শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটা যায় না। ডানে বামে তাকাতে হয়। এখন আবার পেছনেও তাকাতে হয়। পেছনে ঠিক কয়জন মানুষ হাঁটছে, কে কত দূরে আছে, কার হাঁটার গতি কেমন, একা কয়জন আর দলবেঁধে কয়জন, কার গালে দাঁড়ি আছে কার গালে নাই, ব্যাকপ্যাক আছে কিনা, যাদের ব্যাকপ্যাক আছে তাদের দৈহিক গড়ন কেমন, বয়স কত হতে পারে, আরো কত কী যে ভাবতে হয়! এক দেখায় এত কিছু মার্ক করা যায় না, কারণ পেছনে তাকিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে পারেন না মাঝ বয়সী লেখক ও কলামিস্ট কাজল মাহমুদ। তাই বার বার পেছনে তাকাতে হয়। গত এক বছর ধরে হাঁটার সময় এভাবে পিছনে তাকিয়ে এখন তার ঘাড় ব্যাথা রোগে ধরেছে। প্রতি সপ্তাহে একবার ডাক্তারের কাছে যান। এখনও ডাক্তারের কাছে যাবেন বলেই বাসা থেকে বেরিয়েছেন। বেরিয়েই গাড়ি পাওয়া যায় না। একটু হেঁটে সিএনজি অটোরিক্সা নিতে হয়।

বছরখানেক আগে এক ব্লগারের মৃত্যুর পর দৈনিক পত্রিকায় বিশাল প্রবন্ধ লিখেছিলেন। একটি ইসলামিক জঙ্গী সংগঠনের খুনী দল ওই ব্লগারকে তার বাসার কাছে কুপিয়ে হত্যা করে। পত্রিকার প্রবন্ধে কাজল মাহমুদ লিখেছেন “কোরআনে যুদ্ধ ও হত্যা বিষয়ক বিভিন্ন আয়াত পড়ে এবং সাহাবীদের জীবনী পড়ে বর্তমান সময়ের মুসলিম তরুণরা ধর্ম বিরুদ্ধ মানুষদের খুন করার উৎসাহ পায়।“ তিনি আরো লিখেছেন “যেসব মুসলমান ওইসব আয়াত ও জীবনী পড়ে খুন করতে উদ্বুদ্ধ হয় না, তাদের উচিত এসব খুনের প্রতিবাদ করা।“ ব্যস! তিনদিন পর ফোনে হুমকী পেলেন, এরপর পেলেন চিঠি। তার কয়দিন পর পেলেন ফেসবুকে মেসেজ। এরপর ইমেইল। পরপর এতগুলো মাধ্যমে হুমকী পেয়ে ভয় পেলেও একেবারে ভেঙ্গে পড়েননি তিনি।

এরপর থেকে হাঁটার সময় কিছুক্ষণ পর পর পেছনে তাকানোর অভ্যাস করতে হয়েছে। অভ্যাস নয় ঠিক, নিয়ম হয়ে গেছে। কারণ জঙ্গিরা পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে। তারা অসম্ভব ভীতু এবং সাহসী। চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মানুষ খুন করার সাহস আছে তাদের।

এখন কাজল মাহমুদের পেছনে যারা হাঁটছে, তাদের মাঝে ৪ জনের একটা দল আছে। দুই জনের গালে দাঁড়ি আছে, দুই জনের নাই। একজনের হালকা দাঁড়ি, আরেকজনের খোঁচা খোঁচা। ব্যাকপ্যাক আছে সবারই। বয়স গড়ে বাইশ তেইশ হবে। বেশ সুন্দর সুঠাম দেহ সবার। এই মুহূর্তে এদেরকে নিয়েই কাজল মাহমুদের যত ভয়। ব্লগারদেরকে মারার অপারেশনে যারা যায়, তাদের সাথে এদের হুবহু মিল। তাই বার বার তাকাচ্ছেন।

এবার পেছনে তাকিয়ে ভালো করে দেখেন সবাই তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে এবং বেশিরভাগ মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কেউই সামনের দিকে আসছে না। কাজল মাহমুদ ভাবলেন, এটা আবার কী হলো! ওরা সবাই এভাবে দাঁড়িয়ে গেলো কেন। ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখেন পাঁচ জন যুবক চাপাতি তাক করে তার পথরোধ করে আছে। সবার মুখে কালো কাপড় বাঁধা। চেহারা দেখে চেনা যাচ্ছে না। এরা সবাই ফুটপাতের পাশে একটি দোকানে অপেক্ষমান ছিলো। কাজল মাহমুদ বুঝতেই পারেননি কখন তারা হুট করে সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলো!

