৭১-এর যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সরকার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে জিহাদ হিসেবে প্রচার করতে থাকে। পত্র-পত্রিকায় জিহাদের জন্যে অর্থ দানের আহবানও করা হয়। ইসলামের নিয়ম অনুসারে যুদ্ধ বন্ধীদের গনিমতের মাল হিসেবে ভোগ করা যেহেতু জায়েজ, সেহেতু তারা বাংলার নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানীদের ভাষায় বাংলার নারীদের গর্ভে তারা সাচ্চা মুসলমানের বাচ্চা জন্ম দিতে আগ্রহী। একাত্তরের নয় মাস হিন্দুদের উপরও চলে অমানবিক নির্যাতন। হিন্দু নারীদের গনিমতের মাল হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই ক্ষেত্রে শুধু পাকিস্তানীরা নয়, বাংলার অনেক আলেমও হিন্দু মেয়ে ধর্ষণ করা ইসলামে জায়েজ এমন ফতোয়া দেয়। গবেষণা করে অনেকে দুই লাখ নারী ধর্ষণের ঘটনার কথা বললেও বাস্তবতা হল ধর্ষণের সংখ্যা ছিল প্রায় চার লাখ। কারণ বেশির ভাগ পরিবার সম্মানহানির ভয়ে নির্যাতনের ঘটনাগুলো চেপে গেছেন। ৭১-এ বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগের চেয়ে সামান্য বেশি ছিল হিন্দু জনসংখ্যা। কিন্তু ধর্ষিতাদের মধ্যে ৪২ ভাগ ছিল হিন্দু রমণীরা। যাদের মধ্যে ৪৪ ভাগ ছিলেন অবিবাহিত নারী। অর্থাৎ; কুমারী হিন্দু নারীরাই ছিলেন ধর্ষকদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। পাকিস্তানীদের এসব কাজে সাহায্য সহযোগিতা করেছে স্থানীয় দালাল, রাজাকার ও ধর্মীয় নেতারা। তাদের মধ্যে একজন হলেন-শর্ষিণার পীর আবু সালেহ মোহাম্মদ জাফর। এছাড়া হিন্দুদের ধর্মান্তর করে মুসলমান করা হয়েছিল বহু জায়গায়। স্বরোচিষ সরকারের জরিপ থেকে দেখা যায়, বাগেরহাট জেলায় এ রকমের প্রচুর ধর্মান্তর হয়েছিল। এই ধর্মান্তরিত হিন্দুদের গরু খাইয়ে তাদের মুসলমানত্বকে পাকা করা হতো। মরে গেলো পোড়ানোর বদলে তাদের কবর দেওয়া হতো। এছাড়া হিন্দুদের মন্দিরকে মসজিদ তৈরির ঘটনা তো ছিলই। যাই হোক, আমরা শর্ষিণার পীরের বিষয়ে ফিরে যাই।

১৯৭২ সালে ৫ জানুয়ারি ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকার রিপোর্ট-

“শর্ষিণার পীর আবু সালেহ মোহাম্মদ জাফর ধরা পড়েছেন। গত শনিবার পয়লা জানুয়ারি শর্ষিণা থেকে তাকে গ্রেফতার করে বরিশাল সদরে নিয়ে যাওয়া হয়।

গত ১২ই নবেম্বর ৫ শতাধিক রাজাকার, দালাল ও সাঙ্গপাঙ্গসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে তখন থেকে পীর সাহেবকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।

উল্লেখ্য, নরঘাতক টিক্কা খানের আমলে ঢাকার ফরাসগঞ্জের লালকুঠিতে যে সকল পীর, মাদ্রাসার মোহান্দেস-মোদাররেস ও দক্ষীণপন্থী রাজনীতিক রাজাকার বাহিনী গঠন করা, প্রতিটি মাদ্রাসাকে রাজাকার ক্যাম্পে পরিণত করা এবং সকল মাদ্রাসার ছাত্রকে রাজাকার ও পুলিশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় শর্যিণার পীর সাহেব তাদের অন্যতম।

