‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বেশ ভারী দুটি শব্দ। একটা সময় ছিল যখন শব্দ-যুগল বেশ আবেগ নিয়ে ব্যবহার করতাম। কিন্তু এখন ব্যবহার করার আগে একটু ভেবে নিতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে আজকাল অনেক কিছুই চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, যেমন, বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা অপরিহার্য, নইলে এই চেতনার বিলুপ্তি ঘটবে। কেউ কেউ এও বলার চেষ্টা করছেন যে, এখন গণতন্ত্র রক্ষার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা করাই বেশী জরুরী, তাই আওয়ামী লীগের যেকোনো কর্মকাণ্ড সমর্থন করে যেতে হবে। যারা এসব বলছেন তারা জ্ঞাত বা অজ্ঞাত কারণে জেনেও না জানার ভান করেন যে, বাংলাদেশের মানুষ কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে মহিমাহ্নিত করতে বা বাংলাদেশকে একটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কারো হাতে তুলে দেবার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেনি।

মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছিলেন তাদের অনেকেরই স্বপ্ন ছিল এমন একটি দেশের, যেখানে মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে খেয়ে-পরে বাঁচবে, স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করবে, বিদেশী প্রভুদের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারণ করবে। অনেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি দেশের যেখানে ন্যায়বিচার থাকবে; ধর্ম-, লিঙ্গ- বা মতাদর্শ-নিরপেক্ষভাবে যেকোনো দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী কেবল তার মেধা আর সৎ পরিশ্রম দিয়ে তাদের জীবনকে উন্নত করতে পারবে। দেশের সাধারণ মানুষের এই ন্যায্য স্বপ্নগুলোর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করাকেই আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে কাজ করা বলে মনে করি।

দুঃখজনক-ভাবে, একাত্তরে স্বাধীনতা পেলেও এই স্বপ্নগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটেনি। বাংলাদেশের অদম্য প্রাণশক্তির সাধারণ মানুষ ক্ষেতে, কলে-কারখানায়, প্রবাসের বৈরী পরিবেশে রক্ত পানি করে দেশের উন্নতির চাকা ঘুরিয়ে চলেছেন, কিন্তু বার বার রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে থাকা কিছু মানুষ আর তাদের চাটুকারদের সীমাহীন লোভ সেই চাকার গতিরোধ করেছে; কখনোবা পেছন দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই লোভী মানুষগুলোকে বুঝিয়ে দেবার সময় এসেছে যে ব্যক্তিপূজার দিন শেষ হয়ে আসছে। এমন লোকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, যারা ব্যক্তি বা দলের চেয়ে দেশ ও জনগণকে বেশী গুরুত্ব দেন, যারা মনে করেন ক্ষমতায় আসার জন্য কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কিংবা শহীদ জিয়াউর রহমানের বংশধর বা আত্মীয় হওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং যা অপরিহার্য তা হোল সততা, নিষ্ঠা আর যোগ্যতা। সৎ, দেশপ্রেমিক ও যোগ্য নেতৃত্বের হাত ধরেই কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন হতে পারে।

বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিল। বেশকিছু উন্নয়ন সূচকে দলটি দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বের অযোগ্যতা, দুর্নীতি আর আইনের অপব্যবহারের কারণে দলটি আজ জনগণের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছে। অবশ্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ঘটনা নতুন কিছু নয়; স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর ক্ষমতায় আসা দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই আমরা একই প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ দু’দলই ক্ষমতার মেয়াদ-পূর্তির পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশ নিতে অস্বস্তি বোধ করেছে। এর কারণ মূলত জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সীমাহীন ব্যর্থতা। তাই এক মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পর অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জনগণের সামনাসামনি হবার বদলে দুটি দলই চেষ্টা করেছে কি করে বাঁকা পথে, ছলে, বলে কৌশলে রাষ্ট্র ক্ষমতার গদিটি আঁকড়ে ধরে থাকা যায়। আজ যদি আওয়ামী লীগ জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণে সমর্থ হত তাহলে তাদের ক্ষমতায় থাকার জন্য এই বাঁকা পথ ধরতে হত না।

বোঝাই যাচ্ছে আমাদের দেশের এই চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্য দায়ী মূলত আমাদের অসৎ, অযোগ্য আর ক্ষমতা-লোভী রাজনীতিবিদরাই। আর তাদের লোভের যূপকাষ্ঠে বলি হচ্ছি আমরা সাধারণ জনগণ। এই অবস্থা দূর হবে তখনই, যখন একটি রাজনৈতিক দল রক্তধারা, অর্থ ও পেশীশক্তির তোয়াক্কা না করে গণতান্ত্রিক-ভাবে কেবল যোগ্যতার ভিত্তিতে তাদের দলীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ের নেতা নির্বাচন করবে। দেশের আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই আশা দুরাশা মনে হলেও একটি কার্যকরী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাসহ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি চালু থাকলে সময়ের পরিক্রমণে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন হতে বাধ্য। এই ধারনার সমর্থন পাই আমরা প্রকৃতির কাছ থেকেই।

জীববিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি ডারউইনিজমের ঘোর সমর্থক; আমার দৈনন্দিন গবেষণায় আমি প্রতিনিয়ত এর প্রয়োগ দেখতে পাই। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের একটি মূল নিয়ামক হচ্ছে ‘সিলেকশন প্রেশার’। একটি জীবের কোন গুনগত বৈশিষ্ট্য তখনই বংশপরম্পরায় সঞ্চালিত হবে, যখন তা ঐ জীবের টিকে থাকার জন্য সহায়ক হবে। অন্যদিকে টিকে থাকার জন্য ক্ষতিকর বিবেচিত হলে সিলেকশন প্রেশারের প্রভাবে কোন বৈশিষ্ট্যের বিলুপ্তি হতে পারে। ডারউইনিজম যে কেবল জীবজগতের জন্যই প্রযোজ্য তা নয়, জড়জগত বা একটি পদ্ধতি/ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও এর প্রয়োগ হতে পারে।

আমাদের দেশের বেশীরভাগ রাজনৈতিক নেতাই দুর্নীতিপরায়ণ, অযোগ্য এবং জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। দেশের রাজনীতির এই ‘গুনগত’বৈশিষ্ট্যটি দূর হচ্ছে না কারণ এর বিপরীতে কোন উপযুক্ত ‘সিলেকশন প্রেশার’ নেই। যোগ্য নেতা পেতে হলে আমাদের একটি চলমান ‘সিলেকশন প্রেশার’-র ব্যবস্থা রাখতে হবে; আর সেটি হল সুষ্ঠু নির্বাচন, যার মাধ্যমে জনগণ দেশপ্রেমিক, সৎ এবং যোগ্য নেতৃত্বকে নির্বাচিত করতে পারবে। এবারের অভিনব নির্বাচনের (?!!) মত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে, জনমতের তোয়াক্কা না করে সংসদ গঠন করলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের উপযুক্ত নেতৃত্ব আমরা কখনই পাব না। আর তাই আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি হলেও আমি এই নির্বাচন সমর্থন করি না।

(পাদটীকা: উপরে যা লিখেছি তা কোন নতুন কথা নয়। যদিও অরণ্যে রোদন মাত্র, তবুও জনমতের তোয়াক্কা না করে একটি অনৈতিক নির্বাচনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে রাখার জন্য লেখাটি পোষ্ট করছি)