বুঝতে পারছেন না তার এখন কী করা উচিত। দৌড় দিবেন নাকি চিৎকার করবেন। কিন্তু চিৎকার করবেন কিভাবে, গলা একদম শুকিয়ে গেছে। ঢোক গিলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তিনি খেয়াল করলেন গায়ে কোন শক্তি নেই। কিছুক্ষণ আগে প্রস্রাবের বেগ ছিলো, এখন আর নেই। ঘাড়ের ব্যাথাও নেই। কোপ খেলে অনেক ব্যাথা লাগবে, এই বিষয়টাও মাথা থেকে চলে গেছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখে কোন বোধ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আশপাশে অনেক মানুষ, আবার মনে হচ্ছে কেউ নেই। এইখানে এই মুহূর্তে তিনি ভীষন একা। খুব দ্রুত প্রচন্ড শীতে গ্রাস হয়ে যাচ্ছেন। শরীরের ভেতরে শীতের ঢেউ টের পাচ্ছেন তিনি। অনেক শীত। পূর্ণ মাঘেও কখনো এতো শীত লাগেনি তার। তাছাড়া এটা কেমন যেন কাঁচা কাঁচা শীত, তরতাজা শীত। প্রথমে গায়ে এসে লেপ্টে যাচ্ছে, তারপর কামড়ে ধরছে। ঘটনার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এমন কাঁপুনি এলো যে দাঁতের দুই পাটি একে অপরের শত্রু হয়ে খুব পেটাচ্ছে। ঘাড়ের চারপাশ, চেয়াল ও মাথার বিভিন্ন জায়গায় কুঁচকানো শীতে শির শির করছে। মনে হচ্ছে চাপাতির কোপগুলো এসব জায়গায় পড়বে। নিহত ব্লগারদের ছবি দেখেছেন তিনি, এসব জায়গাতেই কোপায় তারা।

এটা ঘোর না, আবার বোধহীনও না। আবার অচেতন অবস্থা কিংবা তন্দ্রাচ্ছন্নতাও নয়। কেমন একটা শোধবোধহীন জেগে থাকা অবস্থা। এই অবস্থা ভেঙে গেলো মুখ ঢাকা যুবকদের একজনের কথায়।

– ভয় পাচ্ছেন কেন? আমরা আপনাকে মারতে আসিনি।

এমন সাবলীল কণ্ঠে কথাটি বললো, যেন চাপাতি দিয়ে টেবিল টেনিস খেলতে আসছে। বিশ্বাস হয় না কাজল মাহমুদের। তবুও মনে মনে খুশি হয়েছেন এই ভেবে যে, যেহেতু তিনি ব্লগার নন, সেহেতু হয়তো প্রাণে মারবে না। কয় কোপ দিয়ে ফেলে রেখে চলে যাবে। তারপর আশপাশের মানুষরা যদি সঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং ডাক্তার পাওয়া যায় এবং অপারেশন থিয়েটার খালি পাওয়া যায় এবং পর্যাপ্ত রক্ত হাতের কাছে মিলে যায়, তাহলে এ যাত্রায় বেঁচে যাবেন।

– না, আমরা আপনাকে আঘাত করতে আসিনি। বিশ্বাস করুন, আপনার ঘাড়, মাথা কিংবা মুখে একটা কোপও দিবো না। অভ্যাসবশতঃ মুখোশ পরে এবং চাপাতি হাতে করে চলে এসেছি। এর মানে এই না যে আমরা আপনাকে কোপাবো। আবার এর মানে এও না যে আমরা আপনাকে ছেড়ে দিবো।

কাজল মাহমুদ মনে মনে বললেন, “বুঝলাম না!”

