(১)
বেশ ক’দিন থেকে মীজান ভাইকে খুব মনে পড়ছে। মন ভীষণ খারাপ থাকলে এমনি করেই সারাক্ষণ মনে পড়ে মীজান ভাইকে। লেখক,অধ্যাপক, গনিতবিদ ডঃ মীজান রহমান। খুউব যে পরিচয় ছিল মীজান ভাইয়ের সাথে সেটা নয়; কানাডা-আমেরিকার প্রায় প্রতিটি শহরে অনেক অনেক আপনজন ছিল মীজান ভাইয়ের, সে সকল আপনজনের মতো এত সখ্য ছিল না, পরিচিতিও ছিল না দীর্ঘদিনের, অন্তত সময়ের বিচারে তো অবশ্যই। তবু প্রয়াত হ’বার দু’আড়াই বছর আগ থেকে বেশ অনেকবারই মীজান ভাইয়ের সখ্যতা পেয়েছি। কোনদিন টেলিফোন করেছি কিনা মনে পড়ে না; কিন্ত তিনি টেলিফোন করতে ভুল করতেন না কখনোই। মাসে দু’একবার তো বটেই। টেলিফোনে না পেলে মেসেজ রেখেছেন; কতবার যে কলব্যাক করিনি মীজান ভাইকে আজ তা ভাবলে অপরাধীই মনে হয়। আজ যখন ভাবি আহা যদি কথা বলা যেত আরও কিছুটা সময়?

(২)
মীজান রহমানই প্রথম একটি ই-মেইল করেন আমার লেখা পড়ে। তখন অভিজিৎ রায়ের “ মুক্তমনা”-য় নিয়মিত লিখতাম। বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংসারিক জীবনের প্রথম দিকে আমাদের হরিহর আত্মার একজন বন্ধু ছিল “ সুরঞ্জনা”। গান-কবিতা-আড্ডা কী না করেছি তিনজনে আমরা! সেই “সুরঞ্জনা” জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পর ধর্মীয় মৌলবাদী একজনের সাথে ঘর বেঁধে বাস করতো আমরা যে শহরে থাকতাম তারই ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে। অথচ উচ্ছ্বল সে “সুরঞ্জনা”-র তখন স্বামী ছাড়া অন্য কোন পুরুষের সামনে আসা নিষেধ। সে কাহিনীই লিখেছিলাম “বিভক্তির সাতকাহনে”। মীজান ভাই সে লেখা পড়েই ই-মেইল করেন। এত উষ্ণ আর আপন সে ই-মেইলের ভাষা যেন অচেনা মীজান রহমান নিমিষেই চিরচেনা মীজান ভাই হয়ে গেলেন। যোগাযোগের সূত্রটা তখন কিন্ত সীমাবদ্ধ ছিল ই-মেইল আর মুক্তমনার ইয়াহু গ্রুপ ই-মেইলে। কিন্ত অনুপ্রেরণার কি কোন কমতি ছিল সে পাবলিক ফোরামের যোগাযোগে? মীজান ভাইয়ের একটি ই-মেইল যেন অনেক দিনের ক্লান্তি মুছে দিয়ে আবার ঝকঝকে তকতকে করে দিত তখন।

(৩)
কোলাহল আগে পছন্দ করতাম; এখন করি না। ফলে সঙ্ঘ ও সমষ্ঠি এড়িয়ে চলি। প্রবাসে এত এত বিখ্যাত ও বিদ্বজনের আগমন যে কোথাও গেলে নিজেকে তাঁদের তুলনায় জ্ঞান-বিজ্ঞানে অপ্রতুল ও অপ্রস্ততই লাগে। তাছাড়া এত বাহারি মুখোশের সমারোহ, এত ঘরে-বাইরের বহুরূপীতা; হাঁপিয়ে উঠি কোথাও গেলে। তাছাড়া বিখ্যাত মানুষদের এড়িয়ে চললে তাঁদের প্রতি সমীহ আর শ্রদ্ধাবোধটা অটুটই থাকে ব’লে আমার বিশ্বাস। কালে ভাদ্রে কোথাও গেলে তাই পেছন দিক থেকেই চলে আসি নিভৃতে নিরবে। মীজান ভাইকে দেখেও সামনে যাইনি কখনো কোনদিন। ক্যালিফোর্নিয়ায় বড় ছেলের কাছে বেড়াতে গিয়ে আমার আরেক বন্ধুর কাছে কিঞ্চিত অভিযোগও করেছিলেন মীজান ভাই।

