নির্বাচন ২০০৮: কিছু ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ

 

এক
২৯ ডিসেম্বর। অন্যান্য ছুটির দিনের মত দেরী করেই ঘুম থেকে উঠি। আমার আসনটিতে দুই জোটের বাইরে উল্লেখযোগ্য কোন প্রার্থী না থাকায়- কোন মার্কায় সিল মারার পরিকল্পনা নেই; “না” ভোটরে তামাশা মনে হয়। ফলে ভোটকেন্দ্রে যাওয়াটা অপ্রয়োজনীয় ঠেকে। সরাটা দিন শুয়ে-বসেই কাটাই। তবে একটা কাজ করি- সেটা হলো টেলিভিশনে ৫ টা চ্যানেল ফলো করি, সংবাদ-টকশো-নির্বাচনী খবর …. খুব মনোযোগ দিয়ে দেখি, শুনি।দুই
দুপুরে মা ভোট দিয়ে আসে, পাশের বাড়ির মহিলার সাথে। পাশের বাড়ির সেই আন্টি আমাকে ভোট দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালালেন কিছুক্ষণ।
: ভোট দেয়া তো নাগরিক অধিকার, ভোট না দিলে তো নাগরিক থাকলা না… (বুঝা যায়- বাঙালি অন্য অধিকারের ব্যাপারে যেমনই হোক- এই ভোটাধিকারের ব্যাপারে তার সচেতনতা একেবারে টনটনে…)
: আন্টি, ভোট দেওয়ার মত কেউ নাই- কারে দিব? নৌকা-ধানের শীষ আমার কাছে একই।
: এইটা কি বললা? (আমার কথায় মনে হইলো আন্টি কষ্ট পাইলেন)। বিএনপি’র অমুক তো একটা পুরা সন্ত্রাসী গডফাদার। সেই তুলনায় আওয়ামিলীগের তমুক তো খুবই ভালো মানুষ।

এই আসনে ৯৬-০১ এ আওয়ামিলীগের সন্ত্রাসী এমপিরে এইবার নমিনেশন দেয়নাই। তবে মনে আছে- ২০০১ এ যখন আওয়ামিলীগের সন্ত্রাসী প্রার্থীরে হারাইয়া বিএনপির বর্তমান সন্ত্রাসী প্রার্থী জিতলো, তখন লোকে খুব খুশী হইছিল।

: তাইলে তো আন্টি, একটা ভালো মানুষরে আপনেরা ভোট দিয়া খারাপ বানাইতে যাচ্ছেন। আর, ভালো মানুষ হলে বিএনপি-আওয়ামিলীগ করতে যাবে কেন?

আন্টিরে আসাদুজ্জামান নুরের গল্প শুনালাম।

তিন
আমার নানাবাড়ি নীলফামারি। নিকট আত্মীয় অনেকেই আওয়ামিলীগ কর্মী। আসাদুজ্জামান নুর আগেরবার যখন নমিনেশন পান, তখন প্রথমেই ছাত্রলীগের ক্যাডারদের (সাজাপ্রাপ্ত/ মামলাধীন) জেলের বাইরে নিয়ে আসেন। এমন একজন ক্যাডার (একটি বাহিনীর প্রধান, দুর্ধর্ষ হিসাবে নাম আছে) আবার আমার আত্মীয়ও হয় (৭ বছরের কারাদণ্ড ছিল)। ভাবি- আসাদুজ্জামান নুরের মত ফ্রেশ মানুষেরই এমন দশা!