– বুঝাবুঝির কিছু নাই। হুজুর বলেছেন আপনাকে সাথে করে নিয়ে যেতে। কী একটা বিষয়ে জরুরী আলাপ আছে। আপাতত কোন কথা না বলে চুপচাপ আমাদের সাথে গাড়িতে উঠেন। ফেয়ার এন্ড ফ্রেন্ডলি। -শেষের শব্দ তিনটি একটু ধমকের সুরে বললো ছেলেটি।

কাজল মাহমুদের হঠাৎ মনে পড়লো ঘাড়ে ব্যাথার কথা। মনে পড়লো ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। ভাবছেন যেহেতু এরা তাকে মারতে আসেনি, সেহেতু মনে হয় ডাক্তারের কথা বললে ছেড়ে দিবে। কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বেরুচ্ছে না। ডিম পাড়া মুরগির ডাকের মত কক কক শব্দ হলেও সেটা অন্য কেউ শুনতে পায়নি।

– সমস্যা নেই, পথে আপনাকে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে যাবো। ঘাড় খুব সেনসেটিভ অঙ্গ। তাছাড়া আপনি চিন্তাশীল লেখক। মুক্তচিন্তার মানুষ। মানুষের সব চিন্তা থাকে মাথায়, ঘাড়ের উপর ভর করে মাথা থাকে। অর্থাৎ ঘাড় হচ্ছে মানুষের চিন্তার স্ট্যান্ড। স্ট্যান্ডে গল্ডগোল থাকলে মাথা ঠিকমতো কাজ করবে না। এতে করে চিন্তায়ও গোলমাল হতে পারে।

এই কথা বলে মুখোশধারী ছেলেগুলো কাজল মাহমুদকে একটা কালো গ্লাসের ঝকঝকে চকচকে নতুন মাইক্রোবাসে তুললো। গাড়িতে উঠে সিটে বসার সময় তার সবকিছু সচল হলো। চিন্তাশক্তি, বাকশক্তি, শরীরের চেতন ফিরে ফেলেন। কিন্তু বুঝতে পারছেন না এতক্ষণ কোন ছেলেটি তার সাথে কথা বলেছে। ছেলেটির কথার বুনন খুব সুন্দর। বাক্য গঠন ও শব্দচয়ন বেশ কমিউনিকেটিভ ও ইনোভেটিভ। এরকম ভাবতে ভাবতে দেখলেন সবগুলো ছেলে মুখের কালো কাপড় সরিয়ে নিলো। তাদের চেহারা দেখে কাজল মাহমুদ নিজের অজান্তে একেবারে আওয়াজ করে বলে ফেললেন – বাহ্ তোমাদের চেহারাও খুব সুন্দর। অসাধারণ।

একটি ছেলে বললো – মাহমুদ সাহেব, আপনার সাথে আমিই কথা বলেছি এতক্ষণ।

একে একে সবাই পরিচিত হলো। কিন্তু মাহমুদ সাহেব বুঝে ফেললেন এগুলো একটাও অরজিনাল নাম নয়। এসব তাদের ছদ্মনাম। বখতিয়ারের ঘোড়া, লাল তলোয়ার, নিপাট সত্য, মরু বীর, নিঃসঙ্গ আকাশ, এগুলো কোন মানুষের নাম হতে পারে না।

নিপাট সত্য নামের ছেলেটি বললো, আরে এসবতো আমাদের ফেসবুক প্রোফাইলের নাম। নাম নিয়ে আপনি এত চিন্তা করছেন কেন? মুক্তচিন্তার মানুষ হয়েছেন বলে কি সবকিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে? তাছাড়া নাম দিয়ে কী হয়! আমাদের প্রত্যেকেরই দশটি করে গুনবাচক নাম আছে। যেমন আমার দশটি গুনবাচক নাম হচ্ছে, পরোপকারী, সত্যবাদী, একনিষ্ঠ, সৎখেয়ালী, বিশ্বস্ত, অনুগত, ভ্রাতৃপ্রতীম, মিষ্টভাষী, মনযোগী ও একাগ্রচিত্তের মানুষ। এভাবে এখানে আমরা পাঁচজনের পঞ্চাশটি নাম আছে। সবগুলো গুণবাচক নাম। এসব নাম হুজুর দিয়েছেন। শুধু নাম নয়, হুজুর আমাদেরকে আরো অনেক কিছু দেন। বিশেষত প্রচুর দোয়া দেন। তার দোয়ায় আজ পর্যন্ত কোন অপারেশন ব্যর্থ হয়নি। তিনি অত্যন্ত দোয়াশীল হুজুর।

মাহমুদ সাহেব ভাবলেন ছেলেগুলো ভালো আছে। গাড়িতে যেতে যেতে তাদের সাথে আলোচনা করা দরকার। অনেক কিছু জানার আছে, জেনে নেয়া যাবে। সাহস করে বলে ফেললেন, কিন্তু তোমাদের বুকের ভেতরে আমি একজন করে খুনী দেখতে পাচ্ছি যারা মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যা করে।

