যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে পাকিস্তানের গোস্যা রহস্য

আবুল হোসেন খোকন

 

বাংলাদেশ এদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে উপযুক্ত শাস্তি দিতে চাইছেএজন্য জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং দেশবাসীও জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে এরপে নিরঙ্কুশ রায় দিয়ে দিয়েছেএরপর আর কোন কথা থাকতে পারে নাকিন্তু পাকিস্তান কেন এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আপত্তি তুলছে? কেনইবা তারা গোস্যা করছে? পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির বিশেষ দূত জিয়া ইস্পাহানি গত ১৬ ফেব্রয়ারি ২০০৯-এ বাংলাদেশের রাজধানীতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, “১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি উত্থাপন করার সঠিক সময় এখন নয়এই মুহূর্তে এ বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া করা উচিত নয়কারণ অনেক বিষয়ে আমরা বাংলাদেশকে সহায়তা করতে ইচ্ছুকআমি মনে করি আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিতিনি কি বলতে চাইছেন এর মাধ্যমে? তিনি কি বলতে চাইছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করলে বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেদেবেন না? বলতে চাইছেন, বিচার করার উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধাচারণ করবেন? দেখে নেবেন? তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করায়পাকিস্তান কি বাংলাদেশকে হুমকী দিচ্ছে? জিয়া ইস্পাহানির কথায় কিন্তু সেটাই সুস্পষ্টআর তিনি যেহেতু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টর বিশেষ দূত হয়ে এসে এ কথা বলেছেন এবং পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছাবাণী নিয়ে আসেনÑ সেহেতু এটাকে আর ব্যক্তিগত পর্যায় বলে মনে করার যুক্তি নেইএককথায় ইস্পাহানি পাকিস্তান রাষ্ট্রের হয়েই বাংলাদেশে এসেছেন এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাষ্যই তিনি বলেছেনপ্রশ্ন হলো, তিনি বা তার পাকিস্তান কি এটা বলতে বা করতে পারে? সে মতা পাকিস্তান রাখে? এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর কিন্তু না-না-নাতাহলে? তাহলে এই ধৃষ্টতা কেন-কিভাবে-কোন সাহসে? এতোবড় ধৃষ্টতা, হুমকী এবং স্পর্ধা বাংলাদেশ কি চুপ করে সহ্য করবে? করা উচি? না, মোটেই নয়, মোটেই উচি নয়এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো উচিসেইসঙ্গে পাকিস্তানি ওই দূতের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গসহ রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তের অভিযোগে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিআর এটা গোটা বাংলাদেশের দাবিকারণ পাকিস্তানি দূত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছেনবাংলাদেশকে সুস্পষ্টভাবে হুমকী দিয়েছেন

 

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে ভূমিকা রাখা বাংলাদেশী যুদ্ধাপরাধীরা আজও বহাল তবিয়তে, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে এরা টিকে রয়েছেএদেরকে নিয়েই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই দেশে ৩০ ল মানুষ হত্যা করেছিল, ৪ লাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানী করেছিল, গোটা বাংলাদেশের সহায়-সম্পদ লুটপাট করেছিল, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করেছিলযুদ্ধে পরাজয়ের পর এই যুদ্ধাপরাধীদের দিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত যতো সন্ত্রাস এবং অপরাধমূলক তপরতা তার সবই পরিচালনা করা হয়েছেএভাবে বাংলাদেশকে পিছিয়ে আর পিছিয়ে, কলুষিত আর কলুষিত করে, সংকট আর জটিলতা তৈরি করে ধ্বংস করে দিতে চাওয়া হয়েছেআজও সে অপচেষ্টা বন্ধ হয়নিসুতরাং বাংলাদেশ আজ আত্মরা করতে যখন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, একাট্টা হয়েছেÑ তখনই পাকিস্তানের এই গোস্যা, আপত্তি, জ্বালা! এটা বুঝতে কারও বাকি থাকে না যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ দেখে পাকিস্তানের ঘুম হারাম হয়ে গেছেসেইসঙ্গে হিতাহিত জ্ঞানও তারা হারিয়ে ফেলেছেনা হলে কোন রাষ্ট্র কখনও বিশেষ দূত পাঠিয়ে এ ধরণের হুমকী দেওয়াতে পারে? মন্তব্য করাতে পারে? কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করাতে পারে? পারে নাসুতরাং ঘটনাটি অতি সাংঘাতিক বলেই বিচেনা করতে হবে 

 

