লেখকঃ মাহমুদুল হাসান
সাম্যের স্বপ্ন মনে নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়েছিলাম। রাজনীতির অনেক পাঠের মধ্যে অন্যতম ছিল ব্যক্তি কেন রাজনীতি করবে। বীরশ্রেষ্ঠ হওয়ার জন্য? সুপারম্যান হওয়ার জন্য? এক্ষেত্রে রাজনীতির পাঠ ছিল, রাজনীতি করে যেতে হবে নিজেরই জন্য। কারণ বর্তমান ব্যবস্থায় জনস্বার্থে নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়ার চেয়ে জনস্বার্থের সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থ এক করাই রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার কার্যকর উপায়। অর্থাৎ একা ভাল থাকা সম্ভব না, তাই সকলকে নিয়ে ভাল থাকার চেষ্টা, সকলের সঙ্গে মিলে ভাল থাকার জন্য অনুকূল সমাজ গঠনের চেষ্টা থেকেই সঠিক রাজনীতি করে যাওয়া, এইই বুঝেছিলাম। বিষয়টা ভুল মনে হয় না। এসব কেন লিখলাম তা পরে ব্যাখ্যা করব। নির্দিষ্টভাবে রাজনীতি নিয়ে লিখতে বসিনি, লিখছি নাস্তিক ব্লগারদের নিয়ে। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে নানা কারণে তাদের একাংশের ইউরোপে আশ্রয় নেওয়া নিয়ে।
‘নাস্তিক ব্লগার’ শব্দদুটি আমার কাছে গালি নয়, আশা করি নাস্তিক ব্লগাররাও এই সম্বোধনকে গালি হিসেবে নেন না। ‘নাস্তিক ব্লগার’ কথাটা এখানে হাটহাজারীয় মাইন্ডসেটে ব্যবহার করব না। আমি এর দ্বারা নাস্তিকতার চর্চাকারী ব্লগারদের কথাই বলছি এবং শব্দদুটো মিন করছি। আমি এখানে ইউরোপে আশ্রয় গ্রহণকারী নাস্তিক ব্লগারদের ‘দালালী’ করব এবং তাদের সঙ্গে কিছু ‘শলাপরামর্শ’ করব।
না, আমার আলোচনা শুধুমাত্র নাস্তিক ব্লগারদের ইউরোপে আশ্রয় নেওয়া নিয়ে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হবে না, সম্ভব হয়ও না। লেজে লেজে অনেক বিষয় এসে যায়। নাস্তিক ব্লগারদের তো আর দোষের অভাব নেই! তাদের অন্যতম দোষ তারা শুধুই ধর্মের বিরুদ্ধে লেখে। সম্প্রতি বিডিনিউজ২৪ডটকমে প্রয়াত অভিজিৎ রায়ের সহযাত্রী বন্যা আহমেদের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, সেখানেও শুধুমাত্র ধর্মের বিরুদ্ধে লেখার বিষয়টি এসেছে। বন্যা আহমেদ তার লেখায় আরও বলেছেন, “এরা সবাই তাদের ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, বুঝে বা না বুঝে শুধু তাদের সুবিধামতো সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে চান। কারণ সার্বিক বিশ্লেষণে গেলেই তো ঝক্কির শেষ নেই। দায়িত্ব এড়ানো বড্ড কঠিন হয়ে যায়।” কথাগুলোর মধ্যে “এরা” শব্দটি দিয়ে তিনি শুধুমাত্র নাস্তিক ব্লগারদেরই বোঝান নি, তবে কথাগুলো নাস্তিকদের একাংশকে উদ্দেশ্য করেও বলা বলে আমার কাছে মনে হয়েছে, কাজেই তাদের ‘দালাল’ হিসেবে এবং আমার নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত হওয়ায় তার আলোকে আমি এটুকুই বলতে পারি যে, আমাদের কারও পক্ষেই হয়তো সার্বিক বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। কাছের উদাহরণ দিয়েই বলছি, ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সার্বিক বিশ্লেষণ কী দাড়াতে পারে? পাকিস্তানী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ দাঁড়ায়, এটা ভারতের পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র, ভারতের বিশ্লেষকদের কেউ বলবে বাংলাদেশি শরণার্থীদের চাপে তারা বাধ্য হয়েছিল মিত্রবাহিনীকে প্রেরণে, কেউ আবার বলবে পাকিস্তানের পূর্ব ফ্রন্টকে বিলুপ্ত করার মধ্য দিয়ে ভারত নিরাপদ হয়েছে, বাংলাদেশেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণ রয়েছে কেউ বলবে এটি ছিল আমাদের স্বাধিকারের