এতদিন ধরে ইতিহাস বলতে আমরা কেবল মানব সভ্যতার ইতিহাসকে বুঝতাম। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় সবকিছুর মত ইতিহাস সম্বন্ধনীয় এই ধারণাতেও পরিবর্তন এসেছে। ডারউইন যখন প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণা দিলেন তখন পৃথিবীর জীবকূলের ইতিহাস রচনার চেষ্টা শুরু করলেন অনেকে। এই চেষ্টায় অবশ্য বিজ্ঞানীরাই অংশ নিয়েছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞানের যাত্রা শুরুর পর থেকেই ইতিহাস এক ধাপ এক ধাপ করে এগোচ্ছে। আর এই ইতিহাস রচনা করছেন বিজ্ঞানীরা। ইতিহাস একেবারে চরম পর্যায়ে পৌঁছায় মহা বিস্ফোরণের ধারণা প্রদানের মাধ্যমে। কারণ এই ধারণার মাধ্যমে মহাবিশ্বের ইতিহাস রচনায় ব্রতী হই আমরা। এ ধরণের ইতিহাসের একটা নতুন নাম দেয়া যেতে পারে। বিজ্ঞানের মাধ্যমে ইতিহাস রচনা করা হচ্ছে বলে একে বৈজ্ঞানিক ইতিহাস বলা যেতে পারে। বিজ্ঞানের সাথে দর্শনের মিশেলে যেমন বৈজ্ঞানিক দর্শনের সৃষ্টি হয়, এটাও অনেকটা সেরকম। কিন্তু আবার ভেবে দেখলাম জীবকূলের ইতিহাস বা এ ধরণের ইতিহাসকে বৈজ্ঞানিক ইতিহাস বললেও মহাবিশ্বের ইতিহাসকে বোধহয় মহাজাগতিক ইতিহাস বলা অধিক যুক্তিসঙ্গত হবে। মহাজাগতিক ইতিহাস রচনার এই প্রচেষ্টায় মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন হল একটা চমৎকার সংকেতের সন্ধান লাভ। সেই সংকেতের নাম “মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ” ইংরেজিতে যাকে বলা হয় “কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন” বা সিএমবিআর।

নিউ জার্সির হোমডেলে স্থাপিত রেডিও দুরবিন যেটি দিয়ে পেনজিয়াস ও উইলসন সিএমবিআর সনাক্ত করেছিলেন

নিউ জার্সির হোমডেলে স্থাপিত রেডিও দুরবিন যেটি দিয়ে পেনজিয়াস ও উইলসন সিএমবিআর সনাক্ত করেছিলেন

মানবজাতির ইতিহাস মানুষকেই লিখতে হয়েছে। আর মহাজাগতিক ইতিহাস নিয়ে ভাবতে গিয়ে এই মাত্র একটা নতুন চিন্তা মাথায় আসলো। যার ইতিহাস তাকেই রচনা করতে হয়। এই সূত্র মেনে মহাবিশ্ব নিজেই তার ইতিহাস রচনা করে গেছে। মানুষের সাধ্য নেই সে ইতিহাস রচনা করবার। সে কেবল রচিত ইতিহাসের ভাষা বোঝার চেষ্টা করতে পারে। এই প্রচেষ্টায় অনেকদূর এগিয়ে গেছি আমরা। পটভূমি বিকিরণকে সেই মহাজাগতিক ইতিহাসের ভাষার বর্ণমালা হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। প্রাচীন মিশরীয় লিপি লেখা হয়েছিল হায়ারোগ্লিফিক বর্ণে। বর্ণ পেয়ে যাবার পর লেখার মর্মার্থ উদ্ধার করতে আমাদের খুব বেশি সময় লাগেনি। পটভূমি বিকিরণ যেহেতু পাওয়া গেছে, মহাবিশ্বের ইতিহাস জানতেও তাই বেশি দেরী হবে না। অচিরেই হয়তো বিজ্ঞানীরা সুনিশ্চিত তথ্যে ভরা বিশাল ভলিউমের ইতিহাস গ্রন্থ লিখে ফেলবেন। আমাদের জানা দরকার, এই পটভূমি বিকিরণটা কি এবং কি কারণে একে ইতিহাস লিখনের চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