আওয়ামিপন্থী মামাদের সাথে যুক্তি-তর্ক হয়। তারা বলেন, নুর ভাই তো নিজে সন্ত্রাসী নন। আর রাজনীতি করতে গেলে সন্ত্রাসীদের পুষতেই হবে।

আসলেই তাই। আওয়ামিলীগ-বিএনপি’র রাজনীতিতে সন্ত্রাসীদের অবস্থান খুব স্বাভাবিক ও সাধারণ ঘটনা।

চার
নির্বাচনের আগে আগে নীলফামারির এক আওয়ামি নেতার (ইনিও আত্মীয়) সাথে কথা হচ্ছিল। তাকে চিন্তিত মনে হলো।
: শেখ হাসিনা প্রথমে নুর ভাইকে নমিনেশন দিতে চায়নি। এই আসন জাতীয় পার্টিকে দিতে চেয়েছিল। এরশাদ নেয়নি (নুর ভাইরে তিনি লাইক করেন)- মিলিটারিও নুর ভাইকে চেয়েছে।
: মিলিটারি?
: আওয়ামিলীগের সিলেকশন কমিটির উপর মিলিটারি প্রভাব ছিল।
: নুরকে শেখ হাসিনা নমিনেশন দিতে চায়নি কেন? সংষ্কারপন্থী হওয়ার কারণে?
: হ্যা। নুর ভাই হাসিনার খুব কাছাকাছি এসেছিলেন। এবং বিগত তত্তাবধায়ক সময়ে এমন কিছু তথ্য সরকারের হাতে গিয়েছিল যে, এতে হাসিনার প্রধান সন্দেহ নুরের দিকে গিয়েছে।
: সেরকম হলে তো ঠিকই আছে। নুরের বিরুদ্ধে ভূমিকা নেয়াটাই ঐ পার্টির উচিৎ কাজ।
: আরে নাহ! আমু-তোফায়েলদের তো কিছু করেনি, ঠিকই নির্বাচন করছে। আর এসব দলে এমনটি তো হয়ই। বিএনপি-জাতীয় পার্টি করা লোক কি আওয়ামিলীগে আসেনি? আওয়ামিলীগ-বিএনপি’র মত বড় পার্টিতে এরকম নানা ট্রেণ্ড থাকেই- সেগুলো গিলে খাওয়ার ক্ষমতা এদের আছে।

পাঁচ
নির্বাচনের দিনে খবরের কাগজে এবং টিভি খবরে বিএনপি-জামাতের নেতা-কর্মী, প্রার্থীর আত্মীয়দের টাকাসহ হাতেনাতে ধরার খবর প্রচারিত হয়। তবে খালেদা জিয়ার আত্মপক্ষ সমর্থন দেখে বেশ মজা পাই। খবরগুলোতে দেখা যায়- তিনি ইনকনফিডেন্ট গলায় জানাচ্ছেন, ধৃত ব্যক্তি ব্যবসার কাজে টাকা নিয়ে যাচ্ছিলেন। কেউ তার কথা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না। অর্থাৎ খালেদা জিয়ার স্টেটমেন্ট এইসমস্ত ঘটনাকে পরিপূর্ণভাবে প্রচারে সহযোগিতা করেছে।

উল্টোদিকে, শেখ হাসিনাকে সকাল থেকেই অনেক কনফিডেন্ট দেখা গেল। তিনি নির্বাচনের ফল যাই হোক না কেন তা মেনে নেয়ার আহবান জানান। মনে হলো- তার এই আহবান যেন খালেদা জিয়ার প্রতি।

ছয়
সন্ধার দিক থেকেই ফলাফল আসা শুরু করে। এবং প্রথম থেকেই মহাজোটের এগিয়ে থাকার খবর আসে। মর্নিং শো’জ দ্য ডে-কে সত্য প্রমাণ করে মহাজোট মহা জয় লাভ করে। রাত জেগে মহাজোটের জয়গাঁথা শুনতে থাকি।

সাত
রাতের প্রথম দিকে বুঝা যায় নিজামী আর মুজাহিদ হেরে যাচ্ছে। সাঈদী আর কামারুজ্জামানের খবর প্রথম দিকে জানা যাচ্ছিল না- এদিক, ওদিকে ফোন করে জানলাম, তারা হারছে। শেষে এদের সবার হার নিশ্চিত হলাম। হই হুল্লোড় করে বাসার সবার ঘুম ভাঙ্গিয়ে সুখবরটি দিলাম। জানালাম, জামাত সবকটিতেই হেরে গেছে।