সংগ্রাম, পাকিস্তানী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, কেউ এখানে দেখেছে দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মুক্তিযুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’ বলে পছন্দ করে। প্রতিটি আলাদা দৃষ্টিভঙ্গির ধারণকারী তার দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে যুক্তি হাজির করতে পারেন। তাহলে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ কী দাঁড়ায়? আমাদের মস্কোপন্থী মার্ক্সবাদীদের কাছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ একরকম, চীনপন্থী মার্ক্সবাদীদের কাছে এটি অন্যরকম। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের একরকম ব্যাখ্যা দেয়, আ.লীগ দেয় অন্যরকম ব্যাখ্যা। সার্বিক বিশ্লেষণ কিভাবে সম্ভব? সম্ভব যদি এরকম প্রতিটি ব্যাখ্যা-যুক্তি জানা সম্ভব হয় এবং তার আলোকে বিশ্লেষণ দাঁড় করানো যায়।
কিন্তু আমরা কেউই সবজান্তা নই। পড়ার জানার আগ্রহ থেকে একটু বেশি পড়ি বলেই পুরোটাই জানার বাধ্যবাধকতা আমাকে কেউ দেয়নি। আমার জানার ভাল লাগার সীমা থাকতে পারে, আমি কতটুকু জানব এবং তা নিয়ে কতটুকু কথা বলব, কতটুকু পালন করব, কতটুকু সক্রিয় হব তা আমি ঠিক করব, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার কার্যকলাপ কারোর জীবনে সত্যিকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ক্ষতি না আনে।
আমার ব্যক্তিগত মত হল, কারো বিশ্লেষণ আংশিক হতে পারে, তা আংশিক সত্য তুলে ধরতে পারে। কিন্তু তা ভুল কিনা সেটা দেখার বিষয়। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের গণহত্যার ইতিহাসকে গৌন করে কেউ যদি যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বন্দ্বকে মুখ্য করে তুলতে ‘সাম্রাজ্যবাদ সাম্রাজ্যবাদ’ বলে চ্যাঁচায় তাহলে তাকে আমি সঠিক বিশ্লেষণ বলতে পারি না। সঠিকতার সংজ্ঞাও স্থান-কাল-পাত্রের উপর নির্ভরশীল, এও মাথায় রাখতে হবে।
আমি মনে করি আজকের বিশ্বজুড়ে যে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, সেখানে ধর্ম কাজ করে চলেছে সাম্রাজ্যবাদের ঢাল হিসেবে। তাই ধর্মকে পরাজিত না করে সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করা সম্ভব বলে আমি মনে করি না। তাই যারা সাম্রাজ্যবাদকে একমাত্র সমস্যা দেখিয়ে সামনে আনেন তাদের সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।
নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে এদেশীয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধীদের (সকলে নয়, উপরোক্ত ক্যাটাগরির) এবং অনেকের উপরোক্ত অভিযোগ তলিয়ে দেখলে ভয়ংকর সব বিষয় চলে আসে। অভিযোগগুলো এরকম: আমরা নাস্তিকরা এমন একটা বিষয় (ধর্ম) নিয়ে কথা বলছি, বর্তমানে যা নিয়ে আলোচনার নাকি আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই! তাদের মতে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এই বিষয়টি ‘খুঁচিয়ে তুলে’ আমরা দেশের মানুষদের বিভক্ত করছি, বিশ্বের সামনে দেশের মানুষদের ভুলভাবে উপস্থাপন করছি, নিকট ভবিষ্যতে যা দেশকে ভয়াবহ পরিনতির দিকে নিয়ে যাবে! এসব ভয়াবহ পরিনতির মধ্যে গৃহযুদ্ধ এবং সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কথা রয়েছে।