অধিকাংশ বিজ্ঞানীই এ ব্যাপারে একমত যে, একটি মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং তখন থেকেই ইতিহাসের শুরু। তবে প্রাক-ইতিহাস তো থেকেই যায়। তাই মহা বিস্ফোরণের আগের যুগটাকে (যুগ বলা কি ঠিক হচ্ছে?) বলা হয় অগাস্টাইনীয় যুগ। এই নামটা অবশ্য জর্জ গামফের প্রস্তাব করা। খ্রিস্টান যাজক সেন্ট অগাস্টাইন মহা বিস্ফোরণের আগের যুগটাকে কেবল ঈশ্বরের জন্য নির্দিষ্ট বলে উল্লেখ করেছিলেন। সে কথা চিন্তা করেই গামফ এমন নামের প্রস্তাব করেন। অবশ্য এ নিয়ে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণার পরিবেশ এখনও সৃষ্টি হয়নি। তাই ইতিহাসের শুরুটা মহা বিস্ফোরণের পর থেকেই। বিস্ফোরণের সময় কি হয়েছিল তাও আমরা ভাবতে পারি না, কারণ স্থান-কালেরই সৃষ্টি হয়েছে মহাবিস্ফোরণের ১০ই-৪৩ (১০ টু দ্য পাওয়ার -৪৩) সেকেন্ড পর। এরপর থেকে মহাবিশ্বের ইতিহাসকে বিভিন্ন যুগে ভাগ করা হয়েছে। সভ্যতার ইতিহাসে যেমন, গ্রিক যুগ, রোমান যুগ, মুসলিম যুগ, মধ্যযুগ তেমনই মহাবিশ্বের ইতিহাসে রয়েছে বিভিন্ন ইপক। মহা বিস্ফোরণের পরের ১০ই-৪৩ সেকেন্ড পর্যন্ত যুগটা হল প্লাংক ইপক। এর পর থেকে গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন ইপক, হেড্রন ইপক, লেপ্টন ইপক, ফোটন ইপক ইত্যাদি বিভিন্ন যুগকে সংজ্ঞায়িত করেছেন বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে ফোটন ইপকটা নিয়ে বলবো এখানে। কারণ এই যুগেই পটভূমি বিকিরণের সৃষ্টি হয়।

ভৌত বিশ্বতত্ত্বে ফোটন ইপক বলতে এমন একটা যুগকে বোঝানো হয় যখন মহাবিশ্বে ফোটন বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল, অর্থাৎ মহাবিশ্বের মোট শক্তির অধিকাংশই সরবরাহ করেছিল ফোটন। মহা বিস্ফোরণের মাত্র তিন সেকেন্ড পরই এই যুগের শুরু। প্রথম কয়েক মিনিটে নিউক্লীয় সংশ্লেষণ নামে একটা বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরমাণুর কেন্দ্রিন (নিউক্লিয়াস) গঠিত হয়। এরপর দীর্ঘকাল মহাবিশ্বের উপাদান ছিল কেবল পরমাণু কেন্দ্রিন, ইলেকট্রন ও ফোটন। এ সময় মহাবিশ্বের ঘনত্ব ও তাপমাত্রা ছিল অনেক বেশি। এই ফোটন যুগের আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল অনচ্ছতা। ইংরেজিতে একে অপাসিটি বলে যার একটি প্রতিশব্দ হতে পারে অসচ্ছ। তাপমাত্রা অনেক বেশি হওয়ায় নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রন একত্রিত হতে পারছিল না আর ফোটনগুলো মুক্ত ইলেকট্রন থেকে অবিরাম প্রতিফলিত হচ্ছিলো। এই অবিরাম বিচ্ছুরণই ছিল অনচ্ছতার কারণ। পরাক্রমশালী রোমান যুগের যেমন পতন ঘটেছিলো, তেমনই অবসান ঘটে এই ফোটন যুগের। কিভাবে অবসানটা ঘটেছিল সেটিই আমাদের আলোচনার মূল বিষয়।

