বিবর্তনকে উদ্দেশ্য করে সৃষ্টিবাদীদের করা সবচেয়ে প্রচারিত সন্দেহ, বিবর্তন শুধুই একটি তত্ত্ব, এর কোনো বাস্তবতা নেই [১]। প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার আগে জেনে নেই তত্ত্বের সংজ্ঞা কী।

প্রচলিত অর্থে তত্ত্ব (Theory) বলতে আমরা যা বুঝি তা থেকে তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা সম্পূর্ণ আলাদা। তত্ত্বের ইংরেজি শব্দ থিওরির দুইটি অর্থ। প্রচলিত অর্থে, থিওরি বলতে অবাস্তব অনুমান বোঝানো হয়। যেমনঃ ঠিক কোন কাজটা করলে আমাদের বাংলাদেশ সোনার বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সে ব্যাপারে আমাদের অনেকেরেই কোনো না কোনো থিওরি আছে। অপরদিকে বিজ্ঞানে থিওরি বা তত্ত্ব শব্দটি একেবারে ভিন্ন অর্থ বহন করে। আমেরিকার জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদের মতে, ‘বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হল প্রাকৃতিক কোনো ঘটনা বা বাস্তবতার (phenomenon) প্রতিপাদিত ব্যাখ্যা। তত্ত্ব, প্রাকৃতিক বাস্তবতাকে যৌক্তিকভাবে বর্ণনা করার সমীকরণ [২] ।’ দেখা যাচ্ছে, বিবর্তন শুধুই একটি তত্ত্ব প্রশ্নটিতে- খুব সুচারূভাবে বিজ্ঞানের তত্ত্ব শব্দটির অর্থকে বদলে ফেলা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবর্তন একটি তত্ত্ব হতে পারে, কিন্তু কখনই ‘শুধুই একটি তত্ত্ব’ এ অর্থে না।

চিত্রঃ তত্ত্বের প্রচলিত অর্থ এবং বৈজ্ঞানিক অর্থ সম্পূর্ণ আলাদা

বিজ্ঞানীরা মূলতঃ বাস্তবতা ব্যাখ্যা করার জন্যই তত্ত্ব দাঁড় করান। কোনো পর্যবেক্ষণ যখন বারংবার বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয় তখন তাকে আমরা বাস্তবতা বা সত্য (fact) বলে ধরে নেই। আর তত্ত্ব হচ্ছে সেই বাস্তবতাটি কিভাবে ঘটছে তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা। গাছ থেকে আপেল পড়ার ব্যাপারটাই ধরি। গাছ থেকে যে আপেল মাটিতে পড়ছে তা বাস্তবতা। আর যে তত্ত্বের সাহায্যে এই বাস্তবতার ব্যাখ্যা দেয়া হয় তাকে আমরা বলি মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব। বিবর্তনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। জীবজগৎ স্থির নয়, তাদের বিবর্তন ঘটছে, এই বাস্তবতাটি বিগত দেড়শ বছর ধরে হাজারো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বহু রকমভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আর যে তত্ত্বের মাধ্যমে এই বাস্তবতাটি ব্যাখ্যা করা হয় তার নামকরণ করা হয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব [৩],[৪],[৫]।

