আমরা কি ভাববাদে ফিরে যাব ?

আতিক রাঢ়ী

 

আমি ডঃ বিপ্লব পালের লেখার একজন ভক্ত। তবে তার সাম্প্রতিক লেখা “ মাও বনাম গান্ধি – প্রতিবাদি আন্দোলনের ভবিষ্যত কোন দিকে ?” আমার কাছে অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাস নিরপেক্ষ আবার অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর মনে হয়েছে।

সেটা আমার নীজস্ব বোধ ও বূদ্ধির সীমাবদ্ধতার কারনে হয়েছে কিনা আমি নিশ্চীৎ নই । সুতরাং আমার প্রয়াসটা মূলত

সেই নিশ্চয়তাকে খোঁজা।

 

কার্ল মার্ক্সের তত্ত্বায়ন ছিল তখন পর্যন্ত সর্বাধীক বিকশিত পূঁজীর দেশ ইংল্যান্ড থেকেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু হবে। সেটা হয় নি। পরবর্তীতে লেলিন বললেন – পূঁজীবাদের সর্বোচ্চরূপ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ। আমরা বাস করছি সাম্রাজ্যবাদের যুগে। কার্ল মার্ক্স সাম্রাজ্যবাদ দেখে জাননি। পূঁজী এখন জাতি রাষ্ট্রের সীমা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পরেছে পুরো বিশ্বে। সুতরাং, যেখানেই সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থী, সেখানেই আমাদেরকে আঘাত করতে হবে। ট্রটস্কি তখন লেলিনের বিরুদ্ধে মার্ক্সবাদ বিকৃ্ত করার আভিযোগ তুলেছিলেন। বলেছিলেন লেলিন একজন আসহিস্নু ধাত্রী, যে নয় মাসের শিশুকে পাঁচ মাসে প্রসব করাতে চায়।

 

জবাবে স্টালিন বলেছিলেন, মার্ক্সবাদ দুই প্রকার, একটা কেতাবি অন্যটা সৃজনশীল। বলসেভিকরা নীজেদেরকে সৃজনশীল মাক্সবাদী মনে করে। এই সৃজনশীল মার্ক্সবাদ চর্চার ধারাবাহিকতায় মাওয়ের জন্ম।

 

মাও সেমি ফিউডাল অর্থনৈ্তিক কাঠামোতে মার্ক্সবাদের প্রয়োগ করেন। ব্যাপারটা আমাদের দেশের স্বঘোষিত মাওবাদিদের মত রোমান্টিক ছিলোনা। মাও হাতে অস্ত্র তুলে নেবার আগে ৮৪টি ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলেছিলেন। যারা জীবনে একটি মাত্র ট্রেড ইউনিয়নও গোড়েছেন বা গড়ার চেষ্টা করেছেন কেবল মাত্র তাদের পক্ষেই        আন্দাজ করা সম্ভব- কি বিশাল কর্মযজ্ঞ এর জন্য

প্রয়োজন। ততকালিন শাসক শ্রেনী কতৃক বহু শংখক কমিউনিস্ত নেতা- কর্মী হত্যার পরে তিনি লং মার্চে যেতে বাধ্য হন।মুক্তাঞ্চল গঠন করেন, বিকল্প সরকার ব্যাবস্বা গড়ে তলেন। অস্ত্র তুলে নেয়াটা ছিল তখনকার বাস্তবতা। মাও কখনই সারা বিশ্বের জন্য তার দেখান মডেলের অনুসরন করতে বলেননি। তবে দ্বন্দ্বতত্ত্বের বিকাশে মাওয়ের যে সংযোজন তা যে কোন বিপ্লবীর জন্য বিপ্লবী তত্ত্ব প্রনয়নের ক্ষেত্রে অপরিহার্য।

 

দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব সহিংস বা অহিংস হওয়া একটা শর্ত সাপেক্ষ ব্যাপার, আগে থেকে ঘোষনা দিয়া এটা হয় না। তবে সাধারনত একই শ্রেনীর মধ্যে ক্ষমতা বদলের দ্বন্দ্ব অহিংস হয়ে থাকে। আর দ্বন্দ্ব যখন শ্রেনীর সাথে শ্রেনীর তখন তা সহিংস হবার সম্ভাবনাই বেশী থাকে। উৎপাদনের উপকরনের ব্যাক্তি মালিকানার উচ্ছেদ – এটা বল প্রয়োগ ছাড়া হয় না।