আমি খুব জানি, এমন দাবি করতে পারি না। তবে যতটুকু জানি তার ভিত্তিতে এসব অভিযোগ বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করছি। সিলেটের চটকছড়া গ্রামের ২১ বছর বয়সী নুরজাহানকে ১৯৯৩ সালে ফতোয়াবাজরা মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করার ঘটনাকে এই শান্তিকামী তথাকথিত ‘বৃহত্তর ঐক্যের’ সন্ধানীরা কি প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যা করবে আমি জানি না। সেসময় তো আসিফ মহিউদ্দীন ছিলেন না, অভিজিৎ রায় ছিলেন না, মুক্তমনা ব্লগ ফেসবুকও ছিল না। তাহলে? ‘তারা’ বলেন আমরা নাকি নাস্তিকেরা নাস্তিকতার চর্চা করছি ইউরোপের অনুকরণে, রিচার্ড ডকিন্সের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী। কিন্তু ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে ফতোয়াবাজি আর পাথর ছুঁড়ে মানুষ হত্যা কোন সংস্কৃতি থেকে এসেছে তার ব্যাখ্যা ‘তাদের’ কাছে পাওয়া যাবে কি? বাংলাদেশে নারী নীতি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি কোন সংস্কৃতির ধারকবাহকদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধে? “আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান” এই স্লোগানের স্রষ্টা কোন মাস্টারমাইন্ড, হুমায়ুন আজাদ নাকি আহমেদ শরীফ?
কিসের ভিত্তিতে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ দেখতে চান ‘তারা’? আমরা নাস্তিকেরা যে ধর্মীয় নিপীড়ন কুআচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি সেই ধর্মের ভিত্তিতে? এ কি ঐক্য, নাকি ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদের প্রতি গণদাসত্ব?
নাস্তিকেরা বিভক্তি সৃষ্টি করেছে, নাস্তিকেরা? ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে বন্ধু না বানানোর কথা কথা কোথায় আছে? ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করার ঐশী আদেশ কোথায় আছে? কোনো মানুষকে দেবতুল্য বানানো আর কোনো মানুষকে মানবেতর বানানো কাদের সংস্কৃতি? নারীদেরকে হেয় করার প্রাচীনতম ধারা কোথা থেকে এসেছে? নাস্তিকতা থেকে? ধর্মের নামে মানুষের সঙ্গে যখন এসব অনাচার চলে তখন কিছু হয় না, আর এসব নির্মূল করতে বললেই ‘বিভক্তি’! বাহ! বাহ!
কার বয়স বেশি, ধর্মের নাকি নাস্তিকতার? ধর্ম আসার পরেই তো এতে বা এর কল্পিত ঈশ্বরে বিশ্বাস করা না করার প্রশ্ন এসেছে। নির্দিষ্ট স্থান-কালের নীতি-নৈতিকতাগুলোকে আত্মীকরণ করে তারই সঙ্গে নানা আচার যুক্ত করে সৃষ্ট ধর্মকে চালিয়ে দেওয়া হয় শ্বাশত বা পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে। ধর্ম কী? ‘তারা’ বলবেন: আমাদের সংস্কৃতিই আমাদের ধর্ম… আরবের ইসলাম আর বাংলাদেশের ইসলাম এক না… ব্লা ব্লা ব্লা। হ্যাঁ, ইসলামের কথাই আসবে। ইসলামের কথা আসবে কারণ এটা বাংলাদেশ, এটা ইসলাম অধ্যুষিত দেশ, এদেশে জন্মে আমি আমরা ইসলামের জীর্ণ কুআচার দেখে ও এসবে আক্রান্ত হয়ে বড় হয়েছি। আমাদের কথায় আমাদের লেখনীতে ইসলাম বিদ্বেষ আসবেই। আরবের ইসলাম আর বাংলাদেশের ইসলাম এক না- এই কথা বলার অথোরিটি ‘তারা’ কোথায় পান আমার জানা নেই। ইসলাম ধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্ম হওয়ায় ইসলাম সম্পর্কে জেনে বুঝেই বড় হয়েছি আমরা অধিকাংশ। আমরা ভাল করে জানি ইসলামের কোনো দেশভিত্তিক বা জাতিভিত্তিক সংস্করণ নেই। এক এবং অপরিবর্তনীয় কোরানের আলোকে ইসলাম সারাবিশ্বেই এককভাবে পালনীয়, মরুভূমির সংস্কৃতি মোতাবেক। জল-কাদার দেশের নবান্ন, চৈত্র সংক্রান্তি, বর্ষবরণ তাই এই ধর্মাবলম্বীদের জন্য হারাম বলেই ফতোয়া দেখেছি রাজধানীর দেয়ালে দেয়ালে। ফতোয়া জারীকারীদের বিষয়ে ‘তাদের’ কোনোও বক্তব্য বা অবস্থান চোখে পড়েনি আমার, শুধু সেগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে আমরা দেশের মানুষদের বিভক্ত করে ফেললাম! আমরা নাস্তিকেরাই আসলে খারাপ!
