‘দূরন্ত পরবাস’ ও প্যাসিফিক স্যামনের গল্প

 

-জাহেদ আহমদ

 

একঃ

প্যসিফিক স্যামন (pacific salmon) মাছের কথা পড়তে গিয়ে মালিক নানার কথা মনে এসে গেল। আমার মায়ের একটু দূরের চাচা হন তিনি। ছোট বেলায় শুনেছি মালিক নানা আমেরিকা থাকেন। বড় হয়ে ও শুনি তিনি আমেরিকাতেই আছেন বউ-ছেলে-মেয়ে সহ। নানাবাড়ির অনেকের কাছে শুনতাম, মালিক নানা পুরোদস্তুর আমেরিকান হয়ে গেছেন। তাঁর চলাফেরা, ওঠাবসা সবই আমেরিকানদের সাথে। তবে নিজ গ্রাম বা আশপাশ এলাকার ভাগ্যবান কারো আমেরিকায় পৌঁছানোর সংবাদ পেলে মালিক নানা নাকি খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যেতেন তাঁদের কুশলাদির খোঁজ-খবর নিতে; প্রয়োজনে সাহায্য ও করতেন।দেশ ছেড়ে আসার ক’মাস আগে শুনি মালিক নানা দেশে চলে এসেছেন; একেবারে থাকবেন বলে। আমার মা জানালেন, মালিক নানা ক্যান্সারে আক্রান্ত, আমেরিকায় ডাক্তাররা ডেডলাইন দিয়ে দিয়েছে। তিনি দেশে এসেছেন মৃত্যুচিন্তা মাথায় রেখে। আমেরিকার জৌলুসময় পরিবেশ ছেড়ে দরিদ্র বাংলাদেশে চলে এসেছেন জীবনের শেষ সময়টুকু কাটাতে। মালিক নানার এই ব্যাপারটা কি দেশপ্রেম, নাকি স্রেফ নাড়ির টান সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছেন, শৈশব-কৈশোর-যৌবন সেখানে কাটিয়ে পরে বিদেশে গিয়ে স্থায়ী হয়েছেন এমন অনেকের বেলায় এরকম ঘটতে দেখা যায়। প্রবাসী অঞ্চল সিলেট আমার জন্মস্থান। ছোট বেলায় প্রায়ই শুনতাম, অমুক গ্রামের অমুক দশ-বিশ কিংবা ত্রিশ বছর পার করে লন্ডন, ডুবাই, আমেরিকা ইত্যাদি দেশ সমূহ ছেড়ে একেবারে দেশে চলে এসেছেন। অনেকে ছুটে যেতেন সে সব দেশান্তরীদের দেখতে। বিদেশে বাড়ি-গাড়ি-ব্যাবসাপাতি এমন কি স্ত্রী-সন্তান রেখে অনেকে চলে আসতেন জীবনের শেষ সময় টুকু জন্মমাটিতে কাটাতে।

 

দুইঃ

প্যাসিফিক স্যামন মাছের কথা একটু বলি।

 

এদের বেশিরভাগই এনাড্রমাস (anadromous) শ্রেনীর প্রাণি। অদ্ভূত এদের জীবন চক্র। জন্ম নেয় নদীর মিঠা পানিতে, তারপর এরা সাগরে চলে যায়; সাগরের নোনা জল এবং বিচিত্র পরিবেশে এক থেকে পাঁচ বছর পার করে তারা বড় হয়। অতপর কয়েক শ, কখনো বা কয়েক হাজার, মাইল পর্যন্ত পথ পাড়ি দিয়ে ঠিকই আবার ফেরত আসে যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তাদের জীবন। জন্মনদীর উদ্দেশে ফিরতি যাত্রায় বিশ্রামহীন প্যাসিফিক স্যামনেরা দৈনিক ১৮ থেকে ৩০ মাইল পর্যন্ত দূরত্ব সাঁতার কেটে অতিক্রম করে। জন্মস্থানের জলে এরা ডিম পাড়ে; ডিম পাড়ার পর এদের বেশির ভাগই মারা যায় জন্মস্থানের মিঠাপানিতে। সেজন্য এদেরকে বলা হয় সিমেলপেরাস (semelparous)। মোট সাত প্রজাতির প্যাসিফিক স্যামন রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ প্রজাতির আবাসস্থল (বা আবাসজল) হচ্ছে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে। বাকী দুই প্রজাতির (চেরী বা মাসু) বাস এশিয়ার জলে। 