আমার সে দৃশ্যমান পলায়নপরতা আর বেশীদিন টিকিয়ে রাখা গেল না। নিউইয়র্ক থেকে আমার এক বন্ধু দম্পতি সেবার বেড়াতে এলো। মীজান ভাইয়ের অতি আপনজন তারা। মীজান ভাইয়ের সাথে দেখা করা ও বেড়ানো তাদের সফর সূচির অংশ। আমি মীজান ভাইকে তখনই প্রথম টেলিফোন করি।প্রথম দিন টেলিফোন ধরেই আমার নামকে দীর্ঘায়িত উচ্চারণে এমনভাবে ডাকলেন যেন মনে হলো কত কতবার কথা বলেছি তাঁর সাথে যেন! কত আপন একজন মানুষের আবেগসিক্ত সম্বোধন,“ ধুর মিয়া,তোমাকে তো পাওয়াই যায় না; থাকো কোথায় শুনি!” কন্ঠের উষ্ণতায় সিক্ত হয়ে গেলাম আমি। প্রথম দিন কম করে হলেও কয়েক ঘন্টা তো কথা বললামই।একটু অবাকই হ’লাম আমাকে ও আমার পরিবারের খুঁটিনাটি সবই মীজান ভাইয়ের জানা। এত আপন একজন মানুষের সাথে আগবাড়িয়ে কেন পরিচিত হতে যাইনি- আপসোসই হলো। ক্ষমা চেয়েছিলাম মীজান রহমানের কাছে। প্রতিশ্রতি আদায় করে নিয়েছিলাম এই বলে যে, আমার বাড়িতে কয়েকদিনের আতিথেয়তা গ্রহনে সম্মত জানালেই তবে বুঝবো যে আমাকে ক্ষমা করেছেন। মীজান ভাই সেবার দু’দিন থেকেছিলেন আমার বাড়িতে।

যেদিন চলে যাবেন সেদিনের দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। স্বল্পাহারি মীজান ভাইকে সেদিন আমরা সবাই মিলে খুউব ঝাল করে রান্না শুটকি মাছ খাইয়েছিলাম প্রায় জোর করেই। মীজান ভাই খাচ্ছেন আর ঘামছেন। ঘরের এয়ারকন্ডিশনের ঠান্ডায় শুটকির ঝালের ঘাম কিছুতেই কমছে না। মাথা-মুখ-নাক দরদর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। একহাতে টিস্যু পেপার দিয়ে ঘাম মুছছেন, অন্য হাতে খাচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে কেনা তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করছি আমরা। মীজান ভাই এত কষ্ট সহ্য করেও খেলেন চান্দা মাছের শুটকি আমাদের আবদার মেনেই। পরে ঠাট্টার ছলে বলেছিলেন, জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে পুরান ঢাকার শুটকি আড়তের কাছে। হয়ত সে কথাই মনে পড়ছিল মীজান ভাইয়ের সেদিন।

(৪)