আরো পরে জানতে পারলাম, কক্সবাজার আর চট্টগ্রাম-১৪ তে জামাত ২টি আসন পেয়েছে। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল।

আট
এরশাদের খবর পেলাম। “বিশ্ববেহায়া” খ্যাত স্বৈরাচার এরশাদ – শেখ হাসিনার বড় ভাই(!)- জিতে গেল। একে এক জাতীয় পার্টি ২৭ টি আসন পেল। বাথরুমে গিয়ে থুতু ফেলে আসলাম। এরশাদের বড় খায়েশ রাষ্ট্রপতি হওয়ার। রাজাকার বিশ্বাসরে বিএনপি রাষ্ট্রপতি বানাইছিল- স্বৈরাচার এরশাদরে কি আওয়ামিলীগের কল্যানে রাষ্ট্রপতি দেখবো? সম্ভাবনা কম বলেই মনে হয়।

নয়
নির্বাচনের আগের দিন একটি চ্যানেলের টকশো’তে জাফর ইকবাল আর অপি করিমের আলোচনা শুনি। অপি বলে, একদিকে যু্দ্ধাপরাধী – কিন্তু আরেকদিকে তো স্বৈরাচার। জাফর ইকবাল জবাবে জানান, দুটো ইস্যুর মধ্যে গুণগত পার্থক্য আছে- একটি হলো দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান- দেশকেই অস্বীকার করা; আর উল্টোদিকে স্বৈরাচার হলো দেশের মধ্যে গণতন্ত্রকে হত্যা করা।

জাফর ইকবাল খুবই শ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তি- কিন্তু তাঁর তুলনামুলক তত্ত ভালো লাগলো না। রাজাকারদের ঘৃণা করি, স্বৈরাচারকেও ঘৃণা করি। ঘৃণার কম-বেশি মাপতে মোটেও ভালো লাগেনা।

দশ
সেক্টর ফোরামের দেয়া যুদ্ধাপরাধীদের তালিকার ২০ জন এবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। তাদের ১৭ জন জামাতের টিকিটে, ২ জন বিএনপি’র টিকিটে এবং একজন জাতীয় পার্টির টিকিটে। জামাতের ১৭ জনই পরাজিত; কিন্তু বিএনপির টিকিটে ১জন (২ এর মধ্যে) এবং মহাজোটের ম্যাণ্ডেটে জাতীয় পার্টির টিকিটে একজন যুদ্ধাপরাধী ঠিকই সংসদ সদস্য।
এগারো
মিডিয়ায় মহাজোটকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসাবে দেখানো হচ্ছে। অথচ এই মহাজোটের মধ্যেও ধর্মভিত্তিক দল আছে। সেগুলোর কথা বাদ দিয়ে এরশাদ বা জাতীয় পার্টিকেও যদি দেখি কি দেখা যায়? এই এরশাদই কিন্তু সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে ব্লাসফেমি আইনের কথা সরাসরি বলছে জামাত। কিন্তু জাতীয় পার্টির ইশতেহারও কম যায় না। জামাতের “ধর্মীয় ও সমাজ জীবন” শীর্ষক অনুচ্ছেদে আছে, “বই, পত্র-পত্রিকা, ইলেকট্রোনিক মিডিয়াতে ধর্মবিরোধী প্রচারণা ও কটূক্তিকারীদের প্রতিরোধ ও শাস্তি বিধানের জন্যে ব্লাসফেমী জাতীয় আইন প্রণয়ন করা হবে”। আর অন্যদিকে জাতীয় পার্টির ইশতেহারে “ধর্মীয়” শীর্ষক অনুচ্ছেদে আছে: “আল্লাহ, রাসুল (সাঃ) এবং শরিয়তের বিরুদ্ধে কটূক্তিকারীদের শাস্তির বিধান সম্বলিত আইন প্রণয়ন করা হবে”। এমন ইশতেহার সম্বলিত দলকে সাথে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন সম্ভব?