– হ্যাঁ, আমরা খুন করতামতো। সর্বশেষ যে ব্লগার নিহত হয়েছে, আমরা এই পাঁচজন তাকে নির্মমভাবে খুন করেছি। শেষ কোপটা আমিই দিয়েছি। প্রথম কোপ দিয়েছে মরু বীর। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়েছিলো। কিছু রক্ত মরু বীরের হা হয়ে থাকা মুখের ভেতর ঢুকে যায়। কিন্তু জানেন, খুনোখুনি একটা বোরিং কাজ। তাছাড়া আমরা এখন আর খুনের পক্ষে নই। খুনের সংস্কৃতি থেকে সরে আসার সময় হয়েছে। রক্তভেজা ঐতিহ্য ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। পৃথিবীর অগ্রযাত্রায় খুন কোন ভূমিকা রাখে না। অযথা টাইম লস, এনার্জি লস।

– বাহ! খুব ভালো কথা।

– শুধু কি তাই! আমরা এখন একে অপরের সমালোচনা করতে পারি। সইতেও পারি। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে হুজুরের সাথে গ্রুপ চ্যাট করি। চ্যাটে আমরা সবাই মিলে হুজুরের সমালোচনা করি, হুজুর তা খন্ডন করার চেষ্টা করেন। কখনো পারেন, কখনো পারেন না।

– খুব ভালো উদ্যোগ। আলোচনা সমালোচনা করলে জ্ঞানের চাষাবাদ হয়। নতুন নতুন চিন্তার সাথে যুক্ত হওয়া যায়।

– আপনারা মুক্তচিন্তার মানুষ। কিন্তু কীইবা এমন চিন্তা করেন। আমাদের হুজুর অনেক বড় চিন্তাশীল মানুষ। তিনি মানুষের স্বপ্ন নিয়ে চিন্তা করেন। হুজুর বলেছেন, “আর কখনো মানুষ খুন করবে না। একজন মানুষ খুন হওয়ার সাথে সাথে তার স্বপ্নও খুন হয়ে যায়। কারণ খুন হয়ে যাওয়ার মানুষটির উত্তরসূরীরা হয়তো তার স্বপ্ন বয়ে বেড়াতে রাজি নাও হতে পারে।“

– হুজুর কি নিজের বাড়িতে থাকেন, নাকি ভাড়া বাড়িতে? যেতে আর কতক্ষণ লাগবে?

– আপনি হয়তো জানেন হুজুরেরও হুজুর আছে। তো, সেই হুজুরেরা আমাদের হুজুরকে একটা বাড়ি দিয়েছিলেন। সেটা ছেড়ে দিয়ে এখন একটা ভাড়া বাড়িতে থাকেন। বাড়ি বলতে বাসা আরকি। এক রুমের বাসা। যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না। সামনেইতো আপনার ডাক্তারের চেম্বার। একটা ব্রেক নিবো আমরা।

– ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। ঘাড়ে ব্যাথা ভালো হয়ে গেছে। আর কখনো ব্যাথা হবে না মনে হয়।

– বাহ্! বেশতো। বেঁচে গেলেন। ঘাড়ে ব্যাথা খুব বিরক্তির। অসহ্য যন্ত্রনাকর। জানেন, পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার ওই বিশাল প্রবন্ধটিই আমাদেরকে বদলে দিয়েছে। ওই প্রবন্ধ পড়ার পর হুজুর আমাদেরকে নতুন করে চিন্তা করতে বলেছেন।

– তাই নাকি! কিন্তু সেটাতো অনেক আগে লিখেছি। এতদিন পর কেন পরিবর্তন হলো?

– আরে, ওইসময়তো শুধু টাইটেল পড়েই হুজুর আপনার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে দিয়েছিলেন। সপ্তাহখানেক আগে কীভাবে যেন পুরো লেখাটি পড়ে ফেললেন। তারপর এই ঘটনা। আপনি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। ভাবনার জগতে ফাটল ধরিয়েছেন। আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

মাহমুদ সাহেব ভাবছেন এসব হচ্ছেটা কী! সত্যিকার অর্থে পত্রিকার লেখাটি অনেক আবেগী ছিলো। এই আবেগী লেখা জঙ্গীদের জীবনবোধ পাল্টে দিবে ভাবেননি। কিন্তু সব চিন্তা কি ওদের হুজুরই করে। ওরা কোন চিন্তা করে না?

