ওবামার অভিষেকঃ পরিবর্তনের পথে স্বপ্নযাত্রার সূচনা

ফরিদ আহমেদ

 

আর মাত্র একদিন পরেই যুক্তরাষ্ট্রের চুয়াল্লিশতম প্রেসিডেন্ট হিসাবে অভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন বারাক ওবামা। ওয়াশিংটন তার নতুন প্রেসিডেন্টকে বরণ করে নেয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছে জানুয়ারী মাসের হাড় কাঁপানো শীতকে উপেক্ষা করেও। এর মধ্যেই দুই মিলিওনেরও বেশি মানুষ রওনা হয়ে গেছে ওয়াশিংটনের পথে ঐতিহাসিক এই ঘটনার স্বাক্ষী হবার জন্য। সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের চোখ আঠার মত টেলিভিশনে লেগে থাকবে স্মরণীয় এই ঘটনাকে মানসপটে সেঁটে রাখার জন্য। আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মত যে সাদা ঘরে বসত গড়তে যাচ্ছেন কালো একজন মানুষ। এতো শুধুমাত্র একজন প্রেসিডেন্ট বদলের মত নিয়মিত কার্যক্রম নয়। সুদর্শন, মেধাবী, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা এই কৃষ্ণাঙ্গ তরুন প্রেসিডেন্ট তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই স্বপ্ন দেখানো শুরু করেছেন মানুষকে। দিনের পর দিন ধরে গভীর বিশ্বাসে শুনিয়েছেন দিনবদলের কথা। আর তার সেই স্বপ্ন এবং পরিবর্তনের আশায় আশার তরীতে পাল তুলেছে আমেরিকানরাসহ সারা বিশ্বের মানুষেরা। ফলে আগামিকালের অভিষেক পেয়ে গেছে ভিন্নতর এক মাত্রা। ওবামাকে অভিষেকের মুকুট মাথায় পরার সাথে সাথে বয়ে নিয়ে যেতে হবে অসংখ্য মানুষের আশার থলিও।

 

অভিষেকের প্রাক পর্যায় শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যেই। ওবামা তার রাজনৈতিক হিরো আব্রাহাম লিংকনের অনুকরণে তার স্মরণে ফিলাডেলফিয়া থেকে ট্রেনভ্রমণ করে এর মধ্যেই পৌঁছে গেছেন ওয়াশিংটন ডিসিতে। ১৮৬১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী ইলিনয়ের স্প্রিংফিল্ড থেকে অভিষিক্ত হওয়ার জন্য ট্রেনে করে যাত্রা শুরু করেছিলেন আব্রাহাম লিংকন।

 

অভাবনীয় কিছু না ঘটলে আগামিকাল থেকেই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন এবং সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী পদে কাজ শুরু করবেন বারাক ওবামা। এমনিতেই এটা ভয়ানক কঠিন গুরু দায়িত্ব। তার উপর বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি একে করে তুলেছে  কঠিনতর। গত আশি বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক মন্দাকাল অতিক্রম করছে  দুনিয়ার অর্থনীতি। মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা। ইরাক এবং আফগানিস্তানে তৈরি হয়ে আছে ভয়াবহ জট। রাশিয়া তার গোবেচারা ভাব ঝেড়েমুছে ফেলে  হয়ে উঠেছে আক্রমণাত্মক, আগ্রাসী। অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার পথে এখন চীন। দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক শক্তিধর ভারত- পাকিস্তান যুদ্ধংদেহী ভঙ্গিতে পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সীমান্তে। এই সমস্ত আন্তর্জাতিক সমস্যার সাথে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত যুক্ত হয়েছে আভ্যন্তরীন সমস্যা সমূহ। বেকারত্ব ছাড়িয়ে যাচ্ছে সকল মাত্রা সীমা, স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার নিজেরই আরোগ্যের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে জরুরী ভিত্তিতে। ক্লান্তিতে শুয়ে পড়তে চাচ্ছে অটো ইন্ডাষ্ট্রির মত আরো অনেক ইন্ডাষ্ট্রিই। এত রাজ্যের সমস্যা একজন মানুষের জন্য সমাধান করা আসলেই কষ্টকর।

