পিলখানার হত্যাযজ্ঞ ও খালেদার অন্তর্জ্বালা

ছগীর আলী খাঁন


আপোষহীন নেত্রী ম্যাডাম জিয়া খুব চেতে গেছেন- শুদ্ধ ভাষায যাকে বলে চটে যাওয়া। তিনি চটেছেন- কারণ আর্মি কেন পঁচিশ তারিখ বুধবার পিলখানা আক্রমন করলো না। তার থিওরী অনুসারে আর্মি আক্রমন করলে নাকি অনেক অমূল্য প্রাণ রক্ষা পেতো। বিডিআর হেড-কোয়ার্টার আক্রমন করতে হুকুম না দেয়াটা শেখ হাসিনার একটি কৌশলগত ভুল বলে চিহ্নিত করেছেন তিনি। তিনি, তার পারিষদবর্গ এবং জাতীয়তাবাদী ঘরানার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া একের পর এক রোমহর্ষক সব কেচ্ছাকাহিনী, গল্প, লিফলেট, সিডি ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচার করছে যে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ধ্বংস করে বাংলাদেশকে পার্শ্ববর্তী দেশের করদ রাজ্যে পরিণত করা এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী করার জন্যেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। নির্বাচনের আগে তিনি বিরামহীনভাবে প্রচার চালিয়েছিলেন যে একমাত্র বিএনপি-জামাতের হাতেই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিরাপদ, আওয়ামী লীগের হাতে দেশ মোটেও নিরাপদ নয়। জনগণ তার লজিক খায়নি, বিপুলভাবে দেশদ্রোহী আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। এখন তারা বুঝুক!


অপরপক্ষ আওয়ামী লীগ প্রচার-প্রপাগান্ডায় ততটা পারদর্শী নয়। তারা মিনমিন করে বলছে- নুতন সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এবং যুদ্ধপরাধী ইস্যু হতে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে একটি বাইরের শক্তির সহায়তায় এই অমানবিক কান্ড ঘটানো হয়েছে। প্রকাশ্যভাবে না বললেও এই বাইরের শক্তি যে পাকিস্তানের আইএসআই- তা বুঝতে কষ্ট হয় না। এই দুই বিপরীতমুখী অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের কোনটি সত্য তার উপর সামান্য আলোচনা করাই বক্ষমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। তবে মূল আলোচনার আগে গোটাকয়েক পুর্ববর্তী ঘটনা বিশ্লেষণ করলে সিদ্ধান্ত টানা সহজ হবে।


১- আওয়ামী লীগের ৯৬-০১ মেয়াদকাল হতে দেশে বোমা সংস্কৃতির শুরু হয়। উল্লেখ্যযোগ্য হামলার মধ্যে উদিচী, রমনা বটমূল, নারায়নগঞ্জের চাষারা, বানিয়াচঙ গীর্জা, কোটালিপাড়া ইত্যাদি হামলাগুলি ছিল প্রধান। এই হামলাগুলির পেছনে ইসলামী জঙ্গীরা জড়িত আছে বলে গোয়েন্দারা ধারণা করে এবং মুফতি হান্নান, শেখ ফরিদ ইত্যাদি জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এর বিরুদ্ধে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম জিয়া গর্জে উঠেন, প্রচার করেন যে এসব হামলা প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী গুন্ডাদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে, শামীম ওসমান নিজেই নিজের উপর বোমা মেরে দায়ভার নিরীহ আলেম ওলামাদের ঘাড়ে চাপাচ্ছে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী আমলে গ্রেফতারকৃতদের ছেড়ে দেন ম্যাডাম এবং তদন্তকাজ হিমাগারে পাঠান। এখন প্রমানিত হয়েছে যে আসলেও ইসলামী জঙ্গীরাই হামলাগুলি চালিয়েছিল, ম্যাডাম সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে মিথ্যা কথা বলেছিলেন তখন।


২- হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা হলে ম্যাডাম বলেছিলেন- পরদিনকার হরতাল সফল করার জন্যে আওয়ামী লীগ হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমন করেছে। পরে প্রমানিত হয়েছে যে ঘটনাটি ঘটিয়েছিল জেএমবি’র আতাউর রহমান সনি। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও মিথ্যা বলে আসল অপরাধীকে আড়াল করেছিলেন তিনি।
৩- ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সারা দেশজুড়ে সংখ্যালঘুদের উপর নির্মম অত্যাচার নেমে আসে। হত্যা, ধর্ষণ, বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির মহোৎসবে নামে বিএনপি-জামাতের ক্যাডাররা। অবস্থা এমন দাড়ায় যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্য্যালয়ে অস্থায়ী আশ্রয় শিবির খুলতে হয়েছিল, বিপুল সংখ্যক সংখ্যালঘুকে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। এক্ষেত্রেও ম্যাডাম তার সোনার ছেলেদের আকামকে জায়েজ করতে এগিয়ে আসেন। প্রকৃত অপরাধীদের বিচারে সোপর্দ করার পরিবর্তে সত্যানুসন্ধানী সাংবাদিকদের উপর বেজায় নাখোশ হন তিনি, ধরে ধরে জেলে পুরেন তাদের। (সেলিম সামাদ, জাইবা মালিক, শাহরিয়ার কবির ইত্যাদি)।
৪- ময়মনসিংহ, সিলেট ও খুলনার সিনেমা হলে বোমা হামলা করে ইসলামী জঙ্গীরা। এক্ষেত্রেও ম্যাডাম তাদের আড়াল করতে এগিয়ে আসেন, সিনেমা হলে বোমা মারার দায় চাপান ঢাকা ভার্সিটির স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের কাঁধে; অধ্যাপক মতিউর রহমান, সাবের হোসেন চৌধুরি ও ম.খা. আলমগীরকে সহযোগী আক্রমনকারী হিসেবে জেলে ঢোকানো হয় ।


৫- ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনার পর তিনি বলেন- আব্দুল জলিল ঘোষিত ৩০শে এপ্রিলের ডেডলাইন বাস্তবায়ন করতে আওয়ামী লীগই জাহাজ ভর্তি করে অস্ত্র এনেছিল। গোয়েন্দারা আসল সত্যকে চাপা দিয়ে নামকা ওয়াস্তে চার্জশীট দাখিল করে এবং প্রধান আসামী হাফিজুর রহমানের জবানবন্দীকে বেমালুম চেপে দেয়। আদালত দুর্বল তদন্তের জন্য তদন্ত কর্মকর্তাদের তিরস্কার করেন এবং মামলাটি ফেরৎ পাঠান। ম্যাডামের আমলে মামলাটি আর আলোর মুখ দেখেনি।


৬- একুশে আগষ্টের মর্মান্তিক গ্রেনেড হামলার পর তিনি ও তার পারিষদবৃন্দ জাতীয় পরিষদের ফ্লোরে দাড়িয়ে ঘোষণা করেন যে সরকারকে বিব্রত করতে আওয়ামী লীগ নিজেরাই নিজেদের মিটিংয়ে বোমা হামলা করেছে। তা নইলে হামলায় আইভি রহমান মরলো- শেখ হাসিনা মরলো না কেন? হামলা যে আওয়ামী লীগ করেনি তা প্রমান করার জন্যে রবীন্দ্রনাথের কাদম্বরীর মতো শেখ হাসিনার মরে যাওয়া উচিৎ ছিল। তা’হলেই কেবল প্রমানিত হতো যে বোমাহামলাটি তিনি বা তার দল করেনি। দূর্ভাগ্যবশত: হাসিনা তা করতে ব্যর্থ হন, প্রাণের আঘাত কানের উপরে নিয়ে কোনমতে প্রাণটি ধরে রাখেন। আওয়ামী দুবৃত্তরা বাইরের সন্ত্রাসী ভাড়া করে বোমা মেরেছে- এই থিওরীতে অটল থাকেন ম্যাডাম; এ্যারেষ্ট করেন ঢাকা সিটির জনৈক আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেসুর রহমানকে। এরপর মুন্সী আতিকুর রহমানকে দিয়ে জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়। এক সদস্যবিশিষ্ট এক জাদরেল তদন্ত কমিটি গঠন করলেন ম্যাডাম যার চেয়ারম্যান, সদস্য, সম্পাদক সব একজন-। অব: বিচারপতি জয়নুল আবেদীন, অল-ইন-ওয়ান। জাল সার্টিফিকেটখ্যাত বিচারপতি ফয়েজী কিংবা সওয়া কোটি ভুতুরে ভোটারের জন্মদাতা হিসেবে সুবিখ্যাত এম.এ.আজিজের মতোই ঘোরতর জাতীয়তাবাদী তিনি। অক্লান্ত পরিশ্রম করে মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে জজসাব যে রিপোর্টটি দাড় করালেন – তাতে সুস্পষ্টভাবে পাশ্ববর্তী দেশটির উপর দোষ চাপানো হলো। পার্শ্ববর্তী দেশটি কেন তাদের সেবাদাস হাসিনার মিটিংয়ে বোমা মারে, ম্যাডামের মিটিংয়ে মারে না- সে প্রশ্ন আমলে নিলেন না মাননীয় বিচারক!