– চিন্তাতো আগে থেকেই করতাম। ব্লগারদেরকে মারতে যাওয়ার আগে সারারাত চিন্তা করতাম। কতকিছু ভাবতাম! ভাবতাম এমন যদি হয় যে, তার ঘাড়ে শুধু কুপিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু কাটা যাচ্ছে না, মাথায় কোপ দিলে আগুন ধরে যাচ্ছে; তখন আমি কী করবো? আল্লাহু আকবার বলে তার সামনে সিজদায় পড়ে যাবো? নাকি ভূত ভূত বলে চিল্লানি দিবো?

লাল তলোয়ার নামে ছেলেটির এই কথা শুনে নিঃসঙ্গ আকাশের মনে পড়লো একটি দুঃস্বপ্নের কথা। – একদিন রাতে স্বপ্ন দেখলাম এক ব্লগারকে জবাই করার সময় রক্তের সাথে অনেকগুলো বাংলা বর্ণমালা বেরিয়ে আসছে। তারপর সেগুলো দিয়ে শব্দ হলো, আপনা আপনি বাক্য হলো। শেষে সবগুলো বর্ণ শব্দ আর বাক্য মিলে একটি কবিতা হলো। কৌতুহলে কবিতার গায়ে হাত দিতেই আমার আঙ্গুল কাটা গেলো। কী ধারালো! ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর সারারাত ঘুমাতে পারিনি। খুব ভয় পেয়েছি।

অদ্ভুত! হরর গল্পের মতো। কিন্তু এমনিতে তোমরা কী চিন্তা করো? – বললেন মাহমুদ সাহেব।

জবাবে বখতিয়ারের ঘোড়া বললো, আমরাতো এখন আর চিন্তা করি না; মুক্তচিন্তা করি। আমাদের প্রত্যেকের একটি করে মুক্তচিন্তা আছে। আপনি শুনে দেখেন, ভালো লাগবে।

– আমার মুক্তচিন্তা হচ্ছে, খুন করার চাইতে একটি গাছ লাগানো অনেক ভালো। এর অক্সিজেন দিয়ে অনেক মানুষ বাঁচতে পারবে।

– রং অনেক শক্তিশালী একটা জিনিস। আমরা পানি দেখলে সাতার কাটার জন্য ঝাঁপ দিই কিন্তু লাল রঙের পানি দেখলে রক্ত ভেবে ভয় পাই। রঙ সবকিছু বদলে দেয়। পানিকে রক্ত বানিয়ে দেয়। এই জন্য হুজুররা রক্ত ভয় পায় না, রঙ ভয় পায়।

– নদী, বন এসব বাঁচানোর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে কোন লাভ নাই। যেখানে মানুষের হাত পড়ে যায়, ঈশ্বর সেখানে অসহায়।

– দ্বিমত করার অভ্যাস গড়ার আগে একমত হওয়া শিখতে হয়। তা না হলে দ্বিমত করার সাহস অরক্ষিত হয়ে পড়ে।

– ঈশ্বরের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। মানুষ ঈশ্বরকে যতটুকু ক্ষমতাবান মনে করে, তিনি কেবল ততটুকুই ক্ষমতাবান। মানুষ নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী ঈশ্বরকে ক্ষমতা দান করে। ঈশ্বর বেঁচে থাকেন মানুষের দয়ায়।

সবার চিন্তা শুনে ভাবনার জটে পড়ে যান মাহমুদ সাহেব। তিনি ভাবেন, মাত্র এক সপ্তাহে এরা এত জটিল কিছু চিন্তা করতে শিখে ফেলেছে! নাকি এরা আগে যা চিন্তা করতো, এখন তার উল্টোটা চিন্তা করে?

– কী যা তা ভাবছেন! একেবারে ঘাড় থেকে কল্লা আলাদা করে দিবো। আমাদের চিন্তা নিয়ে মশকরা করেন? একদম জিহ্বা কেটে দিবো। শালা ফাউল কোথাকার!