বিবর্তন যে বাস্তব সেটা একটু বিশ্লেষণ করা যাক। প্রাণের বিবর্তন ঘটছে। কোন প্রজাতি স্বতন্ত্রভাবে ‘সৃষ্টি’ করা হয়নি, বরঞ্চ প্রাণের উদ্ভবের পর থেকে প্রতিনিয়ত পরিবেশের বিভিন্ন প্রভাবের কারণে এক প্রজাতি বিবর্তিত হয়ে অন্য প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। নর বানরেরা রাতে ঘুমালো, সকালে উঠে দেখলো তারা সবাই আধুনিক মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেছে- এমন নয়, বরং এটি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পরিবেশে টিকে থাকার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনের ফসল। প্রজাতি এক রূপ থেকে আরেক রূপে বিবর্তিত হতে পারে না, এটা এই যুগে এসে মনে করাটা বোকামি, যখন দেখা যায়, জাপানি কৃষকেরা গোল তরমুজকে চারকোণা করে ফেলেছে। কবুতর, কুকুরের ব্রিডিং সম্পর্কেও আমরা সবাই অবগত। মাত্র কয়েক প্রজন্মেই এক প্রজাতির কুকুর থেকে যেখানে আরেক প্রজাতির উদ্ভব হয়, সেখানে পরিবেশ পেয়েছে লক্ষ- কোটি বছর। বিবর্তন যে বাস্তব এই প্রমাণ দেখতে আগ্রহীদের জন্য ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র ‘ওয়াজ ডারউইন রং [৬] , চ্যানেল ফোরের ‘জিনিয়াস অফ চার্লস ডারউইন [৭]’ , অথবা রিচার্ড ডকিন্সের লেখা ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’, জেরি কোয়েন এর “হোয়াই ইভোলিউশন ইজ ট্রু” -এর মতো বইগুলো সহায়ক হতে পারে। সংক্ষিপ্ত ধারণার জন্য দেখুন মুক্তমনা বিবর্তন আর্কাইভের “বিবর্তনের পক্ষে কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি”– ভুক্তিটি দেখা যেতে পারে।

চিত্রঃ নেকড়ে বাঘ থেকে মানুষ দ্বারা কৃত্রিম নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কুকুর প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বিবর্তন ঘটে। পাহাড় সমান সাক্ষ্য প্রমাণ [৮] , ফসিল কিংবা ডিএনএ -র আবিষ্কার প্রমাণ করে,এটা বাস্তব [৯]। আমরা জানি, পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান ব্যাখ্যা করার জন্যই প্রয়োজন হয় বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের। যেমনঃ আমরা উপরে দেখেছি গাছ থেকে আপেল পড়ে, এটি একটি বাস্তবতা, একে ব্যাখ্যা করা হয় নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব দ্বারা। তত্ত্ব কোনও সাধারণ বাক্য নয়, বাস্তবতা ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানীরা প্রথমে একটি হাইপোথিসিস বা অনুকল্প দাঁড় করান। পরবর্তীকালে এই অনুমিত তত্ত্বটি পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সূত্রের মাধ্যমে বার বার যাচাই করা হয়। যদি সব আঘাত থেকে যুক্তিযুক্তভাবে একটি অনুকল্প বেঁচে ফিরতে পারে এবং যখন প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ সকল প্রমাণ একে সমর্থন করে তখন একে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব উপাধি দেওয়া হয়। বিবর্তন যে তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়, তার নাম ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা বিবর্তন তত্ত্ব’[১০]।

প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব নিয়ে ডারউইন একদিকে যেমন নিঃসংশয় ছিলেন অপরদিকে ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ লক্ষ- কোটি প্রজাতির মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট একটি প্রজাতির এই তত্ত্বের বাইরে উদ্ভব হওয়া এই তত্ত্বটি বাতিল করে দিতে যথেষ্ট। দীর্ঘ বিশ বছর বিভিন্ন প্রমাণ সংগ্রহের পর ডারউইন ১৮৫৯ সালে তত্ত্বটি প্রকাশ করেন [১১]। তারপর গত দেড়শ বছর ধরে বিভিন্নভাবে বিবর্তন তত্ত্বকে নানাভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে,এটি কখনোই ভুল প্রমাণিত হয়নি।

তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য থাকে, এর মাধ্যমে আমরা সঠিকভাবে বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। বিবর্তন তত্ত্ব সুচারুভাবে এই দায়িত্ব পালন করে। যেমন,আধুনিক পিঁপড়াদের পূর্বপুরুষের ফসিল কোথা থেকে পাওয়া যাবে, কিংবা মাছ এবং চতুষ্পদী উভচর প্রাণীর মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণীর ফসিল কোথায় পাওয়া যাবে, -এ ধরণের অনুমানগুলো বিবর্তন তত্ত্ব দিয়ে বের করে সত্যতা যাচাই করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পড়ুন – বিবর্তন কখনো বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না এই দাবির উত্তর।