৭- মিজানুর রহমান মিনু, ব্যারিষ্টর আমিনুল হক, আলমগীর কবির, এসপি মাসুদ প্রভৃতি রথী-মহারথীদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাগমারা অঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে তালেবানরাজ কায়েম হলো। শারিয়া আইন চালু করতে যেয়ে তালেবানরা কিছু লোকের উপর “ক্কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ” প্রয়োগ করল এবং তালেবান প্রথানুযায়ী মৃতদেহ গাছে ঝুলিয়ে দিল। ঝুলন্ত লাশের ছবি দেশবিদেশের পত্রপত্রিকা হটকেকের মতো লুফে নিল। অবস্থা সামাল দিতে বাধ্য হয়ে আবারও ম্যাডাম ও তার একান্ত পার্টনার নিজামিকে এগিয়ে আসতে হলো। জনগণকে আশ্বস্ত করে বলতে হলো- এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, মিডিয়ার আবিস্কার, প্রকৃতপক্ষে বাংলাভাই ইংরেজী ভাই বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই দেশে। বাংলাভাই এবং তার শিষ্যরা দেশে আছে কি নাই, কিছুদিনের মধ্যেই দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় জনগণ হাতেনাতে তার প্রমান পেল। ম্যাডাম ও তার অনুগত পত্রপত্রিকা প্রচার করলেন- ভারতের সহযোগীতায়ই নাকি হামলাগুলি পরিচালিত হয়েছিল; কারণ অভিযানে ব্যবহৃত বিস্ফোরকগুলি নাকি ভারত থেকে এনেছিল জেএমবি।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে সুবিধামতো মিথ্যাচার করা মাননীয়া দেশনেত্রীর চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট। পাঠক ভুলবেন না, এই মহামানবীর এ পর্য্যন্ত গোটা চারেকমতো জন্মদিন আবিস্কৃত হয়েছে! একটি স্কুলের জন্মদিন, একটি কাবিননামার জন্মদিন, একটি পাশপোর্টের জন্মদিন এবং একটি রাজনৈতিক জন্মদিন। ৯৬ সালের আগে তার কোন রাজনৈতিক জন্মদিন ছিল না, ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর তিনি উক্ত জন্মদিন আবিস্কার করেন এবং নিষ্ঠার সাথে তা পালন করে আসছেন এযাবত। স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে যে কেলেঙ্কারী তিনি করেছেন, এবং স্বয়ং জিয়াউর রহমান কতৃক সঙ্কলিত প্রামান্য ইতিহাসকে তিনি যেভাবে মিথ্যাচার দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন, তার তূলনা বোধ হয় পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এমতবস্থায় পিলখানার সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে তিনি যে মিথ্যাচার করছেন না- পাবলিক তা কীভাবে বুঝবে? বিশেষ করে নীচের পয়েন্টগুলোর যথাযথ উত্তর না মিললে তার বক্তব্যের সাথে একমত হতে বোধ হয় স্বয়ং লুসিফারের চোখমুখও লজ্জায় লাল হয়ে উঠবে।


১- তিনি বলেছেন- প্রথমেই সামরিক ব্যবস্থা নিলে নাকি প্রাণহানি এতটা ঘটতো না। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ হতে জানা যায় ২৫শে ফেব্র“য়ারী বুধবার সকাল নয়টা থেকে এগারটার মধ্যেই দরবার হলে সমবেত সমস্ত অফিসারকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়, নিতান্ত ভাগ্যের জোরে দু’একজন বেঁচে যান। দুপুর নাগাদ যখন আর্মি ধানমন্ডী এসে ঘাটি গেড়েছে, ততোক্ষনে হত্যাকান্ড অলরেডী কমপ্লিট। তা’হলে আর্মি যদি ম্যাডামের প্রেসক্রিপশন মোতাবেক তক্ষুুনি আক্রমন চালাত, নিহত হয়ে যাওয়া অফিসাররা কীভাবে বেঁচে উঠতো?


