লিবার্টারিয়ানিজম তথা স্বাধীনতাবাদ নিয়ে রীতিমত পড়াশোনা করার ফলস্বরূপ ভাগ্য হয়েছে একে খুব সংক্ষেপে তিন পাতার মধ্যে জানার। অস্ট্রিয়ান স্কুল অব ইকোনমিক্সের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মারি নিউটন রথবার্ডের বই “ফর এ নিউ লিবার্টি: দ্য লিবার্টারিয়ান ম্যানিফেস্টোর” দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুর সেই তিন পাতা। এটা সেই স্বাধীনতাবাদ, যা মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলে। এটাকে সমাজতন্ত্রের এ-ক-দ-ম স-ম্পূ-র্ণ বিপরীত মতবাদ বলা চলে।

বেশ কিছুদিন সমাজতন্ত্র, স্বাধীনতাবাদ এগুলো নিয়ে পড়াশোনার পরে মোটামুটিভাবে এই রাজনৈতিক অবস্থানগুলোকে দেখার দুটো উপায় পেলাম। একটা হলো অর্থনীতি (তথা কার্যকারিতা) সংক্রান্ত। আরেকটি হলো নীতি-নৈতিকতা (তথা তত্ত্ব) সংক্রান্ত। সমাজতন্ত্রের তুলনায় স্বাধীনতাবাদের আবেদনটা অর্থনীতি ও মানব বিবর্তনের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে অনেকটাই বেশি। মানুষের এ যাবৎকালের সভ্যতার অগ্রগতির পেছনে মানুষের সম্পদ অর্জন, সেটাকে ব্যবহার করে উৎপাদন আর অন্যের সাথে সেটার বিনিময়ের রয়েছে সুবিশাল অবদান। এর বিপরীতে, মানুষের গোষ্ঠিগত বলপ্রয়োগমূলক প্রতিষ্ঠানের কারণে যুদ্ধ, গণহত্যা, গণদাসত্ব, উৎপাদনের ধ্বংস সাধন, দুর্ভিক্ষের উদাহরণ অঢেল। ম্যাট রিডলি ওনার নতুন গ্রন্থ “The Rational Optimist: How Porsperity Evolves“-এ বিস্তারিতভাবে সেটা দেখিয়েছেন। আলোচনা করেছেন মানুষের বিগত এক লক্ষ বছরের ইতিহাস নিয়ে। কীভাবে যেই সমাজের ভেতরেই মানুষ নিজের সম্পদ ব্যবহার করে উৎপাদনে দক্ষতা বাড়িয়েছে ও অন্যের সাথে বিনিময় করেছে, সেখানেই সভ্যতার দ্রুত বিবর্তন ঘটেছে, বিকাশ ঘটেছে। আর কীভাবে নেতা আর ধর্মযাজকদের মতো পরগাছা শ্রেণী সর্বদাই ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি ব্যবহার করে একেবারে কোনো প্রকার উৎপাদন না করেও পরগাছার মতো অন্যের উৎপাদনের উপর জীবন নির্বাহই কেবল করে নি, ছড়িও ঘুরিয়েছে। গোষ্ঠিগত বলপ্রয়োগ নয়, নিজের কাজে দক্ষতা বৃদ্ধি আর বিনিময়ই যে সভ্যতার অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি, সেটা সেই গ্রন্থে উল্লেখ করা অজস্র ইতিহাস ও রেফারেন্সে স্পষ্ট। আর এ সবই স্বাধীনতাবাদীদের অর্থনৈতিক মুক্তির দাবির পক্ষে যায়। সে বই নিয়ে ধীরে ধীরে লেখার ইচ্ছে আছে।