বারো
মহাজোট=> ২৬২ (/২৬৩)
চারদলীয় জোট=> ৩২ (/৩০)
অন্যান্য => ৫ (/৪)

তেরো
বিএনপি’র ভরাডুবি।
বিএনপি=>২৯
জাতীয় পার্টি=>২৭

চৌদ্দ
নির্বাচনের ফল নিয়ে একটু গবেষণা করা যাক। প্রথম ও প্রধান প্রশ্ন বিএনপি’র ভরাডুবির কারণ কি? ঘুরেফিরে নিচের কারণগুলোই চলে আসছে-
# ক্ষমতায় থাকা অবস্থা থেকেই বিএনপি’র সাংগাঠনিক অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু হয় (বিকল্প ধারা, এলডিপি), তবে গত দুবছরে বিশেষ করে খালেদা জিয়া জেলে থাকা সময়টিতে একেবারে লেজেগুবরে অবস্থায় দাঁড়ায়। বিএনপি নিজেও তার প্রস্তুতিহীনতার কথা জানতো বলেই নির্বাচন পেছানোর জন্য মরিয়া ছিল। শেষ পর্যন্ত পেছানো হলেও যে সময় পেয়েছে তা তার জন্য যথেস্ট ছিল না। তবে এরপরেও যতখানি নির্বাচনী অর্জন- সেটা শেষ মুহুর্তে খালেদা জিয়ার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল। (সেটা না হলে এতটুকুও হতো কি না সন্দেহ!)।
# দ্রব্যমূল্য ইস্যুতে সাধারণ আমজনতা বিগত চারদলীয় জোট সরকারকে বর্জন করেছে এবং মাঠ পর্যায়ে এটিকে মহাজোট ভালো পিক করেছে। নির্বাচনের আগে-পরে রিকশাওয়ালা-হকার এ ধরণের যতজনের সাথে (খুব বেশীজনের সাথে না- আনুমানিক বারো থেকে পনেরজন হবে) কথা বলেছি তাদের বেশীরভাগের রেসপন্স পেয়েছি- তারা নৌকায় ভোট দিতে যাচ্ছে বা দিয়েছে এবং তার কারণ হিসাবে তারা বলছে- চালের দাম ৬০/৭০ উঠুক এটা তারা চায় না- এমনকি কাউকে কাউকে এটাও বলতে শুনেছি, আওয়ামিলীগ নাকি তাদের ১৫ টাকায় চাল খাওয়াবে।
# দুর্ণীতির ইস্যুটিও বিএনপি জোটকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। আওয়ামিলীগ-বিএনপি উভয়ের নেতা-নেত্রীরা এতে অভিযুক্ত হলেও বিএনপি’র বড় মুখরা বেশী ধরা খেয়েছে। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার দুই পুত্রের ব্যাপারটি এক্ষেত্রে খুব ভাইটাল রোল প্লে করেছে। তারেক জিয়া তো বিএনপি সরকারের আমল থেকেই আলোচিত, বিগত তত্তাবধায়ক সরকারের আমলের দুর্ণীতি বিরোধী অভিযানের সময়ও তারেক জিয়া- আরাফাত কোকো বারে বারে সামনে এসেছে; এবং সর্বশেষ নির্বাচনের একদম মুখে এসে কোকো-সিমেন্স দুর্নীতির খবরটি সামনে আসায় ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে।
# সেই সাথে বিএনপি জোটের প্রার্থী সিলেকশনে আলোচিত কুখ্যাত দুর্নীতিবাজ-সন্ত্রাসী গডফাদাররা নমিনেশন পেয়েছে বেশী। আওয়ামিলীগেও যে এমন প্রার্থী এবার নেই তা নয়, তবে হাজী সেলিম, মকবুল, হাজারি, ইকবাল ….. এরকম অনেক বিগশটের নমিনেশন না পাওয়া ও আপাত নতুন তথা ভালো/ফ্রেশ মুখের নমিনেশন পাওয়াটা ভালো আলোচনায় এসেছে।
# যুদ্ধাপরাধী ইস্যুটি বিএনপি জোটের ভরাডুবির অন্যতম প্রধান ও প্রথমদিককার কারণ। জামাতে ইসলামী আসলেই বিএনপির জন্য একটা বিষফোঁড়া – সেটা এই নির্বাচনে খুব পরিষ্কার। উপরন্তু নির্বাচনের মাসটি ছিল ডিসেম্বর- এ মাসটি জুড়ে এমনিতেই পুরো বাংলাদেশে যুদ্ধপরাধের ইস্যুটি বেশী আলোচিত হয়। শিক্ষিত মিডলক্লাস-আপার মিডলক্লাস যুদ্ধাপরাধ ও দুর্ণীতি এ দুটো ইস্যুতে সবচেয়ে বেশী করে সাড়া দিয়েছে এবং বিএনপি জোটকে বর্জন করেছে। সেই সাথে এবারে প্রথম ভোটার হওয়া বিরাট অংশের তরুন ভোটারেরাও এই দুটিতেই বেশী উচ্চকিত ছিল বলে মনে হয়।