 

মিঠা পানির মাছ সাগরে যায়, আবার মিঠা পানিতে ফিরে আসে- এটা হয়তো বড় কোন ঘটনা নয়। কিন্তু একবার দেশান্তরী হয়ে যাবার পর ডিম পাড়তে আপণ জন্মস্থানের একেবারে হুবহু জায়গায় ফিরে আসা এবং অতঃপর মারা যাওয়ার নজির মাছের জগতে এক মাত্র প্যাসিফিক স্যামনের বেলায়ই দেখা যায়।বহু বছর সাগরে কাটানোর পর কি ভাবে এরা জন্মস্থানকে চিনে নেয় এবং ঠিক সেখানটাতেই ফেরত আসে? বিজ্ঞানীদের মাঝে এ নিয়ে মতের ভিন্নতা আছে। কিছু গবেষকদের মতে, প্যাসিফিক স্যামনের রয়েছে বিশেষ ধরনের স্নায়ু ইন্দ্রিয় বা সেন্সরি গ্যাংগ্লিয়া যা সাগরের স্রোতের প্রবাহের ধরন অনুযায়ী সাড়া দেয় এবং এদের উপকূলে পৌঁছাতে সাহায্য করে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, প্যাসিফিক স্যামন ভূ-পৃষ্ঠের চৌম্বক ক্ষেত্রের ভিন্নতা টের পেতে সক্ষম এবং সে তথ্য এরা উপকূলমুখী যাত্রাতে কাজে লাগায়। তবে সম্ভবত সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা এই বিষয়ে এই যে, প্যাসিফিক স্যামন যখন জন্মজলের আশেপাশে চলে আসে, তখন ফেরোমন বা এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থের অস্তিত্ব এদের সজাগ ঘ্রান ইন্দ্রিয় টের পায়। শৈশবে নদী থেকে সাগরে প্রথমবার দেশান্তরী হবার যাত্রাচিহ্ন এদের মস্তিষ্কে হয়ত স্থায়ী থেকে যায়। যৌবনে ফিরতি যাত্রায় তা কাজে লাগে।                      

 

পৃথিবীর বুকে বহু বিলিয়ন বছর ধরে বিচরনকারী স্যামন মাছকে আদিবাসি আমেরিকানরা ঈশ্বর বলে মানে। স্যামন মাছের জীবন চক্র অনুযায়ী তারা নিজেদের জীবন সাজায়। ‘স্যামন মানব’ বলে নিজেদের তারা পরিচয় দিতে ভালবাসে। ক্ষুধা ও দূর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করতে ঈশ্বর স্বয়ং তাদের সামনে স্যামন মাছ রূপে আবির্ভূত হয়েছেন বলে তারা বিশ্বাস করে।

 

তিনঃ

জন্মস্থানের প্রতি টান অনুভবের ব্যাপারটা সম্ভবত শুধুমাত্র মানুষের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। হারিয়ে যাওয়া বা পথ হারিয়ে ফেলা পশু, যেমন কুকুর-বিড়াল বা গরু, নিজে থেকে পথ চিনে প্রভুর ঘরে ফিরে আসার ব্যাপারটা আমরা মাঝে মাঝে শুনে থাকি। তবে এক্ষেত্রে এটা কি স্রেফ প্রভুভক্তি নাকি নাড়ির মজ্জাগত টান সেটা বলা মুশকিল। ঠিক তেমনি বহু বছর ধরে দেশান্তরী মানুষের মনে জন্মস্থান ও জন্মমাটির প্রতি হাহাকার ও হয়তো যতটা না দেশপ্রেম, তার চেয়ে ও বেশি নাড়ির টান, যদি ও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মনে করেছেন-

 

‘স্বদেশের প্রেম যত সেই মাত্র অবগত

বিদেশেতে অধিবাস যার।‘

 

বাংগালী মহাকবি মাইকেল মধুসূদনের যৌবনে বিদেশপ্রীতি এবং শেষ বয়সে বংগদেশে প্রত্যাবর্তন করে ‘তব ভান্ডারে বিবিধ রতন’ আবিষ্কারের কথা সকল বাংগালীরই জানা। তেমনি ডি এল রায়ের সুরে ‘জন্মেছি মাগো তোমার কোলেতে মরি যেন এই দেশে’ গানটি ও অনেকের শোনা। বহুকাল ধরে আমেরিকা প্রবাসী, প্রথিতযশা বাংগালী কবি শহীদ কাদেরীকে কিছুদিন আগে এক সাক্ষাতকারে হাহাকার করতে দেখলাম এই বলে যে, ‘বিদেশ কখনোই কার ও আপন হয় না।‘