লাল তলোয়ার নামের ছেলেটির মুখে এমন কথা শুনতে প্রস্তুত ছিলেন না মাহমুদ সাহেব। আচমকা ভয়ে জড়সড় হয়ে যান। শরীরে চিকন ঘাম ছেড়ে দেয়ার আগেই ছেলেটি সংশোধন করে দিলো। – স্যরি, অভ্যাসবশতঃ বলে ফেলেছি। আমরা যা চিন্তা করেছি, তা নিয়ে আপনি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারবেন। এটা আপনার অধিকার।

তবুও ভয় কাটে না মাহমুদ সাহেবের। ঘোর সন্দেহ হয়। ভাবছেন এরা বোধহয় জবাই করার জন্যই ধরে নিয়ে যাচ্ছে। হয়তো হুজুরের ইচ্ছে হয়েছে নিজ হাতে জবাই করবে, তাই লোক পাঠিয়ে সিস্টেমে নিয়ে যাচ্ছে। আরামসে নিজের ঘরে বসে বসে জবাই করবে। ছেলেগুলো গাড়িতে ভালো ভালো কথা বলছে ধরা খাওয়ার ভয়ে। যদি চিল্লাপাল্লা করে, ঝামেলা করে! কিন্তু কী করা যায়, তাই ভাবছেন। এখনও সময় আছে, পালিয়ে যাওয়ার। প্রস্রাবের কথা বলে গাড়ি থেকে নেমে দৌড় দেয়া যায় কিনা ভেবে দেখছেন। নাকি পকেট থেকে কলমটা বের করে ড্রাইভাবের ঘাড়ে গেঁথে দিবেন! তাহলে গাড়ি এলোমেলো চলবে, এই সুযোগে দরজা খুলে লাফ দেয়া যাবে। কিন্তু হালকা ব্রেক কষে গাড়িটি থেমে গেলো।

– আমরা চলে এসেছি, গাড়ি থেকে নামুন। আপনার জন্য হুজুর অপেক্ষা করছেন।

শুনে হতাশ হলেন মাহমুদ সাহেব। খুব অসহায় বোধ করছেন। ভাবলেন ওদেরকে বিশ্বাস করে ভুল হয়েছে। আরো আগে পালানোর কথা চিন্তা করা উচিত ছিলো। গাড়ি থেকে নেমেই দৌড় দেয়ার চিন্তা করেছেন। কিন্তু ওরা এমনভাবে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, দৌড় দেয়ার কোন উপায় নেই। ওদের সাথে হুজুরের বাসায় যাওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। উপায়ন্ত না দেখে ঘটনার শেষ দেখার সিদ্ধান্ত নিলেন।

হুজুরের রুমে ঢুকতেই বসা থেকে উঠে কাজল মাহমুদকে অভ্যর্থনা জানালেন দারুন এক হুজুর। আসার সময় কোন অসুবিধা হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। কিন্তু হুজুরকে দেখে অবাক হলেন মাহমুদ সাহেব। মনে মনে ভাবলেন হুজুরের দাঁড়ি কই? তাছাড়া টিশার্টটিও বোধহয় আজিজ সুপার মার্কেট থেকে কেনা। জীবনানন্দ দাশের কবিতার স্ক্রীণ প্রিন্ট। পরনে থ্রি কোর্যার্টার প্যান্ট। এরকম হুজুর এর আগে দেখেননি তিনি।

– আমার গেটআপ নিয়ে কী সব উদ্ভট চিন্তা করছেন! দাঁড়ি দিয়ে হুজুর চেনার চেষ্টা করছেন? আরে ভাই, আমরাতো বানরের বংশধর। গায়ে একটু আধটু চুল থাকবেই। গালের চুলগুলো গতকাল কেটে ফেলেছি। এখন কিছুটা ফ্রেশ লাগছে। পরে ভালো লাগলে আবার রেখে দিবো, সমস্যা কী? এসব চুল টুল নিয়ে না ভেবে আসেন গুরুত্বপূর্ণ আলাপটা সেরে ফেলি। তারপর একসাথে দুপুরের খাবার খাবো।

আরো একবার অবাক হলেন মাহমুদ সাহেব। ভাবলেন অন্যকিছু চিন্তা না করে বরং হুজুরের কথাগুলো শুনি। মনে হয় না জবাই টবাই করবে। হুজুর এখন জবাইয়ের মোডে নেই। হুজুরের চোখ ভরা কৌতুহল। নিশ্চয় চিত্তাকর্ষক কিছু নিয়ে ভাবছিলেন বসে বসে। চিত্তাকর্ষক চোখ খুবই নিরাপদ। আস্থা রাখা যায়। নিশ্চিন্তমনে হুজুরের মুখোমুখি চেয়ারে বসে চোখ ঘুরিয়ে ঘরটা দেখে নিলেন। সাদামাটা। কিছু ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস, একটা খাট, তিনটা চেয়ার, একটা টেবিল, একটা আলমারি আর একটা বইয়ের তাক। খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো। রুমে কেউ নেই। ওই পাঁচজন যুবক এখন বাইরে।

