বাসুনকে, মা

 

লুনা শীরিন

 

পর্ব ৪

 

 

বাসুন,

 

বেলা বয়ে যাচ্ছে, শুধু বয়ে যাওয়া এই সময়ের দিকে তাকিয়েই আমার মনে হয় কেন সময় চলে যাবে? কেন যাবে বাঙলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্যার মারা গিয়েছিলেন ক্যান্সার-এ আক্রান্ত হয়েমারা যাবার বছর তিনেক আগে স্যার লিখেছেন কালজয়ী উপন্যাস খোয়াবনামা, স্যার তখন বার বার বলতেন আর যদি মাত্র পাঁচ বছর সময় হাতে থাকতো?

 

স্যারের এই কথাটা কেন এই মুহুর্তে মনে করে তোকে লিখলাম জানিস সোনা? না জানিস না তুই, তোর জানবার কথাও নাকোনদিনই কি তুই এই চিঠিগুলো পড়তে পারবি বাবু? এই যে তোকে নিয়েই বয়ে চলা যাওয়া এই সময়গুলোকে  লিখে রাখছি, কেন রাখছি জানিস তুই? বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে চানক্য সেন এর বই পিতা পুত্রকে পড়েছিলামসেকি উত্তেজনা আমার ভিতরআমি তো বইটা খুব কায়দা করে একদিন আম্মুর হাতে ধরিয়ে দিলামঘটনাটা খুব চিন্তাভাবনা করেই করলাম, যাতে আম্মু বুঝতে পারে আমার চিন্তা ভাবনা কেমন, আমার গতি প্রকৃতি কিআমাকে দিয়ে চাইলেই যা খুশি তাই করানো যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি নানান ভাবনাকাজও হয়েছিলো, একদিন বাড়িতে ফিরে দেখি আম্মু আর বড়পা বইটা হাতে নিয়ে বসে আলাপ করছে, বড়পা বলছে, তাহলে কি লুনা এরকম জীবনযাপন করতে চায় আম্মু? হায়রে সময়? কোথায় ফেলে এসেছি সেই সময়, আজকে কতটা পিছনে ফিরে সময়কে মিলিয়ে দেখছি আমি? আসলেই বাবু, তোর বাবা আর আমি বিয়ে করেছিলাম নিজেদের সিদ্ধান্তে এবং নিজেরাই আলোচনা করে এই পর্বের সমাপ্তি ঘটিয়েয়েছি, যদি তোর বাবা আর আমার ফেলে আসা সময় নিয়ে কোন অভিযোগ না থাকে তাহলে মানুষ  তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে কেন? কথাগুলো উঠলো এই কারনেই যে, তোর বাবাকে নিয়ে অভিযোগের কথা যেন আমাকে বলতেই হবে এমন একটা বাধ্যবাধকতা আমি অনেকের ভিতরেই দেখতে পাইআজ তোকে আরো একটা মজার ঘটনা বলি, তোর বাবার সাথে আলাদা হয়ে যাবার প্রায় ১ বছর পর আমি ঢাকাতে একদিন আইন ও শালিস কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠানে আমার বন্ধু শাহিন আখতারের সাথে দেখা করতে গেছি, শাহিন আপা যেহেতু তোর বাবার পরিবারকে দীর্ঘদিন থেকে চেনে তাই আমার মনে হয়েছে শাহিন আপাকে বলা দরকার কেন আমি ডিভোর্স করলাম, আমার দিব্যি মনে আছে আপার টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসে আমি কথা বলে যাচ্ছি, আপা শুনতে চাচ্ছেন কিনা সেদিকে আমার খেয়াল নেই, দু-একমিনিট পর আপা নিজেই বললেন, লুনা তুই তো বিয়ে করার সময় কারো কাছে কোন কৈফিয় দিসনি তাহলে ডিভোর্স করার জন্য কেন যুক্তি দাড়  করাচ্ছিস? তোর যদি ইচ্ছে করে তাহলেই তো তুই কাউকে ছেড়ে আসতে পারিস, তাই না? তোকে কারন বলতেই হবে এমন তো কোন কথাতো কোথাও লেখা নেই? আপা কথাগুলো বলে হেসে ফেললেন, আমি সেদিনের মতো এতো অপ্রস্তুত অনেকদিন হইনিআজকে এই মুহুর্ত সহ বহুবার আমি ভেবেছি, তাইতো, আজকের যুগেও শুধু ডিভোর্স করেছি বলেই যে, তোর বাবার খারাপ দিকগুলোর গীত বা আমার দোষগুনের গীত আমাকে গাইতেই হবে এমন দিব্যি তো আমাকে দেয়া হয়নি, আজকের এই লেখার সময়টুকুই শুধু নয় বাবু, তুই ও তো জানিস যে, তোকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেছি তোর বাবা ফোন করলেন আর সাথে সাথেই আশে পাশে সবার মুখ শক্ত হয়ে যায়ভাবটা এমন যে,আমার চীর শত্রুতোর বাবা, তার সাথে আবার কি কথা? না বাসুন, আমি একদিনের জন্যও এভাবে ভাবিনি বরং তোর বাবা আরো দুটো বিয়ে করে ফেললেও আমার ভাবনার কোন পরিবর্তন হবে না জীবন অনেক দীর্ঘ, গত পর্বে তোর ফুপা ফুপুর কথা বলেছিলাম, জানিস সেও এক মজার ঘটনা, আজকে এত বছর নর্থ আমেরিকাতে থেকেও আমি সত্যিকারের কিছু মুক্তমনের প্রগতিশীল মানুষ বাংলাদেশেই দেখে এসেছি তোর ফুপা একদিন আমার আর তোর বাবার মতের অমিল দেখে বলেছিলেন, তোমাদের একসাথে কে থাকতে বলেছে? তোমরা এক কাজ করো, দুজন দুজনের জন্য বাসা দেখো তারপর দুজন দুজনকে একে অন্যের বাড়িতে তুলে দাও এবং নিজেরা একটা ভালো ডিনার করে আলাদা হয়ে যাওসেই কবেকার কথা, অনেকটা সময় বয়ে গেছে কিন্তু অসাধারণ সেই স্মৃতিগুলো একটুও মলিন হয়নি এইতো মাত্র মাসছয়েক আগেই একদিন তোর সেই ফুপা আমাকে টরোন্টোতে হ্যালো বললেন, কি আছে তাতে বাবু বল? একটা পরিবারের সাথে আমার কতদিনের ভালোলাগার সম্পর্ক ছিলো, তা বলতে দোষ কোথায়?