৫ জানুয়ারি ১৯৭২

শর্ষিণার পীর সাহেব দাওয়াতে হানাদার বাহিনী বরিশালের বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং অগ্নি সংযোগ ও লুট করে এবং শর্ষিণা মাদ্রাসার ৫ শতাধিক তালেবে এলেম প্রায় ৩০টি গ্রামে হামলা চালায় এবং বাড়ি ঘর ও বাজার লুট করে কয়েক কোটি টাকার সোনা, খাদ্যদ্রব্য, আসবাবপত্র ও নগদ টাকা এনে পীর সাহেবের “বায়তুল মালে’- ‘গনিমত হিসেবে’ জমা দেওয়া হয়। তারা হিন্দুদের বাড়ির ভিটা পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।

পীর সাহেবের নির্দেশেই তালেবে এলেম রাজাকার এবং হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের একমাত্র পেয়ারা সরবরাহকারী হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল আটঘর, কুড়িয়ানা ও ধলারে পাঁচ দিক থেকে একযোগে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার পুরুষ, মহিলা, শিশুকে হত্যা করে এবং তাদের সর্বস্ব লুট করে। সেখানে বাড়ি-ঘরের তেমন চিহ্ন নেই। মাদ্রাসার ছাত্র রাজাকার সেখানে লোহার রড, লাঠির সাহায্যে হত্যা করা ছাড়াও জঙ্গল ও ধান ক্ষেতে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য মহিলার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। তারা প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক ধরে এনে বেয়নেট চার্জ ও গুলি করে হত্যা করতো।

গত রোজার শেষের দিকে পীর সাহেবের নির্দেশক্রমেই হানাদার বাহিনী ৬ দিক থেকে হামলা চালিয়ে স্বরূপকাঠির শিল্প শহর ও বন্দর ইন্দরহাট পুড়িয়ে দেয়। এবং প্রায় এক হাজার নিরীহ লোককে হত্যা করে। তবে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধে এখানে ২২ জন হানাদার সৈন্য ও শর্ষিণার রাজাকার নিহত হয়। এখানকার স্থানীয় তরুণদের মধ্যে শতকরা ৯০ জনই ছিল মুক্তিবাহিনী ও মাদ্রাসার কয়েকজন স্থানীয় ছাত্রও মুক্তিবাহিনীতে সদস্য ছিল।

গত নয় মাস কাল শর্ষিণার পীরের বাড়ি ছিল হানাদার বাহিনীর একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ। এখানে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও পাঞ্জাবী পুলিশ অবস্থান করে বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালায় এবং রাজাকার ট্রেনিং দান করে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের জন্যে পরে এখানে স্বরূপকাঠি থানা স্থানান্তরিত করা হয়।

বর্তমানে শর্ষিণার রাজাকার এবং দালালরা মুক্তিবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রয়েছে। তবে পীর সাহেবের অনেক সাঙ্গপাঙ্গ ঢাকা, বরিশালে ও অন্যান্য শহরে আত্মগোপন করে আছে।

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমল থেকে শর্ষিণা গণ-বিরোধী চক্রের একটি শক্তিশালী আখড়া ছিল।”

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শর্ষিণার পীর সম্পর্কে লেখা আছেন। সময় ১৯৫৪ এর নির্বাচন, তিনি বলছেন- “জামান সাহেব ও মুসলিম লীগ যখন দেখতে পারলেন তাদের অবস্থা ভাল না, তখন এক দাবার ঘুঁটি চাললেন। অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। গোপালগঞ্জে আমার নিজের ইউনিয়নে পূর্ব বাংলার এক বিখ্যাত আলেম মওলানা শামসুল হক সাহেব জন্মগ্রহণ করেছেন। আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তিনি ধর্ম সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। আমার ধারণা ছিল, মওলানা সাহেব আমার বিরুদ্ধাচরণ করবেন না। কিন্তু এর মধ্য তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করলেন এবং আমার বিরুদ্ধে ইলেকশনে লেগে পড়লেন। ঐ অঞ্চলের মুসলমান জনসাধারণ তাকে খুবই ভক্তি করত। মওলানা সাহেব ইউনিয়নের পর ইউনিয়নে স্পিড-বোট নিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন এবং এক ধর্ম সভা ডেকে ফতোয়া দিলেন আমার বিরুদ্ধে যে, “আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।“ সাথে শর্ষিণার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে নেমে পড়লেন এবং যত রকম ফতোয়া দেওয়া যায় তাহা দিতে কৃপণতা করলেন না। দুই চার জন ছাড়া প্রায় সকল মওলানা, মৌলভী সাহেবরা এবং তাদের তালবেলেমরা নেমে পড়ল।”

