বাঙালা ভাষা আন্দোলনঃ একটি ভিন্ন দৃশ্যপট
রানা রায়, জার্মান প্রবাসী
 

ভূমিকা:
পৃথিবীর সমস্ত সংস্কৃতির বাস্তব অবস্থাকে উপলদ্ধি করে দেখা যায় সংস্কৃতি আসলে শেখার বিষয়। এই শিক্ষণীয় সংস্কৃতির প্রধান বাহন হিসাবে কাজ করে ভাষা। তাই ভাষা যেমন একদিকে সংস্কৃতির শিক্ষা ও বিস্তারে প্রধান উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয় তেমনি অনেক সময় দেখা যায় ভাষা নিজেই একটি সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা এই দুই অবস্থাতেই তার ভূমিকাকে শক্ত-পোক্ত করেছে। ভাষার রয়েছে নিজস্ব রাজনৈতিক অধিকার। পৃথিবীর যে সমস্ত ভাষা রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে মোকাবিলা করতে পারেনি সেই সমস্ত ভাষাগুলির অনেকেই হারিয়ে গেছে- যাচ্ছে ও আগামী দিনেও যাবে। (রবীন্দ্রনাথ এই সকল ভাষাকে ”ভাষাদীন” বলে উল্লেখ করেছিলেন।) এর কারণ অতি সুস্পষ্ট কোন পরাধীন দেশ যখন বিজে তাদের ভাষাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, তখন স্বাভাবিক ভাবেই সামাজিক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কারণে আপন ভাষা বিসর্জিত হয় এবং একই সঙ্গে সংস্কৃতিও। আমাদের দেশে ফার্সি, ইংরেজী ও উর্দূর অভিজ্ঞতা এই প্রসঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাংলা ভাষার সৌভাগ্য এই সে রাজনৈতিক অধিকার মোকাবেলা করতে পেরেছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুইভাবেই করেছে। পরোক্ষভাবে যেমন প্রতিনিয়তই তাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে তেমনি প্রত্যক্ষভাবেও অন্তত দুইবার রাজনৈতিক অধিকার মোকাবেলা করে রক্ত দিতে হয়েছে। প্রথমবার বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) উর্দূ ভাষা চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে, দ্বিতীয়বার ভারত রাষ্ট্রের অসম রাজ্যে বাংলা ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে। আজকে যখন সারা বিশ্বে জাতি সংঘের কল্যাণে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস প্রতিষ্ঠিত তখন বাংলাদেশ, ভারতম নিকারাগুয়ার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিকতা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার জোর প্রয়াস নেয়া বাঞ্চনীয়। বিশেষ করে ক্ষুদ্র জাতিসংঘ গুলোর ভাষা রক্ষার জন্যও এই আন্দোলনগুলি পথ দেখাতে পারে।


ভাষার বিলুপ্তি মানে সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়া আর সংস্কৃতি ম্লানতা হচ্ছে সভ্যতার পরাজয়। একথা ঠিক যে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ভাষার আগ্রাসন ও ভিন্ন সংস্কৃতির আধিপত্য পূর্বতন সময়ের তুলনায় অনেক জটিল। তবুও আমরা যারা ভাষাকে অখন্ড জাতিসত্তার মূল হিসাবে বিবেচনা করি তাদের অবশ্যই অসময়ের বাংলা ভাষা আন্দোলন সর্ম্পকে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ বিষয়ে দেশের বুদ্ধিজীবী মহলে যেমন কোন আলোচনা নেই তেমনি নতুন প্রজন্মও অন্ধকারের বাসিন্দা। ইতিহাসের প্রতি এই অবহেলা নিঃসন্দেহে আমাদের ভিতর অপরাধ বোধের জন্ম দেয় আর উত্তর পূর্ব ভারতের অসম রাজ্যের বাঙালী মানুষদেরকে তাড়িত করে ক্ষোভে। যে ক্ষোভে অন্যায় নয় বরং সুস্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করে ইতিহাস বিকৃতির জগতকে ”দুই বাংলার ভালবাসার কবিতা” সংকলনের ভূমিকায় শামসুর রাহমান ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো করিয়া যখন লেখেন ওপাড় বাংলার মতো ভাতে বাংলা ভাষার উপর কখনো আক্রমন হয়নি তখন তাদের এই বিস্মৃতি আমাদের কেবল ব্যথিতই করে না, আমরা স্পষ্ট অনুভব করতে বাধ্য হই পশ্চিমবঙ্গঁ এবং বাংলাদেশের থেকে আলাদা বাংলা সাহিত্যের অন্য এক ভুবনে আমরা বাস করি।” বরাক উপত্যকার মানুষ বিজিৎ কুমার ভট্টাচার্যের এই কথা যদি সত্য হয় তবে আরো সত্য যে, ইতিহাস বিকৃতি আসলে ব্রাত্যজনের কাজ নয়, বুদ্ধিজীবীদেরই কাজ। যাই হোক, কাছাকাছি সময়ে সংঘটিত দুটি বাংলা ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভিন্ন। তথাপি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনা যে কোন না কোন ভাবে ১৯৬১ সালে বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনকে যথেষ্ট প্রভাবিত করিছেল সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, অসম রাজ্যে বাংলা ভাষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল অসমীয়া ভাষাকে রাজ্য ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও সেই রাজ্যের ভাষা হিসাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান।