 

আমি আমার জীবনের কিছু সময় থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিলাম, এন্ড আই ডীড ইট এর চেয়ে সত্য তো আর কিছু নেই, সেই ফেলে আসা জীবন নিয়ে খারাপ কিছু তো বলতে চাইই  না বরং  যেটুকু ভালো তা আজীবনই বলবো, বলেই যাবো দেখি মানুষ কি করে আমার মুখ চেপে ধরে বাবু, একবার এক কানাডিয়ান বন্ধু আমার কথা শুনে বলেছিলো এটলিস্ট ইউ আর নট পাসিং পয়জন টু ইয়োর সান,দ্যাটস রিয়েলি গ্রেটসেদিন আমার বরাবরের মতো মনে হয়েছে, আমি নিজের বুদ্ধিতে যা করছি তাই যেন করতে পারি আজীবন, বয়ে যাওয়া সময়কে কোন ক্ষোভ, বেদনা, অভিযোগ ছাড়া উপভোগ করছি, তোকে পাশে নিয়ে আমার তরী ভেসে চলছে, আমিও ইলিয়াস স্যারের মতো দীর্ঘ জীবনের প্রতিক্ষায় থাকবো সোনা

 

আদর,

 

তোর মা

 

১ লা ডিসেম্বর, ২০০৮