২- বৃহস্পতিবার অপরাহ্নের আগ পর্য্যন্ত গোটা জাতি বুঝতেই পারেনি যে আসলে পিলখানার ভেতরে কী ঘটে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে দরবার করতে যেসব ক্রিমিনালরা যমুনায় গিয়েছিল, পাইকারী হত্যার বিষয়টি গোপন রাখে তারা। রাষ্ট্রের শক্তিশালী দু’টি বাহিনী যুদ্ধাবস্থায় পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখী। এমতবস্থায় কোন সুস্থ্য বুদ্ধিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা কী করবেন? রাজনৈতিকভাবে বিনা রক্তপাতে বিষয়টির সমাধানের চেষ্টা করবেন, নাকি এক বাহিনীকে আরেক বাহিনীর উপর লেলিয়ে দেবেন?


৩- বিডিআর বিধিবদ্ধ একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। হেডকোয়ার্টার হওয়ার সুবাদে পিলখানায় প্রচুর আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র মজুদ ছিল, ছিল হাজার হাজার দক্ষ জওয়ান। আর্মি যদি আক্রমন করেই বসতো, তারা নিশ্চয়ই নিশ্চুপ বসে থাকতো না। সুরক্ষিত বিল্ডিংয়ের আড়াল নিয়ে তারাও প্রতিরক্ষামূলক আক্রমন চালাত। ফলে কতো হাজার সৈনিক-বিডিআর মারা যেতো- তার হিসেব আমরা না জানলেও জেনারেলপতœী ম্যাডাম জিয়ার অজানা থাকার কথা নয়। আমরা শুধু এটুকুই বুঝি, ম্যাডাম জিয়ার প্রেসক্রিপশন মোতাবেক যদি যুদ্ধ বেধেই যেতো, তা’হলে ভেতরে আটকে থাকা অফিসারদের স্ত্রীপুত্রপরিজন কেউ বাঁচতো না, আজিমপুর নিউমার্কেট ইত্যাদি এলাকা নিশ্চিতভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতো। শুধু কি ঢাকা? ঢাকার বাইরে যেসব বিডিআর ক্যাম্প রয়েছে, সেখানেও যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতো। অর্থাৎ- সারাদেশে এক ভয়াবহ রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের সূচনা হতো। রাজনৈতিক সমাধানের ফলে সেই ভয়াবহ অবস্থা থেকে জাতি বেঁচে গেছে। একটি গুলি না ছুড়েও শেখ হাসিনা সাফল্যের সাথে বিদ্রোহ দমন করেছেন, সেনাবাহিনীর প্রাজ্ঞ অফিসাররাও অসীম সংযম ও ধৈর্য্যরে পরিচয় দিয়েছেন। আশ্চর্য্যরে বিষয়, যুদ্ধ না হওয়াতে ম্যাডাম জিয়া খেপে গেলেন! কেন তার এই অন্তর্জালা? তা’হলে কি আমরা ধরে নেব যে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আশায় বুক বেধে বসে ছিলেন তিনি, যুদ্ধটি না বাধায় দারূনভাবে আশাহত হয়েছেন?


৪- এই পরিকল্পনাটি যারা প্রণয়ন করেছে, স্পষ্টতই তাদের দু’টি লক্ষ্য ছিল। এক- সাধারণ জওয়ানদের ক্ষোভকে উস্কে দিয়ে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করা এবং সেই ধুম্রজালের আড়ালে দরবার হলে সমবেত অফিসারদের পাইকারীভাবে হত্যা করা। দুই- হত্যার রি-এ্যাকশনে বিডিআর ও আর্মির মধ্যে একটি ফুলস্কেল যুদ্ধ বেধে যাওয়া যার ফলশ্র“তিতে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী স¤পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যেতো। পরিকল্পনার প্রথম অংশ সফল হয়েছে, কিন্তু শেখ হাসিনা ও সিনিয়র আর্মি অফিসারদের দূরদর্শীতার ফলে দ্বিতীয় অংশ সফল হয়নি। অর্থাৎ আর্মি-বিডিআরের মধ্যে প্রতিক্ষীত যুদ্ধটি বাধেনি। এজন্যে পরিকল্পনাকারীদের মনে ক্ষোভ ও অন্তর্জালা থাকতে পারে, কিন্তু দেশের প্রধান একজন নেত্রীর মনে এত অন্তর্জালা কেন?