– তাহলে শুরু করা যাক। আসার পথে ছেলেগুলো কী কী বলছে, সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। ওরা নিশ্চয় আপনার মাথায় চিন্তার ঝট পাকিয়ে দিয়েছে। আমি জানি আপনি বেশ স্বপ্নবান একজন মানুষ। আমিও আপনার মতোই। তো, স্বপ্নই সমস্যা আবার স্বপ্নই সম্ভাবনা। আমরা প্রত্যেকে স্বপ্ন দেখি। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, সবারই অনেক অনেক স্বপ্ন। কিছু স্বপ্ন পূরণ হয়, আবার কিছু হয় না। তবুও মানুষ নতুন নতুন স্বপ্ন দেখে। আবার কিছু স্বপ্ন মানুষ নিজের থেকে বাদ করে দেয়। যেমন আমার স্বপ্ন ছিলো বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট এর খলিফা হওয়ার। কিন্তু গত সপ্তাহে এই স্বপ্নটি বাদ করে দিয়েছি। এখন নতুন স্বপ্ন দেখছি। অনেকগুলো মানুষের স্বপ্ন নিয়ে আমার স্বপ্ন। আপনি কি বুঝতে পারছেন আমার কথা?

– জ্বি বলুন। শুনতে খুব ভালো লাগছে।

– ধন্যবাদ। আপনি নিশ্চয় ফরিদপুর জেলা সম্পর্কে জানেন। এই জেলার বেশিরভাগ ভূমি পদ্মা নদীতে ভেঙ্গে যাওয়া আবার বেশিরভাগ ভূমি নদী থেকে উঠে আসা। চর মির্জাপুর সেরকমই একটি এলাকা। চর ভদ্রাসন উপজেলার এই চরের মানুষ মূলত কৃষক ও মৎস্যজীবী। শিক্ষার হার খুবই কম। কিন্তু এই চরের মানুষ বেশ স্বপ্নবান। তারা প্রচুর স্বপ্ন দেখে। যখন তখন স্বপ্ন দেখে। এদের স্বপ্ন দেখার কোন রুটিন নেই। এবং স্বপ্নের হারও ব্যাপক। কিন্তু বেশিরভাগ স্বপ্নই পূরণ হয় না। চরের মানুষগুলো স্বপ্ন সচেতন নয়। তারা স্বপ্নের যত্ন নিতে পারে না বলে প্রায় সব স্বপ্ন মরে যায়। অথবা নদী ভেঙে নিয়ে যায়। এখন আমি চাইছি তাদের স্বপ্নগুলো টিকে থাকুক এবং পূরণ হোক। এই জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। প্রকল্পের দায়িত্বটা আপনাকেই দিতে চাই। আপনি আমার অনেক পছন্দের মানুষ। অনেক আস্থা আপনার প্রতি। আশাকরি আপনি মনযোগ দিয়ে শুনছেন।

কিছুই বুঝতে পারছেন না মাহমুদ সাহেব। পুরো বিষয়টা ক্লীয়ার হওয়ার জন্য দেরি সইছে না। চোখে মুখে দুনিয়ার সব কৌতুহল এক করে বললেন, -জ্বি বলুন।

