বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স এবং পিএইচডি করার দিনগুলোতে একাডেমিক পেপার লিখতে হত জার্নালের জন্য। যারা ভাল জার্নালে পেপার প্রকাশ করেছেন তারাই জানেন কাজটা মোটেই সহজ কিছু নয়। প্রথমে আপনি গবেষণা করছেন যে বিষয়ে সে বিষয়ে আপনার মৌলিক কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবদান থাকতে হবে। হাবি জাবি গালগপ্প লিখলে চলবে না। ধরুন, আপনি বছর খানেক ধরে সেমিকন্ডাকটার নিয়ে রিসার্চ করছেন কিন্ত আইট্রিপলই জার্নালে পাঠালেন ‘শ্রীচৈতন্যের সাধনা’ নিয়ে রোমাঞ্চকর লেখা – এটা প্রত্যাখ্যাত হতে সময় লাগবে না তা বলাই বাহুল্য।  তবে বিষয়ানুগ লেখা পাঠালেও যে সেটা প্রকাশযোগ্য হবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। কনফারেন্সগুলোতে তাও কিছু সাদা মাঠা পেপার (তারপরেও বিষয়ের বাইরে নয় বলাই বাহুল্য) গ্রহণ করা হলেও, জার্নালগুলোতে গার্বেজ লিখে পার পাওয়া সম্ভব নয় ওভাবে।  জার্নালে পেপার পাঠালে তা আপনার কাছে যতই মৌলিক এবং গুরুত্ববপূর্ণ মনে হোক না কেন, আপনাকে ‘পিয়ার রিভিউ’ নামক যন্ত্রণাদায়ক ছাঁকুনির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। জার্নালের সম্পাদক আপনার পাঠানো পেপারটি সেই বিষয়ে যারা পণ্ডিত তাদের কাছে (অন্ততঃ তিনজন) আপনার পেপারটি রিভিউ করার জন্য পাঠাবেন। তারা আপনার পাঠানো পেপারটির প্রতিটি লাইন তাদের শকুন চোখ দিয়ে মাস খানেক ধরে খুঁটিয়ে খুটিয়ে পড়বেন, এক গাদা জায়গায় ভুল ভ্রান্তি ধরবেন, জায়গায় বেজায়গায় নানা রকম প্রশ্ন করবেন, তারপরে তাদের মতামত জার্নাল সম্পাদকের কাছে পাঠাবেন। এতো গেল একজনমাত্র  রিভিউয়ারের মতামত। এরপর ক্রমান্বয়ে আসবে  আরো অন্য রিভিউয়ারদের মতামত। সেই রিভিউয়ারদের মতামতের উপর ভিত্তি করে জার্নাল এডিটর সিদ্ধান্ত নেন পেপারটি প্রকাশের জন্য উপযুক্ত কিনা। যদি উপযুক্ত না হয়, তবে সেখানেই ইস্তফা। লেখককে জানিয়ে দেয়া হয় সম্পাদকের সিদ্ধান্ত। আর যদি ছাপানোর উপযুক্ত মনে করেন – তবে শুরু হবে আরেক প্রস্থ যুদ্ধ। লেখককে বলে দেয়া হয় যে, রিভিউয়ারদের পাঠানো সমস্ত সংশোধনী অনুযায়ী লেখককে পেপারটি পুনরায় ঢেলে সাজাতে হবে। যেখানে যেখানে রিভিউইয়ার আপত্তি জানিয়েছেন –  সেগুলোর স্পষ্ট ব্যাখ্যা হাজির করতে হবে। যদি কোন ফলাফল বা ব্যাখ্যা নিয়ে সন্দেহ হয় রিভিউয়ারদের – তারা সেটা বাদ দিতে বলতে পারেন, কিংবা সন্দেহ নিরসন করতে বলতে পারেন। সেই মোতাবেক লেখক তার পেপারটি আবারো লিখে পুনরায় সম্পাদকের কাছে পাঠান। সম্পাদক আবারো রিভিউয়ারদের সাথে মতবিনিময় করেন। তারপর সকলেই সন্তুষ্ট হলে তবেই একটি পেপার গবেষণাধর্মী বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হতে পারে। বুঝতেই পারছেন – বিষয়টি একদিন দুদিনের মামলা নয়, পাঁচ ছয় মাস থেকে শুরু করে বছরখানেকও লেগে যেতে পারে জার্নালে পেপার পাঠানোর পরে তা প্রকাশ হতে হতে।