 

কিন্তু তারপরেও কঠিন বলে ছেড়ে দেয়ার উপায় ওবামার নেই। তার পূর্বসুরী জর্জ বুশ দুই মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বের যে ভয়াবহ ক্ষতিসাধন করে গেছে তার সংশোধন ওবামাকেই করতে হবে। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত এবং সবচেয়ে অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট হিসাবে এর মধ্যেই নাম কামিয়ে ফেলেছেন জর্জ বুশ। বর্তমানে তার সমর্থনের হার মাত্র ২২ শতাংশ  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বব্যাপী আমেরিকার সুনামে এত বড় বিপর্যয় আর কেউ ডেকে আনেনি কখনো। আমেরিকার অর্থনীতিকেও বিপর্যস্ত করে ফেলেছেন তিনি। আর এই বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে বাঁচাতে বেইল- আউটের মত অজনপ্রিয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হয়েছে তাকে। জর্জ বুশের অপকর্মের কারণে বুশ পরিবারের সুনাম এমনই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে জর্জ বুশের ভাই জেব বুশ পর্যন্ত ফ্লোরিডা থেকে সিনেটে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

 

বুশের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল যে তিনি ছোট্ট একটা উপদেষ্টামন্ডলীর পরামর্শ অনুযায়ী চলতেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন ডিক চেনি। জর্জ বুশের অদক্ষতায় অতি দ্রুতই তিনি সবচেয়ে ক্ষমতাবান ভাইস প্রেসিডেন্টে পরিণত হন। আমলাতন্ত্রে তার অসাধারণ দক্ষতার কারণে তিনি তার পছন্দের লোকদের বসিয়ে দেন এর অলিতে গলিতে। ফলে প্রেসিডেন্টের কাছে তথ্যের অবাধ প্রবাহ যায় বন্ধ হয়ে। ঠুটো জগন্নাথ বানিয়ে দেওয়া হয় প্রেসিডেন্টকে। নেপথ্য থেকে সর্বময় ক্ষমতার আসল অধিকারী হয়ে যান ডিক চেনি। তার কুবুদ্ধিতেই ইরাক যুদ্ধ, গ্লোবাল ওয়ার্নিং সহ প্রায় সব ইস্যুতেই প্রেসিডেন্ট বুশ চরম দক্ষিণপন্থী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ডিক চেনি বাদে আরো যে দুজন জর্জ বুশকে ডুবিয়েছেন তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন বুশের দীর্ঘদিনের পলিটিক্যাল গুরু কার্ল রোভ এবং অন্যজন হচ্ছেন তার ডিফেন্স সেক্রেটারী ডোনাল্ড রামসফিল্ড। কার্ল রোভ প্রশাসনের সব কিছুকে দলীয়করণ করায় নেশাগ্রস্থের মত মত্ত ছিলেন। আর রামসফিল্ড ইরাক যুদ্ধকে বুদ্ধু বুশের মত গণতন্ত্র বিনির্মাণের ফালতু ভাবালুতায় ভোগেননি। বরং আমেরিকান সশস্ত্রবাহিনীর সুদক্ষতা এবং গতিময়তা পরীক্ষা করার সুযোগ হিসাবে নিয়েছিলেন।

 