উত্তপ্ত-ঘন মহাবিশ্বে বিভিন্ন ধরণের কণার পাশাপাশি ছিল প্রতিকণা। ইলেকট্রন এক ধরণের কণা, এমনকি পরমাণু কেন্দ্রিনও বিভিন্ন কণা দিয়ে গঠিত। প্রতিটি কণার বিপরীতে যে প্রতিকণা ছিল সেগুলো বর্তমানে খুঁজে পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয় তাপ ও শক্তি অনেক বেশী হলে কণা-প্রতিকণা জোড়ায় জোড়ায় তৈরী হয়। আদি মহাবিশ্বে যে পরিমাণ তাপ ও শক্তি ছিল তার কারণেই কণা-প্রতিকণা জোড় অবিরাম সৃষ্টি হচ্ছিলো। অবশ্য সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে আবার সেগুলোর পূর্ণবিলয় ঘটছিলো যাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় এনাইহিলেশন বলা হয়। এক কথায়, একেবারে প্রাথমিক মহাবিশ্বে কণা-প্রতিকণা জোড়া অবিরাম সৃষ্টি ও পূর্ণবিলয়প্রাপ্ত হচ্ছিল। পূর্ণবিলয়ের কারণে বিশুদ্ধ শক্তির সৃষ্টি হয়। বিশুদ্ধ শক্তি মানেই ফোটন যে ফোটন নিয়ে আমরা এতোক্ষণ আলোচনা করছিলাম। প্রথম যুগে সৃষ্টি আর পূর্ণবিলয়ের চরম লীলা যখন চলছিলো তখন প্রতিটি পূর্ণবিলয়ের কারণেই ফোটন সৃষ্টি হচ্ছিলো। কিন্তু এই অবস্থা চিরস্থায়ী ছিল না। মহাবিশ্ব ক্রমান্বয়ে প্রসারিত ও শীতল হতে থাকে। এর ফলে অনেকগুলো কণা-প্রতিকণা জোড়ই শেষবারের মত ধ্বংস হয়, কিন্তু তা থেকে নতুন জোড় সৃষ্টি হচ্ছিলো না। তখনই ফোটন যুগের বিদায় ঘন্টা বাজতে শুরু করে।

মহা বিস্ফোরণের ৩৮০,০০০ বছর পরে তাপমাত্রা ও ঘনত্ব এতোটা কমে যায় যে, তার মাধ্যমে নতুন কণা-প্রতিকণা জোড় সৃষ্টি হওয়া সম্ভব ছিল না। শক্তি বলতে তো ফোটনকেই বোঝায়। প্রতিটি বিলয়ের মাধ্যমে যেমন ফোটন সৃষ্টি হয় তেমনই পুনরায় কণা-প্রতিকণা জোড় সৃষ্টির সময় ফোটন শোষিত হয়। কোন এক অজ্ঞাত কারণে সেই বিশ্বে প্রতিকণার তুলনায় কণার পরিমাণ এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ বেশি ছিল। অর্থাৎ প্রতিকণার সংখ্যা এক বিলিয়ন হলে কণার সংখ্যা ছিল এক বিলিয়ন এক টি। ধরি, এক বিলিয়ন প্রতিকণা এক বিলিয়ন কণার সাথে মিলে বিলয়প্রাপ্ত হল এবং প্রতিটি বিলয়ের জন্য একটি করে মোট এক বিলিয়ন ফোটন উৎপন্ন হল। তাহলে বাকি থাকল, একটি কণা এবং এক বিলিয়ন ফোটন। ধরে নেয়ার দরকার নেই। তখন এ ধরণের একটি ঘটনাই ঘটেছিল। ফলে প্রতিটি কণার পাশাপাশি ফোটনের পরিমাণ ছিল এক বিলিয়ন। সব প্রতিকণা শেষ হয়ে যাওয়ায় পূর্ণবিলয়ের আর কোন অবকাশ ছিল না এবং সেই অবস্থাই হয়ে গেল চিরস্থায়ী। মহাবিশ্ব এখনও সেই অবস্থায় আছে। এভাবেই ফোটন যুগের অবসান ঘটেছিল।

