১.

-হ্যালো আমি অভিজিৎ বলছি, মুক্তমনার। আপনার ই-মেইল দেখে কলব্যাক করলাম।

-ইয ইট, রিয়েলি, ইয ইট রিয়েলি ইউ অভিজিৎ রয়?

অভিজিৎ রায়’এর ফোন পেয়ে আমি উত্তেজিত, বললাম, আমি তো মডারেটরকে ই-মেইল, ওহ আপনাদের দুজনকেই মনে হয় এড্রেস করেছিলাম। কলব্যাক করবার জন্য ধন্যবাদ। সো নাইস অফ ইউ।

তদন্তের ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা অভিজিতের, আরো কি কোন হুমকি পেয়েছেন নাকি?

-নাহ, ওই একটাই, টেক্সট, আমার ফোনে কি করে এলো বুঝতে পারছি না; লোকাল কেউ। আমাকে চেনে; সন্দেহ নেই। জানতে চাচ্ছি আপনারাও কি প্রাণনাশের এমন হুমকি টুমকি পান নাকি?

-চিন্তা করবেন না , বাদ দেন এসব। ভয় পেলে লোকাল পুলিশে জানাতে পারেন, ইচ্ছা আপনার। বলেন যে প্রগতিশীল লেখা লেখেন; হুমকি পেয়েছেন। এসব কিছু না মনে হয়। চিন্তা করবেন না। এদেশে এসব হুমকি হাস্যকর। আরো লেখেন। আরো বেশি করে লেখেন।

-উমমম, আচ্ছা।

-চিন্তা করেন না।

-আচ্ছা।

অভিজিৎ একটু থেমে বললো, ফোন নম্বরটা রইলো; দরকার হলে ফোন করবেন। আরো লিখুন।

বললাম, আচ্ছা; ঠিক আছে। নাইস টকিং টু ইউ। ভালো থাকুন।

-আপনিও; ঠিক আছে; বাই তা’হলে।

-শিওর; বাই নাও।

অগাষ্ট ২০১১ তে এই প্রথম কথা হল অভিজিৎ’এর সাথে। ২০০৩ এর দিকে ওর নাম প্রথম দেখি বিপ্লব পালের একটা পিডিএফ লেখায়; ক্যালিফোর্নিয়াতে, ভিন্নমত নামে একটা অনলাইন ওয়েবে। বিপ্লব তখন ঈশ্বর ফীস্বর, বিবেকানন্দ, ধর্ম দর্শন এসব নিয়ে যুক্তি ও খন্ডন নিয়ে কিছু একটা লিখছিলো সে ভিন্নমতে। অভিজিতের নাম সেখানেই দেখলাম। আমি জানতামও না লস এঞ্জেলেস ভিন্নমতের সেই ৮ পাতার ছোট্ট খবরের কাগজের আবার একটা অনলাইন ভার্সন আছে। একটু কৌতূহলে, একটু গোলেমালে নাক ডোবালাম। লেখাগুলো ফলো করা শুরু করলাম। প্রথমে বুঝতেও পারিনি বাংলায় লেখা এইসব কোত্থেকে আসছে? ভিন্নমতের কুদ্দুস খানকে জিজ্ঞেস করতেই বিপ্লবের কালভার সিটির নম্বর পাওয়া গেলো। বললো এটা বিপ্লবের আইডিয়া। একবার ফোনও দিলাম ওকে। সেই সময় বিপ্লব পাল’ও বেশ বাউন্ডারী পেটাচ্ছে। অভিজিৎ আর মুক্তমনার’ও খবর পেলাম এইসব করতে করতেই। যতই দেখি ততই অবাক হই। বাংলাদেশের ছেলে অভিজিৎ, কোলকাতার বিপ্লব, মুক্তমনার জাহেদ এদের সবাইকে ওয়েবে দেখছি; অবাক হচ্ছি। বাংলায় কি সব লিখে চলেছে ওরা। বন্যার কথাও ওই সবেই পেয়েছি পরে। ভাবলাম এসব কি হচ্ছে? কি দারুণ ব্যপার। আমরা বইটই ধার করে, সারাদিন লাইব্রেরী দৌড়ে, নানান দেশী বিদেশী বাম ডান ঘেঁটে, বেশ একটা ভাবসাব ধরে যেসব জানতে চেয়েছিলাম ক বছর আগে; সেই সব কথাবার্তা কি অবলীলায়, কি দারুণ স্বাছন্দে, কি সব রেফারেন্স টেফারেন্স দিয়ে, সহজ অথচ বলিষ্ঠ ভাবে অভিজিৎ’রা লিখে যাচ্ছে। রীতিমত ঈর্ষনীয় ভঙ্গী তাদের যুক্তি তর্কে। কি সাঙ্ঘাতিক। কি চমৎকার। একাই ফলো করতে থাকলাম ওদের সেই থেকেই। সাথে কেউ নেই। যেখানে যা পাচ্ছি ওদের লেখা, পড়ে ফেলছি আর অবাক হচ্ছি। আমার নিজের অস্পষ্টতাও বেশ কেটে যাচ্ছে। মজা পাচ্ছি।