সাম্প্রতিক পরিস্থিতি প্রোপটে অনেকেই পাকিস্তানকে একটু ইতিবাচক চোখে দেখার করেছেনকারণ দেশটিতে দীর্ঘদিন অগণতান্ত্রিক অপশক্তি মতা দখল করে ছিলএই অপশক্তির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি জনগণ লড়েছেনজনগণের অন্যতম দুই নেতা-নেত্রী নওয়াজ শরীফ এবং বেনজির ভুট্টোকে দেশ থেকে মাইনাস করা হয়েছিলতারপর গণঅসন্তোষের চাপে তাদেরকে দেশে ফিরতে দিলেও অপশক্তির বুলেট শেষরা করতে দেয়নি বেনজির ভুট্টোকেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে প্রকাশেতারপর আরও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে দেশটির আন্দোলনকারী মানুষকেতারা বন্দুকবাজদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জনমত গড়েছেন এবং একটি নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রের শক্তিকে বিজয়ী করে মতায় বসিয়েছেনবেনজির ভুট্টোর রক্তের উপর দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক শক্তির বিজয়ের পর স্বভাবতই আমরা অনেককিছু ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চেয়েছিলামকিন্তু পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের দূত বাংলাদেশে এসে যে ভূমিকা রেখে গেলেন এবং যে অবস্থান তুলে ধরলেনÑ তাতে সব ধারণা ভেঙে খান খান হয়ে গেছেকয়লা ধুলে ময়লা যায় না, আর কুকুরের লেজ সোজা হয় নাÑ সেটাই প্রমাণ হলো এর মধ্যদিয়েচারিত্রিকভাবেই পাকিস্তান রাষ্ট্র যে একটি নষ্ট রাষ্ট্র সেটা আবারও আমরা দেখতে পেলামনা হলে এই দু:সাহস এবং অসভ্য আচরণ প্রত্য করতে হতো না

 

এখানে একটা কথা না বললেই নয়সেটা হলো, নষ্টদের একটা আশ্রয়স্থল হলো সৌদি আর ওয়াশিংটনপাকিস্তানে যখন অগণতান্ত্রিক শক্তি মতা দখল করে কব্জায় রেখেছিল, তখন মাইনাস হওয়া দুই নেতানেত্রীর আশ্রয়স্থল ছিল ওই দুই দেশআবার যারা মতা কব্জা করে রেখেছিল, তাদেরও প্রভু ছিল ওই দুই জায়গাইসুতরাং খেলাটা বড় চমকপ্রদ এবং জটিলএই জটিলের খেলা পাকিস্তাকে কেন্দ্র করে ত্রি-সূত্রেরই নয়এর শেকড় বা নেটওয়ার্ক আরো অনেক বড়আমরা ৭১-এ তা দেখেছিনতুন প্রজন্মের মানুষও অনেক কিছু দেখছেনসারা পৃথিবীময় এই শেকড় বিস্তৃত রয়েছেপ্রভুরা যেভাবে খেলান, সেভাবে তার খেলোয়াররা খেলেএ েেত্র কথিত মহাপরাশক্তির দোসর হলো সৌদি আরব, আর সৌদি আরব ভায়া হলো পাকিস্তানএই কয়ে মিলে বাংলাদেশের উপর আছর৭১-এর প্রমাণ ছাড়াও এখনকার ভিত্তি হলো এই যুদ্ধাপরাধীরাএখানেও আবার সুতো বা শেকড়ের বিস্তৃতি রয়েছেআর সে কারণেই কিন্তু চলতি সংসদে জাতীয় নেতারা অনেক কথা বলেছেন, যার মধ্যদিয়ে বেরিয়ে এসেছে অনেক কিছু

 