– ওই চরে নদীর তীর ঘেঁষে একটি কাঠের ঘর বানিয়েছি। ঘরের চালও কাঠের, বেড়াও কাঠের। শরতে হেমন্তে চারপাশ কাশফুলে সাদা হয়ে থাকে। উপজেলা থেকে আসা একটি রাস্তা সোজা এসে ঘর থেকে কিছুটা দূরে বাঁক নিয়েছে। সেই বাঁক থেকে আরেকটি নতুন রাস্তা ওই ঘরের দিকে গেছে আর বাঁক নেয়া রাস্তাটি গেছে গ্রামের দিকে। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে আপনি সেই ঘরে উঠবেন। সেখানে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করা আছে। খাবারের ব্যবস্থাও আছে। পড়ার জন্য আছে বিশাল একটি লাইব্রেরি। গান শোনার, মুভি দেখার ব্যবস্থাও আছে। চব্বিশ ঘন্টা বিদ্যুত থাকবে। ইন্টারনেট আছে। আর আছে একটি ল্যাবরেটরি। সেখানে একটি মেশিন বসানো আছে। অনেকগুলো তাকে সাজানো আছে ছোটবড় কয়েক হাজার বয়াম। এরমধ্যে কিছু বয়াম ড্রাম সাইজের আবার কিছু পেনিসিলিন লিকুইডের ছোট্ট শিশির সমান। চরের বেশিরভাগ মানুষ বুঝতে পারে না তারা আসলে কী স্বপ্ন দেখে। আপনি মেশিন দিয়ে তাদের স্বপ্ন নির্ণয় করবেন। তারপর তাদেরকে সেটা বলবেন এবং সেই স্বপ্ন সাইজ অনুযায়ী বয়ামে ভরে রাখবেন। আমরা এসব স্বপ্ন লালন পালন করবো এবং একটা সময় তাদের সব স্বপ্ন পূরণ করে দিবো। এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। এবার আপনার সিদ্ধান্ত বলুন।

– অসাধারণ প্রকল্প। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কী সুন্দর চিন্তা আপনার! সত্যিই অসাধারণ! আমি এক কথায় রাজি। নিঃশর্তভাবে রাজি। আপনার আইডিয়াটা খুবই ভালো লাগলো। সবকিছু শুনে আমার বাবার কথা মনে পড়লো। তার একটা স্বপ্ন ছিলো। মনে হয় কখনো পূরণ হবে না। বাবা বেঁচে নেই, থাকলে উনার স্বপ্নটিও বয়ামে ভরে রাখতাম। তারপর একটা সময় পূরণ হতো। উনি স্বপ্ন দেখতেন আমি একদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবো। তারপর আমার বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় দেশ ভরে উঠবে সুখ ও সমৃদ্ধিতে। গতরাতেও ভেবেছি, বাবার স্বপ্ন যদি পূরণ হতো, আর আমি যদি প্রধানমন্ত্রী হতাম, তাহলে এখন এভাবে চাপাতির আতংক নিয়ে বেঁচে থাকতে হতো না। আমার নিরাপত্তার জন্য কত মানুষ নিযুক্ত থাকতো। তাদের নিরাপত্তার চাদর ডিঙিয়ে চাপাতিতো দূরে থাক, একটা সুঁইও বের হতে পারবে না। আহা! কী যে মজা হতো।

কথাগুলো বলতে বলতে কাজল মাহমুদ টের পেলেন তার শরীরটা ক্রমশ হালকা হয়ে যাচ্ছে। দেহের ভেতরে খুব শূন্যতা অনুভব করছেন। হাত পা নাড়াতে পারছেন না। চোখ দু’টো বুঁজে আসতে চাইছে। ঘোলাটে দেখছেন সবকিছু। বহুকষ্টে ভালো করে চেয়ে দেখলেন তার পুরো শরীর রক্তে ভেজা। রক্ত গড়িয়ে ফুটপাতের পাশে ড্রেনে গিয়ে পড়ছে। অনেক রক্ত। লাল রক্ত। এর আগে কখনো কাছ থেকে এত রক্ত একসাথে দেখেননি। চাপাতির কোপে হা হয়ে থাকা গালের মাংসে বাতাস লাগছে। খুব শীত লাগছে ওইসব কাটা স্থানে।

তাকে ঘিরে মানুষের জটলা, কেউ কেউ বলছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা। কেউ বলছে একটু সাহস করলেই খুনীদের ধরা যেতো। কেউ বলছে নিশ্চয় ব্লগার, ব্লগার ছাড়াতো কাউকে এভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে না।

মানুষের জটলা থেকে ভেসে আসা শেষের কথাগুলো ঠিকমতো শুনতে পাননি লেখক ও কলামিস্ট কাজল মাহমুদ। নিজেকে বাঁচাতে পারেননি তিনি। মরে গেলেন। মরে যেতে যেতে কিছু স্বপ্ন দেখেছেন। এটা নতুন কিছু নয়। উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখা ছিলো লেখক ও কলামিস্ট কাজল মাহমুদের অনেকগুলো বদ অভ্যাসের একটি।