তবে আজকের আগ্রহ অন্য একটি আবেদন নিয়ে, যেদিকটি দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা স্বাধীনতাবাদের চেয়ে মানুষের মনে এ যাবৎকাল পর্যন্ত বেশিরভাগ স্থানই দখল করে আছে। আর তা হলো নীতি-নৈতিকতার আবেদন। ব্যবসা লোভের নামান্তর, রাষ্ট্র কল্যাণময়, গরীব দুঃখীদের রাষ্ট্র দেখভাল করবে, “লুটেরাদের” প্রতিহত করবে, এসব কথা খুব সহজে মানুষের মন কাড়ে। প্রশ্ন হলো – উৎপাদন ও বিনিময়ের যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, সেটার যদি সভ্যতার অগ্রগতির পেছনে এতোটাই অবদান থাকে, তাহলে জনমনে এর বিরুদ্ধে এতোটা বিদ্বেষ কেনো? অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে মানুষের এতোটা আগ্রহ কেনো? ব্যবসার প্রতি মানুষের কেনো এতোটা বিদ্বেষ? এটা বলা চলে অনেকটা সে কারণে, যে কারণে বিজ্ঞান মানব-সভ্যতার অগ্রগতির পেছনের অন্যতম মূল চালিকাশক্তি হওয়া সত্ত্বেও কয়টা দিন আগে পর্যন্তও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ ছিলো বিজ্ঞানবিমুখ, এমন কি বিজ্ঞানবিরোধীও। তারপরেও গুটি কয়েক মানুষ বিজ্ঞানে অবদান রেখেছে। আর এর সুফল ভোগ করেছে তারাও যারা এর বিপক্ষে সোচ্চার ছিলো। একই কথা উৎপাদন ও বিনিময়ের অর্থনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। উৎপাদন ও বিনিময়ের অর্থনীতির বিরুদ্ধের মনোভাবকে folk economics বলা চলে, যেটার পেছনে বিবর্তনীয় মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে – মানব প্রজাতি তার সুবিশাল সময় যে হান্টার গ্যাদারার যুগে কাটিয়েছে, সেখানে উৎপাদন ও বিনিময় সামান্যই ছিলো। সেখানে মানুষ সম্পদ আহরণ করতো, সে তুলনায় তেমন কোনো উৎপাদনই করতো না। ফলে একের অর্জনে অন্যের সম্পদের বিয়োজনের ঘটনা অঢেল ঘটতো, অর্থাৎ সেই সমাজে zero-sum game প্রকটভাবে উপস্থিত ছিলো।

অন্যদিকে ব্যবসা, অর্থাৎ উৎপাদন ও বিনিময় zero-sum game নয়। এখানে অংশগ্রহণকারী দুইপক্ষেরই লাভ হবার সুযোগ থাকে। কিন্তু ব্যবসা যেহেতু মানব প্রজাতির খুব আধুনিক একটি ঘটনা, ফলে মানুষের মধ্যে সেই হান্টার গ্যাদারারদের zero-sum game সমাজের মনোভাব এখনো রয়ে গেছে। ব্যবসায়িক বিনিময়ে, যেমন পণ্য কেনায়, মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হলো, হয় আমার লাভ হয়েছে নয়তো বিক্রেতার। সংক্ষেপে, ব্যবসা মানে শোষণ। ব্যবসা নিয়ে মানুষের বিদ্বেষের যে folk economics, এর স্বরূপ অনেকটা এমনই।