এত নামের মধ্যে বারবার যে নামটা কেন্দ্রবিন্দুতে উচ্চারিত হচ্ছে; সেটা অভিজিৎ রায়। তার বেশ পরে জেনেছি ছেলেটা কোথাকার কে। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি প্রতিবার; দেশের ছেলে মেয়েরা এত সহজে এইসব মুক্তচিন্তা প্রকাশ করতে পারছে? আমি প্রবল উত্তেজিত; আমি উদ্বেলিত ও উল্লসিত। দারুন। ভাবলাম এদের পেছু ছাড়বো না, এরা পড়ুয়া, আমি আলসে। রেডিমেড লেখাগুলো গপাগপ যা পাচ্ছি তা’ই গিলে নিচ্ছি। কষ্ট করে পড়ে লিখছে ওরা, আর আমি পেয়ে যাচ্ছি অনায়াসে, বিনে পয়সায়। ধর্ম নিয়ে আমার বিশেষ জিজ্ঞাসাগুলোর সূত্র বা উত্তরও পেয়ে যাচ্ছি অনন্ত বিজয়, সৈকত, আবুল কাশেম; আকাশ মালিকদের লেখায়। আসিফ না কে যেন দারুন কাব্যিক বিজ্ঞান লিখছে; বিপ্লবও লিখছে মারকাট টাইপ যুক্তিতর্ক। অভিজিৎ লিখছে সবকিছুই। মুক্তমনা শুরু, ফরিদ আহমেদের মডারেশন ও লেখা দেখছি, অথচ সবকিছু ছাপিয়ে অভিজিৎ কেন্দ্রেই রয়েছে। বুঝে গেলাম এই ছেলেটাই আসলে মধ্যমণি।

দ্বিতীয় মোখ্তাসার পোস্টে দেবার পরদিন অভিজিৎ ফোন করলো আবার, আপনার মোখ্তাসার ২ কিন্তু দারুন। খুব ভালো। একেবারে লিখতেই থাকেন।

-আচ্ছা, পরেরটাও দিচ্ছি শিগগিরই।

-হ্যা, খুব করে, ছাড়াছাড়ি নাই, কিন্তু।

-ঠিক আছে, ভালো থাকুন অভিজিৎ।

লিখে ফেললাম। মোখ্তাসার ৩, , কোথা থেকে এলো আজকের কোরান, হিজাবি মেয়ে বেহেস্তী সূখ, আল মূত্যাজিয়া, আবজাব, লাকুম দ্বীনিকুম ওয়ালিয়াদ্বীন ইত্যাদি আরো কিছু জ্বালাময়ী লেখা। সবগুলোই অভিজিৎ’এর উৎসাহে। অথচ এক সময় এসব লেখার গতি কমিয়ে দিলাম হঠাৎ। নিরুৎসাহিত করার মানুষ আশেপাশেই ছিলো তাই আমিও কখনো কবি আবার কখনো নবী মোডে। এখন থাক না’হয় সেটা।

মুক্তমনায় গোলমেলে কিছু দেখলে, অস্বস্থি লাগলেই ই-মেইল করতাম অভিকে। উত্তর পেতাম ই-মেইল বা ফোনে। এত সবের মধ্যে ফ্রান্কেনস্টাইন হেফাজতিদের খেল হয়ে গেল। আমিই ফোন করলাম অভিজিৎকে।

-এইসব হেফাজতি গ্যান্জামের মধ্যে দেশে যাওয়া; কি ব্যপার অভিজিৎ?