 

মুল বিতর্কটা আসলে মাও বনাম গান্ধী, ভাব্বাদ বনাম বস্তূবাদ, অহিংস বনাম সহিংস নয়। মূল বিতর্কটা হয়া উচিৎ বিপ্লব নাকি সংস্কার। পুরাতন কোন ব্যাবস্বা যা এক সময়ে প্রগতিশীল হলেও বর্তমানে কালের বির্বতনে প্রতিক্রিয়াশীল হয়েগেছে – তখন প্রয়োজন তাকে ছুড়ে ফেলার – তখনই প্রয়োজন বিপ্লবের। যতখন সংস্কারের মাধ্যমে উপাদানের প্রগতশীলতাকে ধরে রাখা যায় ততখন সেখানে বিপ্লব গ্রহনযোগ্য হয়না।

 

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ মূলত ৪৭ থেকেই শুরু। ৫২, ৬৯ পেরিয়ে ৭১। আন্দোলন্টা কিন্তু অহিংস পথেই ছিল। ২৫শে মার্চের পরে অহিংস নীতিকে আকড়ে থাকাটা হতো নপুংসকতা। আমরা গর্বিত যে আমাদের পূর্ব প্রজন্ম তা ছিলেন না। আগেও একবার বলেছি আন্দোলনের চরিত্র আহিংস না সহিংস হবে সেটা শর্ত শাপেক্ষ একটা ব্যাপার। এব্যাপারে পুর্বনির্ধারিত অবস্বান যেকোন আন্দোলনের জন্য বিকারগ্রস্হ্তা বা হঠকারিতার নামান্তর।

 

রোবটেরা একদিন প্রতিবাদি আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তাকে ফুরিয়ে দেবে – এটা কতটুকু সম্ভব ? রোবটতো কারখানাতেই তৈ্রী হবে। আবশ্য যদি এগুলো নীজেরাই নীজেদের বংশ বিস্তার করতে পারে তবে ভিন্ন কথা। এমনটি যদি কখনও সম্ভভও হয় সেক্ষেত্রে তারা মানুষের আজ্ঞাধীন থাকতে নাও চাইতে পারে।

 

দ্বন্দ্বতত্ত্ব বোঝার ক্ষেত্রে স্টালিনের সীমাবদ্ধতা ছিলো। কুলাকদের মেরেকেটে- সেই সাথে, সব ধরনের বিপরীত মতকে থামিয়ে দিয়া, সম্ভবত বলসেভিক পার্টির ৩০ তম কংগ্রেসে তিনি ঘোষনা করেছিলেন – রাশিয়াতে আর কোন বৈ্রী শ্রেনী নাই। তার কথার তাৎপর্য হলো, রাশিয়াতে সাম্যবাদ প্রতিষ্টিত হয়েছে। অথচ রাশিয়াতে তখন সমাজতন্ত্রই কেবল প্রতিষ্টীত হয়েছিলো। পরবর্তিতে মাওসেতুং দেখান যে সমাজতন্ত্রের পুরোকাল জুড়েই শ্রেনী সংগ্রাম জারী থাকে। পুজিবাদী ব্যাবস্হায় বূর্জোয়া শ্রেনীথাকে দ্বন্দ্বের শক্তিশালীদিকে আর সমাজতান্ত্রীক ব্যাবস্হায় শ্রমীক শ্রেনী থাকে দ্বন্দ্বের শক্তিশালীদিকে। এই শ্রেনী সংগ্রামের অবসানের মধ্যেদিয়েই আসবে সাম্যবাদ। তখন শ্রেনী দ্বন্দ্বের জায়গা নেবে অন্য কোন দ্বন্দ্ব। তবে সেটা কি হবে তা এখনই স্বঠিক ভাবে বলে দেয়া যাবেনা। তবে স্টালিনের সীমাবদ্ধতা এক ব্যাপার আর ৪ কোটি মানুষ হত্যা আরেক ব্যাপার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে রাশিয়ার জনসংখ্যা ছিলো ১৪ কোটি। ৪ কোটির পরিসংখ্যাটিকে স্বঠিক ধরে নিলে,  নারী, শিশু আর বয়স্কদের বাদে যেকজন সক্ষম পুরুষ আবশিষ্ট থাকে তার প্রায় সকলকেই মেরে ফেলতে হয়। 