পূর্বকথা
তৎকালীন অসম রাজ্যের বিস্তৃতি অসম নাগাহিলস, লুসাই হিলস, খাশি জৈন্তিয়া হিলস, অরুনাচল, গোয়ালপাড়া, সিলেট, কাছাড় পর্যন্ত বিস্তৃতি ছিল। বৃটিশ শাসনাধীন এই রাজ্যের কারণ ছিল-পলাশীর অশ্রকানন থেকে ইংরেজ তাদের আধিপত্যের জাল সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে দিলেও কোলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী এবং একই সঙ্গেঁ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উত্তর ভারত, মায়ানমার, শ্রীলংকানদের জন্য বিদ্যা শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। যার ফলেই রাজ্যের যে সকল অসমীয়রা ইউরোপীয় সাহিত্য চর্চা, বাংলা সাহিত্য ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয় উঠেছিল তাদের সকলেরই শিক্ষার বহন ছিল বাংলা। অনেক মনীষীর মতো বীর বিদ্রোহী মনিরাম দেওয়ান অসমের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ধর্ম-বর্ণ-জাতি নিয়ে যে ইতিহাস কামরুপ বা বুরঞ্জী রচনা করেন তারও ভাষা ছিল বাংলা। মূলত আঠারো সালের মধ্যবর্ত্তী সময় পর্যন্ত রাজ্যের অসমীয়া ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে একটি পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের ঐতিহ্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু চতুর ইংরেজ বাংলা ও বাঙালীর প্রাধান্য মেনে নিতে পারেনি। রাজনৈতিক বিভাজন তৈরী করে অসমীয়া ও বাঙালীদের মধ্যে ভাষাই তখন ইংরেজের কাছে প্রধান হাতিয়ার হয়ে দঁড়ায়। এ.জে. মোয়াটে মিলস্ নামে একজন ইংরেজ কর্মচারী হঠাৎ করেই রাজ্যে অসমীয়া ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। বৃটিশের এই রাজনৈতিক দূরভীসন্ধিমূলক কাজের অংশীদারিত্ব গ্রহণ করে তাদেরই দোসর আমেরিকান ব্যাপটিস্ট মিশনারীরা। মিশনারীরাই প্রথম অসমীয়া ভাষার ব্যাকরণ, অভিধান ও সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠার কাজ করে। মিলসের প্রতিবেদন একদিকে ইংরেজের জন্য খুলে দিল প্রত্যাশিত ভাষা গঙ্গার দুয়ার অন্যেিদক মার্কিন ব্যাপটিস্ট মিশনারীরা লুফে নিল অসমীয়া ভাষায় মাধ্যমে খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারের সুযোগ এরই চুড়ান্ত পরিণতিতে আঠারো সালের শেষ দিকে দেখা গেল রাজ্যের অনেক জেলার স্কুল ও আদালতে সরকারী ভাষা হিসাবে অসমীয়া ভাষা ব্যবহৃত হতে থাকে। এই সময়ে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে অসমীযা ভাষাকে রাজ্য ভাষা হিসাবে স্বীকৃতির প্রশ্নে বাঙালীরা কিন্তু কখনোই বিরোধীতা করেনি। মিলসের পর এডওযার্ড গেইট বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সর্ম্পকে তীর্যপূর্ণ মন্তব্য উপস্থাপন করলে তখন থেকেই মূলত শুরু হয় ভাষার ত্বাত্ত্বিক লড়াই। ইংরেজের বিভাজননীতি ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাঁ-হাঙ্গামা মধ্য দিয়েই ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগষ্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। এর কিছুদিন পরেই সিলেট জেলাও গনভোটের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে মুক্ত হয়ে যায়। আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরফলৈ তখন নতুন নীতির কথা ঘোষনা করে বলেন-”
Assam is for Assamese  ”।মহাত্ম গান্ধী অবশ্য এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন-” If Assam is Assame; India for whom  ”।


