বাংলাদেশের সেনা বিদ্রোহের নেপথ্যে

বিপ্লব পাল

 

বাংলাদেশে গত তিন দিনে তাদের প্যারামিলিটারি বিডিআর বিদ্রোহে আমি প্রায় সব বাংলাদেশী , ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদে চোখ রাখছিলাম। এখনো অনেক কিছুই ধোঁয়াশা আমার কাছে। সুত্র মিলিয়ে দুই দুই এ চার হচ্ছে না । তাই সমস্ত সম্ভবনাকে খাতিয়ে দেখতে এটা লিখছি-পাঠক আমার ভুল সংশোধন করবেন। ভবিষ্যতের অনুসন্ধান হয়ত অন্যকিছু বলবে-তবুও কিছুটা নিজেকে বোঝানোর তাগিদেই এই লেখা-কি করে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে-যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যথার্থ ভাবেই একটি জনপ্রিয় সরকারের হাতে-সেখানে প্যারামিলিটারী ফোর্স তাদের উর্ধতন মিলিটারীর বিরুদ্ধে এই ধরনের বিদ্রোহ করতে পারে।

প্রথম জনপ্রিয় তত্ত্বটি অবশ্যই প্রলেতারিয়েত শ্রেনী সংঘাত। বি ডী আরের নিজস্ব বক্তব্য তাই। তারা শোষিত এবং তাদের উর্ধত্বন মিলিটারী কতৃপক্ষ দ্বারা নির্যাতিত। তাদের খাদ্যসরবরাহের , ডাল-ভাত প্রোগ্রামের টাকা পর্যন্ত মেরে উড়িয়ে দিয়েছে মিলিটারী। তাদের অভিযোগের সুত্র ধরে, শুধু এটাই জানা যায়-এই ধরনের অভাব অভিযোগ থেকে উর্ধত্তন অফিসারদের গণহত্যা কোথাও হয় নি।আবার এটাও ঠিক পৃথিবীর সবদেশের মিলিটারীতেই সাধারন সৈনিকরা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, অফিসারদের ওপর আক্রমন চালান। আমার জানা প্রায় সব ভারতীয় এবং আমেরিকান সৈনিক মিলিটারী ক্যারিয়ারে এক বা একাধিবার কোর্ট মার্শাল হয়েছেন এই কারনে। মিলিটারীতে অফিসারের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বিদ্রোহ করা-পৃথিবীর সর্বত্র অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এমন কি ২০০৪ সাল থেকে নেওয়া তথ্য অনুযায়ী-সেখানে সন্ত্রাসবাদিদের হাতে নিহত ভারতীয় সৈন্যের সংখ্যা ২৫৪, সেখানে একই সময়ে সেনাবাহিনীতে আত্মহত্যা করেছেন ৩৩৩ জন। আর অফিসারদের হত্যা করেছেন প্রায় একশো জন।

অফিসারদের বিরুদ্ধে পুঞ্জিভূত রাগ পৃথিবীর সবদেশের মিলিটারীতে সর্বদা বিদ্যমান। কারন মিলিটারী একটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনী-যার অস্তিত্ব আসতে আসতে ফুরিয়ে আসছে। রাষ্ট্রের সংজ্ঞাতেই আছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে নাগরিকদের ভীতি দেখিয়ে আইন মান্য করানো- তাই সভ্যতার বিপরীত দিকে হেটেই মিলিটারীর বেঁচে থাকা (এই প্রবন্ধটি দেখতে পারেন)। সেখানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের যে শিক্ষাটা তারা পায়-তার সাথে মানবাধিকার বা সভ্যতার সম্পর্ক নেই। এর ওপর লয়ালিটির পরীক্ষা সাধারন সৈনিকদের সব সময় দিতে হয়। আর চেইন অব কম্যান্ডের লয়ালিটি রক্ষা করার স্বার্থে সব সময়, অধীনস্ত সেনারদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সমস্ত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে, তাদের মানানো হয়। কারন, এইভাবে তাদের স্বাধীন ইচ্ছাকে মেরে দিতে না পারলে চেইন অব কমান্ড তৈরী হয় না-সুতরাং মিলিটারীর স্বার্থেই সমস্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, নীচু তলার সৈনিকদের বাধ্য করা হয় ওপর তলার থুতু চাটতে। সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠা একজন যুবককে যখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের এই প্রাথমিক পাঠ দেওয়া হয়, তখনত প্রশ্ন ওঠে না ওদের কেন সভ্যতা বিরোধি রাগী যুবক হিসাবে তৈরী করা হচ্ছে? তখন ত আমরা নিজেদের সুরক্ষার স্বার্থই দেখি।