এরকম আরও কত তিক্ত সত্য বলা যায় প্রতিটা ধর্ম নিয়ে। এক ইসলামকে নিয়ে লেখা শুরু করলেই এনসাইক্লোপেডিয়া তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু সেসব নিয়ে কথা বলা যাবে না। বললে এতদিন প্রথমে তো ছিল চারপাশের আস্তিকদের অভিশাপ, ‘দেখে নেওয়া’র বক্রোক্তি, সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে কুপিয়ে হত্যা। আর বই নিষিদ্ধ করা তো চলছে বহুকাল ধরেই, এখন ব্লগ মুছে দেওয়া, ফেসবুকে আইডি ডিজঅ্যাবল করে দেওয়া, কুৎসা রটানো এসব তো চলছেই এক চোখা সাইবার আইনের নাকের তলা দিয়েই। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসবে আরও এসেছে ঐক্যের ধ্বজাধারী সমমনা রূপধারীদের ‘বিভক্তি সৃষ্টি’র অভিযোগ। ১৪০০ বছর আগের মরুভূমির সংস্কৃতি এই জল-কাদার দেশে ভয় দেখিয়ে চাপানো, মুক্তিযুদ্ধকালের নারীদের গনিমতের মাল বানানোর আরবীয় সূত্র আমদানি, হাত কেটে নেওয়া, শিরশ্ছেদ, পাথর ছুঁড়ে হত্যার মতো পাশবিক আইনকে ধর্মের ভয় দেখিয়ে চাপানো। শ্লীল-অশ্লীলের আরবীয় ধারনাকে এদেশীয় মানুষের মগজে-মননে ঢুকিয়ে পর্দা প্রথার মতো জঘন্য পশ্চাৎপদ সংস্কৃতির প্রচলন, ভিন্নমতাবলম্বী হলেই হত্যা বা দেশছাড়া করা, এসব নিয়ে ‘তাদের’ সাত চড়েও কোনো রা নেই, আছে উদ্ভট সব থিওরি আবিষ্কার করে উল্টো দোষ চাপানোর রেওয়াজ। আর এসব অনাচারের বিলুপ্তি চাইলেই হাহারেরে… দেশ গেল… সার্বভৌমত্ব গেল… কী উদ্ভট! দেশ-সংস্কৃতি কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফেলল মৌলবাদের ঘৃণ্য উইপোকা, সেদিকে খেয়াল নেই, কিন্তু ব্লগে মৌলবাদের বিরুদ্ধে লিখলেই নাকি তা সাম্রাজ্যবাদকে আহ্বান করে তার কাছে দেশ বেঁচে দেওয়া!