কাজেই বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলো নিয়ে বরাবরই একটি উচ্চাশা ছিলো আমার। জার্নাল গুলোতো আর ব্লগ সাইট নয় যে, কেউ কিছু লিখে সাথে সাথেই প্রকাশ করে দিতে পারে। পিয়ার রিভিউর মত ক্লান্তিকর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেখানে। কিন্তু আমার সমস্ত প্রত্যাশার মুখে জল ঢেলে দিলো একটি জার্নাল। জার্নালটির নাম – International Journal of Cardiology। তারা সেখানে বিষয় বহির্ভুতভাবে গ্রহণ করেছে একটি হাস্যকর ধরনের উদ্ভট পেপার, নাম – The Heart and Cardiovascular System in the Quran and Hadeeth। পেপারটি অনলাইনে পড়া যাবে এখান থেকে :pdf: । পুরো পেপারটি কোরান হাদিসের আয়াতের নানাবিধ ব্যাখ্যা আর গুণগানে ভরপুর। ওই যে আমি প্রথমেই বলেছিলাম আপনি সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে যদি ‘শ্রীচৈতন্যের সাধনা’ নিয়ে রোমাঞ্চকর লেখা জার্ণালে পাঠান – ঠিক অনুরূপ একটি ব্যাপার হয়েছে সেখানে। কিন্তু মজার বিষয় হলো – পেপারটি প্রত্যাখাত হয় নি। বরং সাদরে গৃহীত হয়েছে।  International Journal of Cardiology র মত জার্নালে কোরান হাদিসের ইতিহাস পাঠ কেন তা কে জানে!  তাতেও আমার কোন আপত্তি ছিলো না। কিন্তু কেউ যদি পেপার প্রেরণ এবং গৃহীত হবার তারিখগুলো কেউ যদি মনোযোগ দিয়ে দেখেন, তাহলেই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে। পেপারটি জার্ণালে প্রেরণ করা হয়েছে ৭ ই মে ২০০৯ সালে এবং গ্রহণ করা হয়েছে ১২ ই মে’র মধ্যে। অর্থাৎ মাত্র পাঁচ দিনের গায়েবী যাত্রাপথে সমস্ত পিয়ার রিভিউ টিভিউ সব কম্পলিট হয়ে জার্নালে প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করছে।

আপনার অবাক লাগছে? লেগেছিলো আমারও, আর তাই আমি একটি চিঠি লিখে আমার প্রতিবাদ জার্নালে প্রেরণ করি। বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গঠিত ‘টক রিজন’ সাইটে আমার চিঠিটি প্রকাশ করে দেন। চিঠিটি দেখা যাবে এখান থেকে। 

চিঠিটি প্রকাশের পর তা বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের নজরে পড়ে, এবং তারা প্রতিবাদ করতে শুরু করেছেন। তার মধ্যে অধ্যাপক পারভেজ হুদভয়, ড. ম্যাট ইয়ং, ড. তানের এডিস, অধ্যাপক মার্ক পেরাখ, লরেন্স ক্রাউল, চার্লস সুভিলিয়ান থেকে শুরু করে অনেকেই আছেন। বিভিন্ন সাইটেও এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের আলোচনা এবং প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, উদাহরণ স্বরূপ দেখুন – এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে কিংবা এখানে  এবং আরো বহু জায়গায়। আমাদের মুক্তমনা থেকেও অধ্যাপক ইরতিশাদ আহমেদ, ডঃ কেশব অধিকারী সহ অনেকেই প্রতিবাদ শুরু করেছেন। আরো প্রতিবাদ আমাদের কাছে এসে পৌছুচ্ছে। আপনারাও এই প্রতিবাদে অংশ নিন। আমি বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের প্রতিবাদ সঙ্কলিত করে রাখার চেষ্টা করছি, আমাদের ইংরেজী ব্লগ সেকশনে। সেটা দেখা যাবে এখান থেকে –

আপনি যদি নিজে একাডেমিয়ার সাথে জড়িত হন, কিংবা কাউকে চেনেন যারা জড়িত, তবে অনুরোধ করুন প্রতিবাদে অংশ নিতে।

 

প্রতিবাদের জন্য যা করতে হবে

আপনি যদি মনে করেন এই পেপারটি প্রকাশের জন্য গ্রহণ করে International Journal of Cardiology একটি অনৈতিক কাজ করেছে, তাহলে নীচের লিঙ্কে ক্লিক করুন। ইন্টারনেশনাল জার্নাল অব কার্ডিওলজির সম্পাদককে ম্যাসেজ পাঠানোর একটি পৃষ্ঠা উন্মোচিত হবে।

সেখানে আপনার নাম, ইমেইল লিখে বিষয়ের ঘরে লিখতে পারেন, Opinion on the paper – ‘The heart and cardiovascular system in the Qur’an and Hadeeth’

তারপর, Text of Email এর ঘরে আপনার বক্তব্য জানিয়ে ‘সাবমিট’ বাটন চেপে পেশ করে দিন।

আপনার প্রতিবাদলিপির কপি মুক্তমনাকেও জানিয়ে যেতে পারেন, আমরা সেটি সংকলিত করে এখানে রেখে দেব।