বাসুনকে, মা

 

লুনা শীরিন

 

পর্ব ৪১

 

 

 

বাসুন,

 

কিছু কিছু সত্য থাকে যা বহন করা যায় না, একেবারেই না,মানুষকে প্রকাশ করতে হয় বা বলে যেতে হয়, বলা উচিত মানুষ বলে ফ্যালেআমি বরাবরই তোকে বলেছি, হয়তো আরো বলবো আমি বাংলাদেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবাররের একজন মানুষ আমার বাবা বা তোর নানাভাই ছিলেন ফার্ষ্ট জেনারেশন ইন ঢাকা, তাই জীবনে অনেক সততা বা সরলতা আমাকে এখনো জড়িয়ে আছে যা হয়তো অনেক আধুনিক মানুষের কাছে গ্রাম্যতা কথাগুলো কেন উঠলো বলার আগে তোকে আজকের এই  সময়টার কথা বলে নিতে চাই

 

আজ ছুটির শেষ রাত মানে রবিবার রাততুই আর আমি প্রায়দিনই নয়টার ভিতরই ঘুমোতে চলে যাই, যেহেতু পরের দিন আমার অফিস তোর স্কুল থাকে তাই দেরী করে ঘুমানো চলে না অন্যদিকে আমাকে ছাড়া তো তুই কিছুতেই ঘুমাতে যাবি না অগ্যতা আমি নাচারআজও তেমনি এক রাত, কিন্তু আমার ঘুম এলো না বাবু, কিছুতেই না, আমি প্রায় দু ঘন্টা বিছানাতে চেষ্টা করে তোকে এই চিঠি লিখতে বসলাম — কেন  ঘুম  এলো না সোনা? কি কারণ আমার খুব পরিস্কার জানা  নেই বাবু, তবে কিছু ক্লু তোকে বলে রাখতে পারি আর এই কথা বলার জন্যই তোকে এই পর্বের  শুরুতে একটু ভুমিকা করেছিবাবু, তুই যখন বড় হয়ে উঠবি তখন তোর বোধ/ চিন্তা / চেতনা বা তোর নিজের শিকড়ের প্রতি তোর টান কতটুকু হবে এটা আমি মা হলেও খুব কনফার্ম করে কিছু বলতে পারি না বা বলা উচিত না আমি শুধু বলতে পারি আমি আমার মতো করে তোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো ওই যে বললাম আমার মতো করেএখানেই হয়তো ভালো/মন্দের দুটো ধারা তৈরী হবে যা আমার তোর দুজনেরই নিয়ন্ত্রনের বাইরে বাসুন, আজকে থেকে মাত্র ১৫ বছর আগে যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হই তখনও আমি জানতাম না যে, আমি আজকের এই লুনাতে পরিনত  হবো, বা আমি কিছুতেই জানতাম না, যেই আমি একদিন  স্বাধীন জীবনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম সেই আমি সত্যিকার অর্থে (অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলছি) স্বাধীন হলে এমন কি উল্টে যাবে পৃথিবী? তেমনি আমি জানতাম না একদিন যেই আমি বিদেশে আসার জন্য সব কিছুকে একদিকে করেছি, আবার বিদেশে একটা প্রফেশনাল চাকরি পাবার জন্য দিন দুনিয়া ছেড়ে চেষ্টা করেছি, আজ অনেকটাই সেই জীবন পাবার পরও আমার হাহাকার মিটবে না? না বাবু, কোন কিছুই আমি জানতাম নাআমরা শুধু পাবার জন্য বা কাজ করার জন্য চেষ্টা করে যাই, কিন্তু পরমূহুর্তেই মনটা কিভাবে বদলে যাবে এটা কিন্তু কেউই বলতে পারি না  কোন কোন গভীর রাতে মনে হয়, আসলে কি চাই আমি? রাত অনেক  হয়েছে সোনা তাই হয়তো লাগামহীন আবেগ প্রকাশ করছি, কিন্তু, কিসে মুক্তি? এই সত্য যে আজও খুজে পেলাম না বাবু

 

তুই ঘুমিয়ে যাবার পরে ফোন করেছিলাম বাংলাদেশে, হ্যাঁ বাবু, তুই যে বার বার বলিস ব্যকহোম, সেই ব্যাক হোমে সেখানে আজও সত্যিকাররে  সম্ভবনা আর মুক্তির পথ খোলা আছে আমার জন্যআমি দেশ থেকে চলে আসার আগে আমরা কয়েকজন মিলে দিগন্তের ডাক  নামে একটি ননপ্রফিট অর্গানাইজেশন গড়ে তোলার  কাজ শুরু করেছিলাম, ওই যে তোকে সবসময় বলি বাঙলাদেশের মানুষই আমার কাছে শ্রেষ্ঠ মানুষ কারন আমি চলে আসবার পরেও ওরা লেগে ছিলো, আজ হাটি হাটি করে আমাদের সেই প্রচেষ্টাও অনেকটা মাথা তুলে দাড়িয়েছেহ্যাঁ সোনা, ওই ওরাই , ওদের সাথে যখন কথা হয় তখন এই শহরের জীবনটা আমার কাছে ভীষন খেলো মনে হয়আজও যখন লক্ষণদা, শাহানা আপা, ওমরভাই, পান্নুভাই, ফয়েজভাই, নিশাত, আউয়ালভাই, সবাই, সবাই মিলে আমাকে বলছিলো, আপা আপনি কবে আসবেন? কবে আমাদের সাথে সেই আগের মতো মাঠে মাঠে ঘুরবেন সবার সাথে কথা বলবেন, আপা সবাই আপনার কথা মনে রেখেছে, সবাই জানতে চায় আপনি আর কতদিন পরে আসবেনবাবু,ফোনের ওই প্রান্তে নোয়াখালি মাইজদীতে আমাদের দিগন্তের ডাকের সব সহযোদ্দাদের হাত থেকে হাতে ফোন ঘুরছে আর ফোনের এই প্রান্তে আমি, আমার চোখে তখন সারা পৃথিবীর সব বরফ গলতে শুরু করেছে, আমি তোকে বিছানায় রেখে উঠে আসি আমার ছোট ল্যপটপে, তোকে লেখা  এই চিঠিতে খুব অনাধুনিক মানুষের মতো বলে উঠতে ইচ্ছে করে, আমি আমার দেশে চলে যাবো, আমি আমার প্রিয় দলের কাছে চলে যাবো যাদের কাছে ফিরে গেলে আমার জন্মের দায় শোধ হবে, শুধু খাওয়া/পরার জন্য এই জীবনকে আমি আর একদিনের জন্যও বহন করবো না

 

আমি জানি সোনা,কাল সকাল হবে, তোকে স্কুলে পাঠাতে হবে,আমাকেও অফিস যেতে হবে, কালো অন্ধকার ঠেলে এভাবেই হয়তো আমার স্বপ্নও একদিন আকাশ ছুঁয়ে যাবে, যেতেই হবে বাবু, সত্যিকারের মুক্তির পথ আমি ঠিক খুজে পাবো

 

আদর সোনা,

২৩ নভেম্বর, ২০০৮