দেশ বিভাগের যন্ত্রণা অনেকের মনেই গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। সর্বশান্ত হয়ে বাঙালী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি,হিন্দু, শিখ, খ্রীষ্টান, মুসলমান দলে দলে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। নেহেরু সরকারও তাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। তবে সবচেয়ে বেশী দেশত্যাগ করে বাঙালী হিন্দুরা। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাঙালী হিন্দুরা কোলকাতা ও আসাম যাওয়া শুরু করে। ভারতের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী নেতারা দেশ বিভাগকে ক্ষমতার হাতিয়ার হিসাবে মেনে নিলেও পাকিস্তান থেকে নির্যাতিত মানুষের ভারতে আশ্রয় গ্রহণকে মেনে নিতে পারেনি। আসামের উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতারা চিন্তিত হয়ে পড়লেন”ভারসাম্য রক্ষার জন্য”। শেষ পর্যন্ত ১৯৫০ সালের শুরু হয় আনষ্ঠানিকভাবে বাঙালী খেদা’ আন্দোলন। হিংসা লোভ আর আধিপত্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য হাজার হাজার বাঙালীকে সেদিন আসাম ছেড়ে অন্যান্য জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়। অবশ্য তখন কিছু কিছু বাঙালীকে আবার পুর্নবাসনের নামে আসামে আশ্রয়ও দেয়া হয়। তবে তাদের মাতৃভাষা হিসাবে অসমীয়াকে গ্রহণ করতে হয়। ১৯৫১ সালেই কৌশলগত লোকগননায় দেখা গেল, সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে বাঙালী সংখ্যা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় শতকরা ১৭ আর অসমীয়াদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হল শতকরা ৫৫। অথচ ১৯৩১ সালের লোক গনণার হিসাবে দেখা যায় আসামে বাঙালীর সংখ্যা ছিল ৪.৭৬ লক্ষ আর অসমীয়ার সংখ্যা ১.৬১ লক্ষ মাত্র। ২০ বছরের ব্যবধানে অসমীয়া রাজ্যে ব্যাপক সংখ্যক অসমীয়া ভাষাভাষী মানুষের বৃদ্ধি ও বাঙালী ভাষাভাষী মানুসের হ্রাস তৎকালীন লোকগনণার অধীক্ষক আর বি ভাগাইওয়ালা বলেছিলেন ”
Biological Miracle ” । ১৯৩১ সালে লোক গনণায় আসামের চিত্র দেখে ভাষা বিজ্ঞানী পন্ডিত সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন-”আসামে বঙ্গভাষীরাই সংখ্যা ভুমিষ্ট সম্প্রদায়। অসমীয়া ভাষীদের পক্ষে ইহা একটি বিশেষ অস্বস্তিকর অবস্থা যে তাঁহারা তাঁহাদের স্বকীয় প্রদেশেই সংখ্যায় অত অল্প হইয়া রহিয়াছেন-শতকরা তাঁহারা মাত্র ২১- এদিকে বঙ্গভাষীরা শতকরা ৪২ ইহার দ্বিগুন এবং বাহির হইতে আগত চা-বাগানের শ্রমিক ও অন্য অস্থায়ী অধিবাসীদের (হিন্দুস্থানী, বিহারী, ওড়িয়া, নেপালী প্রভৃতি এবং সাঁওতাল, মুন্ডারী, হো, ওরাওঁ) বাদ দিলে, ঘাস-আসামের বিভিন্ন পাহাড়িয়া জাতির অনুপাত দাঁড়ায় শতকরা ২২। শতকরা ৭৯ এর সামনে শতকরা ২১ কে কিছু পরিমাণ অসুবিধা সহ্য করিতে হয়।………..বাঙ্গালী ও অসমীয়াকে পরস্পরে সঙ্গে ও অন্য জাতির মানুষের সঙ্গে (যাহারাই হইতেছে দেশের সত্যকার প্রাচীনতম অধিকারী, আদিবাসী) প্রীতি ও সহানুভূতির সহিত চলিতে হইবে।”