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটির ২৫৬ পৃষ্ঠা শর্ষিণার পীর সম্পর্কে লেখা আছে।

আমরা জাতি হিসেবে এতোটা দুর্ভাগা যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দেশে একজন স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকার, খুনি’কেও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৮০ সালে আবু সালেহ মোহাম্মদ জাফর কে (শর্ষিণার পীর) শিক্ষায় স্বাধীনতা পুরষ্কার দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছেন, রাজাকারদের প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন এবং রাজাকারের দোসরদের স্বাধীনতার পুরষ্কারও প্রদান করেছেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বাধীনতা পুরষ্কার দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্যে প্রাণ দেওয়া সকল মানুষকে, স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করা সকল মানুষকে অপমান করা হয়েছে। বাস্তবতা হল পরবর্তীতে কোন সরকার এই পুরষ্কার বাতিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করে নি। রাজনীতিবিদরা ভোটের স্বার্থে এসব পীর, ধর্মব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্ক রেখে চলে। বর্তমানে পিরোজপুরের এই পীরের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্যে সকল রাজনৈতিক নেতা পীরের কাছে হাজিরা দেয়। ২০১১ সালে শর্ষিনার পীরের ছেলের বিবাহোত্তর সংবর্ধনায় হুসেন মোহাম্মদ এরশাদ উপস্থিন হোন। এছাড়াও জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী (আওয়ামী লীগ) মো. মাহাবুবুর রহমান যোগ দেন। এছাড়া এরশাদ তাঁর শাসনামলে স্বরূপকাঠি উপজেলার নাম পরিবর্তন করে শর্ষিনার মরহুম পীর নেছার উদ্দিনের নাম অনুযায়ী নেছারাবাদ নামকরণ করেন। স্বাধীনতার পদক যেমন দেওয়া যায় তেমনি তা ফিরিয়ে নেওয়াও সম্ভব। যতদ্রুত সম্ভব শর্ষিণার পীরের স্বাধীনতা পদক ফিরিয়ে নেওয়ার হোক। রাষ্ট্রের আছে এই দাবী জানাচ্ছি।

রাজাকার শর্ষিনার পীর

হিন্দু নারীরা গনিমতের মাল। যুদ্ধ করে জয় করা পণ্য। এই রিপোর্ট প্রকাশ করায় প্রতিবেদক শওকত মিল্টনকে হুমকি দেওয়া হয়। হুমকির পর বর্তমানে তিনি কানাডাতে আছেন। এটিএন বাংলার রিপোর্টটি শেয়ার করা হল।

মুক্তিযুদ্ধের অষ্টম খণ্ডে এই পীরের ইতিহাস লিপিবন্ধ আছে। অষ্টম খণ্ড থেকে ভারতী রাণী বসু’র কথাগুলো তুলে দিচ্ছি।

ভারতী রাণী বসু
গ্রাম – স্বরুপকাঠি
জেলা – বরিশাল

২৭শে এপ্রিল আমি কাঠালিয়া থানার মহিষকান্দি গ্রামে যাই আত্মরক্ষার জন্য। তখন চারদিকে সব বিচ্ছিন্ন অবস্থা। হিন্দু বাড়ি বিভিন্ন স্থানে লুট হচ্ছে, হত্যা চলছে। ওখানে পৌছানোর পরপরই স্থানীয় কিছু লোক হিন্দু বাড়ি লুট শুরু করে দেয়। ২০/২৫ জনের বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে সকালে, দুপুরে, রাতে, ভোরে যখন তখন বল্লম, দা এবং অন্যান্য ধারালো অস্ত্র নিয়ে হিন্দু বাড়ি আক্রমণ করে সব লুট করে ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। আমি স্বরুপকাঠিতে ফিরে আসি ৫ই মে। সেদিন ছিলো হাটবার। ঐ দিনই সমস্ত এলাকা লুট করে নেয় দুষ্কৃতিকারীরা।