এক্ষেত্রে যেসব অফিসাররা সেদিন সভাগৃহ থেকে পালাতে পেরেছিলেন তাদের ভাষ্য অনুযায়ী এটা পূর্বকল্পিত অনেক দিনের চক্রান্ত। ভারতীয় মিডিয়া এর মধ্যে ইসলামিক চক্রান্ত্ব খুঁজে পাচ্ছে। আমি অবশ্য সেরকম কিছু দেখতে পেলাম না। এটা কি করে সম্ভব যখন সভাগৃহে অনেক মিলিটারী কর্ত্তা আছেন, তখন মাত্র একজন লুঙ্গি পড়ে গেঞ্জী গায়ে মেশিনগান চালিয়ে বিদ্রোহ ঘোষনা করল? বাকিরা তার আগেই বেড়িয়ে গিয়েছিল। যদি পরিকল্পনা মাফিক বিদ্রোহের প্রশ্ন ওঠে এটা সম্ভবত খুব বাজে পরিকল্পনা। মানাই কষ্টকর। কারন সেক্ষেত্রে (১) তারা সভাস্থলকে বিদ্রোহের সুতিকা গৃহ হিসাবে ব্যাবহার করবে না-রাতের অন্ধকারে কোয়াটার টু কোয়াটার অতর্কিত আক্রমন করবে (২) আর যদি সভাগৃহকে বাছেও-তাহলে মাত্র একজন লুঙ্গী পরে মেশিন গান চালিয়ে বিদ্রোহের সূচনা করবে না। একটি দল পরিকল্পিত ভাবে সবাইকে ঘিরে ফেলবে। সেরকম কিছু হয় নি।

তাছাড়া যেভাবে মিলিটারী অফিসারদের জওয়ানরা খুন করেছে-তাতে ব্যাক্তিগত আক্রোশের ছাপ বড্ড বেশী। মানে মিলিটারী অফিসারদের বিরুদ্ধে তারা রাগে ফুঁসছিল এটা পরিস্কার। বিদ্রোহের লক্ষ্য মূল থাকলে-তারা রাষ্ট্রের সাথে দরাদরি করার জন্যে মিলিটারী অফিসারদের বন্দী করত-এই ভাবে চোখ খুবলে খুন করত না। সেনারা তাদের শত্রুর দেহকেও এই ভাবে বিকৃত করে হাত পা কেটে হত্যা করে না। এর থেকে তাদের পুঞ্জীভূত রাগের পরিমান প্রকাশ্য।

এছাড়াও গত তিনদিনে বিডিআর বিএস এফের কাছে অনেক চিরকুট পাঠিয়েছে। আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী চিদাম্ববরম তা স্বীকারও করেছেন। সেইসব চিরকুটের অধিকাংশতেই লেখা ছিল, বিডিআর মিলিটারীর অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তাই তারা ধরা না দিয়ে, ভারতের কাছে আশ্রয় চাইছে । যদি এটা ইসলানিস্ট গোষ্ঠির বিদ্রোহ হত, তারা ভারতের কাছে আশ্রয় এভাবে চাইত না।

বাংলাদেশের গুপ্তচররা এই খবর কেন আগে পেলেন না-সেটা নিয়ে অনেক জলঘোলা হচ্ছে। হতে পারে এরকম কিছু কংক্রীট চক্রান্ত ছিল না। অফিসারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ মিলিটারীতে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই হয়ত ব্যাপারটাকে তারা অতটা আমল দেওয়ার প্রয়োজন ভাবে নি। আবার এটাও হতে পারে হাসিনা সরকারা আসায় অনেক গুপ্তচরের যে অতিরিক্ত ইনকাম ছিল -ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদি জঙ্গীদের কাছ থেকে বা আই এস আই এর কাছ থেকে- তা এখন বন্ধ। ফলে বর্তমান সরকার গেলে-তাদের পকেটে দুপয়সা আসে আর কি।

মিলিটারীর অনেক অফিসারই বলছেন তারা বি ডী আরের স্মাগলিং থেকে উপার্জন বন্ধ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ বি ডি আরের গরীব সেনাদের সামান্য যেটুকু অতিরিক্ত ইনকাম ছিল-তাও বন্ধ! গোদের ওপর বিষফোঁড়া। কিন্ত শুধু এইটুকুর জন্যে কেও গণহত্যা করবে না।

পরিশেষে একটা গণতান্ত্রিক দেশে রাজধানীতে কেন ৩০% বর্ডার সুরক্ষা বাহিনীর জওয়ান বা মিলিটারীরা থাকে-সেটাও বুঝলাম না। আমি ভারতে দেখি বি এস এফের ১০-১২ হাজার লোকের থাকার আবাসনগুলি শহর থেকে অনেক দুরেই থাকে। বাংলাদেশে বি ডি আরের সংখ্যা ৬৫,০০০। আর ঘটনার সময় ঢাকায় হেডকোয়ার্টারে ১৫০০০ বিডীআর পাকাপোক্ত ভাবে ছিলেন। এটা একধরনের অপচয়।

রাষ্ট্র যত দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে মিলিটারী নামক সভ্যতা বিরোধি রাষ্ট্রযন্ত্রটির অবসান ঘটে ততই মঙ্গল। ভারতের এই বছরের মিলিটারী বাজেট
২৩ বিলিয়ান ডলার-বাংলাদেশের প্রায় দেড় বিলিয়ান ডলার। যেদেশগুলির অর্ধেক লোক আধপেটা খেয়ে থাকে, নিরক্ষর-সেখানে ওই টাকা শিক্ষা এবং উন্নয়নে খরচ করতে পারলে-দারিদ্র নিশ্চিত ভাবেই কমানো যেত।

যারা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থান ইত্যাদি দেশের অস্তিত্ব টেকানোর পক্ষে তাদের আবার লাল সেলাম!!! কারন দেশের অস্তিত্ব মানলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদিদের (মিলিটারী) পেছনে এই বাজে খরচ এবং তাদের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ রাষ্ট্রবিরোধি সন্ত্রাস মেনে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে! আপনারা কি চান, আমি বাংলাদেশী, আমি ভারতীয় এইসব আবেগের মূল্য দরিদ্র জনগণের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্যের থেকেও বেশী?