কে যেন বলেছিলেন, জনাবা । মনে নেই । উত্তরে স্যার বলেছিলেন, অশ্লীল শব্দটি অবলীলায় বাংলার শিক্ষিত মুসলমানরা ব্যবহার করে যাচ্ছে । জেনে-বুঝে, বলা-মানার কোন আগ্রহ নেই।
আমিও এর মানে জানতাম না। জানতাম, জনাব এর স্ত্রীলিংগ জনাবা।
ভাবতাম, শব্দটি যেহেতু আরব থেকে আগত, তাই এটিও একটি পবিত্র শব্দ। আর সম্পর্কটা যেহেতু জনাবের সাথে, পবিত্র না হয়ে উপায় নেই।
“ইসলাম টিকে আছে ইতরদের মধ্যে । “ – শুরু হয়ে গেল চিৎকার। ইতর শব্দটির জানা থাকলে, এতটা বাড়াবাড়ি হত কিনা সন্দেহ ছিল । বাড়াবাড়িটা এমন পর্য্যায়ে গেল; ফাঁসির দাবী জানিয়ে পোস্টার লাগিয়ে দেয়া হল অলিতে গোলীতে।
ঘটনার পেছনে ঘটনা হল, ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ ১৯৮৭ সনের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত পুস্তকটির সম্পাদক মণ্ডলীতে ছিলেন, ড আহমদ শরীফ, কাজী নুর-উজ্জামান এবং শাহরিয়ার কবির, প্রকাশ করেছিল, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র’। বইটি প্রকাশ হবার পরপরই বাজার থেকে উধাও হয়ে যেত। তখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল, প্রকাশের পরপরই জামাত বাজার থেকে বইগুলো কিনে, সরিয়ে ফেলত। তাদের অর্থবল ছিল, তাই বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণও ছিল।
তারপরের ঘটনা ১৯৯২ সনের মার্চে অনুষ্ঠিত গণ আদালত। সবাই জানেন, সেই আদালতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন আহমদ শরীফ। রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগ এনে, বিএনপি , দেশ বরেণ্য ২৪ জন অগ্রসর চিন্তক, লেখকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে দিল।
জামাত ক্ষেপে ছিল । ১৯৯২ সনের ২১ শে অক্টোবের ‘স্বদেশ চিন্তা সংঘ’ কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে, বলা, ‘ইতর’ শব্দটির অর্থ না জেনেই, ঝাঁপিয়ে পড়ল। ধর্ম্ম নিয়ে , ধর্ম্মের পক্ষে শয়তানও যদিও কথা বলে, ভাল মানুষগুলোও তখন বশ হয়ে যায়।
ঠিক সে সময় মান্যবর বদরুদ্দীন উমর লিখলেন, ‘নাস্তিকতার আস্ফালন’, ছাপা হয়েছিল কোন একটি ( সম্ভবত ‘আজকের কাগজ’ ) দৈনিক পত্রিকায়। আমাদের কানে এসেছিল, নিজামউদ্দীন সেই সংখ্যাটি সংসদে জমা দিয়ে, বিচার চেয়েছিলেন। এ নিয়ে নিশ্চয়ই উমর ভাই লিখতে পারতেন, কিন্তু সেই সময়, সে লেখাটির জন্য আমরা খুব ব্যথিত হয়েছিলাম।
স্যার বিকালে সহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানে হাঁটতে যেতেন বিকালে, সেই হাঁটাও বন্ধ হয়ে গেল। কেউ কেউ স্যারকে উপদেশ দিলেন, পালিয়ে অন্য কোন দেশে চলে যেতে। খুব রেগে গিয়েছিলেন তিনি। কথাটা কে বলেছিলেন, মনে নেই। মনে আছে, স্যার দাঁড়িয়ে গিয়ে, মেঝেতে পা ঠুঁকে বলছিলেন, আমি এই মাটিতে থাকব। আমার নিরাপত্তার দায় রাষ্ট্রের। আমরা জানতাম, রাষ্ট্র দায় নেবে না। স্যারও জানতেন।
ননী দত্ত ( সাবেক অধ্যাপক নডরডেম কলেজ ) / অজয় দত্তকে ( এই নামে লিখতেন ) , ( প্রকাশ্যে নাজমুল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, সাম্যবাদী দল ) স্যারকে ( উনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন, তাই স্যার সম্বোধন করতাম ) অনুরোধ করলাম, শুক্রবারের আড্ডায়, শরীফ স্যারের বাসায় যেতে । উদ্দেশ্য ছিল, একটা বিবৃতি আদায় । আমি জানতাম, তর্ক করে কারও সাথে পারব না । তাই ননী দত্ত স্যারের আশ্রয় নেই । উনি রাজী হলেন । হ্যাঁ, প্রায় দুই ঘন্টা বিতর্ক করার পর সবাই রাজী হলেন, একটা বিবৃতি দিতে । বিরুদ্ধ মত ছিল, এখন বিবৃতি দিলে আগুনে ঘি ঢালা হবে । ননী দত্ত স্যারের তর্কের সারবস্তু ছিল, প্রতিরোধ , তা ক্ষুদ্র হোক না কেন, শত্রুর মনে কিছুটা হলেও ভীতি সঞ্চার