এর পর প্রায় সব ইলেকট্রন কেন্দ্রিনের সাথে মিলে পরমাণু তৈরী করে। আগেই বলেছিলাম মুক্ত ইলেকট্রন থেকে ফোটনের প্রতিফলনের কারণেই অনচ্ছতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু মুক্ত ইলেকট্রন না থাকায় অনচ্ছতাও থাকলো না। মহাবিশ্ব হয়ে গেল একেবারে স্বচ্ছ। এই অবাধ স্বচ্ছতা পেয়ে ফোটনগুলো পুরো মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়লো। প্রথম দিকে ফোটনের তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৩০০০ ডিগ্রি কেলভিন। সেই ফোটনগুলো এখনও টিকে আছে। সব দিক থেকে এক রকম থাকলেও মহাবিশ্বের প্রসারণের কারণে তাদের তাপমাত্রা কমে গেছে। বর্তমানে এই তাপমাত্রার পরিমাণ প্রায় ২.৭ ডিগ্রি কেলভিন। তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় এর তরঙ্গদৈর্ঘ্যও পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ১.৯ মিলিমিটার যা অণুতরঙ্গ তথা মাইক্রোওয়েভ হিসেবে চিহ্নিত হয়। বুঝতেই পারছেন এই ফোটনগুলোর বর্তমান নাম কি? হাঁ, মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ। পটভূমি বলা হচ্ছে কারণ সব দিকে সমানভাবে এগুলো বিস্তৃত এবং সকল দিক থেকে একই হারে এই তরঙ্গ পাওয়া যায়। এই হল সারকথা।

এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কেন মহাবিশ্বের ইতিহাসের ভাষার বর্ণমালা হয়ে উঠেছে পটভূমি বিকিরণ। কারণটা খুবই সোজা, এরা সেই সময় থেকে কোনভাবেই বিবর্তিত হয়নি। তাই এগুলো পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সেই আদি উত্তপ্ত-ঘন অবস্থার ধারণা লাভ সম্ভব। সেই সাথে এদের তাপমাত্রার পরিবর্তন লক্ষ্য করে মহাবিশ্বের প্রসারণের বিভিন্ন পর্যায় সম্বন্ধেও ধারণা লাভ করা সম্ভব। ইতিমধ্যে পটভূমি বিকিরণ আমাদের তিনটি বিষয়ে একেবারে পরিষ্কার করে দিয়েছে:
প্রথমত, মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল,
দ্বিতীয়ত, আদি মহাবিশ্ব ছিল অতি উত্তপ্ত-ঘন ও তাতে তাপীয় সাম্যাবস্থা বিরাজ করছিল এবং
তৃতীয়ত, কণা-প্রতিকণার পূর্ণবিলয়ের শেষে এক পর্যায়ে পরমাণুর সৃষ্টি হয়েছিল।
১৯৬৫ সালে আরনো অ্যালান পেনজিয়াস ও রবার্ট উড্রো উইলসন এই পটভূমি বিকিরণ আবিষ্কার করেন। এর আগে জর্জ গামফ এ বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সেই হিসেবে বলা যায় ১৯৬৫ সাল থেকে মানুষ মহাজাগতিক ইতিহাসের স্বাদ পেতে শুরু করেছে। এডওয়ার্ড গিবনের “ডিক্লাইন অ্যান্ড ফল অফ দি রোমান এম্পায়ার” আর বেশিদিন বোধহয় ইতিহাসের সেরা গ্রন্থের মর্যাদায় থাকতে পারল না। অচিরেই মহাজাগতিক ইতিহাসের আদ্যোপান্ত জেনে ফেলব আমরা। সেই দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।


লেখাটি ২০০৮ সালের ৫ই মার্চ সচলায়তনে প্রকাশিত হয়েছিল