এত অত্যাচার-অনাচার, এতকিছুর পরও ধর্মের কী অলৌকিক দাপট, তার সামনে রাষ্ট্রযন্ত্র, আইন সবারই নতশির! মার্ক্সবাদীদের পর্যন্ত বিবর্তন ঘটছে ধর্মের তেজস্ক্রিয়তায়। যাবতীয় কুআচার আর পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে এতবছরের সংগ্রাম, এত ত্যাগ, তারপর আজকে এসে আত্মবিশ্লেষণ দাঁড়ায়: গণমানুষের মনোভূমিই নাকি বুঝে ওঠা হয়নি আমাদের মার্ক্সবাদীদের! গণমানুষের মন বুঝতে এবার মার্ক্সবাদের খৎনার কথাও শোনা যাচ্ছে আস্তে আস্তে। মার্ক্সবাদ নাকি ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না! ধার্মিকদের ধর্মগ্রন্থ বিকৃতির অভিযোগের মতো ভবিষ্যতে যদি শোনা যায় যে: মার্ক্সবাদ কখনোই ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল না, নাস্তিক লেনিন আর স্ট্যালিন একে বিকৃত করেছে, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না হয়তো।
এদেশীয় নাস্তিকদের বিরুদ্ধে হটকেক কুৎসা (ভদ্র ভাষায় অভিযোগ) হল, আমাদের মধ্যে যারা অনলাইনে ব্লগে ফেসবুকে সক্রিয় তাদের সক্রিয়তার আসল উদ্দেশ্য নাকি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শরণ নেওয়া। দেশে থেকে বই-ব্লগ লেখার পরিণতি হিসেবে লেখক-প্রকাশক হত্যা নিয়ে ‘তাদের’ বিশ্লেষণ: এসব হত্যা নাকি আমাদের নাস্তিকদের সৃষ্ট সেই ‘বিভক্তি’র প্রতিক্রিয়া, আর জীবন বাঁচাতে দেশ ছাড়লে ওই কথা।
প্রবাসী ব্লগারগণ, ছোটবেলা থেকে যে ভূখন্ডের যে পরিবেশ-প্রতিবেশের জল-হাওয়ায় আপনারা বেড়ে উঠেছেন সেই ভূখন্ড ছেড়ে সূর্যের কিরণবিহীন কুয়াশাঢাকা দেশে ভিন্ন ভাষাভাষী ভিন্ন নৃগোষ্ঠির মানুষদের মধ্যে গিয়ে আপনারা আসলেই কে কেমন আছেন? আপনাদের বর্তমান পায়খানার সঙ্গে এদেশীয় পায়খানার তুলনা ব্লগে আমাদের জন্য লেখেন না কেন আপনারা? আপনাদের বর্তমান বিছানার কোমলতা আমাদেরকে জানান না কেন? সেসব দেশের ঠান্ডা তুষারপাত কি আমাদের শ্রাবণের বৃষ্টির চেয়ে বেশি সুন্দর? দেশে থাকতে তো দেশের জন্য আপনারা ফলদ কিছুই করেন নি, সর্বহারা কৃষকদের ধানক্ষেত অরক্ষিত রেখে দেশের মানুষের মাঝে ‘বিভক্তি’ সৃষ্টি করে দিয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে পালিয়ে কিভাবে জীবনধারণ করছেন আপনারা? দেশে থাকতে তো ব্লগ-পোস্টের বন্যা বইয়ে দিতেন, এখন জার্মানি-সুইজারল্যান্ডে গিয়ে আপনাদের লেখা দেখি না কেন আর? নিজের জীবিকা নিশ্চয়ই আপনারা নিজেরা নির্বাহ করছেন না! সেখানে তো নাস্তিকদের বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানো হয়- এমনই কল্পনা করেন ‘তারা’। আপনাদের রাতের খাবারের তালিকায় কি গরম ভাত থাকে এখনো, কিংবা ইলিশ? আসলেই, বলুন তো আপনাদের দিন কাটছে কী করে ওইসব দেশে?