Folk ecomonics নিয়েও বিস্তারিত আরেকদিন লেখা যাবে। আমাদের আজকের আগ্রহ হলো স্বাধীনতাবাদের নৈতিক ভিত্তিটাকে জানা। স্বাধীনতাবাদের বক্তব্য সংক্ষেপে বোঝার চেষ্টা করা, অর্থনৈতিকভাবে এর কার্যকারিতার প্রসঙ্গ না এনেই। সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি তথা কার্যকারিতা নিয়ে কারও স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও সমাজতন্ত্রের নৈতিক ভিত্তি প্রায় সবার কাছেই স্পষ্ট। একটা কেন্দ্রীয় পরিকল্পক সকলের দেখভাল করবে, পরিকল্পিতভাবে কল্যাণের সর্বোচ্চীকরণ করবে। সমাজতন্ত্রের বিপরীত ঘরানার নৈতিক ভিত্তি সে তুলনায় অনেকটাই অস্পষ্ট। অবাধ পুঁজিবাদের নৈতিক ভিত্তি বা বক্তব্যও আমরা সমাজতন্ত্রীদের মুখ থেকে শুনেই অভ্যস্ত। তারা বলে বেড়াচ্ছে, পুঁজিবাদের নৈতিক ভিত্তি নাকি survival of the fittest, লোভ, লুট, শোষণ, কিংবা অনেকে বলছে, এটার নৈতিক ভিত্তি নাকি দুর্বলের elimination। এই ধ্যান ধারণাগুলোর পেছনেও সেই folk economics এর প্রভাবটাই প্রবল। স্বাধীনতাবাদকে পরিষ্কারভাবে জানার উদ্দেশ্যে তাই এর নৈতিক-ভিত্তি সংক্রান্ত রথবার্ডের রচনা নিচে অনুবাদ করলাম। সহজ, সরল, স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করে বর্ণনা করা হলো – স্বাধীনতাবাদ কী।

অনাক্রমণের নীতি (মূল: Murray Newton Rothbard, গ্রন্থ: For a New Liberty: The Libertarian Manifesto)

অনুবাদ:

পুরো স্বাধীনতাবাদের (libertarianism) মতবাদটাই দাঁড়িয়ে আছে একটা মাত্র নীতির উপর ভর করে – আর তা হলো অনাক্রমণের নীতি। এই নীতিটি হলো – কোনো মানুষ বা তার গোষ্ঠি অপর মানুষের শরীর কিংবা সম্পদে আক্রমণ করতে পারে না। এখানে আক্রমণ বলতে শারীরিক আঘাত ও বলপ্রয়োগের কথা ভাবা যেতে পারে।

তো একজন মানুষ যেহেতু অন্য মানুষকে আক্রমণ করতে পারে না, তাই অন্যের আঘাত, আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকাটা প্রত্যেকটা মানুষেরই একটা অখণ্ড অধিকার। ফলে একজন স্বাধীনতাবাদী সর্বদাই নাগরিক স্বাধীনতার সম্পূর্ণ পক্ষে অবস্থান করে। বাক-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভা সম্মেলন করার স্বাধীনতা, এসবই এর মধ্যে পড়ে। কারও শরীর বা সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না এমন সব “অপরাধ”, যেমন – “অশ্লীলতা”, পর্নোগ্রাফি, অর্থের বিনিময়ে স্বেচ্ছা যৌনতা, সামাজিকভাবে বিচ্যুতিপূর্ণ যৌন আচরণ, এই সকলও নাগরিক স্বাধীনতারই অংশ। সত্যিকার অর্থে, স্বাধীনতাবাদীরা এসব কাজকে কোনো “অপরাধ” বলেই মনে করে না। কেবল অন্যের শরীর কিংবা সম্পদে আঘাত করাটাই তাদের মতবাদ অনুসারে “অপরাধ” বলে গণ্য, অন্য কোনো কিছু নয়।

স্বাধীনতাবাদীরা সকল বাধ্যতামূলক জনসেবা ও সেনাসেবাকে গণদাসত্ব বলে মনে করে। আর যুদ্ধের, বিশেষ করে আধুনিক যুদ্ধের, একমাত্র পরিণতি যেহেতু গণমৃত্যু, স্বাধীনতাবাদীরা তাই সকল যুদ্ধকেই সম্পূর্ণ অন্যায্য ও গণহত্যার শামিল বলে মনে করে।