 

মায়ের কাছে শুনেছি যে, জীবনের বেশিরভাগ সময় ‘দুরন্ত পরবাসে’ কাটানো আমার বাবা নাকি দেশে ছুটিতে আসলে মাঝে মাঝে গুন গুন সুরে গাইতেন (বা গাওয়ার চেষ্টা করতেন) জসীম উদ্দিনের বিখ্যাত গান-‘আমার হাড় কালা করলাম রে, আমার দেহ কালার লাইগারে।‘ আমার বাবা বিদেশে নিঃসংগ অবস্থায় মারা যান ১৯৭৫ সালে। সেটা আরেক প্রসংগ।   

 

পরিনত বয়সে বাংলাদেশ ছেড়ে আমেরিকা এসে পরবর্তীতে বউ-বাচ্চা-সংসার সহ আমেরিকাতে স্থায়ী হয়েছেন, এমন অনেক বাংলাদেশী-আমেরিকানকে দুঃখ করতে দেখি এই নিয়ে যে, আমেরিকাতে জন্মগ্রহনকারী তাঁদের ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশ সম্পর্কে একেবারেই নিরাসক্ত। বাংলাদেশী টিভি নাটকে কিষাণের হাল-চাষ বা জেলের নদী-হাওরে জাল ফেলে মাছ শিকারের দৃশ্য দেখে বাবা-বা যখন উদ্বেলিত হন, তাঁদের আমেরিকান ছেলেমেয়েরা এসব ‘সিলি’ এবং ‘বোরিং’ দৃশ্যে বাবা-মার সেন্টিমেন্টাল প্রতিক্রিয়ায় অবাক না হয়ে পারে না। বাংলাদেশ সম্পর্কে আমেরিকাতে জন্মগ্রহনকারী বা এখানে বড় হয়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের কোন প্রকার আসক্তি বা দোটান থাকার কথা নয়। সমস্যা কেবল প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়ে বাংলাদেশ থেকে আসা বাবা-মার বেলায়। ছেলেমেয়ে বিদেশের আবহাওয়ায় মানুষ হয়েছে, বাংলাদেশে গিয়ে তারা নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারবে না। আমেরিকাই সেসব ছেলেমেয়েদের নিজেদের দেশ। লাভ-লোকসানের হিসেব কষে বাবা-মার পক্ষে আমেরিকার মায়া ত্যাগ করা তাই সহজ কথা নয়। আমেরিকার পার্সপোর্টধারী বাংলাদেশী বাব-মার জীবন কাটে তাই বাংলাদেশ নিয়ে নিঃশব্দ হাহাকার, দ্বিধা-দ্বন্ধ আর সংশয়ের আবর্তে। অন্য সময় ভুলে থাকা গেলে ও গভীর রাতে মাঝে মাঝে ঘুম থেকে জেগে উঠেন তাঁরা শৈশবের স্বপ্নে। ভাবেন, অনেক হয়েছে আর নয়, এবার সব কিছু ফেলে দেশে চলে যাবেন। দিবালোকে সেসব স্বপ্ন হারিয়ে যায় সংগত কারণে। সচল এবং জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশে গিয়ে শান্তিতে শেষ সময়টুকু কাটানোর স্বপ্ন সকলের পূরণ হয় না। কারো কারো লাশ দেশের মাটিতে পাঠানো হয়।

 

এই হল ‘দূরন্ত পরবাসে’ আমাদের জীবন। প্যাসিফিক স্যামন মাছের মতন অত বড় ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আর ক’জন জন্মায়? 

 

শুভ নববর্ষ সবাইকে।

                                               —-

     

নিউ ইয়র্ক

০৫ জানুয়ারী ২০০৯

 

লেখকের পরিচয়ঃ নিউ ইয়র্ক স্টেট গভর্ণমেন্টে কর্মরত; মুক্তমনা (www.mukto-mona.com) অনলাইন ফোরামের মডারেটর এবং ঢাকা থেকে প্রকশিত বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ নির্ভর ম্যাগাজিন ‘মুক্তান্বেষা’–র সাথে সংযুক্ত। ই-মেইলঃ [email protected]