরো জানতে চাইলে পড়ুন ডঃ নীরদ বরণ হাজরার আবৃত্তি কোষ।   

 

এবারে জেনে নিন কোথায় কীভাবে বাংলা আবৃত্তির প্রথম ব্যাবহার হয়েছেআদিতম শ্লোক বলা হয় মা নিশাদ প্রতিষ্ঠাং তমগম শ্বাশতী সমাঃ য ক্রঞ্ছ মিথুনাদেকম কাম মহিতমঘটনাটা বলা হয় এমন ছিল যে এক জোড়া পাখি যখন প্রেমে স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি করছিল তখন এক শিকারী তীরে বিধলেন পুরুষ পাখিটিসে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আর সঙ্গিনী পাখীটি কেঁদে কেঁদে চারপাশে ঘুরছেশিকারীটি আবার তীর ওঠালেন, এবার নিশানা সঙ্গীনিটিঅমনি বাল্মীকি বলে উঠলেন শ্লোকটি।   

 

যীশু খ্রীষ্টের জনমের ৩২৭ বছর আগে গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডারও কাব্য চর্চা করতেনআমাদের রত্নাকর কিন্তু তখন বাল্মীকি হননিআলেকজান্ডারের শিক্ষক গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল লিখলেন পয়েটিক্স বা কাব্যতত্ত্ব বা কবিতার বিষয়েপ্লেটো খুঁজলেন কবিতা ধ্বংস করে নাকি সৃষ্টি করেকিন্তু সে যুগে আবৃত্তির কি ধরন ছিল তা জানা যায় নাএ বিষয়ে তর্ক বিতর্ক রয়েছেগ্রীসের শষ্যের দেবী ডিয়ানসিসের সবে ডিয়ারাম্ব নামে এক ধরনের কবিতা আবৃত্তি হোত।। যীশুর জন্মের ৫৩৫ বছর আগে থেপসিসে এধরনের আবৃত্তি শুরুতারপর আসে কোরাস, ১৪ জন কবি সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করতেনআরেক ধরনের আবৃত্তি হতো গ্রীক দেবতা এ্যাপোলোর উদ্দেশ্যে প্রাচীন এই আবৃত্তির  ধরনের নাম নে-মএগুলো একা বা অনেকে হাল্কা বাদ্য যন্ত্রের সাথে পরিবেশন করতোখৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে থাইরমান লিখলেন আবৃত্তির জন্য কবিতা – রেপসদিতবে এর আবৃত্তির ধরন কি ছিল জানা যায়নি 

 

ধরা  যাক, আপনি আবৃত্তি চর্চা শুরু করলেন চ্ছা, প্রথমেই কি কবিতাটি মুখস্থ করে নেবেন?  রও ভিন্ন মত আছে  শংকরী প্রসাদ বসু বলছে, স্মৃতি নির্ভর আবৃত্তি আমার পছন্দের বিষয় আবার বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বলছেন আবৃত্তির মাধ্যমে কবিতাকে ছড়িয়ে দিতে হলে স্মৃতি সমন্ধে আপোষহীন ধারণা ছাড়তে হবে।   

 

আসল  কথা কি জানেন কবিতার অন্তর্নিহিত ভাবটা বুঝতে পারলে  কিন্তু আপনি অনেক খানি এগিয়ে গেলেনএকটি  বহুল শ্রুত ঘটনা —  শ্রী প্রদীপ ঘোষ আবৃত্তি  করতেন কবি শহীদ কাদরীর  কবিতা – তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা সেখানে  বেশ কৌতুক করে পড়তেন একটি চন্দ্রমল্লিকা ভাঙ্গিয়ে লক্ষ টাকা  পাওয়া যাবে ইতাদি ইত্যাদিজনপ্রিয় কবিতাটি মজা করে পড়তেন  এবং শ্রোতাও গ্রহন করতেন সেই ভাবে, একবার কবি শহীদ কাদরী প্রদীপ ঘোষকে বোঝালেন – কবিতাটি ছেলেকে দেয়া বাবার মিথ্যে শ্বা, স্ত্রীকে দেয়া মিথ্যে আশ্বাসের কথা বলছে বাবা জানেন যুদ্ধের অস্থির অবস্থায় সব প্রতিশ্রুতি পুরোবার নয়এরপরই পালটে গেলো প্রদীপ ঘোষের আবৃত্তির  ধরন নিজেই বলছেন, সে থেকে এই কবিতাটি করলেই আমার কণ্ঠে কৌতুক থাকলেও চোখে থাকে জল

  

কবিতার মুল বিষয়টি বোঝা প্রয়োজন কবি symbolic interaction  করেনপ্রতিকী ইঙ্গিত অভীজ্ঞতার ফসলকবি বললেন ফাগুন মাসে রাস্তায় ফোঁটা কৃষ্ণচূড়া আমাদের যাদের বংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের অথবা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আছে আমরা বুঝে নিলাম এ আর কিছুই নয় সালাম বরকতের রক্ততাহলে দেখুন ভাষায় কি প্রচন্ড সমৃদ্ধ আমরাএখানেই আমাদের ঐতিহ্যের জয়, সাফল্য।    

 

বিষয়টা হলো আবৃত্তিকারের অবস্থান সম্পর্কে,  সে যুগ চলে গেছে যখন শিল্পমাধ্যম ছিল পুঁজিপতির হাতে অথবা ধর্ম নিয়ন্ত্রন করতো কার অধিকার রয়েছে শিল্প চর্চা।।  শিল্পকলা এখন  লক্ষ মানুষের জীবন সাধনার নাম।  

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিরঞ্জন অধিকারী বলছেন, আবৃত্তিকারের যোগাযোগ শ্রোতার  সঙ্গে আর শ্রোতার সম্পর্ক কবির সঙ্গেকথাটা মেনে নিতে পারি নাআমারতো ধারনা আবৃত্তিকার আর কবিতাই শ্রোতার কাছে আসে প্রথম, পরে কবিকবির সাথে পাঠকের যতো খানি সম্পর্ক থাকে, মাঝে যদি আবৃত্তিকার  থাকেন তাহলে এই সম্পর্কে ছেদ পড়ে।  

 

এ বিষয়টি আপনার ভাববার অনেক সুযোগ রয়েছে আর সে সাথেই বুঝে ফেলেছেন যথেষ্ট স্বাধীনতা রয়েছে আপনার সরাসরি জনতার সাথে সম্পর্ক স্থাপনেএই যোগাযোগ কিন্তু আবৃত্তিকে গশিল্প করতে পারেযদিও নাটকের মত আঙ্গিক বাচিক, সাত্তিক আহার্য্য  আপনি ব্যাবহার করতে পারছেন নাআপনাকে বাচিক আর আর সাত্তিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হচ্ছেএখানেই জেনে রাখুন আবৃত্তি আর অভিনয়ের মধ্যে পার্থক্য।  

 

প্রসঙ্গত বলি,  নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী কবির চোখে আবৃত্তি বইতে বলছেন আবৃত্তি আর  পাঠ হলো স্মৃতি থেকে পড়া আর না পড়াকে কেন্দ্র করে।  

 

চলবে…

—————————————————————-

 

গবেষণা এবং পরবর্তীতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন  ডঃ ক্যাথেরীনা রোজারিওতিনি যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি শেষে বর্তমানে ফ্লোরিডা সরকারের শিক্ষা বিভাগে কর্মরত রয়েছেনআশির দশকের বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম সাহসী সংগঠক ও কর্মী ছিলেনটিএসসি কেন্দ্রিক আবৃত্তির সংগঠন স্বরশ্রুতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনিতার একক আবৃত্তির সিডি একজন অনিমেষ আজো জেগে আছে প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা থেকে ২০০৭ সালে