উদাহরনটা সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম গডফাদারকে দিয়েই দেই। মারিও পুজোর লেখা এই কাল-অতিক্রম করা উপন্যাস থেকে আরেকটি কাল-অতিক্রম করা চলচ্চিত্রের জন্ম হয়েছিল ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা নামের এক হলিউডি দিকপাল ডিরেক্টরের মাথা থেকে। যাই হোক, এই মুভি কয়েকটি ইটালিয়ান মাফিয়া পরিবারের ক্ষমতার দন্দ্বের কাহিনী যেখানে গডফাদারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলো আমার অন্যতম প্রিয় অভিনেতা মার্লন ব্র্যান্ডো। মুভির কাহিনী অসাধারন হলেও যে বিষয়টা দর্শকদের মনে রেশ রেখে যায় সেটা হল এই পরিবারটির উপরে তাদের এক অমোঘ টান এবং অবশ্যই এটা ভালো চলচ্চিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট যে কাহিনী, অভিনেতা অভিনেত্রীর উপরে দর্শকের অন্যরকম এক ভালো লাগা কিংবা আপন করে নেয়ার অনুভুতি সৃষ্টি হওয়া। বাস্তবে এমন একটা মাফিয়া পরিবারকে আপনি কীভাবে দেখবেন? ভালো লাগার দৃষ্টিতে? আমি জানি উত্তরটা মোটেই আপনার মাথাটাকে উপরে নিচে ঝাকাবে না, ঘোরাবে ডানে বায়ে।

প্রশ্ন তোলা যায়, এমন নির্মম, নির্দয় একটা পরিবারের উপরে, এমন অনৈতিক একটা গ্রুপের উপরে আমাদের একাত্নতা অনুভব করার অনুভুতিটা ঠিক কখন আসে? কেন আসে?

একটু খেয়াল করলেই বিষয়টা বোঝা যায়। যারা চলচ্চিত্র সম্পর্কে একটু খবর রাখেন মানে যারা একটু মুভি বেশি দেখেন তারা আগে থেকেই জানেন যে, একজন চরিত্রকে (যে কিনা ঐ নির্দিষ্ট চলচ্চিত্রে একটা সমাজবিরোধী ক্যারেক্টার হিসাবে আছে) যখন মুভির বেশিরভাগ সময় দর্শকের সামনে রাখা হয়, যখন তার আবেগ ভালোবাসাগুলো খুবই কাছ থেকে দেখানো হয়, সুযোগ দেওয়া হয় চরিত্রের ভালো মন্দ পরিবেশের সাথে দর্শককে একাত্ম হবার। চলচ্চিত্র শেষে সে সমাজের জন্য একটা কীট হলেও তাকেই দর্শকের চোখে হিরো হিরো লাগে। অথচ যার হওয়ার কথা ছিল ভিলেইন।

মুভিতে এল পাচিনোকে যখন সমাজ বিরোধি বলে একজন সিনেটর(অনেক আগে দেখেছি ভুলও হতে পারে) গাল দিয়ে ওঠে তখন আমার চোখে সিনেটরকেই সমাজের জন্য অস্পৃশ্য মনে হয়েছিল, কারন আমি ততক্ষনে এল পাচিনোর ভালোবাসাবাসি থেকে শুরু করে তার ক্যারিজম্যাটিক অভিনয় গোগ্রাসে গিলছিলাম। যেখানে কর্লিয়নি পরিবারকে দেখলে আমাদের বমনিচ্ছা হবার কথা সেখানে আমরা অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে কর্লিওনি পরিবারের প্রেমে পড়ে যাই। যার বিরহজনক সমাপ্তি ঘটে চলচ্চিত্রটির তৃতীয় খন্ডের শেষ দৃশ্যে মাইকেল কর্লিওনি(এল পাচিনো)র চেয়ার থেকে মৃতাবস্থায় বাগানের মাটিতে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যের সাথে সাথে।

ব্যাপারটা খুবই চমকপ্রদ এবং একই সাথে কৌতুহলদ্দিপক।

Soldiers shoot dead 20-year-old man near Gaza border শিরোনামে maannews.net একটা খবর ছাপায় এ মাসেরই ৫ তারিখ সোমবারে(দয়া করে তারিখের ব্যাপারটা খেয়াল করবেন কারন এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বর্তমান লেখায়)। যেখানে বলা হয়ঃ

Israeli soldiers shot and killed a 20-year-old Palestinian man who approached a fence near Gaza’s border with Israel, medics said on Monday.