৫- ঘটনার পর পর দেশবিদেশে অবস্থানরত বাঙালী জনগোষ্ঠি স্বাভাবিকভাবেই দারূন উৎকণ্ঠায় পড়ে যায়। উৎকন্ঠিত জনগণ ও প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান; আ’লীগ, জাপা, বাম দল প্রভৃতি সকল দলের নেতানেত্রীরা। ব্যতিক্রম শুধু বিএনপি-জামাত। ২৫ ও ২৬ তারিখে কোন বিএনপি-জামাত নেতাকে কোথাও দেখা যায়নি, না পিলখানায় না কোন টেলিভিশন চ্যানেলে। ২৬ তারিখ অপরাহ্ন হতে ঘটনা যখন সরকারের আয়ত্বে আসা শুরু হয়, তখনই নানাপ্রকার বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য নিয়ে মঞ্চে আসতে থাকেন তারা! প্রশ্ন, ঐ দু’দিন কেন এত নিশ্চুপ ছিলেন তারা, ঐ দু’দিন তারা কী করছিলেন?


৬- খোলাখুলি নাম না নিলেও বিএনপি জামাত মনে করে- বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে ধ্বংস করতে ভারতের চক্রান্তে এই বিদ্রোহ ঘটেছে। দুই বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেশের প্রতিরক্ষা স্তম্ভটিকে চিরতরে পঙ্গু করতে চেয়েছিল ভারত। এই অভিযোগ যদি সত্য হয়- তা’হলে ভারতের সেবাদাস বলে কথিত শেখ হাসিনার উচিৎ ছিল বিডিআর-আর্মির মধ্যে যুদ্ধ বাধতে দেয়া, যুদ্ধকে নিবৃত করা নয়। কিন্তু ঠিক উল্টো কাজটিই করেছেন তিনি, প্রাণপনে যুদ্ধ রুখতে চেয়েছেন। পক্ষান্তরে যুদ্ধ না বাধার কারণে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেছেন ম্যাডাম জিয়া। ভারতের আসল সেবাদাস তা’হলে কে, হাসিনা না খালেদা? আরেকটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন; কেন শুধু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলেই এ ধরণের ঘটনা ঘটে, বিএনপি’র আমলে কেন ঘটে না? উল্লেখ্য, ছিয়ানব্বুইতেও প্রায় অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল ক্ষমতায় যাওয়ার দেড়মাসের মাথায়। সখীপুরের আনসার বিদ্রোহ। ভারতই যদি এসব ঘটনার হোতা হয়, ঘটনাগুলি ঘটা উচিৎ বিএনপি আমলে, আওয়ামী আমলে নয়।

অত্যন্ত দুঃখজনক মর্মান্তিক একটি ঘটনা ঘটেছে দেশে যার তুলনা হয়তো সারা বিশ্বের ইতিহাস খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। জাতি আশা করেছিল, এরূপ একটি ঘটনায় অন্ততঃ জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকবে, এক দল আরেক দলের উপর দোষ চাপাবে না। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সেই পুরোনো দোষাদোষির চাপান-উতোর খেলা আবার শুরু হয়েছে এবং অতীতের মতোই প্রথম তীরটি ছুড়েছে বিএনপি। তবে ঘটনাটি স্পর্শকাতর, সেনাবাহিনী তার অমূল্য অফিসারদের হারিয়েছে, তাদের মা-বোন লাঞ্ছিত হয়েছে, তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে অনুক্ষন। ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার কোন উপায় নেই। অত্যন্ত সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। কাজটি একান্তভাবেই সরকারের। আমরা আশা করি- যেরূপ দক্ষতার সাথে শেখ হাসিনা জাতিকে অবধারিত গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাচিয়েছেন, বিচারের ক্ষেত্রেও তিনি অনুরূপ দক্ষতা ও আন্তরিকতা দেখাবেন। সারা জাতি তার দিকে চেয়ে আছে এখন।


ছগীর আলী খাঁন
ভাটপাড়া-সাভার
০৮-০৩-২০০৯