-নাহ, অসুবিধা নেই। সব ঠিক আছে।

-তারপর এই যে বইমেলাতে যান টান, খুব চিন্তা লাগে অভিজিৎ।

-হা হা, এই সব কিচ্ছু না, বাদ দেন কাজী’দা।

ঠিক ওই সময়টার আশপাশেই মুক্তমনায় বা অনলাইনে কোথাও দেখছি না অভিজিৎ’কে দেখছি না। ফরিদকে আর আরো দুচারজনকে জিজ্ঞেস করলাম। কেউ জানেনা। ই-মেইল করে করে উত্তর পেলাম অভিজিৎ’এর কাছ থেকে, স্বপরিবারে বিশ্বকাপ এবং পেরু ভ্রমণে রয়েছে সে। মহানন্দেই আছে সে। দুশ্চিন্তা কমলো।

নানান গুজব টুজব, আসিফ, হেফাজত, শাহবাগ আন্দোলন, থাবা হত্যা; খুব খুবই খারাপ সময় শুরু হয়ে গেল। অভিজিৎ জানালো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুক্তমনাদের পক্ষে জনমত তৈরিতে সে ব্যস্ত। আমাকেও বললো অন্তত ক্যালিফোর্নিয়াতে মূলধারার সাথে যেন কাজ করি। বললাম করছি।

২.

সেদিন বেরুতে একটু দেরিই হয়ে গেল। প্রায় ন’টাই হয়েছে। রওয়ানা হয়ে গেলাম কাজে। হঠাৎ চোখের কোনায় ধরা পড়লো ড্রাইভওয়েতে বুলবুলি ছুটে বেরিয়ে এসেছে; পাগলের মত হাত নেড়ে থামতে বলছে আমায়। এমন ঘটেনি কখনো। এই সময়টাতে জমিয়ে বাংলাদেশের টেলিভিশন দেখে সে। দ্রুত ফিরে এলাম। অস্থির হয়ে আমাকে টেনেটুনে নিয়ে গেল ঘরে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠলো, ‘অভিজিৎ কোথায় বলো তো। অভিজিৎ কি দেশে? অভিজিৎ শেষ, ওরা ওকে মেরে ফেলেছে; দেখো দেখো ‘ । লিভিংরুমে দাঁড়িয়ে নিমিষেই পাথর হয়ে গেলাম; স্ক্রলে দেখাচ্ছে কিছুক্ষণ আগে কারা যেন অভিজিতৎ’কে গুরুতর জখম করেছে, রাফিদা আহমেদ (বন্যা) ও গুরুতর আহত। কয়েক মিনিটেই জানা গেলো আর কিছু বাকি নেই।

৩.

ই মেইল ভয়েস মেইলের উত্তরও হবে না আর। অভিজিৎ আর বলবে না কাজী’দা মোখ্তাসারের মত লিখেন না কেন আর? আপাতত এইসব কাব্য কবিতা বাদ দিয়ে ওইসব জমজমাট লেখা দেন। আমরা দুজন বই বের করবো কিন্তু। প্লিজ লেখেন। এখন অন্য কবিতা থাক; আসেন বই বের করি।

৪.

আরেকটা অভিজিৎ কখনো হবে না আর। ওর চেয়ে বেশি ভালো বা কাছাকাছি ভালো হয়ত আর কেউ হবে, আরেকটা অভিজিৎ আর হবে না। অনেকগুলো টুকরো এদিক সেদিক ছড়িয়েই থাকবে। একসাথে করতে পারা যাবে না আর। কোলাজ ই হবে, একাট্টা হয়ে অভিজিৎ হবে না আর।

৫.

অভিজিৎ খুব সহজ ভাষায় মুক্তমনে লিখতো বলেই হয়ত প্রিঅকুপাইড ভাবনার মানুষের কাছে সে ভাষা ভিনগ্রহের। তবু আশা করছি হিংস্র বর্বর যারা তারাও হয়ত একদিন ভালবাসতে শিখবে। মেনে নেবে চিৎকারে;

ইউরেকা

ওদের মনে হবে আমরা ভিনগ্রহের ভাষায় বলছি,
যেখানে বর্ণমালা ব্যাকরণ যেন অদ্ভুত এক দীর্ঘশ্বাস;
বিন্যাস শর্তহীন, একাকার কাঠামো, অনুভবটাই ভাষা,
হয়তো, একদিন, ওরা ইউরেকা চিৎকারে মেনে নেবে।

ভেবোনা। ভেবোনা একদম।
গ্রহান্তরের আগন্তকের মতো,
আবছা মতো;
আছে কিন্তু নেই এর মত,
অধরার মতো,
নাটোরের বনলতার মত,
জীবনের ভালবাসার মতো,
অন্যরকম একটা কিছুর মত,
দৃশ্যমান সত্যির মতো,
বন্ধুর মত,
একটু উষ্ণতার মত,
ওরা,
ওরা ঠিক একদিন একাকার হবে।

ভেবোনা।

বুঝতে শিখবে।

একটুও ভেবোনা।

ওরাও ভালবাসতে শিখবে।