৬ই মে সকালে পাক সেনা প্রথম স্বরূপকাঠিতে যায়। ওখানকার পীর শর্ষিনার বাড়ীতে গিয়ে পাক বাহিনী ওঠে। ওখান থেকে থানায় আসার পথে শর্ষিনার পুল থেকে থানা পর্যন্ত (সাহাপারা) সমগ্র হিন্দু বাড়ী প্রথমে লুট করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওখান থেকে পাক বাহিনীর একটা দল অলঘারকাঠির দিকে গিয়ে ঘর বাড়ী জ্বালানো ও সেই সাথে মানুষ হত্যাও শুরু করে। আর একটা দল স্বরূপকাঠি এসে শুধু হিন্দু বাড়ী বেছে বেছে সকল হিন্দু বাড়ী লুট করে পুড়িয়ে দেয়। কালী প্রতিমার উপর অসংখ্য গুলি চালিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। বহুজনকে হত্যা করে। তারপর পাক বাহিনী ফিরে যায়। তারপর থেকে ক্রমাগত সাত দিন পাক বাহিনী স্বরূপকাঠিতে যায়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে আর লুট করেছে। স্থানীয় কিছু লোক এবং পীরের দল পাক বাহিনীর সাথে থাকতো। লুট করতে বলে তারা যখন লুট করতে আরম্ভ করে তখন পাক সেনারা ছবি তুলতো।

কুড়িয়ানা আটঘর, জলাবাড়ী, সমুদয়কাঠি, জুলুহারা, নান্দিঘর, সোহাগদল, ইন্দ্রিরহাট, মণিনাল, বাটনাতলা ইত্যাদি গ্রামসহ ৯টি ইউনিয়নে পাক বাহিনীরা গ্রামের প্রতিটি কোনাতে ঘুরে সব ধ্বংস করেছে, লুট করেছে।

কুড়িয়ানা আটঘরে পিয়ারার বাগানে বহুজন আশ্রয় নিয়েছিল। পাক বাহিনী হঠাৎ করে ঘিরে ফেলে অসংখ্য লোককে হত্যা করে। এক মেয়েকে পিয়ারা বাগান থেকে ধরে এনে সবাই মিলে পাশবিক অত্যাচার চালায়। তারপর তিনদিন যাবৎ ব্লেড দিয়ে শরীর কেটে কেটে লবণ দিয়েছে। অশেষ যন্ত্রণা লাঞ্ছনা দেওয়ার পর মেয়েটিকে গুলি করে হত্যা করে। মেয়েটি ম্যাট্রিক পাশ ছিল। অন্য একজন মহিলাকে ধরে নিয়ে অত্যাচার চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এখানে অধিকাংশ লোককে গুলি করে এবং বেয়নেট চার্য করে হত্যা করেছে। শত শত লোককে এই এলাকাতে হত্যা করেছে।

কাউখালি স্টেশনে আমি নিজে দেখেছি একজনকে মুক্তিবাহিনী সন্দেহে রাজাকাররা কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। স্বরূপকাঠিতে টিকতে না পেরে মহিষকান্দিতে যাই। ওখানে গেলে আমাকে সবাই মুক্তিবাহিনীর চর মনে করলো এবং অস্ত্র আছে বললো। আমি ওখান থেকে রাতে পালিয়ে যাই রাজাপুরে।

রাজাপুর থানাতে হামিদ জমাদার সমগ্র থানাতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। সমস্ত বাড়িঘর লুট করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করেছে, হত্যা করেছে। হিন্দু কোন বাড়িঘর ছিল না। সব ধ্বংস করেছিল। ওখানে শুক্কুর মৃধা শান্তি কমিটির সেক্রেটারী ছিল। আমি সহ আরো তিনজন তিন হাজার টাকা দিয়ে কোন রকম সেবারের মতো বাঁচি। আমি তখন কুমারী ছিলাম। সবাইকে মুসলমান হতে হবে এবং মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করতে হবে। এমনি একটি পরিস্থিতিতে সুনীল কুমার দাস নামে এক ভদ্রলোককে আমি বিয়ে করি সে সময় দুষ্কৃতিকারীর হাত থেকে বাঁচবার জন্য। সময়টা ছিল জুন মাসের শেষ অথবা জুলাই প্রথম।

রাজাপুরে আছি স্বামীসহ। ভোরবেলা রাজাকার, পুলিশ মিলে প্রায় ৩০/৪০ জন আমাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। স্বামীকে লুকিয়ে রাখি। ওরা এসে সব কিছু লুট করে গালাগালি করে চলে যায়। কিছুক্ষণ বাদে আবার এসে আর যা ছিলো সব নিয়ে অত্যাচার চালায়। পাশের একটি লোককে হত্যা করলো।

