এটা কি বিডিআর বিদ্রোহ, না কি কোন জঙ্গি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন…!

রণদীপম বসু

'পিলখানা বিডিআর সদর দপ্তর প্রধান গেট'         ছবি: রণদীপম বসু

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ বাংলাদেশ রাইফেলস তথা বাংলাদেশের ইতিহাসের যে ভয়াবহতম নৃশংস ঘটনা ঘটে গেলো তাকে একেবারে প্রাথমিকভাবে বিডিআর জওয়ানদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বিদ্রোহ হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে আখ্যায়িত করা হলেও ধীরে ধীরে ভেতরের লোমহর্ষক ঘটনাগুলো মিডিয়ার মাধ্যমে একে একে উন্মোচিত হতে থাকলে তা যে আদৌ কোনো বিদ্রোহ ছিলো কিনা সে হিসাবটাই এখন গরবর হতে শুরু করেছে। অন্তত এটা বুঝা গেলো যে বিডিআর-এর মধ্যে মিশে থাকা তৃতীয় কোন গোষ্ঠী এই ঘটনাধারাকে জনসাধারণের মধ্যে অত্যন্ত সফলভাবে ভিন্নখাতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল বলেই মনে হয়। ইতোমধ্যে ঘটনার যেটুকু আমরা জানতে পারছি তাতেই এর ভয়বহতায় আৎকে উঠছি ! এরই মধ্যে জিম্মি অবস্থা থেকে মুক্ত অনেকের ভাষ্যও মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারছি আমরা। যদিও সবটুকু শোনার সুযোগ আমাদের নেই বা এগুলোর সত্যাসত্য যাচাইয়ের কোন উপায় আমাদের নেই। তবু শুরু থেকে সাধারণ নাগরিকদের কাছে প্রকাশিত ঘটনাচিত্র, জওয়ানদের বিভিন্ন সময়ে উৎক্ষিপ্ত উক্তি, দাবী-দাওয়া এমনকি সামগ্রিক বডিল্যাংগুয়েজের সাথে ঘটনাপরবর্তী আংশিক উন্মোচিত বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে সামগ্রিক পরিস্থিতির গভীরে ভয়ঙ্কর একটা পূর্ব-পরিকল্পনার চিহ্ণগুলো ক্রমেই যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সংগত কারণেই মনের মধ্যে এই প্রশ্নটাই গুমড়ে গুমড়ে উঠছে- এটা কি সত্যিই বিডিআর জওয়ানদের তাৎক্ষণিক বিদ্রোহ ছিলো, না কি গভীর কোন জঙ্গি পরিকল্পনার বাস্তবায়িত অংশ ?

ঘটনার সূত্রপাত থেকে যাঁরা বিষয়টির প্রতি গভীর মনোযোগ সহকারে নজর রাখছিলেন তাঁদের কাছে হয়তো এর কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে পারে। তবে টিভি মনিটরে ভাসমান ঘটনার উল্লেখযোগ্য ছবিচিত্র দেখে অনেকগুলো হিসাব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। যুক্তির প্রশ্নে বেশ কিছু ঘটনা ইতোমধ্যে রহস্যময় ঠেকছে যাতে মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে এটা বিডিআর-এর আভ্যন্তরীণ বিষয়ের বাইরে সুদূরপ্রসারী কোন ষড়যন্ত্রের অংশ। এরকম অংকে না মেলা কিছু প্রশ্ন আমরা হয়তো রিভিউ করে দেখতে পারি।

১.০ ফেব্রুয়ারি ২৪ বিডিআর সপ্তাহ উদ্বোধনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সম্ভাব্য পূর্ণ বিপজ্জনক একটা পরিস্থিতির মধ্যে অবস্থান করছিলেন তা হয়তো আমরা এখন বুঝতে পারছি। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও কি আমাদের মতোই এখন এসে তা বুঝতে পারছেন ? গোয়েন্দারা কি সত্যিই কোন আলামত আগে থেকে টের পান নি ? এটা কি আমরা বিশ্বাস করবো ?

২.০ পিলখানার বিডিআর সদর দপ্তরের দরবার হলের অনুষ্ঠানে গোটা দেশ থেকে সবগুলো সেক্টর, ব্যাটেলিয়ান ক্যাম্পের উর্দ্ধতন অফিসার এবং অনেক জওয়ান অংশগ্রহণ করে থাকে, এটা হয়তো সবাই জানে। কিন্তু সবাই কি সবাইকে চেনে ? পিলখানার ব্যারাকে প্রবেশ এবং অবস্থানকালীন তাদের পরিচয়গুলো কিভাবে মিমাংশিত হয়ে থাকে ? একজন জঙ্গি বাইরে থেকে বিডিআর পোশাক কিনে (শুনেছি বাইরে নাকি আর্মি ও বিডিআর-এর পোশাক কিনতে পাওয়া যায়) নিকটতম সমমনা কোন হাবিলদার বা এ ধরনের কারো সহায়তায় অবস্থান করা কি সম্ভব নয় ?