পনের
স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত ৪টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো (মাঝের তামাশার ইলেকশনের কথা বাদ দিয়ে)। প্রথম ৯১ এ বিএনপি ১৪০ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে, আওয়ামিলীগ পায় ৮৮; এর পরে ৯৬ এ আওয়ামিলীগ ১৪৬ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে- বিএনপি পায় ১১৬; তারপরে আবার ২০০১ এর নির্বাচন। বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মানে ১৯৩ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে, উল্টোদিকে আওয়ামিলীগের হয় ভরাডুবি- মানে তারা পায় মাত্র ৬২ আসন। সেবারেও আওয়ামিলীগ এত কম কল্পনা করতে পারেনি এবং পরিচিত আওয়ামিলীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের হতবাক-হতাশ হতে দেখেছিলাম। এরপরে এবারের নির্বাচন। এবারে বিএনপি জোটের ভরাডুবি সমস্ত অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করে দিয়েছে। বিএনপি সমর্থকদের মুখের দিকেই তাকানো যাচ্ছে না। না যাক, এবারে এই চারটি নির্বাচনের ফলাফলকে পাশাপাশি দেখি।
প্রথমবার বিএনপি, তারপরে বিএনপির বদলে আওয়ামিলীগ, তারপরেরবার আওয়ামিলীগের বদলে আবার বিএনপি এবং এবারে আবার বিএনপির বদলে আওয়ামিলীগ। কি ইণ্ডিকেট করে?

