লেখক: জাবের ইবনে তাহের

বৃষ্টি পরছে বাহিরে। বৃষ্টি ঝুম। এই বৃষ্টি টা খুব ভালো। গুরি গুরি বৃষ্টি কখনো ভাল লাগে না। সেটা বিরক্তিকর হয়।ঝুম বৃষ্টির মাঝে একটা ভাল লাগা ভাল লাগা ব্যাপার থাকে।
মা ডাকছেন- কি রে আজ কি স্কুল এ যাবি?
না, আজকে স্কুল এ যাব না, ভাল লাগছে না।
উত্তর পেয়ে তিনি আবার রুটি বানানোর কাজে মনোযোগ দিলেন।
আমার কখনো স্কুল ব্যাপারটাকে খুব ভাল লাগে আবার কখনো খুব বিরক্তিকর মনে হয়। মনের কোনও ঠিকঠিকানা নাই। মাঝে মাঝে নিজেই বুঝি না আমি নিজে কি চাই?
আমার বয়স ১৬। দশম শ্রেনিতে পরি। নাম-রাহিমা আক্তার নিলা। বাবা আদর করে ডাকেন রাহি। আমার আরও তিন জন ভাইবোন আছে। দুইজন ভাই আর একজন বোন। বাবা তার ছেলেমেয়েদের মাঝে আমাকে সবচাইতে বেশি ভালবাসেন। আর মা বড় ভাইয়াকে।
বাবার জন্য আমার খুব মায়া হয়। বড় ভালোমানুষ তিনি। বাবা যখন আমাকে আদর করে রাহি বলে ডাক দেন তখন আমার বুকের ভেতরটা হটাত মোচড় দিয়ে ওঠে। আমার নয় বছর বয়স পর্যন্ত বাবার কাছেই ঘুমাতাম। আমার অন্য ভাই বোনদের বাবার কাছে আসতে দিতাম না। সবসময় আমিই বাবার সবটুকু ভালবাসা পেতে চাইতাম। আমি বাবা কে এতটা ভালবাসি বলেই বোধহয় বাবা আমাকে এতটা ভালবাসেন। কিংবা বাবা আমাকে এত ভালবাসেন বলেই বোধহয় আমি বাবাকে এতটা ভালবাসি। সমান সমান ভালবাসা।
আমার বয়স বাড়বার সাথে সাথে বাবার কাছ থেকে আমি খানিকটা দূরে সরে যেতে থাকি। মাঝে মাঝে কষ্ট পেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারি না। কারন আমি বড় হয়েছি । খুব খানিকটা বড়। গ্রামে গঞ্জে আমার মত মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়। অনেকের এই বয়সে ছোট বাচ্চাও থাকে। মা হয়ে যায়। মেয়েদের অল্প বয়সেই তারা বড় হয়ে যায়। শরীর মন সব দিক থেকেই বড়। শুধু সময়টাতেই নয়। আমিও বড়।

বড় হবার সাথে সাথে আমার প্রেম ভালবাসায় আগ্রহ জাগতে শুরু করে। এগুলো সম্পরকে খুব জানতে ইচ্ছে হয়।আমাদের স্কুলে একটা ছেলে আছে। আমার খুব পছন্দ হয়। নাম মামুন। ছেলেটা দেখতে শ্যাম বর্ণ। মোটামুটি ভাল। তবে ওর চোখগুলো দেখতে আমার বাবার মত মায়াবী। তাই ওকে আমার খুব ভাল লাগে। বন্ধু বানাতে ইচ্ছে হয়। আবার সংকোচ বোধ ও কাজ করে। তাই তাকে আমার এই ভাললাগার কথাটাও বলতে পারি না। আচ্ছা আমি কি মামুন ছেলেটাকে ভালবাসি?

কে জানে আমি তো নিজেই নিজেকে বুঝি না। কেন বুঝি না আমি ওকে ভালবাসি কি না?
ধেৎ আমি ওকে ভালবাসতে যাব কোন দুঃখে ? ও তো আরেকটা মেয়েকে ভালবাসে।

আমার বাবা মধ্যবিত্ত কিন্তু মামুনের বাবা অনেক ধনী। ওদের অবস্থা আমাদের থেকে ভাল। এই ব্যাপারটা আমাকে প্রায়ই হীনমন্যতায় ভোগায়। আমি নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করি- মামুনের বাবা অনেকগুলো বিয়ে করেছেন। তার ছোট বউয়ের ছেলে মামুন। অনেক সম্পত্তি হলেও ছেলে মেয়েদের মধ্যে ভাগ হলে কমে যাবে। প্রতিনিয়ত আমার মাঝে এই হিসাব নিকাশ চলে। নিজেকেই যুক্তি দিয়ে বোঝাই ………। কেন বোঝাই?