৩.০ দরবার হলে কেউ অস্ত্র নিয়ে যেতে পারে না বা যাওয়ার রেওয়াজ নেই বলে শোনা যায়। তাহলে পিলখানার গেটের ভেতর থেকে জওয়ানরা মিডিয়াকে উচ্চস্বরে যে বক্তব্য রেখেছিল- ডিজি প্রথমে গুলি করে জওয়ানদের উপর, তারপরই জওয়ানরা বিদ্রোহ করে; কথাটা মিথ্যা এবং পরিকল্পিত। কেন এই পরিকল্পিত মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিল তারা ? একইভাবে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধেও জনমনে একটা আতঙ্কজনক ধারণা তৈরির চেষ্টা করেছিল। কেন ? এমনকি প্রধানমন্ত্রির সাথে বিডিআর সদস্য প্রতিনিধিরা মিথ্যে তথ্য প্রদান করে সাধারণ ক্ষমার আশ্বাস নিয়েছিল। বিদ্রোহীরা কি এরকম ক্ষেত্রে কখনো মিথ্যে তথ্য বলে, যা নাকি যৌক্তিক সময় পরেই ফাঁস হয়ে যাবে ?

৪.০ একজন ডিজির বিরুদ্ধে কথিত দুর্নীতি বা দুর্ব্যবহারকে উপলক্ষ্য করে বিপুল সংখ্যক চৌকস নিরস্ত্র সেনা কর্মকর্তাকে, যাঁরা জঙ্গি বিরোধী ভূমিকায় প্রশংসনীয় সাহসী অবদান রেখেছিলেন, তাঁদেরকে ব্রাশ ফায়ারে গণহত্যা করা তাৎক্ষণিক বিদ্রোহ হিসেবে কতোটা অনুমোদনযোগ্য ? আসলে কি এটা বিদ্রোহ, না কি কোন ব্যাপক ষড়যন্ত্রের অংশ ?

৫.০ ঘটনা ঘটার পরপরই অনেক জওয়ানদের মুখমণ্ডলে লাল কাপড় বাঁধা থাকতে দেখা গেলো। কোন্ আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়ায় এগুলো হঠাৎ করে সবার কাছে বেরিয়ে এলো ? আধা সামরিক বাহিনী হিসেবে মুখে কাপড় বাঁধার জঙ্গি স্টাইল না হয় বাদই রাখলাম, কাপড়গুলো কখন সংগৃহিত হলো ?

৬.০ যতটুকু জানা যায়, অস্ত্রাগারের চাবি নাকি কোন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছেই রক্ষিত থাকে এবং এমুনিশান বা গোলাবারুদের মজুতখানাও নাকি অস্ত্রাগার থেকে বেশ দূরে। আগে থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহে না থাকলে দরবার হলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এতো দ্রুততার সাথে আদৌ কি ঘটানো সম্ভব ?

৭.০ বেঁচে ফিরে আসা প্রত্যক্ষদর্শী কোন কোন অফিসারের ভাষ্যে জানা গেল যে অনেকগুলো সশস্ত্র ঘাতক জওয়ানদেরকে অপরিচিত মনে হয়েছে। একজন সেনা কর্মকর্তার চোখে অপরিচিত কথা বৈশিষ্ঠ্যমূলক বৈ কি ! তবে কি বাইরের কোন গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ছিলো ?

৮.০ যে লোমহর্ষক অবস্থায় বহু সেনাকর্মকর্তার মৃতদেহ ম্যানহোল, স্যুয়ারেজ বা স্বল্প সময়ে খোড়া গণকবর থেকে উদ্ধার হচ্ছে, এই সংস্কৃতিতে বিডিআর জওয়ানরা কি পূর্ব অভিজ্ঞ বা অভ্যস্ত ? যদি না হয়ে থাকে এই অভ্যস্ত সংস্কৃতির ঘাতক গ্রুপের পরিচয় কী ?

৯.০ পিলখানার বিভিন্ন জায়গা থেকে যে পরিমাণ লুকানো গোলাবারুদ, গ্রেনেড বা ধ্বংসাত্মক এমুনিশান উদ্ধার হচ্ছে সেগুলো কি বিডিআর মজুদখানার সরবরাহ ? জওয়ানরা আত্মসমর্পণ যদি করবেই তাহলে এসব আবার লুকিয়ে ফেলার কারণ কী ? নাকি ওগুলো আসলেই লুকানো ভাণ্ডার, যা আগে থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছিলো ?