৯১ এর বিএনপি রাজাকার বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছে, গোলাম আযম সহ রাজাকারদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, কৃষকদের বুকে গুলি চালিয়েছে, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেয়, দিনাজপুরে ইয়াসমিনের ধর্ষণকারীদের পক্ষ নিয়েছে…. ইত্যকার ঘটনায় ৯৬ এ বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় জনগণ আসে আওয়ামিলীগ, কিন্তু আওয়ামিলীগ সরকারেই যায় জামাতের সাথে একসাথে আন্দোলন করে এবং ঘাদানিকদের আন্দোলন-সংগ্রামকে পায়ে মাড়িয়ে- পুরো ৫ বছরে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে চুপ থাকে, দেশজুড়ে সন্ত্রাসী গডফাদারদের জন্ম দেয়, পাবলিক টয়লেট থেকে হাটবাজার- গ্রামের স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়- সর্বত্রই একক দখলদারিত্ব কায়েম করে, জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের ধর্ষণ, ধর্ষণকারীদের সেঞ্চুরী উদযাপন- তাদেরকে রাজনৈতিক ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, প্রাকৃতিক সম্পদ বিদেশী কোম্পানীর হাতে অসম চুক্তির মাধ্যমে তুলে দেয়া ইত্যকার নানা আকাম-কুকামে অতিষ্ঠ মানুষ আবার বিএনপির শরনাপন্ন হয় ২০০১ এর নির্বাচনে। দ্বিতীয়বার বিপুলভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বিএনপি আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। প্রথম আঘাত সংখ্যালঘু নির্যাতন, এর পর থেকে একের পর এক সন্ত্রাস-দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি… সমস্ত দিক থেকেই বিএনপি সরকার জনবিরোধী হয়ে ওঠে। আর তারই ফল এই নির্বাচনের এমন ফলাফল।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, জনগণ যখন গতবার বিএনপি কে ১৯৩ বা এবার আওয়ামিলীগকে ২২৯ আসন দিচ্ছে, তখন কোনভাবেই এটা মনে করার উপায় নেই যে, জনগণ গতবার বিএনপি-কে বা এবার আওয়ামিলীগকে খুব পছন্দ করছে বা ভালোবেসে ফেলেছে। তারচেয়েও বরং এটাই প্রতীয়মান হয় যে, জনগণ বাঁচতে চেয়েছে- এবং সাম্প্রতিক ক্ষমতায় থাকা দানবের হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছে। ফলে- এই ফলাফলগুলো গ্রহণ নয়- এই ফলাফল বর্জনের। আগেরবার বর্জন করেছে সে সময়ের দানব আওয়ামিলীগকে, এবার বর্জন করেছে সাম্প্রতিক দানব বিএনপি-জামাতকে। এটা একদিক দিয়ে ইতিবাচক এ কারণে যে জনগণ তার শত্রু মানে দানবকে চিনতে পারছে; কিন্তু এটা একই সাথে হতাশার ও ট্রাজেডির এ কারণে যে- জনগণ এভাবে আপাত দানবের হাত থেকে সাময়িক মুক্তি পেলেও তার প্রকৃত মুক্তি ঘটছে না। এবং সেটা সম্ভবও না, যদি না কোন প্রকৃত বিকল্প তাদের সামনে হাজির হতে না পারে।

ষোল
প্রশ্ন আসছে বর্তমান সরকারের কাছে আমরা কি আশা করতে পারি? আমি ব্যক্তিগতভাবে তেমন কিছু আশা করিনা, আশা করতে পারিনা কারণ অতীত অভিজ্ঞতা। তবে তেমন কিছু আশা না করলেও এটা মনে করি, আজ জনগণের মধ্যে যতখানি সচেতনতা তৈরী হয়েছে সেটুকু ধরেই এদের কাছ থেকে অনেক কিছু আদায় করে নেয়া সম্ভব- এবং সেটুকু পারা গেলেই অনেক লাভ। আর, কি কি আদায় করা যায় বললে বলবো- প্রথমত এখন থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে এক হয়ে উচ্চকিত হতে হবে, ব্যাপক আন্দোলনের মাধ্যমে এদেরকে বাধ্য করা খুবই সম্ভব মনে করি; এবং দ্বিতীয়ত দ্রব্যমূল্য কমানোর ব্যাপারে এদের নির্বাচনী অঙ্গীকার বারেবারে মনে করে দেয়া ও তাদের বাধ্য করা যেতে পারে।

অন্য বিষয়গুলোতে আসলে কিছুই হবে না। কেননা- সেগুলোতে আওয়ামিলীগ-বিএনপি মাসতুতো-পিসতুতো ভাই, কোন তফাৎ নেই।

সবাইকে ধন্যবাদ।

নাস্তিকের ধর্মকথা