 

আজকের প্রথম বিশ্বের জীবন মানের জৌলুসের পেছনে কর্পোরেট ক্যাপিটালের ভূমিকা ব্যাপক বিস্তৃত। পুঁজির বিশ্বায়নের ব্যাপারে

ধনী দেশগুলো খুবই সোচ্চার। তাদের মুক্তবাজার ব্যাবস্হায় পুঁজি ও পন্যের চলাচল অবাধ। উৎপাদনের অপর মৌ্লিক শর্ত শ্রম অবাধ নয়। খুবই মজবুত প্রাচীর দিয়ে ঘীরে রাখা হয়েছে আমাদের শ্রমশক্তিকে। চাইলেই আমরা পারছিনা শ্রম বিক্রী করতে।

প্রথম বিশ্ব- সারা বিশ্ব থেকে লগ্নিকৃ্ত পূঁজি্থেকে আয়ের একটা অংশ নিজ দেশের শ্রমজিবী শ্রেনীর মধ্যে বন্টন করে থাকে। কৃ্ষী ভর্তুকিও তার অংশ। প্রবেশ অধিকার সংরক্ষিত করে তারা নীজেদের বিশ্বে একটা কৃ্ত্রিম শ্রমবাজার তৈ্রী করে রেখেছে।

তাই যারা ওখানে আছেন, দেখছেন খুব কাছে থেকে, অনেক কিছু যেমন ভালো দেখছেন আবার অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তও হচ্ছেন।

পৃথিবীর কতশতাংশ মানুষের কাছে এখনও বিদ্যুৎ পৌছায়নি সে হিসাব না মিটিয়ে ইন্টারনেট বিপ্লবের স্বপ্ন, নিয়তিবাদেরই নামান্তর।

 

আন্দোলনের পথেই আসবে মুক্তি, সেই আন্দোলনের চরিত্র অহিংস হতে পারে আবার স্বহিংসও হতে পারে। এযাবৎ  মানব সভ্যতার যা কিছু মহান অর্জন সবই কোনো না কোণো আন্দোলনের ফসল।আজকের গনতন্ত্র যেমন ফরাসি বিপ্লবের ফসল,

তেমনি ভবিষ্যতেও মানুষকে মূল্য দিয়েই অধিকার প্রতিষ্ঠীত করতে হবে।

 

যুদ্ধ প্রশ্নে মাও এবং গীতার বক্তব্যে যে মিল আছে, বেমিলটা তার চাইতে অনেক বেশী মৌ্লিক। গীতা যেখানে বলছে – কর্মেই তোমার অধিকার, ফলে নয়। সেখানে মাও বলছে, ফলাফল নীজেদের পক্ষে আনার লক্ষ্যে ও উদ্দেশ্যেই যুদ্ধ করতে হবে।

 

আগুন, কৃ্ষি, চাকা, লোহা এসব আবিস্কারের কোনোটাই মানূষঅকে আরেক দল মানূষের কতৃক শোষনের হাত থেকে মুক্ত করতে পারেনি। তেমনি রোবট বা ইন্টারনেটও সেটা পারবেনা। সেই আশাটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা সমর্থন করেনা। তবে ভাববাদে- ঈশ্বরের ইচ্ছাই যেখানে শেষ কথা- সেখানে কিনা হতে পারে ? ঈশ্বরকেতো আর কার্য – কারনের ধার ধারতে হয়না।

 

কিন্তু সে পথে হাটার ঝুকি অনেক। এরফলে বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদের মত অপূর্ব আর্যনগুলোকে বিষর্যন দিয়ে ঈশ্বরের কার্য – কারন বিহীন অসীম জগতের গোলক ধাঁধাঁয়  হারিয়ে যেতেপারে প্রগতির পথে মানব সভ্যতার সকল অর্জন।