পৃথিবীতে তো আরও অনেক ধনী লোক আছে, তাদের ছেলে আছে। কারো ব্যাপারটা আমাকে জ্বালা দেয় না কিন্তু মামুনের টা কেন দেয়? আমি কেন ওদের সম্পত্তির হিসাব নিকাশ করি? কেন চাই অরা আমাদের মত হয়ে যাক, মধ্যবিত্ত।

আমি আমার ভালপবাসার কথা কাউকে বলতে পারব না। কারন আমার বড় ভাইয়া জানলে তুল্কালাম কাণ্ড করবে। ভাইয়া HSC পরবার সময় তাব্লিগে যায়। এরপর আর লেখাপড়া হয় না।প্রায়েই ভ্যাগ কাধে নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যায় । মসজিদ থেকে মসজিদে ঘুরে বেড়ায়। আর কাজ বলতে ভাইয়ার এক্তা চায়ের দকান আছে। সেখানে ভাল জিনিস ও বিক্রি হয়। পাড়ার চায়ের দোকানের ,অত অতটা খারাপ নয়। তার থেকে ভাল।

ভাইয়ার বদউলতে আমাকে বাসা থেকে বোরকা পরে চোখমুখ ঢেকে বের হতে হয়।
আমার বোরকা পরতে সবসময় ভাল লাগে না। স্কুলে যাবার সময় ও বোরকা পরে যেতে হয়। অর্ধেক রাস্তায় গিয়ে বোরকা খুলে ফেলি। ছেলেরা হাসাহাসি করে। বোরকার নিচে শয়তা………………………………এইসব বাজে কথা বলে। তাই স্কুলে যাবার আগে রাস্তার মাঝেই বোরকা খুলে ফেলি। একদিন বাবার সামনে ধরা পরেছিলাম। বাবা বললেন- কিগো মা তোমার বোরকা কই?আমি নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। লজ্জায় আমার চোখমুখ লাল হয়ে আসছিল। বাবাকে কি বলা সম্ভব যে ছেলেরা বাজে কথা বলে তাই বোরকা পরি না। আমার তখন খুব কান্না পাচ্ছিল।

আমার ছোট ভাই তুহিনটা আমার বেশ কাছের মানুষ ছিল। এক বছরের ছোট। বন্ধুর মত সম্পর্ক। হটাত করে অচেনা হয়ে গেল আমার ভাইটা। মেয়েদের দিকে তার আকর্ষণ বেশি। আমি ওর ব্যাগে অনেকগুলো লাভ লেটার পাই। একেকটা একেক রকম হাতের লিখা।নেকামি করে লিখা। বুঝাই যাচ্ছে ও অনেকের সাথে প্রেম করে। এটা কি ঠিক? ও এরকম করে কেন? ওকে যেই মেয়েগুলো ভালবাসে ও তাদের সাথে প্রতারনা করে কেন? মানুষের জিবনে কি বিশ্বাস বলতে কিছু নাই? কাউকেই কি বিশ্বাস করা যাবে না? সব ছেলে ই কি তুহিনের মত? আমার বাবাও?

বৃষ্টি পরছে, আমি স্কুলের বাহিরে এক্তা গাছের নিচে দাড়িয়ে আছি। শরিরটা খানিক ভেজা। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। হটাত একাটা রিকশা থেকে কেউ ডাকল – এই নিলা রিকশায় উঠ। বৃষ্টি তে ভিজছ কেন?
পেছনে ফিরে দেখি মামুন। আমার লজ্জা করছিল।আমি বললাম থাক লাগবে না। ও আবার request করল। আমি ইতস্তত হয়ে ওর পাশে বসলাম। লজ্জায় আমার মুখটা লাল হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে রিকশার ফুট উঠানো।

মামুন আমাকে বলল, তুমি দেখতে খুব মিষ্টি। আমি আগে কখনও খেয়াল করি নি ।

আমার আরও লজ্জা করতে শুরু করল। মা ধমক দিয়ে উথলেন। আমি থতমত খেয়ে গেলাম।

-খাতায় এগুলো কি আঁকছিস? পৃষ্ঠা নষ্ট করিস কেন? এগুলোর কি দাম নাই?
আমি পরতে শুরু করি , ছোট বোন ওহি এসে তখন কাঁদতে শুরু করল।
-আপু একটা ছবি একে দেও না?
-এখন পারব না। যা তো এখান থেকে
-দেও না আপু, এই আম্মু আপুকে বল না একটা ছবি একে দিতে

বাধ্য হয়ে আমাকে ছবি আঁকতে হয়। আমি ভাল ছবি ও আঁকতে পারি না। মানুষকে আকৃষ্ট করার কোন বিশেষ গুন ই আমার মাঝে নেই। শুধু চেহারা ছাড়া। সেই চেহারায় ও এখন ব্রন ওঠা শুরু করেছে।ব্রণগুলো খুব বাজে দেখায়। তানিয়ার কথায় আমি হলুদ বাটা দেই। কিন্তু সমস্যা না কমে আরও বেড়েছে।