* ১৯৩১ সারের লোক গনণায় শতকরা হিসাবে আসামের লোকসংখ্যা-

বঙ্গভাষী ৪৩ জন
অসমীয়া ভাষী ২২ জন
পূর্বী হিন্দি, বিহারী ৬ জন
সাঁওতাল, মুন্তারী, হো, প্রভৃতি কোলভাষা  ৩ জন
বোগে  ৩ জন
মনিপূরী  ৩ জন
খাসিয়া  ৪ জন
ওড়িয়া  ২ জন
গারো ২ জন
১০ নেপালী ২ জন
১১ সিকির ২ জন
১২ অন্যান্য ভাষা (নাগা, আরব, মিশসী, ঘাসতি, দফলা, দ্রাবিড়, ওঁরাও, প্রভৃতি ১ জন

সেই প্রীতি ও সহানুভূতির সম্পর্ক আর বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেনি আসামের উগ্রজাতীয়তাবাদী নেতাদের আধিপত্যের জোরে। ফলে দেখা গেলো দেশ স্বাধীন হবার পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রমশই বাংলা ভাষার ব্যবহার সংকুচিত হয়ে আসতে লাগল। পক্ষান্তরে অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার শুরু হল। রাজ্যের লোকাল বোর্ড থেকে জানিয়ে দেয়া হল যে, যদি কোন বিদ্যালয় অসমীয়া ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ না করে তবে সে স্কুলের অনুদান বন্ধ করে দেয়া হবে। এর ফলে শুধুমাত্র গোয়ালপাড়া জেলাতেই ১৯৪৭-১৯৫১ সালের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের এক ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায়।
 

 

Year

Total no. of lower primary school with ASSAMESE of medicim of isntruction

Expenditure

BENGAL

Ex.

1947-48

348

Rs. 96,135/-

250

Rs. 66000/-

1948-49

582

Rs. 2,11,470/-

130

Rs. 48360/-

1949-50

773

Rs. 3,84,063/-

45

Rs. 22236/-

1950-51

833

Rs. 3,58,990/-

3

Rs. 4674/-


উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও সরকারের এই বৈষম্য বজায় ছিল। বিভিন্ন কলেজে উল্লেখযোগ্য বাঙালী ছাত্রের উপস্থিতি থাকলেও সেখানে মুখপত্রে কোন বাংলা বিভাগে লেখার সুযোগ দেয়া হতো না। অথচ ছাত্রছাত্রীদের নিকট থেকে ম্যাগাজিন ফি রীতিমতই নেয়া হয়।


রাজ্য কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ যখন রাজ্য ভাষা হিসাবে একমাত্র অসমীয়াকেই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন তখন বাঙলাভাষী নেতৃবৃন্দ ও আদিবাসী নেতৃবৃন্দ এর তীব্র বিরোধীতা করেন। সমগ্র প্রদেশ জুড়েই জ্বলে উঠে ভাষা আন্দোলনের বহ্নিশিখা। ডাকা হয় নিখিল আসাম বাঙলা ভাষা সম্মেলন। তখন থেকেই বাসে ট্রেনে স্কুল কলেজে বাঙলাভাষীদের নানাভাবে নির্যাতন করা হতে থাকে। ব্যাপকভাবে শুরু হয় দাঙ্গা-হাঙ্গামা। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে রঞ্জিত বরপুজারী নামে একজন আন্দোলনকারী নিহত হয়। সম্ভবত এই রঞ্জিত বরপুজারীই আসাম ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। সে সময় দাঙ্গায় সরকারী হিসাব মতেই প্রায় ৪০ জন নিহত হয়। এই ভয়াবহ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে অসমীয় বুদ্ধিজীবী শ্রী রনেন্দ্র মোহন দাস মন্তব্য করেছিলেন।” আসামের দাঙ্গা আর এই ভাষা বিল সংখ্যা গরিষ্টতার জোরে সভায় গৃহিত হবে একথা সত্য, কিন্তু এর ফলে রাজ্যের ভাঙ্গন কেই রোধ করতে সক্ষম হবে না। এটাই ইতিহাসের নির্দেশ। এক আসাম রাজ্য ভেঙ্গেঁ ততোধিক রাজ্য গঠনের বীজ কী এখানেই ছিল না?
রাজ্যে ক্ষমতায় কংগ্রেস কেন্দ্রেও তাই কংগ্রেস এই আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে না-এই মনোভাব নিয়ে অনেক কংগ্রেসী নেতাও মুখ্যমন্ত্রীর বহিষ্কারাদেশ উপেক্ষা করে বাঙলা ভাষার পক্ষে আন্দোলনে অংশ নিলেন। ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে এমনকি ভাষার বিভেদ ভুলে গিয়েও অনেকে এক কাতারে দাঁড়ালেন। গোটা রাজ্য তখন বাঙলা ভাষার আন্দোলন টালমাটাল। মিছিলে শ্লোগান উঠছে ”জান দেব জবান দেব না, মোদের গরব মোদের আশা আমরি বাঙলা ভাষা। সবার মুখে মুখে গান ”দুর্গম গিরি কান্তার মরু, চল চল চল, ইত্যাদি। কেন্দ্র ও প্রদেশ কংগ্রেসের নেতার এর সমাধান করতে পারলেন না-তখনই ডাক দেয়া হয় হরতাল কর্মসূচীর।


১৯৬১ সালের ১৯ মে সারা রাজ্য জুড়ে হরতাল ডাকে সংগ্রাম কমিটি। পরবর্ত্তীতে এই ১৯ মে স্বাধীন ভারতের বুকে কলংকের তিলক এঁকে বাংলা ভাষার জন্য এক গৌরবময় ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল।
 