লক্ষণীয় যে, এই অবস্থানগুলো আজকাল “বামপন্থী” অবস্থান বলেই বেশি পরিচিত।

অন্যদিকে, স্বাধীনতাবাদীরা মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদের উপর আঘাতেরও বিরোধী। ফলে মানুষের সম্পদের অধিকারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপেরও তারা সমান বিরোধী। তারা মুক্ত বাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপন, ভর্তুকি, নিষেধাজ্ঞা, এই সব যাবতীয় হস্তক্ষেপের বিপক্ষে। কারণটা খুব সাধারণ। অন্যের আক্রমণ ও লুণ্ঠন থেকে নিজের সম্পদকে রক্ষা করা প্রতিটা ব্যক্তির যদি অখণ্ড অধিকার হয়, তাহলে তার সম্পদ যাকে খুশি তাকে প্রদান করাটাও (যেমন, সম্প্রদান কিংবা উত্তরাধিকার) তার অধিকার। কিংবা রাষ্ট্রের কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই অন্যের সাথে নিজের সম্পদের বিনিময় করাটাও (স্বাধীন চুক্তি এবং মুক্ত বাণিজ্য) নিঃসন্দেহে তার একান্ত অধিকার। স্বাধীনতাবাদীরা ব্যক্তিগত সম্পদ ধারণ এবং তা মুক্তভাবে বিনিময়ের সম্পূর্ণ পক্ষে। একে বলা যায় “অবাধ পুঁজিবাদ”।

সম্পদ ও অর্থনীতির ব্যাপারে স্বাধীনতাবাদীদের এই অবস্থানগুলো আবার “চরম ডানপন্থী” হিসেবে পরিচিত।

তো কিছু বিষয়ে “বামপন্থী” ও অন্য কিছু বিষয়ে “ডানপন্থী” হবার মধ্যে কোনো অসঙ্গতি আছে বলে স্বাধীনতাবাদীরা মনে করে না। বরং, তারা তাদের এই অবস্থানকে ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতার পক্ষে বস্তুত একমাত্র সঙ্গত অবস্থান বলেই মনে করে। কেনোই বা নয়? কী করেই বা একজন বামপন্থী রাষ্ট্রের যুদ্ধজুলুম আর বাধ্যতামূলক সেবার বিরোধিতা করার পাশাপাশি আবার রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আর বাধ্যতামূলক কর আদায়ের জুলুমকে সমর্থনও করে? আবার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মুক্ত বাণিজ্যকে সমর্থন করা ডানপন্থীরাও বা কী করে একই সাথে যুদ্ধ আর বাধ্যতামূলক সেবাকেও সমর্থন করে? অন্যের অনাক্রমণাত্মক আচরণ ও কার্যকলাপকেই বা কীভাবে তারা স্রেফ নিজেদের কাছে অনৈতিক মনে হয় বলে আইন করে নিষিদ্ধ করে রাখতে চায়? আবার, সামরিক-শিল্প প্রতিষ্ঠানের পেছনে যে প্রকাণ্ড ভর্তুকি, অনুৎপাদনশীলতা আর অদক্ষতা, সেটাকে না দেখার ভাণ করে থেকে একজন ডানপন্থী কী করে নিজেকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির পক্ষের বলে ভাবতে পারে?

স্বাধীনতাবাদীরা ব্যক্তির শরীর ও সম্পদের উপর সকল ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠিগত আক্রমণের বিরোধী। এবং স্বাধীনতাবাদীরা লক্ষ্য করে যে – একটা কেন্দ্রীয় ও প্রধান আক্রমণকারী চরিত্র সমস্ত ইতিহাস জুড়ে এবং বর্তমানকাল অবধি মানুষের এই সকল অধিকারকে লঙ্ঘন করে আসছে। আর সেই চরিত্রের নাম হলো – রাষ্ট্র। বাম, ডান ও মধ্য – সকল -পন্থীরাই মানুষের উপর কোনো না কোনো প্রকার হস্তক্ষেপমূলক কর্মকাণ্ডের নৈতিক অনুমোদন রাষ্ট্রকে দিয়ে আসছে। কিন্তু এগুলো এমন সব কর্মকাণ্ড, যা রাষ্ট্র বাদে সমাজের দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠি করলে নির্ঘাত সেটাকে আমরা অনৈতিক, অবৈধ ও অপরাধ বলে গণ্য করে থাকি। স্বাধীনতাবাদীরা রাষ্ট্রকেও সে ধরনের কোনো অনুমোদন দিতে অপারগ। মানুষের সাধারণ নৈতিক বিধানসমূহ সকল মানুষের উপরেই সমানভাবে প্রযোজ্য বলে তারা মনে করে। কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে বিশেষ ছাড় দিতে তারা রাজি নয়।