১০.০ ডিজি’র বাসা এবং অফিসার কলোনি বা মেসগুলো ব্যাপক লুটপাট ও পুড়িয়ে সম্পূর্ণ ভস্ম করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে সাধারণ পোশাকে ধৃত জওয়ানদের কাছ থেকে লুটপাটকৃত স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধারও করা হয়েছে কিছু কিছু। সাধারণ জওয়ানের মনস্তত্ত্বে কর্মএলাকায় এসব লুটপাট কতটুকু সাযুজ্যপূর্ণ ? এরা কি সত্যিই বিডিআর জওয়ান ছিল ?

১১.০ শোনা যাচ্ছে প্রথম রাতেই অনেক বিদ্রোহী জওয়ান ব্যারাক ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এজন্যই কি পিলখানার আশেপাশে বা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সেনা অবস্থানের তীব্র বিরোধিতার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে ? এরা কি সত্যি কোন বিদ্রোহী জওয়ান, না কি বাইরের কোন গ্রুপ ? নিরাপদে পালানোর সুযোগ চাচ্ছিল ?

১২.০ শুধু দরবার হলেই নয়, কলোনিগুলোতে তল্লাশি চালিয়ে কর্মকর্তাদের হত্য করা হচ্ছিল। এমনকি যেসব জওয়ান এর বিরোধিতা করেছে তাদেরকেও সাথে সাথে হত্যা করা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে যে নারকীয় কায়দায় ছারখার করে দেয়া হচ্ছিল, মুহূর্তের মধ্যে সহকর্মী সহযোদ্ধা জওয়ানদের এরকম পাল্টে যাওয়া ঘাতকমূর্তি ধারণ করা কি আদৌ সম্ভব ? এই ঘাতকেরা কি বিডিআর সদস্যই ছিল ?

১৩.০ আগের দিনের সদর দপ্তরের কথিত বিদ্রোহ পরের দিন দেশের অন্যান্য বিডিয়ার সেক্টর ব্যাটেলিয়ন ক্যাম্পগুলোতে নাড়া দেয়া শুরু করলো। এই সময় ফ্যাক্টরে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে কি ?

সময়ের সাথে সাথে এরকম আরো বহু প্রশ্ন হয়তো দেখা দেবে। এসবের উত্তর আমাদের সাধারণের জানা নেই। তবে যেসব নৃশংস আলামত একে একে পাওয়া যাচ্ছে, কোন ঘৃণ্য জঙ্গি গ্রুপ ছাড়া একটা সুশৃঙ্খল বাহিনীর সাধারণ জওয়ানদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশকে কোন্ মনস্তত্ত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করা হবে ? এগুলোর মধ্যে যে সুদূরপ্রসারী গভীর ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনার স্পষ্ট লক্ষণ আমাদের সাধারণের নজরে এসে যায় কেবল দেখে বা শুনে, বাস্তবে তা যে আরো অনেক বেশি ভয়ঙ্কর চেহারায় রয়েছে তা কেবল আঁচ করতে পারি আমরা। আর কেঁপে কেঁপে ওঠি। কতদিন থেকে কী পরিমাণ অর্থায়নে কিভাবে এসব জঘন্যতম পরিকল্পনা হচ্ছিল, কে বা কারা এর পেছনে সক্রিয় ছিল বা আছে, সেই কালো হাতগুলোকে চিহ্ণিত করা কি সরকারযন্ত্রের জন্য খুব বেশি কষ্টকর বিষয় ?

থেকে থেকে মা বোন শিশুদের কান্নার রোল আর কতো বেশি গগনবিদারী হলে রাষ্ট্র এই অপশক্তিগুলোকে খুঁজে খুঁজে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে ? এরকম আর কতো ভয়াবহ ট্র্যাজেডি এই দুর্ভাগা জাতিকে এমন অসহায়ভাবে দেখে যেতে হবে ?

অবশেষে যে কথাটা না বললেই নয়, আমাদের সেনাবাহিনী এবার যে সহনশীলতা আর জাতির প্রতি নিরঙ্কুশ বিশ্বস্ততার পরিচয় দিলেন, এতে তাঁদের ক্ষয়ে যাওয়া ভাবমূর্তি অবশ্যই জনমনে ভীষণ ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে নিশ্চয়ই। এক বেদনাময় রক্তগাথা বুকে চেপে তাঁদের এ বিশ্বস্ততাকে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে সাধুবাদ জানাই। তাঁরা যে আমাদেরই ভাই। আর বিদ্রোহের নামে এমন নারকীয় পৈশাচিকতা কোন দেশপ্রেমিক বাহিনীর সদস্যের দ্বারা সংঘটিত হওয়া আদৌ কি সম্ভব ? পেছনের সেই কুৎসিৎ ছায়ামুখগুলোর মুখোশ উন্মোচন করাটা খুবই জরুরি এখন, রাষ্ট্রের নিরাপদ আগামীর জন্যই।