মহাজাগরণের দিন
১৯৬১ সালের ১৯ মে ভোর চারটা থেকেই শুরু হয়ে যায় সত্যাগ্রহ কর্মসূচী। হাজার হাজার সত্যাগ্রহী শিলচর শহরের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিতে আরম্ভ করে। সরকারী অফিস আদালত, ও রেল ষ্টেশানে অনেক আগে থেকেই পুলিশী প্রহরা বসানো হলো। তবে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব পায় রেলষ্টেশনে সত্যাগ্রহীদের অবস্থানের বিষয়টি। সেখানে তারা ছিলো খুবই সংগঠিত। কিছুক্ষন বেশ শান্তিপূর্ণভাবে চলে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় গ্রেফতার করা। বিভিন্ন স্থান থেকে সত্যাগ্রহীদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হতে লাগল। যখন কারাগারে আর ঠাঁই হচ্ছিল না তখন বিভিন্ন স্কুলে তাদেরকে আটকে রাখা হলো। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দও অবশ্য পরিকল্পনা মাফিক একজনকে গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গেই সেই জায়গায় অন্যজনকে বসিয়ে দিত। এক পর্যায়ে কারাগার আর স্কুলগুলোতে সত্যাগ্রহীতে পূর্ণ হয়ে গেলে পুলিশ এক অভিনব পন্থা গ্রহণ করে। সত্যাগ্রহীদের ধরে আন্দোলন স্থল থেকে আট দশ মাইল দূরে নির্জন কোন জায়গায় রেখে আসতে লাগল। পুলিশের গাড়ির পিছনে পুটল সত্যাগ্রহীদের গাড়ী। পুলিশ যেখানেই ছেড়ে দিত সেখান থেকেই সত্যাগ্রহীরা ফিরে এসে আন্দোলনে যোগ দিত। যে সমস্ত স্থানে স্বেচ্ছাসেবকদের পিকেটিং এর কারণে অফিস আদালত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেখানেই পুলিশ নির্মম অত্যাচার চালায়। ” চুলের মুঠি ধরে মহিলাদের তুলে হিচড়ে লাইনের উপরে নিক্ষেপ করা, মাথায় বুট আর বন্দুকের বাটের আঘাত করা, মহিলাদের তলপেটে লাথি মারা” এসবই করেছে সেদিন আসাম পুলিশ রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে। বেলা আনুমানিক আড়াইটার দিকে পুলিশের একটি ট্রাক রেলষ্টেশনে জনতার ভীড়ের মধ্যে এসে দাঁড়ায়। ট্রাক থেকে একজন নেমে এমনবাবে বনেট দেখতে লাগল যেন যান্ত্রিক ক্রটি হয়েছে। অপর দিকে চোখের নিমিষেই পুরু ট্রাকটিতে পুলিশ নিজেরাই পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। আশেপাশের লোকজন বালু কাঁদা আর জল দিযে সেই আগুন নিভিয়েও ফেলে। কিন্তু পুলিশ যেনো এমন একটি ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল। মুহুর্তেই সেখানে বি.এস.এফ এর জোয়ানরা হাজির হয়ে গেরিলা কায়দায় গুলি বর্ষন করতে শুরু করে। আহতদের দ্রুততার সাথে রেডক্রসের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। সমস্ত বুলেটই সেদিন ছোড়াঁ হল সত্যাগ্রহীদের বৃক আর মাথা লক্ষ্য করে। এক সঙ্গে প্রাণ হারানোর নয়জন সত্যাগ্রহী, হাসপাতালে মারা যায় একজন আর একজনের লাশ পরে পাশের একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। আসামের বাঙলা ভাষা আন্দোলনের মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য এই সময় মোট ১১ জন শহীদ হয়। এদের নাম ও পরিচয়-


১. শ্রী শচীন্দ্র মোহন পাল (ছাত্র)
২. শ্রী চন্ডী চরণ সূত্রধর (কাঠ মিস্ত্রী)
৩. শ্রি তরণী দেবনাথ (ব্যবসায়)ী
৪. শ্রী হীতেশ বিশ্বাস (-)
৫. শ্রী কুমুদ দাস (ষ্টলবয়)
৬. শ্রি সুকোমল পুরকায়স্থ (ব্যবসায়ী)
৭. শ্রী সুনীল সরকার (ব্যবসায়ী)
৮. শ্রী কানাইলাল নিয়োগী বেল (কর্মচারী)
৯. কুমারী কমলা ভট্টাচার্য্য (ছাত্রী)
১০. শ্রী সত্যেন্দ্র দেব বেসরকারী (কর্মচারী)
১১. শ্রী ধীরেন্দ্র সূত্রধর (কাঠ মিস্ত্রী)

এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের পর সন্ধ্যায় কার্ফু ডাকা হল শিলচরবাসীর ”শান্তি ও জানমালের নিরাপত্তার জন্য”। এরচে বড় পরিহারেস বিষয় ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী জহরলাল নেহেরু সেদিন শিলচরেই অবস্থান করছিলেন। বিষয়-রবীন্দ্রনাথের জন্ম বার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ ও বাঙলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। সরকারী এই সভায় নেহেরু রবীন্দ্রনাথ ও বাঙলা ভাষা অনেক গুনকীর্তন করলেন কিন্তু বাঙলা ভাষার জন্য সেদিন দুপুরে যারা প্রান দিল তাদের জন্য একটি শব্দও ব্যয় করলেনা। এটি বোধ হয় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নেহেরুর সীমাবদ্ধতা বা স্ববিরোধীতা নয়, গোটা বজুয়া ও পুঁজিবাদী চরিত্রেই মূল বিষয়।
ইতিহাসের এই বর্বর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সমগ্র ভারত বর্ষেই নিন্দার ঝড় ওঠে। বামপন্থীরা একে উগ্র জাতীয়তাবাদের নগ্ন আস্ফালন হিসাবে চিহ্নিত করে বলেন- ”আসাম সরকারের সংকীর্ণ প্রাদেশীকতাবাদ কেন্দ্রের প্রশ্রয়েই এমন চরম সীমায় পৌছেছে। এর একমাত্র হলো উগ্র জাতীয়তাবাদকে জিইয়ে রেখে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা…যেহেতু বাঙালীরা প্রগতিবাদী চিন্তার অধিকারী সেই কারণে কংগ্রেস নেতৃত্ব বাঙালী জাতি সম্নন্ধে আতংক বোধ করে।