রিপোর্টটা পুরোটা পড়লে আমরা জানতে পারি যাকে হত্যা করা হয়েছিল তিনি একজন মানসিক রোগী যাকে কিনা আগেও একবার আটক করা হয়েছিল সীমান্তের কাছাকাছি নিষিদ্ধ এক জায়গাতে যাবার জন্য। যদিও পরবর্তীতে তার হেডকোয়ার্টারে ঝামেলা আছে বুঝতে পারে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফিলিস্তিনি মেডিকদের প্রায় ৬ ঘন্টা বসে থাকতে হয়েছিল তার লাশ নেবার জন্য। এবং তারা আশংকা করেছিল ইজরায়েলিদের আদর সোহাগ সহ্য করতে না পেরেই হয়ত তার মৃত্যু হয়েছে।

খবরে শেষের দিকে আরেকটি খবর দিয়েছে সেটা হলঃ


On Friday, a Palestinian man was seriously wounded after Israeli artillery fired several shells in the same border area. The army said it had suspected he was planting an explosive device, but no explosion ensued.

একই ওয়েবসাইটে আরেকটি প্রায় একইরকম খবর প্রকাশিত হয় একই মাসের(মানে এ মাসে) ৮ তারিখ বৃহস্পতিবার যার শিরোনাম ছিল Medics: Israeli fire kills boy in south Gaza

মূল খবরঃ

GAZA CITY (Ma’an) — A 13-year-old Palestinian boy died Thursday in southern Gaza, in a shooting medical officials blamed on the Israeli military.

তেরো বছরের হামিদ ইউনিস আবু দাকা মারা গিয়েছিল মেশিনগানের গুলিতে।

প্যালেস্টিনিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস(PCHR) এর নিজস্ব ওয়েবসাইটে
New Israeli Escalation against the Gaza Strip, 7 Palestinians, Including 3 Children, Killed and 52 Others, Including 6 Women and 12 Children, Wounded শিরোনামে একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১১ নভেম্বর রবিবার ২০১২। বলা হয়


Over the past 72 hours, the Israeli Occupation Forces (IOF) have escalated their aerial and ground attacks against the Gaza Strip. Five Palestinian civilians, including 3 children, have been killed, and 52 others, including 6 women and 12 children, have been wounded. Four of these deaths and 38 of the injuries resulted from an Israeli attack on a football playground in al-Shoja’iya neighborhood east of Gaza City. Additionally, 2 members of the Palestinian resistance were killed, and some civilian facilities were destroyed or damaged.

তার ঠিক পরের দিনই দুনিয়ার সমস্ত মিডিয়ার খবর প্রকাশিত হয়, হামাস ইজরায়েলে রকেট হামলা চালিয়েছে। যেমন বিবিসিতেঃ

Israel hit by fresh volley of rockets from Gaza

কিংবা সিবিসিতেঃ

Gaza rocket fire raises pressure on Israel government

যেখানে আবেগঘন কন্ঠে(কৃতজ্ঞতাঃ দৈনিক মতিকন্ঠ) নেতানিয়াহু বলছেঃ

I don’t know of any of your governments who could accept such a thing. I don’t know of any of the citizens of your cities, who could find that acceptable and something that could proceed on a normal basis. I think the whole world understands that this is not acceptable

আহারে ভাই আমার! এমন সভ্য ভদ্র মানুষও হয়!!

আমি যখন লিখছি তখন ফিলিস্তিনিদের উপরে ইজরায়েলি হামলার ৭ম দিন। নিহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে অসামরিক ৫৩ জন। আহত ৮৪০ জন যার মধ্যে ২২৫ জন শিশু। আর হামাসের রকেট (পড়ুন ওয়েপন অফ মাস ডিস্ট্রাকশন) হামলায় মৃতের সংখ্যা ৩!

নাউ গেস হু ইজ দ্যা টেরোরিস্ট?

ইউ গট ইট। হামাস!

ইজরায়েলের অন্যতম প্রভাবশালী দৈনিক Haaretz এর চালানো একটা পোল-এ দেখা গেছে ৯০ শতাংশের বেশি ইজরায়েলী জনগন ফিলিস্তিনিতে চলমান হামলার পক্ষপাতি। তিরিশভাগ রাজি একেবারে ট্যাংক নিয়ে ঢুকে যেতে।

Haaretz poll: More than 90 percent of Israeli Jews support Gaza war

নাস্তিককূলের মাওলানা গোত্রের ফতোয়া অনুযায়ী ঘুমিয়ে আছে আত্নঘাতি, সব মুসলিমের অন্তরে। একই সুত্র অনুযায়ী ইজরায়েলী এই ৯০ ভাগের বেশি জনগনকে কী বলা যায়? মুমিনেস্তো জিব্রায়েলিয়া?

ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয়তাবোধ যদি ধর্মান্ধতা হয় তাহলে ইজরায়েল জাতিগোষ্ঠীর ধারনাটাই ধর্মান্ধতার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরন। আপনি যদি ইহুদী হন আর দুনিয়ার যেকোন জায়গায় বসে একবার ইজরায়েলী মোসাদ মামাদের জানাতে পারেন আপনি সমস্যায় আছেন, দুনিয়ার সমস্ত ফোর্স নিয়ে তারা ছুটে আসবে আপনার কাছে, সসম্মানে ইজরায়েলে নিয়ে যাবার জন্য। নাস্তিক অনলি ইসলাম-গোত্রের মুফতিদের কাছে জাতি জানতে চায়, এটা যদি দুধের ধোয়া তুলশি পাতা হয় যেটা কিনা তাদের ফিকাহ শাস্ত্রের পাতা থেকে কোন ফতোয়া জারি করতে পারে না তাহলে মুসলিম জাতিয়তাবোধ এমন কী আলাদা যেটা তাদের নাওয়াখাওয়াঘুমসঙ্গম হারাম করে দিয়েছে শুধু মুসলিম মননে টেরোরিজম খুজে বার করতে?

হামাসের রকেট হামলা মোটেও ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরুর জন্য করা হয় নি। এটা একটা ধারাবাহিক ইজরায়েলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু আমরা কী জানতে পারলাম? নাটেরগুরু হামাস। সমস্ত দোষ ফিলিস্তিনির। এই মুসলমানরা সবসময়েই উগ্র। এদের সাথে কোন সময়েই আলোচনা করা সম্ভব না। এরা ইচ্ছা করে ইজরায়েলী ভু-খন্ডে হামলা চালায়। সুতরাং এদের কী করা উচিত? এদের অবশ্যই দাবড়ানি দিয়া বুঝিয়ে দেয়া উচিত ওহে, মাস্তানি করব আমরা। তোরা কে রে?

প্রথমে আমি গডফাদার মুভির উদাহরনটা দিয়েছিলাম কী জন্য পাঠক হয়ত বুঝতে পেরেছেন। ইজরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যার খবর পশ্চিমা মিডিয়াতে এমনভাবে আসবে যেটা দেখলে আপনার মনে হবে বাস্তবে আসল ভিক্টিম হল ইজরায়েল। আর আগ্রাসন চালাচ্ছে হামাসের মতন ইসলামি টেরোরিস্ট(তথাকথিত) গ্রুপগুলো। গডফাদারের কর্লিওনি পরিবারের সাথে আমরা যেমন চলচ্চিত্রের পুরো সময়টুকু একাত্নতা অনুভব করি, এই দুইদেশের সমস্যায় অনলি-ইসলাম সমালোচনা ধর্মের মুফতিরা (একই সাথে পশ্চিমা বেশিরভাগ জনগন) শুধু ফিলিস্তিনিদের রকেট হামলা দেখে। কারন লাইমলাইটে থাকে শুধু ইজরায়েলীদের কুম্ভিরাশ্রু। কিন্তু এটা যে ইজরায়েলের করা পশুবৃত্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী জনগনের প্রচন্ড চিৎকার সেটা তাদের চোখে তো দূরের কথা কানেও পৌছাতে পারে না, যার ফলশ্রুতিতে তারা একের পর এক ইসলামের আলোচনা(মতান্বরে আলুছানা) সমালোচনা করে মানবতার জয়গান গেয়ে যায়। আর মানবতার দেশ, মালালা আক্রমনে মানবতার আবেগ-বাষ্পে কেঁপে ওঠা দেশ আম্রিকার প্রেসিডেন্ট, যে কিনা এখন দেশে দেশে মানুষের ভালোবাসা কুড়িয়ে যাচ্ছে ভার্চুয়ালী তিনি ফতোয়া দিয়েছেনঃ

Barack Obama: We fully support Israel’s right to defend itself

এটা কোন দোষ না, দোষ হল তালেবানদের মালালার উপরে হামলা চালানো। কেননা সেখানে মালালার উপরে হামলা করেছে মুসলমান জঙ্গীগ্রুপ আর এখানে ইজরায়েল-ফিলিস্তিনিতে আন্তর্জাতিক ভালোবাসা উৎসব হচ্ছে। বাহ বাহ, কী চমৎকার দেখা গেলো!!


আসুন লেখাটি পড়ে আমরা আমজামকাঁঠালজনতা মানবতার চর্চা করেছি এই ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সেঁটে একটা ঘুম দেই। ঘুমে স্বপ্ন দেখি, খবরদার দোষ যাতে না দেখি। আমেন!

আপডেটঃ শেষ খবর পাওয়া গেছে, ৮ দিনের গনহত্যার শেষে যুদ্ধবিরতিতে আসার পর, শুক্রবার তা ভঙ্গ করে আবার একজন ফিলিস্তিনি হত্যা করেছে এবং আহত করেছে ১৯ জন।

সিএনএনঃ Hamas: Israeli troops kill 1 Palestinian