“জার্মানি কবে যাচ্ছেন”- এমন বক্রোক্তিতে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে সমমনা নাস্তিক ব্লগার সুষুপ্ত পাঠক তো তার সমমনাদের আহ্বান জানিয়ে বসেছেন দেশ না ছাড়ার। নাস্তিকতার মিথ্যা চর্চা করে ইউরোপের দেশে শরণ নেওয়ার ঘটনা ঘটেনি, এমন দাবি করব না। কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে নাস্তিক ব্লগাররা কি তাহলে অন্য দেশে যাবেন না আর? না যেতে হলে তো ভালই হত, কিন্তু মৃত্যুর পরোয়ানা ঘাড়ে নিয়ে তারা কেন দেশে থাকবেন? ব্লগারদের লড়াই মগজে-মননে, তাদের বেঁচে থাকাই তো জরুরি। আর তারা লেখেনই বা কেন? এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যাই হল আমার এই লেখার প্রথম প্যারাটি। আমি মনে করি নাস্তিকরা বিভিন্ন মাধ্যমে নাস্তিকতার চর্চা করেন ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য, তারা ধর্মের বিরুদ্ধে লেখেন তাদের ভালবাসার মানুষটিকে মুক্তমন নিয়ে ভালবেসে যাওয়ার জন্য, তারা মগজে-মননে মুক্তির কথা লেখেন তাদের উত্তর প্রজন্মকে বাসযোগ্য পৃথিবীতে ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য। এই চাওয়া দোষের নয়।
সামনের পৃথিবী নাস্তিকতার। কারণ মানব সংস্কৃতি-সভ্যতার ধারাবাহিক বিবর্তনে ধর্ম তার উপযোগিতা হারিয়েছে বহু আগেই। এসব এখনো ধ্বংসাবশেষের মতো টিকে আছে সমাজে এখনো অস্তিত্বমান স্বঅবমূলায়িত অবমানবদের মনে। এধরণের মানসের বিলুপ্তির মধ্য দিয়েই ধর্মের বিলোপ ঘটবে। কাজেই আজকে যারা নাস্তিকতা ভাঙ্গিয়ে শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থে বিদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল সময়ই দিয়ে দেবে। তারা আলোচ্য না, হবেনও না।
নাস্তিক ব্লগাররা যারা বিদেশে আশ্রয় পেয়েছেন তারা বিদেশেই থাকুন। যারা দেশ ছাড়ার সুযোগ খুঁজছেন, সুযোগ পেলে চলে যান। এখন আজকে আপনাদের মগজ ফুটপাতে পড়ে থাকলে এক মাস পরেই সেই ফুটপাত দিয়ে অবলীলায় সকলে হেঁটে চলবে আপনাদের নাম-নিশানা ভুলে গিয়ে। তাই বেঁচে থাকুন, আর যে লক্ষ্যকে ধারণ করে মাতৃভূমি ছেড়েছেন সেই লক্ষ্যে স্থির থাকুন, সক্রিয় থাকুন। ‘তাদের’ কুৎসায় আপনাদের বা কারোরই কিছু এসে যাবে না, অপ্রস্তুত কিছু মনকে ‘তারা’ বিভ্রান্ত করে যাবে এইই যা।
নাস্তিক ব্লগাররা, কোনো বিভক্তিই আপনারা সৃষ্টি করেন নি। ভাল, সঠিক ও শুভ সবসময়ই মন্দ, বেঠিক ও অশুভের থেকে পৃথক। এদেরকে বিভক্ত করার কিছু নেই। এদের মধ্যে সংঘাত চলছে, চলবে। তবে ভবিষ্যতে এই সংঘাতের মাত্রা কেমন হবে তা সময় মতো দেখা যাবে। তবে আমি মনে করি এরকম সংঘাতই সঠিকতার ক্ষেত্র বিনির্মাণ করার সুযোগ। এই সংঘাতে আদর্শিক লড়াইটা মগজ-মনন দিয়ে লড়ে দেবেন হয়ত আপনারাই বা আপনাদেরই কেউ। সেভাবেই প্রস্তুত হোন, দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন সেখানে বসেই প্রস্তুত হোন। যে আদর্শের জন্য নিজেদের জীবনকে অনিরাপদ করেছিলেন তার জন্যই ভিন্ন দেশে অনভ্যস্ততা, টিকে থাকার সংগ্রাম, এসবকে জয় করে আদর্শিক লড়াইটাকে টিকিয়ে রাখুন। তাহলে আপনারাই থাকবেন, ‘ওরা’ নয়, ‘ওদের’ সুবিধাবাদ তো নয়ই।