নেহেরু সরকার থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভাষা বিরোধের কোন নিস্পত্তি হয়নি। বরং কখনো কখনো তা অসমীয়া বাঙালী দাঙ্গায় পরিণত হয়। বাঙালীরা সেখানে নির্যাতিত হয়। ১৯৬১ সালের পর ১৯৭২ সালে এবং ১৯৮৬ সালে পুনরায় দু’জন করে আরো চারজনকে মাতৃভাষার জন্য জীবন দিতে হয়। আসামে এই পর্যন্ত সর্বমোট ১৫ জন মাতৃভাষার আন্দোলনের জীবন উৎসর্গ করেছে। ইতিহাসের এই গর্বিত অধ্যায় বাঙালা ভাষার জন্য নিঃসন্দেহে মাইল ফলক। বাংলাদেশের একুশে ফেব্র“য়ারী আর ভারতের ১৯ শে মে, ১৭ই আগষ্ট, একুশে জুলাই এর ইতিহাস একসাথে পাশাপাশি বহমান থাকবে এটাই প্রতিটি বাঙালীর কাম্য।
”কিন্তু ভারতে এই প্রজন্মের পশ্চিমবঙ্গের বহু বাঙালী জানেন না যে বরাক উপত্যকার বাঙালী ভাষার অধিকারের জন্য রক্তম্লান করেছে। পশ্চিমবঙ্গে ঊনিশে মে আসে যায়। কোন সভা হয় না ” বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী শোভন সোমের অভিযোগ যেকোন সচেতন মানুষকেই ভাবাবে। মাতৃভাষার মুল সত্তা অভিন্ন। এই অভিন্ন সত্তার ইতিহাস ঐতিহ্যকে তুলে ধরার দায়িত্বকে কেউই এড়িয়ে যেতে পারেন না। আমরা চাই, একুশে ফেব্র“য়ারীক পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা যে শ্রদ্ধার সাথে পালন করে ঠিক একই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করুন। আমাদের বাঙলা ভাষা আন্দোলনের শহীদেরও। তা না হলে সেটি হবে অন্যায় ও অবহেলা। যে অভিযোগ এখনই করছেন কেউ কেউ ” পশ্চিমবঙ্গের আবেগে জবজব বাঙালীরা একুশে ফেব্র“য়ারীর স্মরণে সভা সমিতি শুরু করলেন। একুমের নামে নানা সংসদ, নানা প্রতিষ্ঠান, গজিয়ে উঠতে লাগল। গলার শিরা ফুলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী চিৎকার করে একুমের শহীদের শ্রদ্ধা জানাতে লাগলেন। তা জানান। জানানো উচিত। কিন্তু তারা ভূলে গেলেন যে এই ভারতেই বঙ্গভাষি অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষে মাতৃভাষার অধিকার দাবী করে এগারোজন ভারতীয় বাঙালী তরুন তরুনী আত্মেৎসর্গ করে গেছেন যাতে পরবর্ত্তী প্রজন্মের কন্ঠ থেকে মাতৃভাষার অধিকার কেই কেড়ে নিতে না পারে। রবীন্দ্র সদনের সামনে ঢাকার শহীদের স্মরনে ফলক বসানো হল, শিলচরের শহীদের নামোচ্চারণ ও কেউ করলেন না”।


এই অবস্থার অবসনে হোক।
 

জয় হোক বাঙলা ভাষার


তথ্য নির্দেশ
১. বরাক উপাত্যকার ভাষা আন্দোলন-সুধীর কর
২. সাংস্কৃতিক –সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়
৩. অনুষ্টুপ শারদীয় সংখ্যা ১৪০৮ কলকাতা
৪. একবিংশ দশম পুর্তি সংখ্যা-ঢাকা।

 


রানা রায়।