রাষ্ট্রকে যদি আমরা নগ্নচোখে দেখি, তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, এমন সব কাজ করা রাষ্ট্রের জন্যে সর্বজনীনভাবে অনুমোদিত, যা অন্য যে কেউ করলে এমন কি অস্বাধীনতাবাদীদের কাছে পর্যন্ত সেটা গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য হতো। রাষ্ট্র মাঝে মাঝেই গণহত্যা সম্পাদন করে, আর তার নাম দেয় সে “যুদ্ধ” কিংবা “দুষ্টের দমন”। রাষ্ট্র জোরপূর্বক তার সেনাবাহিনীতে দাস নিয়োগ করে, আর তার নাম দেয় সে “বাধ্যতামূলক সেনাসেবা”। এবং রাষ্ট্র তার জীবন নির্বাহ করে জবরদস্তিমূলক চৌর্যবৃত্তি আর লুণ্ঠনের মাধ্যমে, আর তার নাম দেয় সে “কর আদায়”। স্বাধীনতাবাদীরা দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করে যে – সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অনুমোদন দেয় কি দেয় না তার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের এইসব কর্মকাণ্ডের মর্যাদা পাল্টে যায় না: জনগণ অনুমোদন দিক বা না দিক, যুদ্ধ সর্বদাই গণহত্যার শামিল, বাধ্যতামূলক সেবা হলো দাসত্ব, আর কর আদায় হলো স্রেফ ডাকাতি। স্বাধীনতাবাদীরা যেনো গল্পের সেই বালকটি, যে কিনা চোখে আঙুল দিয়ে বার বার দেখিয়ে দেয় যে রাজার গায়ে আসলে কোনো কাপড় নেই।

সমগ্র ইতিহাস জুড়ে সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীশ্রেণী রাজাকে নানা রকম ছদ্মপোশাক সরবরাহ করে এসেছে। অতীতে বুদ্ধিজীবীশ্রেণী জনগণকে বোঝাতো যে রাষ্ট্র কিংবা তার শাসকেরা হলো দৈব ক্ষমতাপ্রাপ্ত, কিংবা তারা নিজেরাই স্বয়ং ঈশ্বর। ফলে সাদা চোখে যা নির্ঘাত স্বৈরাচার, গণহত্যা, আর প্রকাণ্ড লুণ্ঠন বলে চিহ্ণিত হবার কথা, সেটাকে দৈবের সদাশয় ও রহস্যময় আচরণ বলে মানুষ ভেবে এসেছে। অধুনা শাসকশ্রেণীর দেবত্বে যেহেতু টান পড়েছে, “রাজার” অলৌকিক পোশাক যেহেতু জীর্ণ হয়ে এসেছে, রাষ্ট্রের পোষা বুদ্ধিজীবীরা রাজার জন্যে এবার তাই আরো সূক্ষ্ম ছুতোর নতুন জাল বুনে এনেছে। মানুষকে এখন তারা বোঝাচ্ছে – রাষ্ট্র যা কিছু করে “গণ কল্যাণের” জন্যে করে, “সর্বসাধারণের মঙ্গলের” জন্যে করে। তারা বলে – কর আদায় আর সেটা ব্যয়ের যে প্রক্রিয়া, সেটা এক রহস্যপূর্ণ “বর্ধনের” মাধ্যমে অর্থনীতিকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখে। তারা বোঝায় – রাষ্ট্র যে সেবা প্রদান করে, সেটা কোনোভাবেই সরকারের বাইরে মানুষের স্বেচ্ছাকৃত যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে সাধন করা সম্ভব হতো না। স্বাধীনতাবাদীরা এই সকল দাবিকেই অস্বীকার করে। তারা এই সকল অজস্র ছুতোকেই রাষ্ট্রের শাসনের পক্ষে মানুষের সম্মতি আদায়ের প্রতারণাপূর্ণ উপায় বলে মনে করে। সে দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করে যে রাষ্ট্রের এই সকল সেবাই মানুষের ব্যক্তিগত ও যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে আরো অনেক দক্ষতা ও নৈতিকতার সাথে প্রদান করা সম্ভব।