কাকতালীয় হলেও দেখেছি যখনি প্রচন্ড মন খারাপ থাকতো, ভাবতাম মীজান ভাই কল করলে ভালোই হতো! মিজান ভাইয়ের টেলিফোন পেতাম দু’চারদিনের মধ্যেই। হতাশাকে বিদায় করে নানা কথা বলে যেতেন মীজান ভাই। প্রবাসী বাংগালীদের কূপমন্ডুকতায় প্রচন্ড ব্যথিত হতেন; ধর্মীয় গোঁড়ামি কেনো এত জগদ্বল পাথরের মতো জেঁকে বসছে এ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বলে যেতেন মীজান ভাই। প্রাচীন ও মধ্যযুগের আরব ভূখন্ডের ইতিহাস এত পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণ ডঃ আহমদ শরীফের পর মীজান ভাইয়ের কাছেই শুনেছি। বাংলাদেশ ও প্রবাসের বাংগালী মুসলমানের মন মানসিকতা কেন ওই অন্ধকার যুগের আরব ভুখন্ডের ইতিহাস দ্বারা প্রভাবান্বিত হচ্ছে ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনা দিয়ে তা বিশ্লেষণ করতেন মীজান রহমান। মীজান ভাইয়ের পরামর্শেই অনেকগুলো বই কিনেছিলাম, তাদের অন্যতম “ Reading Lolita In Tehran”। বইটি নিয়ে আর আলোচনা করার সুযোগ হলো না। আয়ান হিরসি আলীর “Infidel”, “Nomad”-এর পর “ Heretic :Why Islam needs a Reformation now” বেরিয়েছে। বইটি পড়ে অনেক কিছু আলোচনা করা যেতো মীজান ভাইয়ের সাথে- সে সুযোগটা এ বছরের প্রথম মাসের প্রথম সপ্তাহেই চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গেল।

মীজান ভাইয়ের সাথে শুধু যে সম্মতি সূচক আলোচনাই হতো সেটা বলা যাবে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যত, গনজাগরণ মঞ্চ এসব নিয়ে মীজান ভাইয়ের দৃষ্টিভংগী খুব আশাপ্রদ ছিল না। মীজান ভাইয়ের এ নেতিবাচকতার সাথে একমত হতে পারতাম না তখন। কিন্ত এ এক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশে সর্ব্ব্যাপি অবক্ষয় আর ধর্মীয় মৌলবাদের তোষামোদ দেখে এবং গনজাগরণ মঞ্চের মতো একটি উদীয়মান সম্ভাবনাকে এমনভাবে নষ্ট করা দেখে মীজান ভাইয়ের সে নেতিবাচকতাকেই বাস্তব মনে হয় এখন। মীজান ভাইয়ের সে নেতিবাচকতা সত্য প্রমানিত হলে বাংলাদেশ হারাবে তার স্বাধীনতার মূলচেতনা- যদিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কিছু অবশিষ্ট আছে সেটাও কি বলা যাবে এখন?

(৫)

কিছু বিষয়ে একটু মন খারাপই করেছিলাম মীজান ভাইয়ের ওপর।অভিমান ছিল কিন্ত অভিযোগ জানানোর সময় হলো না। স্ত্রী মারা যাবার পর অনেকটাই একা হয়েছিলেন মীজান রহমান। ছেলেরা দূরে চলে গেলেন কর্মক্ষেত্রে। প্রথাবিরোধী লেখা ও কথাবার্তার জন্য সবসময় ঘেটু বাংগালীদের কাছ থেকে সচেতনভাবেই দূরে থাকতেন। চিন্তা চেতনার অমিলের জন্য নিজ বাসস্থান অটোয়ায় ঘনিষ্ঠজন তেমন কেউ ছিল না। টরন্টো নিউইয়র্ক কিংবা অন্যান্য শহরেই তাঁর মন ও মতের মিল আছে এমন মানুষ বেশী ছিল। এঁদের অনেকের সাথেই তাঁর দেখা সাক্ষাত খুব কম হতো; অধিকাংশই টেলিফোনের আলাপে পরিচয়। ফলে অনেক প্রতিক্রিয়াশীল মানুষজন ও পরিবারের সাথেও তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে; তিনি যে তা বুঝতেন না সেটা বলা যাবে না। যদিও বাহ্যিকভাবে অনেকের কাছেই তা দৃষ্টিকটু মনে হতো। কিন্ত অনেকটা ক্ষমা ও উদারতা নিয়েই তিনি সে মানুষগুলোর সাথে মিশতেন। তবে তাঁর প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনায় কখনো কোথাও আপোষ ছিল না।এ সামান্য অভিযোগটুকুও আর বলার সুযোগ হলো না। চির বিদায় নিলেন মীজান ভাই।

অভিযোগ জানানো হলো না মৃত্যুর পরে তাঁর মরদেহ নিয়ে যা করা হলো সেটা নিয়েও। অভিমান রয়েই গেল তাঁর সারাজীবনের মতাদর্শবিরোধী যে ধর্মীয় প্রথা- কেন তাঁকে সে মতেই সমাহিত করা হলো সেটা নিয়েও। অভিযোগ করা হলো না, কেন মীজান ভাই তাঁর স্ত্রীর কবরের পাশে নিজের জন্য কবরের জায়গা কিনে রেখে গিয়েছিলেন?

অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে যখন ধর্মীয় প্রথা মেনে সমাহিত করা হয় তখন আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম, খানিক ক্ষুব্ধও হয়েছিলাম অনেকেই। তখন তাঁর স্বজনেরা বলেছিলেন, হুমায়ুন আজাদের মত ও বিশ্বাসের মতো তো অনেক কিছুই হয়নি, তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহটাকে কবর দেয়া হলে না হয় আরও একটা বিশ্বাসের মৃত্যুই হবে?তবুও তাঁর স্বজনেরা প্রশান্তি তো পাবেন।

একেকবার ভাবি বড়ই খোড়া এ যুক্তি। বড়ই অমর্যাদাকর ও বিপরীত এ আপ্তবাণী , যা এ প্রগতিশীল মানুষগুলোর সারাজীবনের শিক্ষা ও মতাদর্শ পরিপন্থী। আবার ভাবি যে মানুষটা চিরদিনের জন্য চলে গেছেন, তাঁর প্রাণহীন দেহ শুধু একটুকরো জড়বস্ত ব্যতিত বই আর তো কিছু না। সেটা কবর কিংবা দান কিংবা যা খুশী করা হোক সেটা নিয়ে ভাবা কি খুব জরুরী কোন বিষয়?

একজন আরজ আলী মাতুব্বর, একজন হুমায়ুন আজাদ, একজন আহমদ শরীফ কিংবা একজন মীজান রহমান কিংবা একজন অভিজিৎ রায় তাঁদের লেখনির মাধ্যমে যে চেতনার দ্যুতি ছড়িয়েছেন তার আলোতেই বেঁচে থাকবেন। আমরা কিছুদিন বলবো, “ অথচ যাঁদের জন্য বেঁচেছিলাম এ নির্জনে, তাঁরা কেউ নেই”। আবার কোন প্রথাভাঙ্গা নতুন মানুষ আসবেন; শোনাবেন প্রগতির কথা, সামনে চলার কথা, ধর্মীয় গন্ডির বাইরের এক সার্বজনীন মানবিকতার কথা, বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মানের কথা। এক চক্রাবর্তের ঘূর্ণীতে তাঁরাও আবার বিগত হবেন; পথ দেখাতে আসবে আবার অন্য কোনো আলোর পাখিরা।

আরজ আলী মাতুব্বর, হুমায়ুন আজাদ, আহমদ শরীফ কিংবা মীজান রহমান কিংবা অভিজিৎ রায় –রা আসবেনই ফিরে ফিরে। তবুও খুউব মনে পড়ে মনখারাপকরা সময়ে, মীজান ভাই; আজকে এই সময়ে যেমন খুউব মনে পড়ছে আপনাকে!!!

।।সেপ্টেম্বর ৯,২০১৫ ।।