নৈকাঠি রাজাপুর থানা গ্রামে শতকরা ৯৮ জনকে হত্যা করে। ওখানকার সব হিন্দু। ৯৮% মহিলা আজ বিধবা। নৈকাঠির প্রায় সব পুরুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাদের যথাসর্বস্ব আত্মসাৎ করে হামিদ জমাদার ও তার দল। ঐ বিপদের মাঝে জঙ্গলে জঙ্গলে এ বাড়ি ও বাড়ি করে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম। আমার সব কিছু লুটে নেয় রাজাকার আর পাক বাহিনী। আমি কোন মতে পালিয়ে বাহিরচরে যাই জুলাই মাসের ১৭ তারিখে। আমি আমার কাজে যোগ দেই। তার পরপরই আমাকে সাসপেন্ড করে রাখে তিন মাস । বাহিরচরে সমগ্র এলাকা খুন, ডাকাতিতে ভরা। সমগ্র এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো।

অক্টোবর মাসে কুদ্দুস মোল্লাকে (মুক্তিবাহিনী) চিকিৎসা করার জন্য কর্নেল আমাদের সবাইকে ডেকে লাঞ্ছনা দেয়। যাবার পথে গানবোট থেকে আমাদের হাসপাতালে শেল ফেলে। আমরা দারোয়ান পাহারা রেখে মুক্তিবাহিনীর চিকিৎসা করেছি। আমাদের ডাঃ শামসুল হক মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গোপনে গিয়েও তাদের চিকিৎসা করেছেন। আমরা সবাই সবকিছু দিয়ে তাদের সাহায্য করতাম।

বাহিরচরে পাক বাহিনীরা মেয়েদের উপর চালিয়াছে অকথ্য নির্যাতন। বোয়ালিয়া, কাঁদপাশা, রাজগুরু, বাবুগঞ্জ থানা, দুয়ারিকা ইত্যাদি এলাকা থেকে বহু মেয়ে ধরে এনে ভোগ করেছে। আমার জানা এক হিন্দু মহিলাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ধরে নিয়া যায়। মহিলা খুব সুন্দরী ছিল। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চারদিন ক্রমাগত অকথ্য দৈহিক নির্যাতন চালায়। অসহ্য যন্ত্রণায় মহিলা ছটফট করেছে। চারদিন পর মহিলা ছাড়া পায়। আমরা তার চিকিৎসা করে ভালো করি।

আমি স্বামীসহ বাস করছিলাম। আমার সর্বস্ব যাওয়া সত্ত্বেও স্বামী নিয়ে কোন রকমে দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার স্বামী স্বাধীনতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। আমাকে প্রায় বলতেন ডিসেম্বর মাস যদি বাঁচি জানুয়ারীর মধ্যে নিশ্চয় স্বাধীনতা পেয়ে যাবো।

৯ ই ডিসেম্বর গৌরনদী থানার মাহিলারার ব্রিজের উপর দিয়ে আমার স্বামী যাচ্ছিলেন। তখন পাক বাহিনী প্রায় আত্মসমর্পণ করে এমন অবস্থায় ব্রিজে ডিনামাইট স্থাপন করে রেখেছিলো। সেই ডিনামাইট ফেটে ব্রিজ ধ্বংস হয়। আমার স্বামী ওখানেই নিহত হন। সব হারিয়ে একমাত্র স্বামী ছিলো তাও স্বাধীনতার পূর্বমুহূর্তে হারাতে হলো।

আমি বাহিরচর থেকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জন্য খাবার পাঠিয়েছি। রাতে যখন তখন আমার ওখানে তারা এসে থাকতো, যেতো। আমার স্বামী মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে মাঝে মাঝে যেতেন। আমার স্বামীর বড় সাধ ছিলো স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাস করা। তার সে সাধ পূর্ণ হলো না।

স্বাক্ষর/-
ভারতী রাণী বসু
১৮/৮/৭৩

সহায়তায়-
পত্রিকার ছবিগুলো International Crimes Strategy Forum (ICSF) and Center for Bangladesh Genocide Research (CBGR) থেকে নেওয়া।

মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর একটি নির্দলীয় ইতিহাস-গোলাম মুরশিদ