বাসুনকে, মা

 

লুনা শীরিন

 

পর্ব ৪ 

 

 

বাসুন,

আবারও সেই বরফ দিয়ে ঢাকা টরোন্টো শহর, প্রতিদিনই তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ২০ এর কাছাকাছি তুই স্কুল থেকে আসার ঘন্টা পেরোতেই  চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আসে, একটু আগে তোকে নিয়ে বাজার করে এলাম, ফেরার পথে ট্রলি ঠেলে ঠেলে আমাকে হেল্প করতে চাইলি, আমার মনে পড়ে গেলো নিজের ছোটবেলার কথা, আমরা চারবোন সবাই ছোটবেলা থেকে আমার মাকে বলতেন এই মেজ মেয়েটাই তোর ছেলে হবে, আমি আমাদের পরিবারের সব ছেলেদের কাজগুলো করতাম, বাজার করা, চিঠি পোষ্ট করা, গ্রামের বাড়ি থেকে কেউ এসেছে তাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, বাসার কাজে দৌড়ে ব্যাংকে যাওয়া, সব করতাম আমি, তাই বড় হয়ে যাবার পরও আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেরা ডাকতো গুন্ডা, বিগ্রেডিয়ার, মেজর জেনারেল ইত্যাদি করেঅনেকে আমাকে হলে দেখতে আসতো আমি  বিছানার চাদর বিছাতে পারি কি না, জানিনা সেই আমি আজ তোর মা বাবু, আমার পরিচিত অনেকেই আজো বলে তুমি সংসার করছো, ঘরের সব কাজ পারো তুমি, রান্না করতো পারো? হ্যাঁ, শুধু সংসার করছি বললে ভুল হবে, সম্পূর্ণ  স্বাধীন জীবনযাপনের অধিকারী হয়েও আমি কেন যেন খুব বেশী ঘরমুখো হয়ে গেছি। জানিস বাবু, আমার নিজের ভিতরটাকেই আমি ঠিক চিনে উঠতে পারিনি আজো, কেমন করে মানুষের মনের আবেগ আর চাওয়া/ পাওয়া ইচ্ছে /অনুভুতি গুলো বদলে যায়? জানতে ইচ্ছে করে ভীষণ।

 

এখন সন্ধ্যা ৭ টা মতোন হবে, পাশের ঘরে তুই হোমওয়ার্ক করছিস আর আমি বাংলাদেশের পত্রিকা খুলে বসেছি।  প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পাতার ছোট একটা খবর হয়তো কারো চোখেই পড়বে না কিন্তু আমি হু হু করে কেঁদে উঠলাম, তাহলে কি দেশ সত্যি বদলে যাচ্ছে? পাবনা জেলার বেড়া থানার আওয়ামী লীগের এক সংসদ সদস্য শামসুল হক টুকুকে সোনার নৌকা দিয়ে বরণ করা হলে তিনি তা ফেরত দিয়ে বলেন আমাকে এভাবে নির্বাচিত করার জন্য আপনাদেরকেই আমার সংর্বধনা দেয়া উচিত, কিন্তু আপাতত সেই সামর্থ্য আমার নেই, আর  তা ছাড়া এভাবে উপহার নেবার রেওযাজ পরিবর্তন হওয়া দরকার (প্রথম আলো ১৬ ই জানুয়ারী ২০০৯)। আমি খরবরটা বার বার পড়ি, মনে হয় এখনো তো সত্যিকার মানুষ আছে, যারা লোভ সংবরন করতে পারে। তাহলে খালেদা জিয়ার ছেলে কোকো কেন ২১ কোটি টাকার দুর্নীতি করবে? কার টাকা মেরে খায় এইসব কুলাঙ্গার সন্তানেরা? এই একই দিনের পত্রিকার প্রথম পাতায় খালেদা  জিয়া আবার বিরোধী দলের কাছে দেশে ভালো পরিবেশ আশা করেকোন মুখে খালেদা টিভি ক্যামরার সামনে দাড়ায়? সময় থাকতেই উনি কেন দেশের মানুষের কাছে করজোরে ক্ষমা চান না? লজ্জা বা  শরম জাতীয় শব্দগুলো কি আমাদেও রাজনীতি থেকে চিরতরে উঠে যাবে?

 

বাবু, তোকে নিয়ে বিদেশে এলাম ঠিকই কিন্তু এক মুহুর্তের জন্যও দেশটাকে ভুলে থাকতে পারলাম না, সেইতো  সারাদিন বুঁদ হয়ে থাকা দেশের জন্যআজ একজন  ইমেল করে জানিয়েছে অনেকেই নাকি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসায় দেশে ফিরে যাচ্ছে, আমার যাবার কোন ইচ্ছে আছে  কিনা, আমি হাসবো না কাদঁবো, দেশ থেকে তো আমি পালিয়ে আসিনি,স্বইচ্ছায় এসেছি আমি ও আমার মতো চুঁনোপুটিদের ভাগ্য সবজায়গায় একই রকম  অর্থ্যা খেটে খেতে হবে, বরং যত অল্প পয়সায় তোকে নিয়ে টরোন্টো শহরে দিন গুজরান করছি তা নাকি  ঢাকাতে অসম্ভবতবে  আর কিসের জন্য প্রাণ দিতে দেশে যাওয়া? বরং পরম করুনাময়ীর  কাছে প্রার্থনা বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে শামসুল ইসলাম টুকুর মতো কর্মীরা হাল ধরুক, দীর্ঘদিনের পুঁতি দুর্গন্ধময় দেশের শাষণ ব্যবস্থ্যায় একটু সূর্যের আলো লাগুক

তোর কপালে চুমু সোনা

তোর মা,

১৬ই জানুয়ারী ২০০৯