আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিনে

প্রদীপ দেব

 

১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ সকাল সাড়ে এগারোটায় আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্ম। জার্মান ভাষায় লেখা তাঁর জন্ম-সনদঃ

 

einstein-259-a

 

   

বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় এরকমঃ

 

জন্মসনদ

সূত্রঃ ২২৪

উল্‌ম, ১৫ মার্চ ১৮৭৯

 

১৩৫ নং ব্যানহফস্ট্রাফ (বি), উল্‌ম নিবাসী ইহুদী ধর্মে বিশ্বাসী ব্যবসায়ী হেরমান আইনস্টাইন জানিয়েছেন যে তাঁর উল্‌ম এর বাসায় তাঁর সাথে বসবাসকারী ইহুদী ধর্মে বিশ্বাসী তাঁর স্ত্রী পলিন আইনস্টাইন (কোচ) ১৪ মার্চ ১৮৭৯ তারিখের সকাল এগারোটা ত্রিশ মিনিটে একটি পুং লিঙ্গের শিশু জন্ম দিয়েছেন। শিশুটির নাম রাখা হয়েছেন আলবার্ট।

– পঠিত, অনুমোদিত এবং স্বাক্ষরিত – হেরমান আইনস্টাইন-

নিবন্ধনকৃত – হার্‌টমান

 

einstein-255-a

 

আলবার্ট আইনস্টাইন – বয়স ৩-৪। আলবার্টের যতগুলো ছবি পাওয়া যায় তাদের মধ্যে এ ছবিটিই তার সবচেয়ে ছোট বয়সের ছবি।  

 

বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছোটবেলা নিয়ে আমাদের কৌতূহলের শেষ নেই। মাঝে মাঝে তাদের সম্পর্কে এমন অনেক ঘটনা প্রচারিত হয় – যার কিছুটা হয়তো সত্যি, বেশির ভাগই অতিরঞ্জন। আলবার্ট আইনস্টাইন সম্পর্কেও সেরকম অনেক কথা প্রচলিত আছে। যেমন জন্মের সময় নাকি আইনস্টাইনের মাথা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বড়। জন্মের সময় শিশুর মাথার আকার ছোট-বড় হতেই পারে। আলবার্টের মাথার সাইজের মাথা নিয়ে অনেক শিশু জন্ম নিচ্ছে প্রতিদিন। তাদের সবাই যে আইনস্টাইন হচ্ছে তা নয়। আলবার্ট অনেক দেরিতে কথা বলতে শুরু করেছিল এ প্রসঙ্গেও নানারকম তথ্য পাওয়া যায়। এই তো শুক্রবার (১৩/০৩/০৯) প্রথম আলোর অন্য আলো-তে লেখা হলো আইনস্টাইন কথা বলতে শুরু করেছেন চার বছর বয়সে – তাও একেবারে পূর্ণ বাক্য দিয়ে। এটাও অতিরঞ্জন।

 

 

বিশিষ্ট ব্যক্তিরা লেখাপড়ায় সাধারণ মানের হলে আমরা অতি-সাধারণরা  তা খুব মনে রাখি। যেমন রবীন্দ্রনাথ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ না করেও বিশ্বকবিসম্রাট হয়ে উঠেছেন তা আমরা খুব মনে রাখি। আলবার্ট আইনস্টাইনও যে স্কুল-কলেজের লেখাপড়ায় খুব একটা আহামরি কিছু ছিলেন না, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি-পরীক্ষায় একবার ফেল করেছিলেন – তাও খুব যত্ন করে প্রচার করি। দেখা যাক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় কেমন করেছিলেন আইনস্টাইন।

 

আলবার্ট আইনস্টাইন ১৭ বছর বয়সে স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা পাস করেন ক্যান্টন আরগাউ স্কুল থেকে। তাঁর স্কুল পাসের সার্টিফিকেট দেখুনঃ

 

 

einstein-260-a

বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় এরকমঃ

 

ক্যান্টন আরগাউ শিক্ষাবোর্ড এই মর্মে প্রত্যয়ন করছে যে, মিঃ আলবার্ট আইনস্টাইন, সাং – উল্‌ম, জন্মতারিখ- ১৪ মার্চ ১৮৭৯, আরগাউ ক্যান্টন স্কুলের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর টেকনিক্যাল কোর্সে অধ্যয়ন করেছে। ১৮৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৮, ১৯, ২১ ও ৩০ তারিখে অনুষ্ঠিত লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে তার প্রাপ্তনম্বর নিম্নরূপঃ

জার্মান – ৫

ফ্রেঞ্চ – ৩

ইংরেজি –

ইটালিয়ান – ৫

ইতিহাস – ৬

ভূগোল – ৪

এলজেব্রা – ৬

জ্যামিতি – ৬

বর্ণনামূলক জ্যামিতি – ৬

পদার্থবিজ্ঞান – ৬

রসায়ন – ৫

প্রাকৃতিক ইতিহাস – ৫

শৈল্পিক অংকন – ৪

কারিগরী অংকন – ৪

 

প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে এই সনদপত্র প্রদান করা হলো।

আরাউ, অক্টোবর ৩, ১৮৯৬।

 

তখনকার হিসেবমতে কোন বিষয়ে গ্রেড ৬ হলো সর্বোচ্চ গ্রেড। দেখা যাচ্ছে আইনস্টাইন গড়পড়তা ভালো ছাত্রদের দলেই ছিলেন। স্কুলে ইংরেজি ভাষা তিনি পড়েন নি কখনো। বিদেশী ভাষা ফ্রেঞ্চ ও ইটালিয়ান পড়েছিলেন। ইটালিয়ানে ভালোই করেছিলেন। ফ্রেঞ্চ খুব একটা ভালো করেননি।