যেমন বাম নেতা রাশেদ খান মেনন এমপি বলেছেন, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের আদলে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশের ডিজিএফআইবিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই ডিজিএফআই পাকিস্তানি আইএসআইয়ের মতো বাংলাদেশর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলএসময় এই সংস্থাটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নানা হস্তপে এবং বিশেষ করে নেতাদের আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চালায়এসময় ডিজিএফআই প্রচারমাধ্যমসহ সব মহলের কাছে এক আতঙ্ক হিসেবে বিরাজ করেআইএসআইয়ের কায়দায় ডিজিএফআই ইনফরমেশন সেল গঠন করে টেলিভিশন ও সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করেছেপলিটিক্যাল উইং করে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেসংস্কারের নামে দল ভেঙেছেকিংস পার্টি তৈরি করার চেষ্টা হয়েছেমেনন সংসদে প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশকে পাকিস্তান হিসেবে পরিণত করা হয়েছিল কিনা? চলতি জাতীয় সংসদ অধিবেশনের ভেতরে-বাইরে আরও বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ একই কথা বলেছেনতারা তাদের উপর সামরিক বাহিনীর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পৈশাচিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেনসাবেক মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাত ভাই শেখ সেলিম এমপি বলেছেন, জয়েন্টইন্টারগেশন সেলে একটানা ৪৮ ঘণ্টা তাকে ঘুমাতে দেওয়া হয়নিচালানো হয়েছে পৈশাচিকভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনচোখ বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছেমাথার উপর জ্বালানো হয়েছে হাজার পাওয়ারের বাল্বপ্রচণ্ড গরমে যন্ত্রণাহত করা হয়েছেইলেকট্রিক শক চালিয়ে মাথার মগজকে লাফালাফি করানো হয়েছেকানে-মুখে সর্বশক্তি দিয়ে চপেটাঘাত করা হয়েছেকানের পর্দা ফেটে রক্ত ঝরতে থেকেছেপৈশাচিক নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে যেতে হয়েছেতিনি জানান, ২০০৭ সালের ২৯ মে তাকে যৌথবাহিনী আটক করে এবং ইন্টারগেশন সেলে নিয়ে বলা হয়, তাদের (সামরিক বাহিনীর) কথা না শুনলে বাসা থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হবে, পরিবারের সবাইকে অস্ত্র মামলায় আসামী করা হবে এবং নেওয়া হবে ক্রসফায়ারেসেখানে বাইফোর্স করে কথা রেকর্ড করা হয়, বাজিয়ে শোনানো হয়বলা হয়, যতোণ পর্যন্ত না শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলা হবে, ততোণ নির্যাতন করা হবেবাইফোর্স করেই আদালতে বলার জন্য ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া হয়েছিলআওয়ামী লীগের যুগ্ন-সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তাকে রিমান্ডে নিয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছেসাবেক মন্ত্রী, এমপি বা জননেতা বলে কোন সম্মান করা হয়নিঠিক একই কথা বলেছেন, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল এমপিপ্রবীণ নেতা হওয়া সত্ত্বেও তার উপর যে পৈশাচিক নির্যাতন এবং অসম্মানজনক আচরণ করা হয়েছে তা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পৈশাচিকতাকেও হার মানিয়েছেএরকম আরও বিবরণ দিয়েছেন সাবেক মন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরতিনি এজন্য সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইকে অভিযুক্ত করেন

 

সুতরাং শেকড় যে কতো প্রথিত তা বলারই অপো রাখে নাআর রাখে না বলেই পাকিস্তান এখন বাংলাদেশের একাট্টা অবস্থানে বিচলিতকারণ কান টানলে মাথা আসেএখানেও সে ব্যাপারটি রয়ে গেছেযদি যুদ্ধাপরাধীদের গলায় ফাঁস পড়ানো হয় তাহলে পাকিস্তানী আরও দোসর বা নেটওয়ার্কগুলোর অবস্থা বিপদজনক হয়ে যাবে, তারা ফেঁেস যাবেএমন হলে বাংলাদেশে আর শয়তানি করা যাবে না, এ দেশকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ঠেকানো যাবে নাভেঙে গুড়িয়ে যাবে পাকিস্তানি সকল নেটওয়ার্ক এবং ষড়যন্ত্রসে কারণেই পাকিস্তানি দূতের মুখোশটা মিডিয়ার সামনে খুলে পড়েছেএই খুলে পড়ার মধ্যদিয়ে কার্যত থলের বিড়ালই বেড়িয়ে পড়েছে

 

সুতরাং শেষ কথা হলো, কোন শত্রবা শত্রদের সঙ্গে রেখে কখনই দেশ চালানো যেতে পারে নাদেশের উন্নয়নও সম্ভব নয়, অশান্তি দূর করারও সম্ভব নয়দেশরা করতে হলে তাই ৭১-এর যদ্ধাপরাধীদের মতো সব পাকিস্তানি দালালদের বিচার করতে হবে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবেনা হলে কোন কাজই করা যাবে না, দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন কোনটাই অর্জন করা যাবে নারাজনৈতিক মতা সবসময়ই থাকবে চরম হুমকীর মুখেঅতএব বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া চলবে না কোনভাবেই

[ঢাকা, বাংলাদেশ : ২০ ফেব্রয়ারি ২০০৯]

 

       আবুল হোসেন খোকন : সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট