এমন মানব জনম

 

ক্যাথেরীনা রোজারিও কেয়া

 

টেলিফোনে বোনের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জেনেছিলাম সঞ্জীব চৌধুরী ভালো ছিলেন না। স্ট্রোকের কারনে মৃত্যু পথযাত্রী। ডাক্তার ৭২ ঘন্টা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। শেষ খবরটা অবশ্য ৭২ ঘন্টার আগেই পেলাম যে সঞ্জীব চৌধুরী দেহত্যাগ করেছেন।

 

খবরটা শোনা মাত্র একগাদা স্মৃতি হুড়মুড় করে ভীড় জমালো মানসপটে। ইদানিংকালের দলছুট এর সঞ্জীব চৌধুরী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকেন জগন্নাথ ছাত্রাবাসে। সবে হলিক্রস কলেজে পড়ছি আমি। বড় বোনের হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এস সি তে যাওয়া আসা শুরু করেছি। স্বরশ্রুতি নামের একটি সংগঠনকে দাঁড় করানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছি। আবৃত্তির বিভিন্ন ধরণ নিয়ে গবেষণা করছি। তুমুল আয়জন করছি জাতীয় আবৃত্তি উসবসহ আরো অনেক অনুষ্ঠান।

 

সে সময়ে স্বরশ্রুতির পাণ্ডুলিপি তৈরি হতো কবিতা আর গণসঙ্গীতের সমন্বয়ে। সঞ্জীব দা আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন গণসঙ্গীতের শিল্পী হিসাবে।

 

সঞ্জীব দা বিদ্রোহী ধারা বহন করতেন। সব সময়ে খানিকটা অন্যরকম ছিলেন। মাঝে মাঝে অসহ্য রকমের উদাসীনতা কাজ করতো তার মধ্যে। এমন ঘটনা প্রায়শ ঘটতো যে ছাত্রাবাসে থাকাকালিন সময়ে সকালে ঘুম থেকে উঠে রওনা হলেন ক্যান্টিনে নাস্তার জন্য। পথে কেউ ধরে বসলো। সঞ্জীবদা গান শুনিয়ে যান। ফিরে এলেন নিজের রুমে, হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেন। গান যখন শেষ হলো বেলা গড়িয়ে তিনটা বাজে। রুমে তিলধারনের জায়গা নেই। কোথায় নাস্তা, কোথায় ক্লাশ, কোথায় দুপুরের খাওয়া। সবাই তখন সঞ্জীবের গানে মগ্ন।

 

মনে আছে রিহার্সেলের কোন এক ফাঁকে মামুলী কথার মতোই জিজ্ঞেস করেছিলাম। আচ্ছা সঞ্জীবদা  মানুষের তো সামনে লক্ষ্য থাকে, উদ্দেশ্য থাকে। আপনি কি ভাবছেন, কি হবেন, কি করবেন- জবাবে বলেছিলো অকর্মণ্য মানুষেরার তো ঘর জামাই হয়, আমি ঘর শালা হবো। আসলেই প্রচণ্ড স্নেহভাজন ছিলেন তিনি তার দিদি আর দাদাবাবুর। যতদূর মনে পড়ে ভদ্রলোকের নাম পিণাকী দাস।

 

সঞ্জীবদা তার উদ্দেশ্যবিহীন বাঁধনহীন জীবনের কথা অকপটে স্বীকার করতেন। আমি পরবর্তীতে সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে ফেলি ঢাকার সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ। প্রবাস জীবন শুরু করায়, সেই যোগাযোগে চিরস্থায়ী ভাটা পড়ে যায়।

 

প্রবাসে আমার পরিচিত মহলে এমন একজন নেই যার সঙ্গে সেই সময়কার কথা আলাপ করতে পারি। সুতরাং একাই স্মৃতির জাবর কাটি, আর মন চাইলে কলম নিয়ে বসি। বোধকরি আমার নিঃসঙ্গ বোধগুলো সুযোগ পেয়ে উঁকি ঝুঁকি দিতে চাইছে। এবার মুল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এ বছরের শুরুতে প্রতি বছরের মতো দেশে গিয়েছিলাম। দুঃসাহস করে বাংলা আবৃত্তির একক একটি সিডি এর কাজ শেষ করেছি। কেন যেন মনে হলো সিডিটা উপলক্ষ করে পুরনো সম্পর্কগুলো খানিক চাড়িয়ে দেই। বিশাল লিস্ট ধরে ফোন করতে শুরু করলাম। সঞ্জীবদা আমার কন্ঠস্বর শুনে অবাক এবং খুশী হলেন। মাঝের এতো গুলো বছরে আমার জীবনে যেমন পরিবর্তন হয়েছে, হয়েছে তারও। জানালাম দেশে না থাকলেও জানি দলছুট তাকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে গেছে।

 

সঞ্জীবদা আসলেই দলছুট ছিলেন সারাজীবনই। কথা বলে বুঝলাম বদলান নি একটুকুও। একই ধরণের স্বভাবসিদ্ধ কথা বলেন এখনো। জনপ্রিয়তা তাকে কোন দানব বানায়নি।

 

বললেন, বিয়ে করেছেন। এবার আমার অবাক হবার পালা। সঞ্জীবদা কোন বাঁধনে বাঁধা পড়ার লোক নয়; তাই অবাক হলাম। আনন্দ হলো জেনে তার ৬ বছরের কন্যার নাম কিংবদন্তী। গৃহী বাউল বুঝি একেই বলে। আমিও জানালাম আমার পুত্র বিপ্র পাঁচ বছরের। সঞ্জীবদার অকাল মৃত্যু আবারো প্রমাণ করলো সে বাঁধনে বাঁধা পড়ার লোক নয়। তার চলে যাওয়াটা জরুরী ছিলো কিনা জানি না। তবু বোধ হয় যার জন্ম দলছুট হয়ে তার বুঝি সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করতে নেই।

 

আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়ে সঞ্জীবদার সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিলো বলেই তার মৃত্যু আমাকে বিমর্ষ করছে বার বার। মনে হচ্ছে আমার সুখের স্মৃতিগুলোতে কুয়াশা জমছে। খুব স্বার্থপরের মতো ভাবনা; কিন্তু না ভেবেও উপায় নেই – মানুষ তো। এখন সেই স্বরশ্রুতির স্মৃতি মনে পড়লে সঞ্জীবদার মৃত্যুর কথা মনে পড়বে। এর আগে হারিয়েছি আরেক সতীর্থ  রাজশাহী গণশিল্পী সংস্থার শিল্পী জাহাঙ্গীর আলমকে, যিনি পরবর্তীতে স্বরশ্রুতিতে যোগ দিয়েছিলেন। শুনেছি গত হয়েছে বন্ধু সোহেল, যে কিনা কাঁচা হাতে আর কাঁচা বোধে সবে মাত্র লিখতে শুরু করেছিলো।

 

যখন সঞ্জীব চৌধুরীর মৃত্যুর কথা জানলাম, সেই থেকে ঘুরে ফিরে একটা গানের কলি মনে আসছে। এমন মানব জনম আর কি হবে, মন যা চায় ত্বরায় করো এই ভবে।

 

আজ না কাল, কাল না পরশু করে যে ইচ্ছেগুলো, স্বপ্নগুলো দূরে সরিয়ে রাখছি সময় হবে তো তা দেখার?

 

মায়ামি

 

 

লেখাটি সাপ্তাহিক ঠিকানায় প্রকাশিত হয়েছিল। লেখিকার অনুমতিক্রমে মুক্তমনায় প্রকাশ করা হলো।