 

স্কুলের লেখাপড়া নিয়ে আইনস্টাইন মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। স্কুলের শিক্ষকরা মিলিটারি কায়দায় জোর করে মাথার ভেতর পড়ালেখা ঢোকানোর চেষ্টা করবেন – আর শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে শিক্ষকদের আদেশ নিষেধ মেনে চলবে এটা তাঁর কোনদিনই ভাল লাগে নি। নিজের বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করতে গিয়ে স্কুলে আলবার্টকে অনেক অপমান সইতে হয়েছে। তাই স্কুলিং সিস্টেমের উপরই তাঁর আস্থা চলে গিয়েছিল। তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদ লাভের জন্য প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিরও ঘোর বিরোধী ছিলেন। কীরকম হওয়া উচিত পরীক্ষা পদ্ধতি? এ প্রশ্নের উত্তরে আইনস্টাইন বলেছিলেন – সারা বছর পাঠদানের পর শিক্ষার্থীরা একটা থিসিস বা এরকম কিছু লিখবে। এবং তা দেখে ডিগ্রি দিয়ে দেয়া হবে। মজার ব্যাপার হলো আইনস্টাইনের এ পদ্ধতি আসলে কোন কার্যকরী পদ্ধতি ছিল না। তিনি সিস্টেমের বিরোধীতা করলেও নিজের পছন্দমত কোন সিস্টেম চালু করে যেতে পারেন নি। প্রথম চাকরি হিসেবে তিনি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। সেই মিলিটারি কায়দায় শিক্ষাদান পদ্ধতির অংশ হয়েছিলেন। তখন হয়তো তাঁর সুযোগ ছিল না প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি পরিবর্তন করার। কিন্তু পরে বার্লিন বা  প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে কাজ করার সময় তিনি তাঁর পছন্দমত শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োগ করতে পারতেন – কিন্তু তা তিনি করেন নি। শিক্ষক হিসেবে তিনি খুব একটা সফল ছিলেন না। তাঁর অধীনে একজন শিক্ষার্থীও পি-এইচডি করেন নি। খুব একটা ভালো পড়াতেও পারতেন না তিনি। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে তাঁর অধ্যাপক পদটি ছিল মূলত গবেষণার জন্য। তিনি কোন কোর্স পড়াতেন না সেখানে। ইংরেজি লিখতে পারলেও ভালো বলতে পারতেন না বলেই হয়তো আমেরিকায় বসে ক্লাস নেয়া হয়নি তাঁর তেমন একটা।

 

আইনস্টাইন আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন ১৯৪০ সালে। তাঁর নাগরিকত্ব সনদ পত্র দেখুনঃ

 

einstein-266-a

 

 

আইনস্টাইনের ঈশ্বর-বিশ্বাস নিয়েও নানারকম মতবাদ চালু আছে। ঈশ্বরবিশ্বাসীরা যখন ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের বিরোধ নেই প্রমাণ করতে চান – কিংবা বলতে চান যে বিজ্ঞানে ধর্মের প্রয়োজন আছে – তখন আইনস্টাইনের একটা বাক্য খুব প্রচার করেন – তা হলো, ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান খোঁড়া, আর বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ। খুবই দার্শনিক কথাবার্তা। কিন্তু তাতে আসলে তেমন কিছুই প্রমাণিত হয় না। অনেক কিছু ব্যাপারে আইনস্টাইন খোলামেলা কথা বললেও ঈশ্বর বিশ্বাসের ব্যাপারে তিনি খোলাখুলি বলেন নি যে তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, নাকি করেন না। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস করেন না বলেছেন ঠিকই – কিন্তু ইহুদি ধর্মের ব্যাপারে তিনি অনেক কিছু করেছেন। উচ্চমার্গের ঈশ্বর বিশ্বাস তাঁর ছিল সবসময়। আবার ঈশ্বরের নামে মিলিটারি কায়দায় ধর্মের অনুশাসন মেনে চলার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। আমাদের পৃথিবীর বেশির ভাগ বুদ্ধিমান পাবলিক ফিগার আসলে এরকম। জনপ্রিয়তা হারানোর রিস্ক কেউই নিতে চান না। ঈশ্বরের কোন প্রয়োজন নিজেদের জীবনে না থাকলেও অন্যের মনে আঘাত কীভাবে দেবেন – ইত্যাদি যুক্তি দেখিয়ে ঈশ্বরের প্রশ্নে হয় নীরব থাকেন – নয়তো বলে থাকেন যে সকল ঈশ্বরই মহান। আইনস্টাইনও খুব একটা ব্যতিক্রম ছিলেন না এ ব্যাপারে। রিচার্ড ফাইনম্যান বা রিচার্ড ডকিন্সদের মত সাহসী হতে পারেন নি আইনস্টাইন। যেমন ঈশ্বরের প্রশ্নে আমাদের দেশের মুহম্মদ জাফর ইকবালও হুমায়ূন আজাদের মত সাহসী নন।

 

 

einstein-258-a 

 

আইনস্টাইন – বয়স ৭৫

 

১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল মারা যান আলবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর মৃত্যু-সনদ দেখুনঃ

 

 

 

 einstein-269-a

 

 

আইনস্টাইনের মৃত্যুর এত বছর পরও আইনস্টাইনের বিজ্ঞান এখনো আধুনিক। আইনস্টাইনের জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করছি আজ।

 

 

১৪ মার্চ ২০০৯

মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।