করবে। কার কার সাক্ষর সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম, সবার নাম মনে ছিল না । আব্দুল মতিন খান, আজিজ মেহেরের সাক্ষর সংগ্রহ করে, মনে আছে, আবুল কাশেম ফজলুল হক স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম, উনি সাক্ষর দিয়ে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন টিএসসিতে । ওখান থেকে বেরিয়ে আসার পর দেখা হয়েছিল , বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলনের কল্লোল দার সাথে । বলার সাথে সাথে সাক্ষর দিয়ে দিলেন । তালিকাটা পেয়ে গেলাম, সুব্রত শুভর লেখায়। (বিবৃতি-দাতারা হচ্ছেন-বশীর আল হেলাল, অধ্যাপক মনসুর মুসা, ড. সাঈদ উর রহমান, অধ্যাপক আবুল কাশেম, ফজলুল হক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, আবদুল মতিন খান, ড. নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস, আজিজ মেহের, আব্দুল মান্না, শফিকুল হক স্বপন, অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, মুহম্মদ হাবিবুল্লাহ, খ ম আব্দুল আউয়াল, কল্লোল রায়, ও ইসরাইল খান।) সাম্যবাদী দলের কেন্দ্রীয় সদস্য নাজমুল হোসেন এক প্রতিবাদে বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিটিকে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্যেই ড. আহমদ শরীফের বক্তব্যকে বিকৃত করে ছাপা হয়েছে। সন্ধ্যার আগেই কোনরকম পত্রিকা অফিসে পৌঁছে দিয়েছিলাম সেই বিবৃতি । কোন কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, মনে নেই ।
পরিস্থিতি যখন এইরকম, তখন তিনি যাবেন, সেমিনারে বক্তব্য রাখতে। কে রুখে?
আব্দুল মান্নান ভাই, পেশায় আইনজীবী, বললেন, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। স্যারকে জানানো যাবে না ।
সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে শরীরের যেসব অঙ্গহানি হয়েছিল, চোখ ছিল, তাদের মধ্যে প্রধানতম। ঘণ্টা কয়েকের জন্য কন্ট্যাক্ট ল্যান্স ব্যবহার করতে পারতাম। তাই দিয়ে কোনরকম কাজ চালিয়ে নিতাম।
মাসুদকে গিয়ে বললাম সব। এক সময় ওকে পড়াতাম। তারপর আমাদের সাংগঠনিক কাজ-কর্ম্মে জড়িয়ে যায় ও । মাসুদ তার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে এসেছিল। মান্নান ভাই আর আমার সাথে , স্কুটারের আগে পিছে ছিল ওরা। পরে জেনেছি, মাসুদের যে ক’জন বন্ধু এসেছিল, তারা ছিল এলাকার ক্ষুদে মাস্তান। তারা নিজ জীবনের বিনিময়ে স্যারকে রক্ষা করবে, এ রকম অঙ্গীকার নিয়েই এসেছিল।
আল্ল-ভগবান-ঈশ্বরে আস্থা-বিশ্বাস না থাকলেও; আস্থা ছিল মানুষের উপর।
ঘর থেকে বের হব, এমন সময় ফটকের সামনে ছালার চট পরিহিত দীর্ঘদেহী, শ্মশ্রুমণ্ডিত , শ্যামবর্ণের এক ফকির দাঁড়িয়ে। জানতে চাইলেন, এটা ড আহমদ শরীফ স্যারের বাসা কিনা?
স্যার নিজেই এগিয়ে গিয়ে বললেন, আমিই আহমদ শরীফ।
আপনার সাথে কথা বলতে চাই।
আমি এখন একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন। আমি চানাস্তা দিতে বলি।
আমরা কিছুটা সতর্ক হয়েই ছিলাম। স্যার কথা বলছিলেন, খুব স্বাভাবিকভাবে। ফকিরকে ভেতরে বসিয়ে, চানাস্তার কথা বলে , তবেই বের হলেন।
সেমিনার কারা আয়োজন করেছিল, মনে নেই। খুব সম্ভবত মহসিন শস্ত্রপাণি ভাই স্যারকে অভ্যর্থনা জানিয়ে, টিএসসির সেমিনার কক্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন।
খুব সম্ভবত স্যারের কোন একজন ছাত্র, যিনি কিনা, সংসদ সদস্য স্যারকে ফোনে বলেছিলেন, ‘ইতর’ শব্দটি ব্যবহার না করলেই ভাল হত। স্যারের ভাষাজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন! ইতর শব্দটির অর্থ বলে দেবার পর , পরিস্থিতি কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে । (স্মৃতি নির্ভর )