আবার আসা যাক নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বে। একটি অনুকল্প যখন গ্রহণ করা হয় তখন এর সত্যতা পরীক্ষার জন্য একে বর্তমান পর্যন্ত সকল আহরিত জ্ঞানের চোখ দিয়ে যাচাই করা হয়। যদি এই অনুকল্পটি বিভিন্ন পরীক্ষায় সঠিক ফলাফল দেয়, এবং সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়, তাহলেই একে তত্ত্বের মর্যাদা প্রদান করা হয়। আমরা জানি, দীর্ঘ সময় পর্যন্ত গাছ থেকে আপেল পড়া বাস্তবতাটির ব্যাখ্যায় নিউটনের তত্ত্বই সঠিক ফলাফল দিয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে নিউটনের সূত্র খুব ভালই ফলাফল দেয়। কিন্তু দেখা গেল বিশেষ কিছু পরিস্থিতি, যেমন- অত্যন্ত দ্রুত বেগে (আলোর বেগের কাছাকাছি) চলমান বস্তুর ক্ষেত্রে কিংবা কৃষ্ণগহ্বরের মতো বিশাল ভর গণনায় নিউটনের তত্ত্ব সঠিক ফলাফল দিতে পারছে না। যা পারছে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। সুতরাং এখন আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বই সার্বিকভাবে মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব থেকে গ্রহণযোগ্য। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন, গাছ থেকে আপেল পড়ার ব্যাখ্যা যা দিয়েই দেওয়া হোকনা কেন, আপেল পড়া কিন্তু থেমে যায়নি। বিবর্তনও তাই। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে গত দেড়শ বছর ধরে পাওয়া হাজারো প্রমাণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা শতভাগ নিশ্চিত যে, পৃথিবীর সকল প্রজাতির উদ্ভব বিবর্তনের মাধ্যমেই হয়েছে। এটি সূর্য পৃথিবী চারদিকে ঘোরার বা গাছ থেকে আপেল পড়ার মতোই বাস্তবতা। এই বাস্তবতাটি ডারউইনের প্রস্তাবিত প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব দিয়ে এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে, ভবিষ্যতের কোনও পরিস্থিতিতে ডারউইনের তত্ত্ব যদি সঠিক ফলাফল দিতে অপারগ হয় তাহলে আমরা আরও সঠিক কোনো ব্যাখ্যার সন্ধান পাবো। কিন্তু গাছ থেকে আপেল পড়ছিল, পড়ছে এবং পড়তে থাকবে, বিবর্তনও হয়েছিল, হচ্ছে, হতেই থাকবে।

তথ্যসূত্রঃ

১. বিবর্তন নিয়ে ইসলামী পন্ডিত জাকির নায়েকের লেকচার http://tiny.cc/xkexk
২.সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনের জুলাই ২০০২ এর ইস্যুতে সম্পাদক জন রেনি’র “15 Answers to Creationist Nonsense” প্রবন্ধ। মুক্তমনার লেখক পৃথিবীর করা অনুবাদের অনলাইন লিংক http://tiny.cc/a0sbr
৩. মোরান, লরেন্স “Evolution is a Fact and a Theory”, টক অরিজিন। অনলাইন লিংক http://tiny.cc/xctrm
৪. গুল্ড, স্টিফেন জে “Evolution as Fact and Theory”. Discover 2 (5): 34–37. অনলাইন লিংক http://tiny.cc/0cvsk
৫.লেনস্কি, রিচার্ড ই “Evolution: Fact and Theory”. American Institute of Biological Sciences. অনলাইন লিংক http://tiny.cc/p253u
৬. http://tiny.cc/b8n7k
৭. http://tiny.cc/p487c
৮. মুক্তমনা বিবর্তন আর্কাইভ ‘বিবর্তনের পক্ষে কোনো সাক্ষ্যপ্রমান পাওয়া যায়নি’।
৯. অভিজিৎ রায়,এক বিবর্তন বিরোধীর প্রত্যুত্তরে, অনলাইন লিংক http://tiny.cc/qph0b
১০. বন্যা আহমেদ,বিবর্তনের পথ ধরে,অবসর প্রকাশনী। অনলাইন লিংক http://tiny.cc/ocp2d
১১. চার্লস ডারউইন, The Origin of Species by Means of Natural Selection (London: John Murray, 1859)