ফলে স্বাধীনতাবাদীদের মূল শিক্ষামূলক কাজ হলো রাষ্ট্রের অভাগা শিকারের সামনে রাষ্ট্রের দেবত্ব মোচন ও রহস্য উন্মোচন। তার দায়িত্ব হলে বার বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যে কেবল “রাজারই” যে পরনে কাপড় নেই তা নয়, এমন কি “গণতান্ত্রিক” রাষ্ট্রের পরনেও আসলে কোনোই কাপড় নেই। সকল রাষ্ট্র তার জীবিক নির্বাহ করে মানুষের উপর শোষণমূলক বিধি জারি করে। সেই সকল বিধিই নৈর্ব্যক্তিক প্রয়োজনের বিপরীত যাকে বলে – ঠিক তা। রাষ্ট্র ও তার করারোপ বিধি মানুষের মধ্যে – শাসকশ্রেণী আর শাসিতশ্রেণী – এমন একটা শ্রেণীবিভাজন তৈরি করতে বাধ্য। আর এটা বেফাঁস করাটাই স্বাধীনতাবাদীদের সংগ্রাম। রাষ্ট্রের পোষা বুদ্ধিজীবীদের কাজই হলো রাষ্ট্রকে সমর্থন যোগানো, রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা রহস্যের জাল বুনে মানুষকে রাষ্ট্রের শাসন মেনে নিতে প্রণোদনা দেওয়া। এর বিনিময়ে এই বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রের অর্থ ও ক্ষমতার একটা ভাগ পায় – যেটা কিনা আবার জনগণের থেকে রাষ্ট্রের শাসকেরা মূলত লুণ্ঠন করেই এনেছে। আর এগুলো বেফাঁস করাটাই স্বাধীনতাবাদীদের কাজ।

যেমন ধরুন, কর আদায়ের চর্চাটি। রাষ্ট্রবাদীরা একে এক রকম “স্বেচ্ছামূলক” বলে দাবি করে এসেছে। কেউ সত্যি যদি ভেবে বসেন যে কর আদায়ের ব্যাপারটি এক ধরনের স্বেচ্ছামূলক ব্যাপার, তাকে আমি আহ্বান জানাচ্ছি – একবার কর না দিয়ে দেখুন কী হয়! রাষ্ট্রের কর আদায়ের চর্চাকে বিশ্লেষণ করলে আমরা একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পাই। সমাজের সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাষ্ট্রই একমাত্র যা বলপূর্বক ও সহিংসতার মাধ্যমে তার আয় উপার্জন করে। সমাজের অন্য সবাইকে উপার্জন করতে হয় অন্যের স্বেচ্ছাদান গ্রহণ (আশ্রম, দাতব্য সংস্থা, দাবা সমিতি) কিংবা পণ্য ও সেবা বিক্রয়ের মাধ্যমে, যা কিনা ভোক্তা স্বেচ্ছায় তার থেকে খরিদ করে। রাষ্ট্র ছাড়া অন্য যে কেউ কর আদায় করতে গেলে সেটাকে নির্ঘাতভাবেই বলপ্রয়োগ ও ছদ্মাবৃত্ত দস্যুতা হিসেবে চিহ্ণিত করা হতো। কিন্তু এইসব কার্যকলাপকে রাষ্ট্রপ্রভু তার রহস্যময় সাজপোশাকের আড়ালে এমনভাবে অবগুণ্ঠিত করে রেখেছে যে কেবল স্বাধীনতাবাদীদের পক্ষেই সম্ভব হয় কর আদায়কে তার প্রাপ্য অভিধাটি দেওয়া, আর সেটা হলো এই যে – কর আদায় স্রেফ একটা সংগঠিত ও আইনসিদ্ধ গণলুণ্ঠন।

(সমাপ্ত)