এর ফলশ্রুতিতে বুশ প্রশাসন পরিণত হয়েছিল দলীয়করণ এবং রাজনৈতিককরণযুক্ত একটি অথর্ব প্রশাসনে। জর্জ বুশ হচ্ছেন স্মরণকালের সবচেয়ে পক্ষপাতদুষ্ট দলীয় প্রেসিডেন্ট। দেশের অর্ধেক লোকের প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি খুশি ছিলেন। দেশের রাষ্ট্রপতির সুউচ্চ এবং মর্যাদাপূর্ণ পদকে তিনি দলীয় প্রধানের পদে অবনমন করেছিলেন। তার মূল লক্ষ্যই ছিল রিপাবলিকান কোটারির স্বার্থ রক্ষা করা। অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী সুফলের চেয়ে স্বল্পমেয়াদী লাভের দিকেই তার ঝোঁক ছিল বেশি।

 

সেই তুলনায় বারাকা ওবামা লক্ষ্যণীয়ভাবে আলাদা। সবচেয়ে মূল্যবান মন্ত্রীত্ব তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারী ক্লিনটনকে দেয়া এবং সফল ডিফেন্স সেক্রেটারী রবার্ট গেটসকে রেখে দেয়াটাই প্রমাণ করে যে তিনি চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে রাজী নন। এর মধ্যেই এমন একটা টিম গড়ে তুলেছেন যারা লোকজনের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। নিজের ভুল ত্রুটি স্বীকার করতেও পিছপা নন তিনি। এর মধ্যেই তিনি আমেরিকানদের সতর্ক করে দিয়েছেন যে, শক্ত হাতে দেশ চালানোর জন্য তাকে প্রয়োজনে কঠোরও হতে হতে পারে

 

যদিও নির্বাচনের সময়ে অসংখ্য আশার বাণী শুনিয়েছেন তিনি লোকজনকে। ফলে তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে মানুষের বিপুল প্রত্যাশা  কিন্তু নির্বাচনের পরে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়কালীন সময়ে সেই আশার বাণীতে রেশ টেনে ধরেছেন তিনি। তার নির্বাচনী প্রচারণা যে সুউচ্চ প্রত্যাশা তৈরি করেছে তাকে প্রত্যেকটা সুযোগে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছেন ওবামা। সবচেয়ে আশার দিক হচ্ছে তার এই কৌশল ভালই কাজ করছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস/সিবিসির করা গতকালের এক জরীপে দেখা গেছে যে, যদিও বারাকা ওবামার সব সমস্যার বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলার ব্যাপারে সামর্থ্যের উপর আমেরিকানদের দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে, কিন্তু তারা কোন ধরনের অবাস্তব আশা করছে না কেউই। সবকিছু ঠিকঠাক হতে যে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে সে ব্যাপারটি তারা মেনে নিয়েছে বাস্তবসম্মতভাবেই। 

 

আগামি চার বছর অথবা আট বছরে বহু কিছুই হতে পারে। যার ভবিষ্যবাণী করা হয়তো এখনই মুশকিল। হতে পারে বিশাল কোন পরিবর্তন এসে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে সবকিছুকে মঙ্গলময় দিকে, অথবা হতাশায় মুষড়ে দেওয়ার মতো অনাকাঙ্খিত ঘটনাও ঘটে যেতে পারে। পুড়তে হতে পারে স্বপ্ন ভঙ্গের তীব্র বেদনায়। হয়তো ওবামার অনভিজ্ঞতাই পিছিয়ে দিতে পারে সবকিছুকে। কিংবা লংকায় যেয়ে অন্যেরা যেরকম রাবণে পরিণত হন, তিনিও সেরকম আরেকজন রাবণে পরিণত হতে পারেন ক্ষমতার মসনদে বসার পরই। অথবা এই দুইয়ের মাঝামাঝি কিছুও হতে পারে।  কিন্তু সব কিছু ছাড়িয়ে আশার দিক যেটা আছে তা হলো ওবামা একজন চিন্তাশীল এবং সংবেদনশীল মানুষ। অত্যন্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তিও বটে। যার উপর মনে হয় ভরসা করা যায় নিশ্চিন্ত মনে। আর সেটাই বোধহয় এই ক্রান্তিকালে সবচেয়ে জরুরী আমাদের জন্যে।

 

মায়ামি, ফ্লোরিডা

[email protected]