বড় ভাইয়া তুহিন কে অনেক মেরেছেন। ও সিগারেট খায়। ওকে মারার সময় আমার খুব খারাপ লাগছিল। আবার ওর উপরে রাগ ও হয়। ও এমন কেন? ও এতটা খারাপ হয়েছে কেন? বাসায় কারো সাথে কোন কথা বলে না। চুপচাপ থাকে। হাতের মাঝে অনেক গুলো চুড়ি সদৃশ বস্তু দেখা যায়। নিজেকে এখন তুহিন অনেক কিছু মনে করে। সেদিন আমাকে বলল –নিলা , তুই আসলে একটা গাইয়া ক্ষেত।

আমি বললাম- কেন?
ও কিছু না বলে তাচ্ছিল্লের হাসি হেসে চলে গেল।

ওর উপর প্রচন্দ জিদ লাগে।মাঝে মাঝে দেখি ছোট গেঞ্জি টেনে বড় করে আয়নায় নিজেকে দেখে। ছোট গেঞ্জি বা শার্ট টেনে টেনে স্টাইল করে বাসা থেকে বের হয়। গেঞ্জি খানিকটা উপরে উঠে যায়। চারিপাশের মানুষের দিকে তাকিয়ে আবার টেনে টেনে নিচে নামায়। খুব মায়া হয় তখন আমার ভাইটার জন্য। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। আমার কাছে কিছু টাকা থাকলে শয়তান টা কে স্টাইল করার বড় জামা কিনে দিতাম। ফাজিলটার জন্য এত মায়া হয় কেন?

মা এই পরিবারের নীরব দর্শক। সবকিছু দেখে যান। সামলানোর আগ্রহ কমে গিয়েছে। তাকে দেখলে মনে হয় এই সংসার থেকে মুক্ত হতে চায় কিন্তু পারে না। সমাজ তাকে বন্দী করে রেখেছে। মায়ের ব্রেন টিউমার। শুধু আমি আর বাবা জানি। মা জানে না। ব্রেন টিউমারের অপারেশনে বাচার সম্ভাবনা ৩০%। খরচও অনেক। তাই বাবা অপারেশন করান না। মায়ের অপারেশন করাতে গেলে আমাদের পথে বসতে হবে। মাঝে মাঝে মায়ের যখন প্রচন্দ মাথা বাথা হয়, আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারি না। বাবাও কাঁদেন। মা অবাক হন। সামান্য মাথা বাথায় এত কাদার কি আছে? এরা কি পাগল না কি?

…………………………………………………
…………………………………………………

হটাত বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। ব্যাল্কনিতে রকিং চেয়ারে গিয়ে বসালাম। বৃষ্টির দুই একটা ফোঁটা রেলিং এ পরে ছিটকে আমার মুখে এসে পড়ছে। প্রতিবার শরীর টা ঝিন করে ওঠে । আজ মায়ের দশম মৃত্যু বার্ষিকী। দশ বছর আগেও এই দিনটা তে বৃষ্টি হয়েছিল।মায়ের মৃত্যুর দিন নিয়ে কারো কোনও মাথা বাথা নাই। সবাই নিজের পথে। বড় ভাইয়া দিন আনে দিন খায়। ভাবির বাবা রিকশাওালা ছিলেন। ভাইয়া ভাবির সাথে মিল করতে পারেন না। ঝগড়া লেগে থাকে সারাদিন। আর এই মহিলাকে আমারও ভাবি ডাকতে কোনও ইচ্ছে হয় না। একটা রিকশাওয়ালার মেয়েকে………………। তুহিন এলাকার সন্ত্রাস। খুন করে এখন পলাতক।
আর ওহি বর নিয়ে সুইডেন থাকে। আমার মায়াময় পিতা আমার কাছে ই থাকেন। তার স্মৃতি কিছুক্ষণ পরপরেই চলে যায়। আলঝেইমার। আমাকেও চিনতে পারেন না। মাঝে মাঝে মনে হয় স্মৃতিভ্রংশ লোকটি কি আমার বাবা হতে পারে?তার মন ও আমার বাবার মন কি এক?

পিছন থেকে কেউ একজন বলল-এই নিলা , তোমার গায়ে তো বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে, বৃষ্টিতে ভিজছ কেন?

আমার স্বামী মামুন। স্কুলের সেই মামুন নয়। কিন্তু এই মানুষটাও অনেক অর্থ বিত্তের মালিক।তারপরেও তার টাকা নিয়ে আমি হীনমন্যতায় ভুগি না। এগুলোকে নিজের বলে মনে হয়।আমার স্বামীর চোখটাও আমার বাবার মত। সব মামুন দের চোখই কি আমার বাবার মত হয়?

-তুমি কিন্তু দেখতে খুব মিষ্টি। আমি তোমাকে এর আগে কখনো এত খেয়াল করে দেখি নি।তুমি সত্যি খুব সুন্দর।
আমি বললাম-আমার হাতে একটা চিমটি কাটো তো
মামুন বলল, কেন?
আমি বললাম, না এমনিতেই ,কাটো না
মামুন চিমটি কাটল । একবার নয়, বেশ কয়েকবার চিমটি কাটল। সপ্ন নয়, সত্যি জিবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি।