ডিজিটাল বাংলাদেশ বনাম রোকেয়া হল কর্তৃপক্ষ

প্রদীপ দেব

 

গত সপ্তাহটা কেটেছে সিডনিতে। ক্লিনিক্যাল রেডিওবায়োলজির একটা ওয়ার্কশপ ছিল। সেমিস্টার চলাকালীন একটানা এক সপ্তাহ সময় বের করাটা ভীষণ ঝামেলার কাজ। কারণ সপ্তাহের পাঁচদিনের মধ্যে চারদিন আমার ক্লাস আছে। তার ওপর গত সপ্তাহটা ছিল আমাদের ফার্স্ট সেমিস্টারের ফোর্থ উইক – টেস্ট উইক। তার মানে আমার স্টুডেন্টদের পরীক্ষাও ছিল সারা সপ্তাহ জুড়ে। কাজ থেকে ছুটি নেয়ার কোন উপায় নেই। কিন্তু ছুটি না নিয়েও – কাজের কোন ক্ষতি না করেও – মেলবোর্ন থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে সিডনিতে গিয়ে ওয়ার্কশপে এটেন্ড করা সম্ভব হয়েছে কম্পিউটার প্রযুক্তির কারণে। ধন্যবাদ ডিজিটাল টেকনোলজি। লেকচারগুলো রেডি করে অনলাইনে দিয়ে দিয়েছিলাম। আর স্টুডেন্টদের জন্য অনলাইন টেস্টের ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম। নির্দিষ্ট সময়ে তারা যার যার কম্পিউটারের সামনে বসে আমার লেকচার এটেন্ড করেছে। আর পরীক্ষাও দিয়েছে। আমি ওয়ার্কশপের ফাঁকে ফাঁকে – কফি ব্রেকে – লাঞ্চ ব্রেকে তাদের টেস্ট মনিটর করেছি, তাদের কোন প্রশ্ন থাকলে তার উত্তর দিয়েছি। ডিজিটাল টেকনোলজি আমাদের গতি দিয়েছে- কাজকে সহজ করেছে – কদিন আগেও যা অসাধ্য বলে মনে হতো – তা সাধ্য করে তুলেছে।

        এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমেরিকা, ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ায় বসে যা করা সম্ভব, বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে বসে তা করা সম্ভব কি না। এটা সত্যি যে অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা খুবই গরীব। অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিটি স্টুডেন্ট এর জন্য কম্পিউটারের ব্যবস্থা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানই করে দেয়। এখানে স্টুডেন্টদের ব্যবহারের জন্য রয়েছে বিশাল বিশাল কম্পিউটার ল্যাব। বাংলাদেশে সেরকম ব্যবস্থা করার জন্য ইউনিভার্সিটিগুলোর যে পরিমাণ অর্থ দরকার তা নেই। সেটা আমরা জানি। কিন্তু যদি সামর্থ্য থাকতো তাহলে কি সবার জন্য কম্পিউটারের ব্যবহার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হতো না? অবশ্যই হতো – এ বিশ্বাসে বাংলাদেশের ইউনিভার্সিটিতে কম্পিঊটারের দাবীতে কোন আন্দোলন হয় না। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা  নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিচ্ছে কোন না কোন ভাবে। মা-বাবা যেভাবেই হোক ছেলে-মেয়েদের কম্পিঊটার কিনে দিচ্ছেন। যাদের মা-বাবা পারছেন না, তারা নিজেরাই টিউশনির টাকা জমিয়ে কম্পিঊটার কিনছে। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে কোন না কোন ভাবে নিজেদের ডিজিটাল যুগের সাথে খাপখাইয়ে নেয়ার জন্য প্রস্তুত করে নিচ্ছে। এখন কেউ যদি বলেন যে শিক্ষার্থীরা কম্পিঊটার ব্যবহার করতে পারবে না, কারণ কম্পিঊটার ব্যবহার করলে তারা খারাপ হয়ে যাবে – কেমন লাগবে?

        কাল (২৮/৩/০৯) সমকালের প্রথম পাতায় অনলাইন জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছে মেয়েরা খারাপ হয়ে যাবে যুক্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোকেয়া হলের ছাত্রীদের ল্যাপটপ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। এ পদক্ষেপ কি ঠিক হয়েছে? দেখেই কেমন যেন মাথা খারাপ হয়ে যাবার অবস্থা আমার। অন্যান্য পত্রিকাগুলোতেও খুঁজে দেখলাম। প্রথম আলো সম্পাদকীয় ছেপেছে এ ব্যাপারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রোকেয়া হলে একটি রুমে একটির বেশি কম্পিঊটার মানে ডেস্কটপ রাখতে দিচ্ছেন না, আর কাউকে ল্যাপটপ ব্যবহার করতে দিচ্ছেন না। কারণ ছাত্রীরা ল্যাপটপ ব্যবহার করলে খারাপ হয়ে যাবে।

        আমার মনের ভেতর প্রথম যে প্রশ্নটি আসে তাহলো-  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সব উচ্চশিক্ষিত কর্তৃপক্ষ কি অত্যধিক গঞ্জিকা সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এরকম আবোল তাবোল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? খারাপ হয়ে যাওয়া বলতে কী বোঝাচ্ছেন তাঁরা? এটা ঠিক যে বাংলাদেশের মত দেশে প্রযুক্তির অনেক অপব্যবহার হয়। মোবাইল ফোনের অনেক অপব্যবহার হচ্ছে। নোংরা ভিডিও ক্লিপে বাজার ছেয়ে যাচ্ছে। মোবাইল ফোনে গোপনে ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু তা সামান্য কয়েকজনের বিকৃত মানসিকতার প্রতিফলন। তাই বলে আমরা বলছি না যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যাবে না। এখন ল্যাপটপ ব্যবহার করার সাথে মেয়েদের খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্পর্ক কী? আর মানুষের খারাপ হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা এত বেশি ব্যক্তিনির্ভর যে – তা নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ কোন মন্তব্য করা যায় না। ল্যাপটপ ও ডেস্কটপের সাথে তুলনা করলে ল্যাপটপের অন্যান্য সব সুবিধা বাদ দিলেও বাংলাদেশে ইলেকট্রিসির যে দুরবস্থা – তাতে ব্যাটারি সুবিধা থাকার কারণে ল্যাপটপই বরং কিছুটা হলেও কাজের সময়ে কাজ করার সুযোগ দেয়। সে অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মত জায়গায় একটা উঁচু অবস্থানে থেকে যারা এরকম পশ্চাৎপদ মন নিয়ে হাস্যকর নিষেধাজ্ঞা জারি করছেন তাদের ব্যাপারে সতর্ক হবার দরকার আছে। হয় তারা প্রযুক্তি সম্পর্কে আসলেই কিছু বোঝেন না, নয়তো বুঝেও না বোঝার ভান করেন। খালেদা সরকারের আমলে যেরকম কিছু মানুষ আমাদের বিনামূল্যে পাওয়া সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত হতে দেন নি।

        বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার শপথ নিয়ে দায়িত্বে এসেছে। কিন্তু এরকম ল্যাপটপ ব্যবহার নিষেধ করে কী ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া হবে? অবশ্য ডিজিট শব্দের আরো একটি অর্থ হয়। মেডিকেল টার্মে ডিজিট মানে আঙুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের কর্মকর্তাদের মত কিছু লোক হয়তো মনে করছেন তাদের আঙুলের ইশারায় বাংলাদেশ চলবে – এবং তা হবে তাদের নিজেদের ডিজিটাল বাংলাদেশ। আসলেই কি তাই?

 

২৯ মার্চ ২০০৯

মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।